বর্তমান পৃথিবীতে যত সমস্যা আছে, তার মধ্যে বড় একটি সমস্যা হলো বিশুদ্ধ খাওয়ার পানির অভাব। এই অভাব এতই প্রকট যে, বলা হয়ে থাকে পরবর্তী বিশ্বযুদ্ধ হবে বিশুদ্ধ পানির সন্ধান নিয়ে। কেবল বাংলাদেশের কথা বিবেচনা করলেও এমন কাউকে পাওয়া যাবে না যে এই সমস্যার মুখোমুখি হয়নি কিংবা এর সমাধান নিয়ে ভাবেনি।
পৃথিবীর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এই সমস্যার সমাধানে নিত্য নতুন চিন্তা করেছে, করেছে নানা ধারণা। পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে আধুনিক সব পদ্ধতির সাথে। ক্ষুদে বিজ্ঞানীদের এই ধারার মধ্যে নিয়ে আসার লক্ষ্যে সুইডেনের স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল ওয়াটার ইন্সটিটিউট বা SIWI ১৫ থেকে ২০ বছরের শিক্ষার্থীদের নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করে, যার নাম স্টকহোম জুনিয়র ওয়াটার প্রাইজ। প্রতি বছর বিশ্বের প্রায় ৪০টি দেশ থেকে হাজার হাজার প্রতিযোগী এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। স্বল্প খরচে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের উদ্ভাবনী পদ্ধতি বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরাই এই প্রতিযোগিতার মূল উদ্দেশ্য।

আগস্টে বিশ্ব পানি সপ্তাহ উপলক্ষে SIWI দুইটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। একটি হলো স্টকহোম ওয়াটার প্রাইজ বা SWP। এটি বিশ্বের সেরা সকল বিজ্ঞানী তাদের উদ্ভাবনী প্রযুক্তি বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরেন। অপরটি হলো স্টকহোম জুনিয়র ওয়াটার প্রাইজ বা SJWP। নাম দেখেই বোঝা যায় এ প্রতিযোগিতাটি ক্ষুদে বিজ্ঞানীদের নিয়ে আয়োজন করা হয়। এই প্রতিযোগিতা নিয়েই আমরা কথা বলবো।
দুইটি মূল ধাপে এই প্রতিযোগিতা আয়োজিত হয়। একটি জাতীয় পর্ব এবং অপরটি আন্তর্জাতিক পর্ব। জাতীয় পর্বের বিজয়ীদের স্টকহোমে পাঠানো হয় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অংশগ্রহণের জন্য। দেশভেদে প্রতিযোগিতাটির জাতীয় পর্বের বিভিন্ন নাম রয়েছে। বাংলাদেশে এই পর্বের নাম হলো বাংলাদেশ স্টকহোম জুনিয়র ওয়াটার প্রাইজ বা সংক্ষেপে SJWPBD। ২০১৫ সাল থেকে প্রতি বছর হাউজ অব ভলান্টিয়ার্স ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ এই প্রতিযোগিতাটির জাতীয় পর্ব আয়োজন করে আসছে। সহ-আয়োজক হিসেবে সাথে থাকছে ওয়াটার এইড বাংলাদেশ। ২০২০ সালের SJWPBD এর আউটরিচ পার্টনার হিসেবে সাথে থাকছে রোর বাংলা।

প্রতিযোগিতার জাতীয় পর্বে অংশগ্রহণের জন্য একজন শিক্ষার্থীর বয়স ১ আগস্ট, ২০২০ তারিখে অবশ্যই ১৫-২০ বছর বয়সের মধ্যে হতে হবে এবং তাকে অষ্টম থেকে দ্বাদশ যেকোনো একটি শ্রেণির শিক্ষার্থী হতে হবে। একই কথা প্রযোজ্য ইংরেজি মাধ্যমের ও-লেভেল এবং এ-লেভেলের শিক্ষার্থীদের বেলায়। সেই সাথে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীর জন্মসনদ কিংবা বৈধ পাসপোর্ট থাকতে হবে। কেবলমাত্র এই কয়টি শর্ত পূরণ করতে পারলেই যেকোনো শিক্ষার্থী এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারবে। শিক্ষার্থীরা একক অথবা সর্বোচ্চ ২ জনের দল গঠন করে অংশ নিতে পারে।
সাধারাণত বিভিন্ন বিজ্ঞান মেলায় দেখা যায় শিক্ষার্থীরা তাদের উদ্ভাবনী চিন্তাকে ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রজেক্ট প্রদর্শন করছে। SJWPBD-এর ক্ষেত্রে এরকমই প্রজেক্ট প্রদর্শন করতে হলেও বিষয়টি পুরোপুরি এক না। এখানে একজন শিক্ষার্থীকে তার প্রজেক্টের উপর ল্যাব রিপোর্ট তৈরি করে সেটি বিচারকমণ্ডলীর কাছে প্রদর্শন করতে হয়। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে, বাংলাদেশের স্কুল কলেজগুলোতে তো উন্নতমানের কোনো ল্যাব নেই, তাহলে শিক্ষার্থীরা তাদের পরীক্ষার জন্য ল্যাব পাবে কোথায়? আর কোনোভাবে পরীক্ষা করার ব্যবস্থা করতে পারলেও ল্যাব রিপোর্ট লেখার নিয়ম তো তারা জানে না।
এজন্য বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)-এর বেশ কজন সম্মানিত শিক্ষক এবং ওয়াটার এইড বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা শিক্ষার্থীদের সহায়তা করে থাকেন। সেই সাথে বুয়েটের ল্যাবরেটরি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের ল্যাবরেটরি ব্যবহার করার সুযোগ পায় শিক্ষার্থীরা। SJWPBD এর মূল ওয়েবসাইটে এই সংক্রান্ত একটি নীতিমালা দেওয়া আছে।
শিক্ষার্থীদের সুবিধার জন্য ৩টি মেন্টরিং সেশনের আয়োজন করে SJWPBD এর আয়োজক দল। এই মেন্টরিং সেশনগুলোতে শিক্ষার্থীরা তাদের প্রজেক্ট নিয়ে কীভাবে সামনে এগোবে সে বিষয়ে আলোচনা করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি শিক্ষকমণ্ডলী এবং ওয়াটার এইড বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা। প্রথম মেন্টরিং সেশন হবার সম্ভাব্য তারিখ ১৭ জানুয়ারি ২০২০। এবং বাকি দুটো মেন্টরিং সেশন যথারীতি ফেব্রুয়ারি এবং মার্চ মাসে আয়োজন করা হয়ে থাকে।
৩টি মেন্টরিং সেশন শেষে এপ্রিলে আয়োজন করা হয় জাতীয় পর্বের ফাইনাল রাউন্ড। সেখানে শিক্ষার্থীরা তাদের পুরো প্রজেক্টের বিস্তারিত বিষয়াবলী একটি পোস্টার প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে বিচারকমণ্ডলীর সামনে তুলে ধরেন। ১ম মেন্টরিং সেশনে অংশগ্রহণকারী সকলে সার্টিফিকেট প্রদান করা হয় এবং ফাইনাল রাউন্ডে অংশগ্রহণকারী সকলকে দেওয়া হয় ফাইনালিস্ট সার্টিফিকেট এবং মেডেল। সেইসাথে বিজয়ী দল বা প্রতিযোগীদের দেওয়া হয় আলাদা সার্টিফিকেট, মেডেল এবং ক্রেস্ট।

জাতীয় পর্যায়ের বিজয়ীদের হাউজ অব ভলান্টিয়ার্স এবং ওয়াটার এইড বাংলাদেশের যৌথ খরচে স্টকহোম পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। সেখানে বিশ্বের অন্যান্য সকল জাতীয় বিজয়ীদের সাথে বাংলাদেশকেও বিশ্বমঞ্চে প্রতিনিধিত্ব করে আমাদের ক্ষুদে বিজ্ঞানীরা। স্টকহোম আগস্টের বিশ্ব পানি সপ্তাহে অনেকটা ক্ষুদে পানি বিজ্ঞানীদের মিলনমেলায় পরিণত হয়ে যায়।
স্টকহোম জুনিয়র ওয়াটার প্রাইজের আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিজয়ীরা পায় ১৫০০০ মার্কিন ডলারের প্রাইজ মানি এবং সাথে একটি ব্লু ক্রিস্টাল প্রাইজ স্কাল্পচার এবং স্টকহোমে থেকে একটি ডিপ্লোমা করার সুযোগ। এছাড়াও প্রতিযোগীদের জন্য থাকছে বিশ্ব পানি সপ্তাহে অংশগ্রহণের সুযোগ যেখানে অংশ নেন ২০০ এর বেশি স্বনামধন্য বিজ্ঞানী, অসংখ্য গবেষক, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং পানি সমস্যা সমাধানে কর্মরত অনেকেই। ফলে প্রতিযোগিতার পাশাপাশি প্রতিযোগীরা নিজেদের প্রজেক্টের কাজ নিয়ে আরো বিস্তারিত জানতে ও জানাতে পারে। সেই সাথে অনুষ্ঠানের প্রধান অথিতি হিসেবে উপস্থিত থাকেন সুইডেনের ক্রাউন প্রিন্সেস ভিক্টোরিয়া।

বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের সুযোগ হয়েছে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিজয়ী হবার। ২০১৭ সালের আয়োজনে বাংলাদেশের মাস্টারমাইন্ড স্কুল এবং কলেজের অনিরুদ্ধ চৌধুরী, অর্নব চক্রবর্তী এবং রিতুরাজ দাস গুপ্ত ডিপ্লোমা অব এক্সেলেন্সি গ্রহণের সুযোগ পায় যেটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সম্মামনা। সেই সাথে মার্কিন পানি প্রযুক্তি বিষয়ক সংস্থা Xylem এর সেরা ৫ প্রজেক্টের তালিকায় রয়েছে এই বাংলাদেশিদের প্রজেক্ট। Xylem হলো আন্তর্জাতিক পর্যায়ের আয়োজনের মূল পৃষ্ঠপোষক।

কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী দিদারুল ইসলাম SJWPBD এর ২০১৮ এবং ২০১৯ পরপর দুই আসরের জাতীয় বিজয়ী। এর মধ্যে ২০১৮ সালে এককভাবে বিজয়ী এবং ২০১৯ সালে ঢাকা কলেজের মোঃ শাহরিয়ার হাসানের সাথে দলগতভাবে বিজয়ী ছিল। ৫ বারের আয়োজনে ৯ জন জাতীয় বিজয়ীর অনেকেই এখন বিশ্বের বিভিন্ন স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে এবং তাদের মেধার সাক্ষর রাখছে। এরা সকলেই পড়াশোনার পাশাপাশি নিজেদের প্রজেক্ট নিয়েও কাজ করছে।

২০১৫ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ৫ বার হয়েছে এই আয়োজন। হাউজ অব ভলান্টিয়ার্স ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের ৩টি স্টুডেন্ট চ্যাপ্টার (বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়) এই আয়োজনের পেছনে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছে। সেই ধারা অব্যাহত রেখে ৬ষ্ঠ বারের মতো আবারও এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে যাচ্ছে হাউজ অব ভলান্টিয়ার্স ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ এবং ওয়াটার এইড বাংলাদেশ।
১ নম্ভেবর, ২০১৯ থেকেই SJWPBD 2020 এর আয়োজন শুরু হয়ে গিয়েছে। শীঘ্রই শিক্ষার্থীদের সাথে সরাসরি কথা বলার জন্য স্কুল কলেজগুলোতে যোগাযোগ শুরু করে দিচ্ছে SJWPBD এর আয়োজক দল। প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশন করতে হবে SJWPBD এর মূল ওয়েবসাইট www.sjwpbd.org থেকে। এছাড়াই SJWPBD এর ফেইসবুক পেইজ থেকে শিক্ষার্থীরা চাইলে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারবে।