ধরুন, আপনার নববিবাহিত স্ত্রীকে নিয়ে একটা সিনেমা দেখতে গেলেন। বসুন্ধরার স্টার সিনেপ্লেক্সে কিংবা যমুনা ফিউচার পার্কের ব্লকবাস্টারে। আধা ঘণ্টা দেখেই আপনি বুঝে গেলেন যে এটা একটা বস্তাপচা সিনেমা হতে যাচ্ছে। আপনার সঙ্গিনীকে বললেন, “চলো। এবার উঠা যাক।” আপনার সঙ্গিনী তাতে রাজি হলেন না। তার যুক্তি, “এভাবে হাজার টাকা পানিতে ফেলব?” আপনি প্রতিবাদ করলেন, “টাকা যা যাবার, তা গেছেই। পুরো সিনেমা দেখলে যে এই টাকা উশুল হবে, এমন না।”
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কে সঠিক? আপনি? না আপনার সঙ্গিনী? কথায় আছে, Your wife is always right। এমতাবস্থায় সম্ভাব্য দৃশ্য হচ্ছে, আপনার সঙ্গিনী আপনার দিকে রাগে কটমট করে তাকাবে এবং আপনাকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাকি সিনেমা দেখে শেষ করতে হবে। এই ঘটনটা সাংক কস্ট ফ্যালাসি (Sunk cost fallacy)-র সবচেয়ে ভালো উদাহরণ।
এবার ধরুন আপনার একটি বড় কোম্পানি আছে। আপনার কোম্পানি একটা নতুন পণ্য বা সেবা বাজারে ছাড়ল। ভাল প্রচার প্রচারণাও করা হলো। কিন্তু পণ্য বা সেবাটি বাজার মাতালো না। কেউ সেটা গ্রহণ করলো না। কোম্পানির বোর্ড মিটিংয়ে বললেন, জিনিসটা বাজার থেকে উঠিয়ে নিতে। কিন্তু ব্র্যান্ড ম্যানেজার সেটা হতে দিতে রাজি না। তার বক্তব্য, এর পেছনে এরই মধ্যে কোটি টাকা খরচ হয়ে গেছে। এখন যদি এটা বাজার থেকে উঠিয়ে নেওয়া হয়, সব টাকা আর কষ্ট একদম জলে যাবে। Sunk cost fallacy’র আরেকটা ভালো উদাহরণ।
এবার ধরুন আপনি অবিবাহিত। আপনার প্রিয় মানুষটির সঙ্গে বহুদিন ধরেই একটা জটিল সম্পর্কে জড়িয়ে আছেন। বহুবার সে আপনার সাথে ধোকা দিয়েছে। প্রতিবারই সে অনুতপ্ত হয়ে আপনার কাছে ফিরে আসে আর ক্ষমা চেয়ে বলে, “প্রিয়, আর কখনো এরকম হবে না।” আপনিও তাকে ক্ষমা করে দেন এই ভেবে যে, এই সম্পর্কের পেছনে আপনি এতো সময় আর শ্রম দিয়েছেন যে, এখন সম্পর্কের ইতি টানলে মনে হবে গোটা সময়টাই বৃথা গেল। এখানেও আপনি সেই Sunk cost fallacy’র শিকার।
এই ফ্যালাসিতে আমরা তখনই বেশি করে পড়ি, যখন বিশেষ কিছুর প্রতি আমরা অনেক বেশি সময় বা অর্থ বা শ্রম বিনিয়োগ করে বসি। বিনিয়োগটা তখন এই লগ্নি নিয়ে পড়ে থাকার একটা কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যত বেশি বিনিয়োগ, ততো বেশি সাঙ্ক কস্ট, আর ততো বেশি ঐ জিনিসটাকে আঁকড়ে ধরে থাকার প্রবণতা।
শেয়ার বাজারে এই ব্যাপারটা অনেক বেশি ঘটে। একটা বিশেষ কোম্পানির শেয়ার কিনে আপনি বিরাট লোকসান খেলেন। আপিনি তখন আর সেই শেয়ার বিক্রি করতে চাইবেন না। আপনার একটা জেদ চেপে যাবে। আবারো দাম উঠবে, আপনি তখন বিক্রি করবেন। অথচ সেই শেয়ার ধরে রেখেও আপনার কোনো লাভ হচ্ছে না। একসময় দেখা যাবে কেনা দামের চেয়েও অনেক কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।
জেনেবুঝেও আমরা কেন এই অযৌক্তিক আচরণগুলো করি? কারণ, আমরা নিজেদের ভুল স্বীকার করতে চাই না। নিজেদের ভুল স্বীকার করতে অনেক সাহস লাগে। সেই সাহস আমাদের অধিকাংশেরই নেই।
এজন্যই গবেষকদের বেলায় একটা বৈজ্ঞানিক প্রজেক্ট মাঝপথে আটকে গেলেও তারা সেটা বন্ধ করতে ভয় পায়। ভয়টা নিজেকে। কেননা, একদিন নিজেরাই প্রজেক্টটির পরিকল্পনা করেছিল। রাতের পর রাত জেগে ডিজাইন করেছিল, হিসাব নিকাশ করেছিল। এখন মাঝপথে এই পরিশ্রমের প্রজেক্ট ছেড়ে দেওয়া মানে নিজের সব কষ্ট আর ত্যাগ ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়া। হতে পারে সেই প্রজেক্টের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। নিজের মনের সাথে তো আর যুদ্ধ করা যায় না।
Sunk cost fallacy’র সবচেয়ে বড় কর্পোরেট উদাহরণ হচ্ছে কনকর্ড সুপারসনিক বিমান। ব্রিটেন আর ফ্রান্স- দুই দেশই জানত, সুপারসনিক গতির এই বিমানের বাণিজ্যিকভাবে সফল হবার সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ। এরপরও তারা এর পেছনে ইচ্ছেমতো টাকা ঢেলেছে কেবল নিজেদের ইমেজ ঠিক রাখার জন্য। প্রজেক্ট বাতিল করা মানে নিজেদের পরাজয় মেনে নেওয়া। শেষ পর্যন্ত যদিও তারা উভয়ই প্রজেক্ট বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। উভয়েরই বিরাট অংকের টাকা লোকসান হয়। এই ফ্যালাসিকে তাই অনেকে ‘কনকর্ড ইফেক্ট’-ও বলে থাকেন।
এই ইফেক্ট মানুষের বোধবুদ্ধি লোপ করে দেয়। এজন্যই আমেরিকানরা দিনের পর দিন ভিয়েতনামে যুদ্ধ চালিয়ে গেছে। অথচ সেখানে তাদের পরিস্থিতি ছিল প্রতিকূলে। যুদ্ধবাজ আমেরিকানদের যুক্তি ছিল, এতো টাকা যখন গেছেই এর পেছনে, আরেকটু যাক না তাহলে। এর ফাঁদে পড়েই প্রযোজকরা নিশ্চিৎ ফ্লপ হবে জেনেও সিনেমার পেছনে টাকা ঢেলে যায়। এর ফাঁদে পড়েই ভালোমনা প্রেমিক/প্রেমিকারা নিজেদের অবিশ্বস্ত সঙ্গীর সাথে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখে বছরের পর বছর।
এই ইফেক্টের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে আসে আরেকটি ইফেক্ট। যার নাম আমরা দিতে পারি, ‘ভালো কিছু হবার আগে অবস্থা একটু খারাপ হবেই।’ ধরুন, আপনার শরীরের কোথাও ব্যথা হলো। আপনি ডাক্তারের কাছে গেলেন। ডাক্তার আপনার শরীর টিপেটুপে নানারকম পরীক্ষা করে দেখল। শেষমেশ একটা এন্টিবায়োটিক দিয়ে আপনাকে বিদায় করে দিল। আপনার ব্যথা তাতে সারলো না। আরো বাড়লো বরং। আপনি আবার গেলেন ডাক্তারের কাছে। তিনি এবার এন্টিবায়োটিকের ডোজ দ্বিগুণ করে দিলেন। তাতেও কিছু হলো না। আরো বাড়লো বরং। শুনে ডাক্তার বললেন, “ওরকম হওয়াটা স্বাভাবিক। রোগ সারার আগে রোগীর সামান্য অবনতি হয়ই।” আপনি তখন অন্য ডাক্তারের কাছে গেলেন। তিনি পরীক্ষা করে দেখলেন, অন্য ঘটনা। আপনার এপেন্ডিসাইটিস হয়েছে। অপারেশন করে ফেলে দিতে হবে।
সাধারণ মানুষ যে শুধু এই ফাঁদে পড়ে, তা নয়। বড় বড় কোম্পানিগুলো আরো বেশি করে পড়ে। ধরুন এক কোম্পানি খুব লোকসান খাচ্ছে ইদানিং। বেচাবিক্রি কিছুই হচ্ছে না। অবস্থার উন্নতির জন্য কোম্পানির প্রধান একজন ফাইন্যান্সিয়াল এ্যাডভাইজার নিয়োগ দিলেন। তার বেতন দিনে এক লাখ টাকা। তিনি প্রধানকে বললেন, “রাতারাতি তো সব কিছু পালটে দেওয়া সম্ভব না। আমি কিছু ইনিশিয়েটিভ নিচ্ছি। কিন্তু এর ফলে শুরুতে আপনার কোম্পানির বিক্রি আরো কমবে। কিন্তু সামান্য ধৈর্য ধরলে দিনশেষে আপনি লাভের মুখ দেখবেন।”
এই কথায় বিশ্বাস করে তাকে এক বছর সময় দিলেন। এক বছর পর দেখা গেল, বিক্রি আসলেই কমেছে। আরো এক বছর গেল এভাবে। বিক্রি তো আর বাড়ার নামে নাম নেই। কমছে তো কমছেই। এদিকে আপনি দিনে এক লাখ টাকা করে গুণে চলেছেন। আপনার উপদেষ্টার ভবিষ্যদ্বাণীর প্রথম অংশটুকুই মিলেছে কেবল, শেষ অংশটুকু নয়। তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রপ্রধানরা জনগণকে এভাবেই বুঝ দেয়। বড় গলায় বলে যে, শুরুর কয়েকদিন সবার একটু কষ্ট হবে। কিন্তু ধৈর্য ধরলে সোনালী দিন আসবেই। কিন্তু সেই সোনালী দিন আর আসে না।
সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হলে তাই পেছনের দিকে তাকিয়ে থাকলে চলবে না। আপনি যত অর্থ বা সময়ই ব্যয় করুন না কেন, ফুটো হওয়া তরী আর ভেসে উঠবে না। এর পেছনে বিনিয়োগ করে লাভ নেই।
তবে তার মানে এই না যে, কোনো কিছুতে ব্যর্থ হলেই তাকে ছেড়ে দিতে হবে। সিদ্ধান্ত নেবেন কেবল ভবিষ্যতের লাভক্ষতির কথা চিন্তা করে। আপনার কষ্টের বিনিয়োগের যদি কোনো ভবিষ্যৎ থেকে থাকে, তাহলে যান একে জয় করুন।