“বলা নেই, কওয়া নেই, হঠাৎ করে মানুষ দুজন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। অথচ তারা দুজন কয়েক মুহূর্ত আগেও রাস্তায় দাঁড়িয়ে খোশগল্পে মত্ত ছিল। আমরা দুজনকে একসাথে মরতে দেখলাম। এরপর শুনলাম পাড়ার দর্জির স্ত্রীও নাকি হুট করে মরে গেছে। রাস্তায় হেঁটে যাওয়া আরেক তরুণের মৃত্যুর খবরও শোনা গেল।”
১৪৮৫ সালের এক বিভীষিকাময় দিনে লন্ডনের বুকে হানা দেয় এক অদ্ভুত এবং রহস্যময় রোগ। এই রোগের নেই কোনো ভয়ঙ্কর লক্ষণ। মধ্যযুগের অন্যান্য ভয়াবহ কলেরা, প্লেগ, ম্যালেরিয়া, পীতজ্বর, কালাজ্বর, স্প্যানিশ ফ্লু মহামারির মতো অসহনীয় ক্ষত বা জখম সৃষ্টি হতো না এই রোগে। দেখতে সুস্থ-সবল হাসিখুশি মানুষ এই রোগের কবলে পড়লে ঘণ্টা খানেকের মাথায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ত। আর মৃত্যুর পূর্বে মানুষের দেহ থেকে নির্গত হতে থাকত ঘাম।
শুধু ঘাম থেকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে থাকায় এই রহস্যজনক মহামারির নামকরণ করা হয় ‘ইংরেজ স্বেদন রোগ’ (English Sweating Sickness) হিসেবে। পরবর্তীতে ইংল্যান্ডের বাইরে এই রোগ হানা দিলে এর নাম সর্বসাধারণের নিকট শুধু ‘স্বেদন বালাই’ (Sweating Sickness) হিসেবে পরিচিত হয়। এই রোগের আগমন ঘটত কোনো আগাম অশনি বার্তা ছাড়াই। দ্রুততার সাথে বিশাল জনগোষ্ঠীর একাংশের মৃত্যু ঘটিয়ে ফের হাওয়া হয়ে যেত এই রোগ।
সোয়েটিং সিকনেস কী?
“এই রোগ শুরু হতো ঘামের মাধ্যমে। রোগীর দেহ থেকে বিপুল পরিমাণ ঘাম নির্গত হতো এবং দুর্গন্ধ ছড়াত। চেহারার বর্ণ লালচে হতো প্রথমে। সেটা সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ত। রোগের বিষ রোগীর সারাদেহে ব্যথার উদ্রেক ঘটাত।”
মধ্যযুগের পৃথিবীতে কয়েক বছর পর পর একটি মহামারি আঘাত হানত। গ্রামের পর গ্রাম, শহরের পর শহরে মৃত্যুর ঢল বসিয়ে দিত সেসব মহামারি। তখনকার মানুষের স্বাস্থ্য সচেতনতার অভাব এবং সঠিক ঔষধ না থাকায় মৃত্যুর হার ছিল বেশি। যুগের পর যুগ ধরে ত্রাস সৃষ্টিকারী এসব রোগ জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে ধীরে ধীরে মানুষের নিকট তার রহস্য খোলাসা করেছে। রোগের কারণ, প্রতিকার সবকিছু নির্ণয়ের মাধ্যমে মানুষ এসব মহামারিকে পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু এই তালিকা থেকে বাদ যাবে একটি মহামারির নাম, তা হচ্ছে Sweating Sickness বা স্বেদন বালাই। নিতান্ত অদ্ভুত এই মহামারি তার রহস্য নিয়েই পৃথিবীর বুক থেকে বিদায় নিয়েছে।
পঞ্চদশ এবং ষোড়শ শতাব্দীতে ইউরোপের বুকে আগমন ঘটে এই স্বেদন রোগের। বিভিন্ন ঐতিহাসিক পাণ্ডুলিপি ঘেঁটে এই রোগের সম্ভাব্য লক্ষণ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। রোগের শুরুতে জ্বর এবং কাঁপুনি হতো রোগীর দেহে। অনেকের দেহে জ্বরের সাথে মাথা, ঘাড়, গলা ও পায়ের পেশিতে ব্যথা এবং দুর্বলতা অনুভূত হতো। জ্বর এবং ব্যথার এই পর্ব ত্রিশ মিনিট থেকে তিন ঘণ্টা পর্যন্ত স্থায়ী হতো। এই পর্বকে ‘শীতল পর্ব’ বলা হয়। এরপর শুরু হতো ‘উষ্ণ পর্ব’। এই উষ্ণ পর্বের উপসর্গের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ঘন ঘন ঘাম নির্গত হওয়া, তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠা ও বুক ধড়ফড় করা।
এই পর্বের পর আসতো চূড়ান্ত পর্ব। এই পর্বে রোগী ক্লান্ত হয়ে জ্ঞান হারাত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রোগী জ্ঞান হারানো অবস্থায় মৃত্যুবরণ করত। তবে রোগী যদি প্রথম ২৪ ঘণ্টার ধকল সহ্য করে বেঁচে থাকতে সক্ষম হয়, শুধু সেক্ষেত্রে তার আরোগ্য হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিত। এই রোগের সবচেয়ে ভীতিকর ব্যাপার ছিল, অত্যন্ত দ্রুততার সাথে রোগটি আক্রান্তদের মৃত্যু ঘটিয়ে দিত এবং আশেপাশের লোকজনের দেহে ছড়িয়ে পড়ত।
স্বেদন বালাই এর পাঁচ মহামারি
পৃথিবীর বুকে স্বেদন রোগ মহামারি হিসেবে আঘাত হেনেছে মোটে ৫ বার। ১৪৮৫ সালে সর্বপ্রথম ইংল্যান্ডের বুকে এই রোগের দেখা মিলে। সর্বশেষ মহামারীর সময়কাল ছিল ১৫৫১ সাল। এর দু’শ বছর পর ‘পিকার্ডি সোয়েট’ নামে সাদৃশ্যপূর্ণ একটি রোগ ফ্রান্সে মহামারি ঘটিয়েছিল, কিন্তু এই দুই রোগের মধ্যে শক্ত যোগসূত্রতা এখনও প্রমাণিত হয়নি।
প্রথম মহামারির সময় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মসনদে ছিলেন সপ্তম হেনরি। সেবার মাত্র এক মাসে প্রায় ১০ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল। এরপর দ্বিতীয় এবং তৃতীয় মহামারির দেখা মেলে ১৫০৭ সালের শুরু এবং শেষের দিকে। দ্বিতীয় ধাক্কা কিছুটা সামলে উঠতে পারলেও তৃতীয় মহামারির সময় বেশ কিছু অঞ্চলের প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিল। মানুষ এই রহস্যময় রোগের প্রতি এক চাপা ভয় নিয়ে দিন-রাত গুজরান করত। ভয়ের মাত্রা এতটাই ছিল যে, ১৫২৮ সালের মহামারির সময় স্বয়ং সপ্তম হেনরি লন্ডন থেকে পালিয়ে যান। ঐতিহাসিকদের তথ্যমতে, তিনি প্রতিনিয়ত নিজের বাসস্থান বদলাতে থাকেন, যেন এই বালাই তাকে স্পর্শ করতে না পারে।
ইংল্যান্ডের বাইরে প্রথম মহামারির শিকার হয় জার্মানির শহর হামবুর্গ। কয়েক সপ্তাহে এক হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যুর পর এই রোগ যেন ইউরোপ সফরে বের হয়। একে একে আক্রান্ত হতে থাকে সুইজারল্যান্ড, ডেনমার্ক, সুইডেন, নরওয়ে, লিথুয়ানিয়া, পোল্যান্ড, রাশিয়ার জনগণ। প্রায় কয়েক হাজার মানুষের রহস্যজনক মৃত্যুর সাক্ষী এই মহামারি সর্বশেষ ১৫৫১ সালে হানা দেয়।
ধনাঢ্যদের যম
“হঠাৎ এক বালাইয়ের উদ্ভব হলো যা ঘামের মাধ্যমে মৃত্যু ঘটায়। এই অদ্ভুত রোগ রাজকীয় কাজে বাধার প্রতীক হয়ে দাঁড়াল। রোগটা এতই নিষ্ঠুর যে দুই ঘণ্টার মাথায় সুস্থ মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে। রাজদরবারের বহু সভাসদ মারা পড়ল। লর্ড ক্লিন্টন, লর্ড গ্রে অফ উইলটন, বহু নাইট যোদ্ধা, সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিবর্গ, কর্মকর্তা- কেউ পরিত্রাণ পেল না।”
ইতিহাসবিদ এডওয়ার্ড হলের ডায়েরি থেকে এই মহামারির সাথে সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিবর্গের আক্রান্ত হওয়ার চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যায়। অবশ্য হল একাই নন, দেখা গেল সমসাময়িক পাণ্ডুলিপিগুলো একই কথা বলছে। রাজা সপ্তম হেনরি স্ত্রী অ্যান বলেইন নিজে এই রোগের খপ্পরে পড়েছিলেন। কিন্তু ভাগ্য সহায় হওয়ায় তিনি আরোগ্য লাভ করেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি যুবরাজ আর্থার টিউডরের। তার রহস্যজনক মৃত্যুর সাথে অনেকেই স্বেদন বালাইকে দায়ী করে থাকে। যদিও এই দাবির পেছনে শক্ত প্রমাণাদি নেই। ইউরোপের ধনীরা এই রোগের ভয়ে দেশ থেকে পালাতে শুরু করে।
এই রোগের আরেকটি অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য ছিল ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড এবং ওয়েলসের কেউ এই রোগে আক্রান্ত হতো না। এমনকি সেসব দেশে বসবাস করা ইংরেজরা এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মরতে থাকে। যারা এই রোগে মারা পড়েছিল তাদের সবাই মাঝবয়েসী তরুণ বা তরুণী ছিল। দেখা গেল, অশীতিপর (আশিরও অধিক বয়স্ক) বুড়ো-বুড়ি আর কোলের শিশুরা এই রোগ থেকে মুক্ত ছিল।
এই রোগের কারণ কী?
প্রতিটি মহামারির পেছনে থাকে কোনো ভয়ঙ্কর জীবাণু বা ক্ষতিকারক পদার্থের হাত। স্বেদন রোগও এর ব্যতিক্রম হওয়ার কথা নয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই রোগের ময়নাতদন্ত করার জন্য যথেষ্ট সুযোগ এবং সময় পায়নি তৎকালীন বিজ্ঞানীগণ।
তখনকার সীমিত জ্ঞান এবং প্রযুক্তি এই রোগের কারণ ধরতে ব্যর্থ হয়েছিল। তবে সর্বশেষ মহামারির শত বছর পর এই রোগ নিয়ে গঠনমূলক গবেষণা শুরু হয়, যার পুরোটাই মহামারি চলাকালীন চিকিৎসক এবং ইতিহাসবিদদের পাণ্ডুলিপি নির্ভর ছিল। ১৮৮১ সালে আর্থার বর্ডিয়ার নামক এক চিকিৎসক নৃবিজ্ঞান বিষয়ক এক জার্নালে বেশ চাঞ্চল্যকর এক তথ্য পরিবেশন করেন। সেখানে তিনি বর্ণনা করেন, এই রোগ কেবলমাত্র অ্যাংলো-স্যাক্সন বংশোদ্ভূতদের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকবে। কিন্তু পৃথিবীর বহু চাঞ্চল্যকর তথ্যের মতো এই তথ্যও যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত এবং প্রমাণহীনতার কারণে ধোপে টেকেনি।
এই রোগের কারণ হিসেবে আধুনিক বিজ্ঞানীদের প্রথম সন্দেহ পড়েছে হান্টা ভাইরাসের ওপর। এই ভাইরাসটি ইঁদুর জাতীয় প্রাণীর দেহে কোনো রোগবালাই না ঘটিয়ে অবস্থান করতে পারে। তখন সেই প্রাণীটি ভাইরাসের সক্রিয় বাহক হিসেবে কাজ করে। হান্টা ভাইরাসের প্রভাবে আক্রান্তের দেহে জ্বর, সর্দি, পেশী ব্যথা, ক্লান্তি ইত্যাদি ফ্লু জাতীয় উপসর্গ দেখা দেয়। বিজ্ঞানীদের ধারণা, হান্টা ভাইরাসের অজানা কোনো প্রকার থেকে হয়তো এই রোগের উৎপত্তি। হান্টা ভাইরাস ছাড়াও মশা মাছি দ্বারা ছড়ানো আরবো ভাইরাস আছে বিজ্ঞানীদের সন্দেহের তালিকায়। এর কারণ, বেশ কিছু অঞ্চলে বর্ষা মৌসুমের পর পর দেখা দিত এই মহামারি। বিশেষ করে ভারি বর্ষণ এবং বন্যা আক্রান্ত অঞ্চলে। এধরনের অঞ্চলে মশা মাছির উপদ্রব বেশি থাকে। হয়তো আরবো ভাইরাস দায়ী বলেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের শীতল এবং উঁচু অঞ্চল স্কটল্যান্ড, ওয়েলস এই মহামারি মুক্ত ছিল।
ভাইরাসের বাইরে অ্যানথ্রাক্স রোগের জন্য দায়ী ব্যাকটেরিয়া Bacillus anthracis-কেও অনেকে দায়ী করেছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২০০১ সালে জৈব অস্ত্র হিসেবে অ্যানথ্রাক্স জীবাণুর ব্যবহারের ফলে প্রায় ২২টি ক্ষেত্রে দেখা গেছে, আক্রান্তের দেহে প্রচুর পরিমাণ ঘাম নির্গত হয়েছে এবং দেহের বিভিন্ন অঙ্গে ব্যথার সূত্রপাত ঘটেছে। এডওয়ার্ড ম্যাক সুইগান নামক এক অণুজীববিজ্ঞানীর মতে, ইংরেজ মুলুকে মহামারির পেছনে ওলের মাধ্যমে ছড়ানো অ্যানথ্রাক্স জীবাণুর স্পোর দায়ী থাকতে পারে।
Sweating sickness বা স্বেদন বালাইয়ের আসল কারণ বের করতে বিজ্ঞানীদের আরো তথ্য-উপাত্তের প্রয়োজন। হয়তো ভবিষ্যতে আমরা এর আসল কারণ জানতে পারবো। প্রশ্ন উঠতে পারে, যে রোগ প্রায় ৫০০ বছর আগে পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে, সেই রোগের কারণ জানার যৌক্তিকতা কী? এর উত্তর হচ্ছে, যদি ভবিষ্যতে এই রোগ আমাদের পুনরায় আক্রমণ করে, সেক্ষেত্রে আমাদের প্রস্তুতি যেন অসম্পূর্ণ না থাকে। মধ্যযুগীয় পাণ্ডুলিপির তথ্যগুলো যদি সত্য হয়, সেক্ষেত্রে বলতে হচ্ছে, এমন ভয়ঙ্কর মহামারি মোকাবেলায় পূর্ব প্রস্তুতি গ্রহণ করার কোনো বিকল্প নেই। তাহলে হয়তো আমরা নতুন কোনো মহামারির হাত থেকে পৃথিবীর হাজার হাজার মানুষের প্রাণ বাঁচাতে পারব।