বিখ্যাত লেখক নাসিম তালেব একবার বেশ মুটিয়ে গেলেন। মোটা হয়ে যাওয়া তো কোনো কাজের কথা নয়। ভদ্রলোক ভাবলেন, কিছু একটা করা দরকার। তিনি বিভিন্ন রকম খেলাধুলার প্রতি আকৃষ্ট হলেন। প্রথম সপ্তাহ তিনি জগিংয়ের চেষ্টা করে দেখলেন। লাভ হলো না। দেখলেন, যারা জগিং করে, তাদের একটা বড় অংশই চেহারা সুরতে অসুখী।
তারপর বডিবিল্ডিংয়ের চেষ্টা করে দেখলেন। এতেও লাভ হলো না। তার কাছে বডিবিল্ডারদের খুব নিম্ন বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন মানুষ বলে মনে হলো। আর টেনিস খেলোয়াড়দের মনে হলো বেশি বড়লোক ঘেঁষা। শেষমেশ, সাঁতারুরা তাকে আকৃষ্ট করলো। দেখলেন, এদের শরীর সত্যিই সুগঠিত এবং পেটোয়া ধাঁচের। স্থানীয় একটা সুইমিং পুলে তিনি নাম রেজিস্ট্রি করে এলেন আর সপ্তাহে অন্তত দুইবার সাঁতার কেটে আসার প্রতিজ্ঞা করলেন মনে মনে।
কিছুদিনের মাঝেই ভদ্রলোক বুঝে গেলেন, তিনি একটা বিভ্রান্তির জালে আটকা পড়েছেন। পেশাদার সাঁতারুদের ত্রুটিহীন শরীরের রহস্য এই না যে তারা খুব পরিশ্রম করে কিংবা খুব কঠিন একটা ট্রেনিংয়ের মধ্যে দিয়ে যায়। তারা ভালো সাঁতারু, কারণ তাদের শরীরের গঠনটাই এমন। সাঁতারু হবার জন্য উপযুক্ত। প্রকৃতি তাদেরকে বানিয়েছেই এভাবে। চেষ্টা আর পরিশ্রমের মাধ্যমে তারা এর সুবিধা নিচ্ছে মাত্র।
একই কথা খাটে নারী মডেলদের ক্ষেত্রে। টিভিতে, বিলবোর্ডে সারাদিনই আমরা তাদের দেখি শাড়ি, গহনা আর কসমেটিকসের বিজ্ঞাপন করতে। এদের যে টার্গেট অডিয়েন্স, সাধারণ নারীসমাজ- তার একটা বড় অংশই বিশ্বাস করে এই শাড়ি, কসমেটিকস ইত্যাদি ব্যবহার করলে তাদেরও তেমনই সুন্দর দেখাবে। তারা এটা জেনেও ভুলে যায় যে, লাক্স কিংবা সানসিল্ক এই নারীদের ‘মডেল’ বানায়নি। এরা আগে থেকেই আকর্ষণীয়া। তারা সেরকম শারীরিক গঠনের অধিকারী, যা আর দশটা তরুণী বা নারীর আকাঙ্ক্ষিত। সাবান আর স্যাম্পু বিক্রেতারা তাদের এই বৈশিষ্ট্যকে নিজেদের বাণিজ্যে ব্যবহার করছে কেবল। সাঁতারুদের মতোই, সৌন্দর্য বা দেহাবয়ব এখানে কারণ হতে পারে, কিন্তু ফলাফল নয়।
যখনই আমরা এভাবে কারণের সাথে ফলাফল গুলিয়ে ফেলি, নাসিম তালেবের মতে আমরা Swimmers body illusion-এ পড়ি। এই Illusion বা ভ্রান্তি না থাকলে বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলোকে না খেয়ে মরতে হতো। এই ভ্রান্তি যে বিজ্ঞাপনের রঙিন চকচকে জগতেই কাজ করে, তা নয়। উন্নত দেশের শিক্ষাব্যবস্থাও এই ভ্রান্তি থেকে মুক্ত নয়।
হার্ভার্ডের কথাই ধরা যাক। পৃথিবীর অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয় এটা। বহু নামী-দামী মানুষ এখান থেকে পড়াশোনা করেছেন। তার মানে কি এই যে হার্ভার্ড আসলেও একটা সেরা বিশ্ববিদ্যালয়? এর শিক্ষকেরা কি অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চেয়ে কোনোভাবে আলাদা? এর ল্যাবগুলো কি আসলেই সর্বাধুনিক? এর কারিকুলাম কি আসলেই যুগোপযোগী? এমনও তো হতে পারে, এগুলোর সব দিক দিয়েই হার্ভার্ড অন্য অনেক সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে অনেক পিছিয়ে আছে। হার্ভার্ড সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় নাম লেখাতে পেরেছে শুধু এর ছাত্রদের কারণে। হয়তো হার্ভার্ডের সব কিছুই খুব বাজে, কিন্তু এর ছাত্ররা খুবই তুখোড়।
হার্ভার্ড বিশ্বের সেরা ছাত্রদের বাছাই করে নিজের গোয়ালে তোলে। ঐ ছাত্ররা যেখানেই যেত, সেখান থেকেই বের হয়ে ভাল দুধ দিত। এ হিসেবে এখানে হার্ভার্ডের কৃতিত্বই নেই। সে কেবল একটা প্লাটফর্ম। মূল জাদু আসলে ছাত্ররা।
‘দ্য আর্ট অব থিংকিং ক্লিয়ারলি’ বইয়ের লেখক রলফ ডবেলি (Rolf Dobelli)-রও একই অভিজ্ঞতা। ভদ্রলোকের পড়াশোনা সুইজারল্যান্ডের সেন্ট গ্যালেন ইউনিভার্সিটিতে। ইউরোপের সেরা দশ বিজনেস স্কুলের মধ্যে এটা একটা। ভদ্রলোকের ভাষ্যমতে, এই শানদার জায়গার শিক্ষার মান ছিল খুবই সাধারণ।
এখান থেকে যারা গ্র্যাজুয়েট হয়েছে, তারা কি তাহলে জীবনে ব্যর্থ হয়েছে? না, এদের একটা বড় অংশই জীবনে বেশ সফলতার পরিচয় দিয়েছে। এই সাফল্যের রহস্য কী? সুইস মনোরম পরিবেশ? অনিন্দ্যসুন্দর প্রকৃতি? ক্যাফের খাবার? সম্ভবত এর একটাও নয়। সম্ভবত এর ভর্তি প্রক্রিয়াই একে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে নিয়েছে।
সারা পৃথিবীতেই এমবিএ স্কুলগুলো সম্ভাব্য প্রার্থীদের ভবিষ্যতে লাখ টাকা আয়ের লোভ দেখিয়ে আকৃষ্ট করে। পুরো কাজটাই করা হয় এমবিএ স্কুলগুলোর মাত্রাতিরিক্ত টিউশন ফি-কে একটা পরোক্ষ বৈধতা দেওয়ার জন্য। তাদের এই কৌশল কাজেও দেয় বটে। অনেকেই এই ফাঁদে আটকা পড়ে।
এই না যে, এমবিএ স্কুলগুলো তাদের প্রসপেক্টাসে বা ওয়েবসাইটে মিথ্যা কথা বলে। তারা সত্যটাই বলে। কিন্তু আংশিক সত্য। কেন? যারা এত পয়সা খরচ করে এমবিএ করে, তারা কিছুটা হলেও অন্যদের চেয়ে আলাদা। এরা হয়তো মানুষের সাথে ভালো কমিউনিকেট করতে জানে। নিত্যনিতুন আইডিয়া তৈরি করতে জানে। সেই আইডিয়াকে বিপণন করতে জানে। দশ বছর পর এদের আয়ের সাথে, অন্যদের আয়ের যে পার্থক্যটা তৈরি হয়, তা শুধু এই এমবিএ ডিগ্রির কারণে নয়। এরা এমবিএ না পড়ে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়লে কিংবা কোচিংয়ের ব্যবসা করলেও হয়তো প্রায় একই আয় করতো। এখানেও আমরা সেই Swimmers body illusion-এর প্রভাব দেখি। এমবিএ ডিগ্রিটা কারণ নয়, কারণটা হচ্ছে মানুষ। এমবিএ ডিগ্রিটা হচ্ছে ফলাফল।
একজন সুখী মানুষকে ধরে আপনি জিজ্ঞেস করলেন তার সুখের রহস্য কী। সে হয়তো বলবে, “তোমাকে গ্লাসের অর্ধেকটা খালি না দেখে এর অর্ধেকটা ভরা দেখতে হবে।” কিন্তু এটা আসল ব্যাপার নয়। ব্যাপারটা অনেকটা এমন, সুখী মানুষগুলো জন্মগতভাবেই সুখী হবার অসম্ভব ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছে। আশেপাশের ভালো ভালো ঘটনাগুলোই শুধু এদের চোখে পড়ে।
হার্ভার্ড গবেষক ভ্যান গিলবার্টের মতে, সুখে থাকার এই ক্ষমতা মানুষের একটা বিশেষ গুণ। যার নাই, তাকে শত থেরাপি দিয়েও আপনি পজিটিভ মানুষে পরিণত করতে পারবেন না। আর যার আছে, আশেপাশের শত দুর্ঘটনাও তাকে জীবনবিমুখ করতে পারে না। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। কিন্তু মোটের উপর, লম্বা হবার জন্য শত চেষ্টা করেও যেমন লাভ হয় না, জোর করে সুখী হবার চেষ্টা করেও লাভ হয় না।
মোটিভেশনাল লেখকেরা কিংবা বক্তারা যখন সুখী হবার দশটা উপায় বাতলে দেন বা সফল হবার একশো একটা টিপস দেন, চোখ বন্ধ করে সেই টিপস না নেওয়াই ভালো। যে নিয়ামকগুলো তাদের সুখী বা সফল হতে সাহায্য করেছে, কোটি কোটি মানুষের ক্ষেত্রে সেটা কাজে আসবে না। অসুখী বা ব্যর্থ মানুষেরা যদি বই লিখতো, সেগুলোই বরং বেশি কাজে দিতো। আমরা অন্তত জানতে পারতাম কী করলে আমরা দুঃখ বা ব্যর্থতা থেকে দূরে থাকতে পারি।
মোদ্দা কথা হলো- জীবনে যা কিছুই অর্জন করতে চান না কেন, হোক সেটা সিক্স প্যাকের শরীর কিংবা ব্র্যাড পিটের মতো লুক কিংবা লাখ টাকার চাকরি, এমনকি দীর্ঘ জীবন কিংবা সুখ, আর্টসেলের ভাষায় নিজেকে আগে ‘বাজিয়ে’ নেবেন। নিজের দৌড় নিজে বোঝাটা খুব জরুরী। আশাবাদী মানুষেরা যতই বলুক মানুষের পক্ষে কিছুই অসম্ভব নয়, আপনার পক্ষে চাইলেই মাইকেল ফেলপ্স বা লিওনেল মেসি হওয়া সম্ভব নয়। আপনি হয়তো আর দশজনের চেয়ে ভাল করবেন, হয়তো একশো জনের চেয়েও। কিন্তু এর বেশি নয়। কোনো কিছুর লক্ষ্যে দৌড়ানোর আগে তাই আয়নায় নিজের চেহারাটা দেখে নেবেন। আপনি এর যোগ্য তো?