দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার সাথে সাথেই আমেরিকা এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে শুরু হয় স্নায়ুযুদ্ধ। এই যুদ্ধের পুরো একটি অংশ জুড়েই দেশ দুটির মধ্যে চলে মহাকাশ প্রতিযোগিতা- কে কার আগে মহাকাশ জয় করতে পারে? যদিও এই প্রতিযোগিতার প্রাথমিক বিজয়ী নিঃসন্দেহে সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল- পৃথিবীর প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ মহাকাশে প্রেরণ, প্রথম মানুষ হিসেবে ইউরি গ্যাগারিনকে মহাশূন্যে প্রেরণসহ আরো অনেক প্রথম অর্জনের মাধ্যমে, কিন্তু চূড়ান্ত বিজয়ী ছিল আমেরিকা; চাঁদে মানুষ প্রেরণের মাধ্যমে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিজয় লাভের পর সোভিয়েত ইউনিয়নের মহাকাশ অভিযান স্থিমিত হওয়ার মাধ্যমে তখনকার মতো মহাকাশ প্রতিযোগিতা শেষ হয়ে যায়।
মহাকাশ প্রতিযোগিতা থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের সরে যাওয়ার পর আমেরিকার মহাকাশে একক আধিপত্য বজায় ছিল কিছুদিন আগপর্যন্তও। কিন্তু বর্তমানে মহাকাশে আমেরিকার এই একক আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে বেশ কয়েকটি দেশ। তাদের মধ্যে অন্যতম উদীয়মান পরাশক্তি চীন, সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্তরসূরী রাশিয়া, অগ্রসরমান প্রযুক্তির দেশ জাপান এবং ভারতসহ অন্য দেশগুলো। তাই এই প্রশ্নটি আন্তর্জাতিক মহলে আবার খুব জোরেশোরেই উচ্চারিত হচ্ছে- মহাকাশ প্রতিযোগিতা কি আবার ফিরে এসেছে?
২০২১ সালে আমেরিকার পর দ্বিতীয় দেশ হিসেবে মঙ্গলের মাটিতে রোবটিক যান নামিয়ে রেকর্ড সৃষ্টি করে চীন। তারা এখন পর্যন্ত একমাত্র দেশ যারা মঙ্গলে প্রথম মিশনে গ্রহটি প্রদক্ষিণ করে, এর মাটিতে অবতরণ করে, এবং একটি রোবটিক যানকে মিশনে নিয়োজিত করে।
নাসা অবশ্য এর তিন মাস আগে ‘Perseverance’ নামের একটি রোবটিক যান মঙ্গলের পৃষ্ঠে অবতরণ করায় এবং সফলভাবে সেটি মঙ্গলের মাটিতে এখন পর্যন্ত অপারেট করে যাচ্ছে। তাছাড়া, এর প্রায় দেড় মাস পর পৃথিবীর বাইরের কোনো গ্রহ মঙ্গলে প্রথমবারের মতো আকাশযান উড়িয়ে নাসা তার উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন প্রযুক্তিগত দক্ষতার কথা আবার জানান দেয় বিশ্ববাসীকে। এই দুটি দেশ ছাড়াও মঙ্গল নিয়ে অভিযান পরিচালনা করেছে ভারত, আরব আমিরাত ছাড়াও আরো কয়েকটি দেশ। যদিও গত শতাব্দীর ষাটের দশকে মঙ্গল গ্রহে অভিযান নিয়ে প্রতিযোগিতা ছিল শুধুমাত্র সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং আমেরিকার মধ্যে, বর্তমানে সেটি অনেকগুলো দেশের মাঝে বিস্তৃত।
১৯৭২ সালের ১৯ ডিসেম্বর অ্যাপোলো-১৭ প্রোগ্রাম শেষে বিগত ৫০ বছরে নাসা চাঁদে আর মানুষ প্রেরণ করেনি। বর্তমানে চাঁদে মানুষের বাসযোগ্যতা যাচাই, বাণিজ্যিকভাবে মানুষকে চাঁদে প্রেরণ, চাঁদের বুকে দীর্ঘস্থায়ী উপস্থিতি এবং চন্দ্রপৃষ্ঠে অধিক পরিমাণে গবেষণা পরিচালনার উদ্দেশ্যে নাসা আর্টেমিস প্রোগ্রাম হাতে নিয়েছে। এ প্রোগ্রামের মাধ্যমে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর নাগাদ চাঁদের বুকে আবার মানুষ প্রেরণের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে নাসা। কিছুদিন আগে সেই প্রোগ্রামের জন্য নভোচারীও চূড়ান্ত করে নাসা। সেই প্রোগ্রাম থেকে অর্জিত জ্ঞান কাজে লাগিয়ে নাসা তার ‘হিউম্যান মার্স’ প্রোগ্রাম সফল করতে চায়।
এদিকে চীনও থেমে নেই। তারা ২০৩০ সালের মধ্যে দুজন নভোচারীকে চাঁদের পৃষ্ঠে নামাতে চায়। এই লক্ষ্যে গত ফেব্রুয়ারিতে তারা তাদের ‘চন্দ্র অবতরণ যান’ বিশ্ববাসীর কাছে উন্মুক্ত করে।
এদিকে রাশিয়াও বসে নেই। তারা এ বছরের জুলাইয়ের মধ্যে তাদের লুনা-২৫ প্রোগ্রাম শুরু করতে যাচ্ছে। এই প্রোগ্রামের মাধ্যমে তারা চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে রোবটিক যান পাঠিয়ে নমুনা সংগ্রহ করবে। গত ১২ এপ্রিল রাশিয়ান স্পেস এজেন্সি রসকসমস (Roscosmos) এর সিইও বলেন, রাশিয়ার ‘ম্যানড মুন প্রোগ্রাম’ এর একটি খসড়া কেন্দ্রীয় সরকারে বিবেচনা করা হচ্ছে। তার মতে, “চাঁদে নভোচারী পাঠানোর জন্য সুপার হেভি ক্লাস রকেট তৈরি করা প্রয়োজন। বর্তমানে এ ধরনের একটি কর্মসূচি, সেই সাথে মুন প্রোগ্রামের অগ্রগতি ও অনুমোদনের জন্য কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংস্থার সাথে সমন্বয় করা হচ্ছে।”
অর্থাৎ, সোভিয়েত পরবর্তী রাশিয়া আবার চাঁদে মানুষ পাঠানোর তোড়জোড় শুরু করেছে, যা করতে তার পূর্বসূরীরা ব্যর্থ হয়েছিল। তাছাড়া, রাশিয়া এবং চীন একটি যৌথ প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে যার মাধ্যমে তারা তাদের দক্ষিণ মেরুতে একটি ‘আন্তর্জাতিক চন্দ্র ঘাঁটি’ স্থাপন করবে ২০৩৫ সালের মধ্যে।
এছাড়া, চাঁদে আরো অভিযান পরিচালনা করতে যাচ্ছে ভারত এবং ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি। ভারত এ বছরের জুনের মধ্যে চাঁদের মাটিতে রোবটিক যান পাঠানোর পরিকল্পনা করছে।
ইউনিভার্সিটি অব পোর্টসমাউথের স্পেস প্রজেক্ট ম্যানেজার ডক্টর লুসিন্ডা কিংয়ের মতে, “চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে যে পানি আছে এটি এখন সবার জানা। এই পানি ভেঙে হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেন তৈরি করা সম্ভব, যা চাঁদ থেকে মঙ্গলে এবং গভীর মহাশূন্যে যাত্রার জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব। যে কারণে মহাকাশ সুপার পাওয়ার দেশগুলোর মধ্যে চাঁদে যাওয়ার জন্য আবার তোড়জোড় শুরু হয়েছে, যাতে সেখানকার পানির অংশীদারিত্ব দাবি করতে পারে।”
১৯৬০ এর দশকে মহাকাশ প্রতিযোগিতা ছিল মূলত পুঁজিবাদী আমেরিকা এবং সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যকার আদর্শিক দ্বন্দ্বের ফল। কিন্তু বর্তমানে মহাকাশ প্রতিযোগিতার মধ্যে আদর্শের স্থান তেমন একটা নেই। বর্তমান প্রতিযোগিতা মূলত কে কার আগে মহাকাশে বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করতে পারে তা নিয়ে। যেমন- বাণিজ্যিকভাবে মহাকাশে, চাঁদ, মঙ্গলসহ বিভিন্ন গ্রহ-উপগ্রহে মানুষ প্রেরণ; গ্রহ, উপগ্রহ এবং নিকটবর্তী গ্রহাণু থেকে মূল্যবান খনিজ ধাতু উত্তোলন ইত্যাদি।
নাসার হিসেব মতে, পৃথিবীর নিকটবর্তী গ্রহাণু, যেগুলোতে ভবিষ্যতে সম্ভবত খননকাজ চালানো যাবে, সেগুলোতে সম্পদের পরিমাণ আনুমানিক ৭০০ কুইন্টিলিয়ন ডলার। নাসা শুধু হিসেব করেই বসে নেই, তারা 16 Psyche গ্রহাণুতে এ বছরের মধ্যে অভিযান চালানোর প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে, যেটিতে প্রচুর পরিমাণে মূল্যবান ভারী ধাতু আছে।
এ লক্ষ্যে আমেরিকা ২০১৫ সালে প্রথম দেশ হিসেবে ‘মহাকাশ সম্পদ আইন’ অথবা ‘US commercial space launch competitiveness act’ প্রণয়ন করে, যার মাধ্যমে মার্কিন নাগরিকদের মার্কিন আইন এবং যেসব আন্তর্জাতিক আইনে আমেরিকার বাধ্যবাধকতা আছে সেসব আইন অনুসারে মহাকাশের সম্পদ লাভ করার অধিকার দেওয়া হয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, নাসা সম্প্রতি ৪টি আমেরিকান বেসরকারি কোম্পানির সাথে চুক্তি করেছে, যারা চাঁদ থেকে নমুনা সংগ্রহ করে নাসার কাছে বিক্রি করবে। অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, লুক্সেমবার্গ এবং আরব আমিরাতের মতো ছোট দেশও তাদের নিজস্ব ‘মহাকাশ সম্পদ আইন’ প্রণয়ন করছে।
মহাকাশে আমেরিকার অর্থনৈতিক এবং নিরাপত্তাগত বিষয়কে চ্যালেঞ্জ জানাতে চীন মহাকাশ সম্পদ উন্নয়নকে তাদের জাতীয় অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করছে।
বর্তমান মহাকাশ প্রতিযোগিতার অন্যতম আরেকটি ক্ষেত্র হচ্ছে যোগাযোগের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনার জন্য পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে হাজার হাজার কৃত্রিম উপগ্রহ স্থাপন করা।
এ লক্ষ্যে আমেরিকার ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্স এখন পর্যন্ত ৩,৫০০ কৃত্রিম উপগ্রহ স্থাপন করেছে, যার বিরাট ব্যবহারের একটি নমুনা ইউক্রেন যুদ্ধ। স্টার লিংক প্রজেক্টের মাধ্যমে স্পেসএক্স ২০২৭ সালের মধ্যে ১২,০০০ কৃত্রিম উপগ্রহ, এবং মোট ৪০,০০০ যোগাযোগ উপগ্রহ পাঠানোর পরিকল্পনা করছে।
এদিকে চায়না স্যাটেলাইট নেটওয়ার্ক গ্রুপ নামে একটি কোম্পানি খুব দ্রুত ১৩,০০০ যোগাযোগ উপগ্রহ পাঠানোর পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে, যে প্রজেক্টের মাধ্যমে পৃথিবীর যেকোনো স্থানে ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়া যাবে।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে এ সিদ্ধান্তে আসা বোধহয় অত্যুক্তি হবে না যে, মহাকাশ প্রতিযোগিতা আবার শুরু হয়ে গেছে, এবং এবারের প্রতিযোগিতায় খেলোয়াড় অনেকগুলো দেশ। এ প্রতিযোগিতা হয়তো আমাদের সামনে মহাকাশের অফুরান সম্পদ উন্মুক্ত করে দেবে। এসব অভিযানেই হয়তো চাঁদ এবং মঙ্গলে মানুষের বসতি স্থাপনের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ লাভ করবে।