
বিষ কথাটা শুনলেই যেন আঁতকে দশ হাত পিছিয়ে আসি আমরা। জীবননাশের জন্য কয়েক ফোঁটা বিষই যথেষ্ট। সজ্ঞানে, সুস্থ স্বাভাবিক মস্তিষ্কে বিষপানের কথা আমরা কল্পনাও করতে পারি না। কিন্তু যদি বলা হয়, আপনি হয়ত নিজের অজান্তেই প্রতিদিন এমন কিছু বিষপান করছেন, তাহলে একটু নড়েচড়ে বসে আপনি জানতে চাইবেন, “আপনি কি পাগল হলেন মশাই, মশকরা করছেন নাকি?” চিকিৎসাশাস্ত্রে সেই বহুকাল আগে থেকে বেশ কিছু গরল পথ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে যা কখনো আমাদের মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে আনে, কখনো আবার সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য শারীরিক সুস্থতা রক্ষা করে থাকে।
ওলভসবেন

ওলভসবেন; Image Source: listverse.com
এই গাছটির বৈজ্ঞানিক নাম একোনিটাম ফেরক্স। হিমালয়ের আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এই গাছটিতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে সিউডাকনিটিন নামক এক ধরণের অ্যালকালয়েড, যা এক প্রাণঘাতী বিষ।
এই গাছের এমন অদ্ভুত নামের পেছনের কথা একটুখানি বলে রাখি। একসময় ধারণা করা হত, মানুষের বেশে লোকালয়ে অনেক ওয়্যারউলফ বাস করে এবং রাতের আঁধারে তারা মানুষের ক্ষতি করে থাকে। এই মানুষরূপী ওয়্যারউলফদের খুঁজে বের করার জন্য এই ফুলটি ব্যবহার করা হত। সন্দেহভাজনের চিবুকের উপর যদি ফুলের হলুদ রং এর ছায়া পড়ত, তাহলে তাকে ওয়্যারউলফ ধরে নেয়া হত।
এই গাছ থেকে প্রাপ্ত একোনিট নামক অ্যালকালয়েড চিকিৎসাশাস্ত্রে ব্যবহৃত হয়। কফ, নিউমোনিয়া, কন্ঠনালীর প্রদাহ, ল্যারিঞ্জাইটিস, অ্যাজমা প্রভৃতি রোগের ক্ষেত্রে এটি ব্যবহৃত হয়।
আর্গট

আর্গট; Image Source: listverse.com
আর্গট ক্লাভিসেপস গোত্রের অন্তর্ভুক্ত এক ধরণের ছত্রাক। বিভিন্ন শস্যদানা, যেমন: রাই, বার্লি, ওটস, গম প্রভৃতিতে ছত্রাকজনিত রোগের সৃষ্টি করে থাকে। এরা বাড়ন্ত শস্যের শুধুমাত্র বীজকোষকে সংক্রমিত করে এবং প্রচুর পরিমাণে বিষাক্ত অ্যালকালয়েড নিঃসরণ করে থাকে। আর এই বিষাক্ত অ্যালকালয়েড মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীকুলের জন্য খুব ক্ষতিকর। রোগাক্রান্ত এসব শস্য গ্রহণের ফলে হ্যালুসিনেশন, উদ্ভ্রান্তের ন্যায় আচরণ, খিঁচুনি, এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। এছাড়াও মূত্রনালীর সংক্রমণ, মাথাব্যথা এবং মাঝে মাঝে সংজ্ঞা হারানোর মতো লক্ষণও দেখা যায়। অনেক সময় দেখা যায়, খাবার গ্রহণের ফলে এই ছত্রাক মানুষের শরীরে ছড়িয়ে পড়ে এবং অঙ্গহানির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
মধ্যযুগে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেন, পরিমিত মাত্রায় আর্গট সেবনের ফলে গর্ভপাত সুনিশ্চিত হয়, প্রসবের পর মায়ের রক্তক্ষরণ বন্ধে সহায়তা করে এবং পারকিনসন্স রোগের পথ্য হিসেবে কার্যকরি ভূমিকা রাখে। আর্গটের এবং ক্যাফেইন একত্রে মাইগ্রেনের ব্যথায় বেশ উপকারী।
চিলিয়ান রোজ নামক এক বিষাক্ত মাকড়সার বিষ

চিলিয়ান রোজ; Image Source: listverse.com
আমেরিকা এবং ইউরোপে গেলে খুব সহজেই দেখা মিলবে চিলিয়ান রোজ নামক এক বিষাক্ত মাকড়সার। গায়ে তীক্ষ্ম কাঁটাযুক্ত এই মাকড়সা নিরীহ প্রকৃতির, তবে আসন্ন বিপদ বুঝলে সে তার সূচালো কাঁটা ফুটিয়ে দেয়। কাঁটার অগ্রভাগে রয়েছে বিষ, যা মৃত্যুর কারণ না হলেও তীব্র ব্যথা এবং রক্তক্ষরণের জন্য দায়ী।
নিউইয়র্কের ইউনিভার্সিটি অফ বাফেলোতে কর্মরত এক জৈবপদার্থবিদ এই মাকড়সার বিষ নিয়ে দীর্ঘদীন গবেষণা করেছেন। তিনি বলেন, “এই বিষে এমন একটি প্রোটিন রয়েছে, যা মানুষকে হার্ট অ্যাটাকজনিত আকস্মিক মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করবে।” আমাদের হৃদপিণ্ডের কোষ যখন প্রসারিত হয়, তখন এতে অবস্থিত কিছু ছোট ছোট নালীর মুখ খুলে যায় এবং এই সরু নালীগুলো হৃদকোষের সংকোচনে সহায়তা করে থাকে। যদি কখনো কোনো শারীরিক কারণে এই নালীগুলোর মুখ অনেক বেশি প্রসারিত হয়, তখন রক্তের ধনাত্মক আয়নবিশিষ্ট কণিকাগুলো প্রচুর পরিমাণে হৃদপিণ্ডে প্রবেশ করতে থাকে, যা হৃদপিণ্ডের বিভিন্ন সিগনালিংয়ের ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি করে। ফলশ্রুতিতে অস্বাভাবিকভাবে হৃদস্পন্দন বেড়ে যায় এবং মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। মাকড়সার বিষে অবস্থিত সেই প্রোটিন ছোট ছোট নালীর মুখগুলোকে অতিমাত্রায় প্রসারিত হতে দেয় না কখনো এবং হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি অনেকটা কমিয়ে আনে।
কেনিয়া জায়ান্ট নামে এক ধরণের হলুদ বিছার বিষ

হলুদ বিছা; Image Source: listverse.com
এই বিছাগুলো এতটাই বিষাক্ত যে হুল ফুটিয়ে মুহূর্তেই একজন সুস্থ-সবল মানুষকে মেরে ফেলতে পারে।
ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রান্সমলিকুলার কর্পোরেশনে কর্মরত কিছু গবেষক এই বিছা থেকে প্রাপ্ত বিষ হতে এক ধরনের প্রোটিনের সন্ধান পেয়েছেন, যা ক্যান্সার নিরাময়ে সহায়ক। মানুষের মস্তিষ্কের গ্ল্যায়াল কোষে অবস্থিত কোনো ধরনের টিউমার বা ক্যান্সার কোষের সাথে যুক্ত হওয়ার এক ধরনের প্রবণতা রয়েছে এই প্রোটিনের। সাধারণত ব্রেন ক্যান্সারের নিরাময় খুবই জটিল। ব্রেন ক্যান্সার নিরাময়ের জন্য বিজ্ঞানীরা প্রোটিনের একটি সিনথেটিক ভার্সন তৈরি করেছেন এবং একটি রেডিওএকটিভ আয়োডিন সল্যুশনের সাথে যুক্ত করেছেন। এই পুরো সল্যুশনটিকে ইনজেকশনের মাধ্যমে রক্তপ্রবাহে প্রবেশ করানো হয় এবং প্রোটিনের আসক্তির কারণে সে টিউমার কোষ খুঁজতে থাকে। অতঃপর সেই কোষগুলোর সাথে যুক্ত হয়ে সেগুলোকে ধ্বংস করে ফেলে।
ডেডলি নাইটশেড বা অ্যাট্রপা বেলাডোনা

বেলাডোনা; Image Source: listverse.com
অ্যাট্রপা বেলাডোনা ইউরোপের সবচেয়ে বিষাক্ত গাছগুলোর মধ্যে একটি। সোলানেসি গোত্রের এই গাছটির প্রতিটি অংশই বিষাক্ত, কারণ এর পুরো শরীর জুড়ে রয়েছে ট্রপেন অ্যালকালয়েড। এই গাছের ফল দেখতে অনেকটা চেরি ফলের মতো, যা ছোট বাচ্চাদের খুব সহজেই আকৃষ্ট করে। ছোট বাচ্চাদের ক্ষেত্রে ২/৪টি এবং প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে ১০/২০টি ফল মৃত্যুর কারণ হওয়ার জন্য যথেষ্ট। জেনে অবাক হবেন যে, এই গাছের মাত্র একটি পাতা ভক্ষণ করলে আপনি মুহূর্তেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বেন।
এই গাছ থেকে প্রাপ্ত ট্রপেন অ্যালকালয়েডগুলোর মধ্যে এট্রপিন অন্যতম। ব্রাডিকার্ডিয়া, অ্যাসিস্টল এবং কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের মতো অসুখের তাৎক্ষণিক নিরাময় হিসেবে এট্রপিন ইনজেকশন ব্যবহার করা হয়। এই ঔষধটির কার্যকারিতা এবং বহুল ব্যবহারের কারণে ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের এসেনশিয়াল ড্রাগস লিস্টে একে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
হেমলক

হেমলক; Image Source: listverse.com
সর্বজনীন পরিচিত একটি বিষের নাম হেমলক। এই গাছের বৈজ্ঞানিক নাম কোনিয়াম ম্যাকুলাটাম, এটি একটি গুল্মজাতীয় গাছ। এই গাছে উপস্থিত অ্যালকালয়েডের মধ্যে সবচেয়ে বিপদজনক হচ্ছে কনিন। কনিনের রাসায়নিক গঠন অনেকটা নিকোটিনের মতো। কনিন একটি নিউরোটক্সিন যা মানুষের সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেমের কার্যকলাপকে বিপর্যস্ত করে ফেলে। শুধু তা-ই নয়, শ্বাসযন্ত্রের পেশীগুলোকেও অসাড় করে ফেলে, যার ফলে হৃদপিন্ড থেকে মস্তিষ্কে অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। শরীরে এই বিষ প্রবেশের ৪৮-৭২ ঘন্টার মধ্যে যদি চিকিৎসা শুরু করা না হয়, তাহলে মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। ১০০ গ্রাম হেমলক সেবনে একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি মুহূর্তেই মৃত্যুমুখে পতিত হবে।
পেশীর খিঁচুনি প্রতিরোধক গুণ থাকায় এটি দীর্ঘদিন যাবত ঘুমের ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। অবশ্য গ্রীস এবং ইরানের চিকিৎসকরা হেমলককে আর্থ্রাইটিসের মতো নানা অসুখের পথ্য হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন।
কপারহেড ভেনোম

কপারহেড সাপ; Image Source: listverse.com
উত্তর আমেরিকায় কপারহেড নামক এই সাপটি প্রায়ই দেখা যায়। এই সাপটিকে নিশ্চুপ শিকারি বলা হয়ে থাকে। শিকারের অপেক্ষায় সে ঘাপটি মেরে থাকে এবং খুব সন্তর্পনে দংশন করে আবার দ্রুত পালিয়ে যায়, যার কারণে মানুষ বা অন্যান্য প্রাণী বুঝে উঠার আগেই সাপের দংশনের শিকার হয়ে পড়ে। এই সাপের বিষ মানুষের মৃত্যুর কারণ না হলেও যে জায়গায় কামড় দেয় সেখানকার টিস্যুগুলোকে নষ্ট করে ফেলে।
এই সাপের বিষে কনটরট্রস্টেইন নামক এক ধরনের প্রোটিন খুঁজে পাওয়া গেছে, যা মানবদেহে ক্যান্সার কোষগুলোকে ধ্বংস করতে সাহায্য করে এবং টিউমার কোষগুলোকে আর বড় হতে দেয় না।
ডিজিটালিস

ডিজিটালিস; Image Source: listverse.com
এশিয়া, ইউরোপ এবং আফ্রিকার মাটিতে জন্ম এই গুল্মজাতীয় গাছের। অনেকে এই গাছকে ফক্সগ্লোভসও বলে থাকেন। এই গাছের প্রত্যকেটি অংশই বিষাক্ত। এই গাছের পাতার অংশবিশেষও যদি আপনার পেটে চলে যায় কোনোভাবে, তাহলে মৃত্যু অনিবার্য।
বিজ্ঞানীরা এই বিষাক্ত গাছ থেকে ডিজিটালিন নামক এক ধরনের ঔষধ তৈরি করেছেন, যা কার্ডিয়াক কন্ট্রাকটিলিটি, হার্ট ফেইলার, কার্ডিয়াক এরেস্টের মতো অসুখে ব্যবহৃত হয়। এই ঔষধের অ্যান্টিএরিদমেটিক বৈশিষ্ট থাকার কারণে তা খুব সহজেই হৃদস্পন্দনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
শঙ্কু শামুকের বিষ

শঙ্কু শামুক; Image Source: listverse.com
শঙ্কু শামুক সাগরের এক ধরনের শিকারী শামুক, এরা আকৃতিতে মাঝারি থেকে বড় সাইজের হয়ে থাকে। শামুককে ধীর গতিসম্পন্ন নিরীহ প্রাণী বলেই আমরা জানি। কিন্তু এই শামুকগুলো মোটেও সেরকম না। এরা মানুষ বা অন্যান্য শিকারকে হারপুনের মতো করে হুল ফুটিয়ে দেয় আর নিউরোটক্সিন সম্বলিত বিষগ্রন্থি থেকে নিঃসৃত তরল পদার্থ শরীরে প্রবেশ করা মাত্র মানুষ মারা যায়।
শঙ্কু শামুকের কিছু প্রজাতি যেমন ম্যাজিশিয়ান, কোনাস ম্যাগাস এর শরীরে এক ধরেণের রাসায়নিক পদার্থ পাওয়া যায় যা পেইন কিলার হিসেবে কাজ করে থাকে। জেনে অবাক হবেন যে, এর কার্যকারিতা মরফিনের চেয়েও প্রায় হাজার গুণ বেশি। এছাড়াও কম্বাইন্ড ড্রাগ হিসেবে অ্যালঝেইমার ডিজিস, পারকিনসন্স ডিজিস এবং এপিলেপসির চিকিৎসাতেও প্রাপ্ত রাসায়নিক পদার্থটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
ওয়ারফেরিন

ওয়ারফেরিন; Image Source: listverse.com
ওয়ারফেরিন এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ যা মূলত ইঁদুর মারার বিষ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
কিন্তু এর অ্যান্টিকোয়াগুলেন্ট (রক্তের জমাট বাঁধার সময়কালকে দীর্ঘায়িত করে) ধর্মের কারণে তা থ্রম্বসিস এবং ইম্বোলিজম রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। ১৯৫০ সালের দিকে এই কীটনাশকটি মানুষের স্বাস্থ্য উপকারের জন্য ব্যবহার করা শুরু হয়। উত্তর আমেরিকায় এটি প্রচুর পরিমাণে রোগীদের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়।