হয়তো ভাবছেন কান্নাকাটি তো আবেগধর্মী ব্যাপার, এর মধ্যে বিজ্ঞান আসে কিভাবে? কিন্তু বিজ্ঞান মানেই অজানাকে জানা, রহস্যের সমাধান করা। আর কাঁদার পেছনেও রয়েছে বিজ্ঞান। কাঁদলে কেন চোখ দিয়ে পানি পড়ে? কান্না কি কেবল দুঃখ-কষ্ট বা আবেগেরই বহিঃপ্রকাশ? পশুপাখির চোখ দিয়ে পানি পড়লেও মানুষই এক মাত্র প্রাণী যে খুশিতে বা কষ্টে কাঁদে। কিন্তু কেন? এসব আগে না ভেবে থাকলে নতুন করে ভাবা যাক এবার।
কান্নাকাটি আপনার ভালো লাগুক বা না লাগুক, এটি আপনার জীবনেরই অবিচ্ছেদ্য একটি অংশ। কেবলমাত্র বুক ভাঙা কষ্ট পেলে বা বাঁধভাঙা আনন্দেই যে আপনার নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই চোখে পানি চলে আসে তা কিন্তু না। বিজ্ঞানের কাছেও ক্রন্দন আজও এক রহস্য। আপনি সারাদিন নিজের অজান্তেই কেঁদে চলেছেন। কিভাবে? আসছি সে কথায়। কিন্তু কাঠখোট্টা বিজ্ঞানের কেতাবি ব্যাপার জানার আগে কিছু নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার দেখে নেয়া যাক।
আপনি আয়নার সামনে গিয়ে নিজের চেহারা দেখার সময় কখনও হয়তো হঠাৎ লক্ষ্য করেছেন আপনার চোখ সারাক্ষণই ভেজা ভেজা থাকে। কিংবা পেঁয়াজ কাটতে শুরু করলে হঠাৎই বলা নেই কওয়া নেই চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু বন্যা বইতে শুরু করে, সাথে বিরক্তিকর চোখ জ্বালা । কখনোবা টেলিভিশনের চলচ্চিত্রে বা বইয়ের পাতার কোনো আবেগঘন ঘটনায় আপনার বুক হু হু করে উঠল, নিজেকে সামলাতে না পারায় চোখ দিয়ে আবারো আপনার অশ্রু বন্যা বয়ে গেল।
আর এসব সাধারণ ঘটনার সাথে জড়িয়ে আছে তিন ধরনের চোখের পানি। যাদের প্রত্যেকের কাজ, গঠন আলাদা আর সেসব কিন্তু আপনার সুস্বাস্থ্যের জন্য বেশ উপকারীও। কীভাবে? সেসব উত্তর জানানোর জন্যই আজকের এই লেখা।
অশ্রুজলের উৎপত্তিস্থল
নিউ ইয়র্ক টাইমসের দেয়া তথ্যানুসারে, চার্লস ডারউইন (১৮০৯-১৮৮২) মানুষের আবেগী কান্নাকে নিষ্প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেছিলেন। কিন্তু তার ১৫০ বছর পরও আজ মানুষের কাছে তা ধাঁধাঁই থেকে গেছে। চোখের পানি আসে কোথা থেকে আর মানুষের চোখ দিয়ে পানিই বা পড়ে কেন তার উত্তর জানার চেষ্টা শুরু করে মানুষ আনুমানিকভাবে ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে। প্রায় ১০০ বছর ধরে মানুষ বিশ্বাস করে এসেছে যে, চোখে পানি একধরনের উপজাত দ্রব্য যেটি তৈরী হয় হৃদযন্ত্রের বিভিন্ন উপাদান দুর্বল হয়ে পড়লে এবং তা চোখ দিয়ে পড়ে।
আপনি বিশ্বাস করুন বা নাই করুন, এখন তত্ত্বটি বেশ হাস্যকর শোনালেও সেই সময়ে মানুষ এটিই বিশ্বাস করেছিল। হিপোক্রেটিসের সময় মনে করা হতো, চোখের পানি তৈরী হয় মন থেকে। ষোড়শ শতকের দিকে একটি তত্ত্ব বেশ সাড়া ফেলে মানুষের মনে- আবেগ, বিশেষ করে ভালোবাসা মানুষের হৃদযন্ত্রকে বেশ গরম করে দেয় আর সেটি ঠান্ডা হবার জন্য পানিকে বাষ্প রূপে বের করে দেয়, যা চোখ দিয়ে গাল গড়িয়ে পড়ে। কিন্তু শেষপর্যন্ত বিজ্ঞানের আশীর্বাদে ১৬৬২ সালে ড্যানিশ বিজ্ঞানী নীলস স্টেনসেন আবিষ্কার করেন, চোখের অক্ষিগোলকের বাইরের ল্যাক্রিমাল গ্ল্যান্ড বা অশ্রুগ্রন্থি থেকে চোখের পানি নিঃসৃত হয়। আর এর মাধ্যমেই কান্নার পেছনের বিজ্ঞান আশার আলো দেখতে শুরু করে। মানুষের মনে আসতে থাকে বিভিন্ন প্রশ্ন আর শুরু হয় সেসবের উত্তর অনুসন্ধান। মানুষের চোখের পানির উৎপাদন কিন্তু কেবল আবেগের সাথেই জড়িয়ে নেই।
স্বাভাবিকভাবে দেখতে এক মনে হলেও চোখের পানি আলাদা আলাদা হয়। চোখের পানির বিভিন্ন নমুনা সংগ্রহ করে বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত তিন ধরনের চোখের পানি আবিষ্কার করেছেন। কিন্তু তারা এখনও পর্যাপ্ত পরিমাণে আশ্বস্ত নন যে, কেন মানুষ আবেগে কাঁদে। তবে তারা এখন পর্যন্ত যে সকল ব্যাখ্যা দিয়েছেন আমরা সেগুলোই আজ জানবো।
বেসাল টিয়ার্স
সব অশ্রু নিঃসরণের শুরু হয় ল্যাক্রিমাল গ্ল্যান্ড বা অশ্রুগ্রন্থি দিয়ে। ল্যাক্রিমাল গ্ল্যান্ড অক্ষিগোলকের ঠিক ওপরে খানিকটা বাম দিকে থাকে। উভয় চোখেই একটা করে ল্যাক্রিমাল গ্ল্যান্ড আছে। এই গ্রন্থি থেকে যে অশ্রু তৈরী হয় সেটাই বেসাল টিয়ার্স, যার বাংলা করলে দাঁড়ায় মৌলিক অশ্রু। এই গ্রন্থি প্রতিনিয়ত উৎপন্ন করে চলেছে নতুন অশ্রু। কতটুকু? প্রায় ১০ আউন্স বা ২৮৪.৪ গ্রাম পর্যন্ত একদিনে আর বছরে সেটা প্রায় ৩০ গ্যালন বা ১৩২ কেজির কাছাকাছি। মানে আপনি ডুবে যেতে পারবেন আপনার অশ্রু সাগরে। আর এই নতুন তৈরী অশ্রু অপসারণের জন্য আছে ল্যাক্রিমাল পাংক্টা, যেটা চোখের নিচের কোনার ডান দিকে থাকে। ল্যাক্রিমাল গ্ল্যান্ড থেকে অশ্রু উৎপন্ন হয়ে সেটা ল্যাক্রিমাল পাংক্টা দিয়ে অপসারিত হয় নাসারন্ধ্র দিয়ে।
এই প্রক্রিয়া অনবরত চলতে থাকে আর এজন্যই চোখ কখনও শুকিয়ে যায় না। বেসাল টিয়ার্স আপনার চোখের পাতা ওঠা-নামা করতে সাহায্য সাহায্য করে। কারণ এর মাধ্যমে চোখ পিচ্ছিল থাকে। এটি তিনটি লেয়ার দ্বারা গঠিত যার একেবারে ভেতরেরটি হল মিউকাস লেয়ার, মাঝেরটি অ্যাকুয়াস লেয়ার আর উপরেরটি তৈলাক্ত লিপিড লেয়ার। এই লেয়ারগুলো চোখে ভিটামিন আর পুষ্টি সরবরাহ করে আর চোখকে আর্দ্র রাখে, বাইরের ক্ষতিকর ব্যাক্টেরিয়ার হাত থেকে রক্ষা করে। বেসাল টিয়ার্স সারাদিন নিজ কাজ করে চললেও আপনি তা টের পান না।
রিফ্লেক্স টিয়ার্স
পেঁয়াজ কাটলেন আর চোখ দিয়ে পানি পড়লো না এমনটা সাধারণত হয় না। পেঁয়াজ কাটার ফলে এর মধ্যে থাকা সালফার একটি চেইন রিয়েকশন করে প্রথমে সালফোক্সাইড, এরপর সালফেমিক এসিড এবং পরবর্তীতে সিন-প্রপেন্থিয়াল-এস-অক্সাইড উৎপন্ন করে, যা বাতাসের মাধ্যমে চোখে পৌঁছে চোখ জ্বালা শুরু করে এবং ল্যাক্রিমাল গ্ল্যান্ডকে উদ্দীপ্ত করে। আর তখনই রিফ্লেক্স টিয়ার্স নিঃসরণ শুরু হয় অত্যাধিক পরিমাণে।
চোখে কোনো প্রকার আঘাত লাগলে বা ক্ষতিকর, বিরক্তিকর কোনো গ্যাস বা বস্তুর সংস্পর্শে আসলে এ ধরনের পানি নিঃসরিত হয়। বেসেল টিয়ার্সের মতো এই রিফ্লেক্স টিয়ার্স বা প্রতিরোধী অশ্রুও তিন লেয়ার বিশিষ্ট, কিন্তু এদের মধ্যে বেশ পার্থক্য আছে। এই অশ্রুতে বেশি পরিমাণে এন্টিবডি থাকে, যাতে কোনো জীবাণু চোখের ক্ষতি করতে না পারে। আর চোখের সংস্পর্শে আসা সেসব বস্তুকে সরিয়ে দিতে এতে পানির পরিমাণ বেশি থাকে, প্রায় ৯৮%।
ইমোশনাল টিয়ারস
আবেগের অশ্রু; এই অশ্রু আমরা সকলেই চিনি এবং এর সাথে অনেকেই বেশ গভীরভাবে পরিচিতও। আর বিজ্ঞানীদের জন্য এক রহস্যও বটে এই আবেগী অশ্রু। এর আরেক নাম সাইকিক টিয়ারস, যা চাইলেই ইচ্ছাকৃতভাবে বের করা যায় না, কারণ এর সাথে আবেগ জড়িয়ে থাকে।
অতিরিক্ত আনন্দ বা কষ্ট কোনোটাই চেপে রাখা আপনার জন্য ভালো ফল বয়ে আনবে না। তাই কান্নার মাধ্যমে সেই সুখের বা দুঃখের আবেগকে প্রশমিত করাই হলো ইমোশনাল টিয়ার্সের কাজ। আবেগের সাথে সম্পর্কিত মানব মস্তিষ্কের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল হাইপোথ্যালামাস এবং বেসাল গ্যাংলিয়া। এগুলো ল্যাক্রিমাল গ্ল্যান্ডের সাথে যুক্ত থাকায় আবেগ প্রশমিত করার জন্য মস্তিষ্ক থেকে সংকেত পাঠায়। কিন্তু বিজ্ঞানীরা এখনও নিশ্চিত নন কেন এমনটা ঘটে।
রিফ্লেক্স টিয়ার্স আর ইমোশনাল টিয়ার্সের মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। বিভিন্ন গবেষণার মাধ্যমে দেখা গেছে, এ অশ্রুতে অনেক বেশি মাত্রার স্ট্রেস হরমোন থাকে। ACTH (Adrenocorticotropic hormones) এমন একটি হরমোন। এছাড়াও লিউসিন, এনকেফালিনের মতো রাসায়নিক পদার্থ থাকে, যা ব্যথানাশকের কাজে দেয়। তাই হয়তো একটু কান্নার পর আপনি বেশ স্বস্তি অনুভব করেন আর কাজের জন্য উদ্যম ফিরে পান। কিন্তু সকল বিজ্ঞানী এখনও এ ব্যাপারে সহমত প্রকাশ করেন নি। কারণ এজন্য আরো গবেষণার প্রয়োজন।
মানুষ কেন কাঁদে
এত কিছুর পরও একটি প্রশ্ন থেকেই যায়। আর তা হলো- মানুষ কেন কাঁদে? আগেই বলা হয়েছে, বিজ্ঞানীরা এখনও এর কারণ নিয়ে নিশ্চিত নন, তবে বিভিন্ন গবেষণা থেকে কিছু ব্যাপার উঠে এসেছে। যেমন শিশুরা কাঁদে বড়দের মনোযোগ পাবার জন্য, কিন্তু বড় হবার পর? একটি গবেষণায় কিছু মানুষের কান্নার ছবি তোলার পর ফটোশপের মাধ্যমে অশ্রুগুলোকে মুছে দেয়া হয়। এরপর ২টি ছবির মধ্যে তুলনা করে দেখা যায়, যে ছবিতে অশ্রু আছে সে ছবিতে কষ্টের অনুভূতি বেশ স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে, আর যে ছবি থেকে অশ্রু মুছে ফেলা হয়েছে সেগুলোতে কষ্টের ছাপ তেমন একটা বোঝা যায় নি। বরং সেগুলোতে অনেকে মিশ্র অনুভূতিও লক্ষ্য করেছেন। অনেক ক্ষেত্রে মানুষ কাঁদে অন্যের সহানুভূতি পাবার আশায় ।
পিটসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের পোষ্ট ডক্টরেট লরেন বিলস্মা কয়েকজনকে নিয়ে একটি গবেষণা করেন, যাতে দেখা যায় অংশগ্রহণকারী কাঁদলে এবং তাকে অন্য কেউ কাঁদতে দেখলে সেটি কেমন প্রভাব ফেলে। যদি সেই অন্য মানুষটি কাছের কেউ হয়, তাহলে কাঁদতে ভালো লাগে। কিন্তু সেটি যদি অপরিচিত কেউ হয়, তাহলে কাঁদতে বেশ লজ্জা লাগে বা অস্বস্তিকর লাগে। কিন্তু তারপরও কাঁদলে সেটা হয় কোনো নির্মম ঘটনার জন্য। তারা সব থেকে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন একা একা কাঁদতে (Journal of Research in Personality, 2011)।
১৯৮০ সালে প্রাণ রসায়নবিদ উইলিয়াম এইচ ফ্রেই এক গবেষণায় দেখেন, মেয়েরা ছেলেদের তুলনায় একটু বেশিই কাঁদে। প্রতি মাসে গড়ে একজন নারী যেখানে কাঁদেন ৫.৩ বার, সেখানে একজন পুরুষ কাঁদে মাত্র ১.৩ বার। লরেন বিলস্মাও একই ফলাফল পান তার গবেষণায়। এজন্য দায়ী করা যেতে পারে ছেলেদের টেস্টোস্টেরোন হরমোনকে যা কাঁদতে বাঁধা দেয়, আর মেয়েদের প্রোল্যাক্টিন হরমোনকে যা কান্না বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু এটি পুরোটাই প্রাকৃতিক ব্যাপার না।
কাঁদলে মন হালকা হয়। কাজে উদ্যম ফিরে আসে। তাছাড়া ইমোশনাল টিয়ার্স আপনার শরীরের স্ট্রেস কমিয়ে দেয়। তাই কান্নার কিন্তু বেশ কিছু উপকারিতাও আছে। যদিও খুব বেশি কাঁদলে ডিহাইড্রেটেড হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। খুশির কান্না অনেক সময় সামাজিক বন্ধন দৃঢ় করার জন্য হয়ে থাকে। আরেকটি মজার তথ্য হলো ছোট বাচ্চাদের কান্নারও ধরন আছে। সেটি তিন রকমের- মৌলিক কান্না, রাগের কান্না এবং ব্যথার কান্না।
শেষ করবো কুমিরের কান্না দিয়ে। অনেক প্রচলিত একটি প্রবাদ হলো কুমিরের কান্না, যা আমরা মায়া কান্না বা নকল কান্না বুঝাতে ব্যবহার করি। এই প্রবাদটি এসেছে কুমিরের একটি আচরণ থেকে। কুমির শিকার করার সময় চোখ দিয়ে অশ্রু নিঃসরণ করে এবং অবশ্যই সেটি আবেগের অশ্রু না। কুমিরের ল্যাক্রিমাল গ্ল্যান্ড থাকলেও আবেগের জন্য কুমির কখনও কাঁদে না। আর সেজন্যই কেউ কোনো উদ্দেশ্যে নকল কান্না কাঁদলে তাকে কুমিরের কান্না বলে। তার মানে কান্না একটি অস্ত্রও বটে!