কোনো বস্তুকে হাতে নিলাম, একে টুকরো টুকরো করলাম, টুকরোগুলোকে আরো ক্ষুদ্র টুকরো করলাম। এভাবে করতেই থাকলাম। এই প্রক্রিয়া চালিয়ে গেলে এক পর্যায়ে ‘পরমাণু’ নামক স্থানে এসে থামতে হবে আমাদেরকে। সেখানে দেখতে পাবো, সারি সারি অগণিত পরমাণু মিলে পদার্থ গঠন করেছে। শুধু এই বস্তুটিই নয়, অন্য যেকোনো বস্তুর বেলাতেও একই ফলাফল পাওয়া যাবে। এক টুকরো পারদকে কেটে কেটে সর্বনিম্ন যে পরিমাণ ক্ষুদ্র অংশ পর্যন্ত তাকে ‘পারদ’ বলে ডাকা যায়, তা-ই হলো পারদের পরমাণু। পরমাণু শব্দের অর্থ ‘অবিভাজ্য’। শাব্দিক অর্থ অনুসারে, একে আর কোনো ক্ষুদ্র অংশে ভাগ করা যায় না।
পরমাণু কথাটার মানে অবিভাজ্য হলেও মজার ব্যাপার হচ্ছে, পরমাণুকেও ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত করা সম্ভব। কিন্তু এরপর এটা আর পরমাণু থাকবে না। যেমন সর্বনিম্ন এককের পারদ-পরমাণুকে আরো ক্ষুদ্রতর অংশে ভাগ করা হয়তো যাবে, কিন্তু ভাগ করে নিলে তা আর পারদ থাকবে না। ভাগ করা মাত্রই সেটি তার পরিচয় হারাবে। তখন চলে আসবে মৌলিক কণিকার হিসাব নিকাশ।
বৈজ্ঞানিকভাবে সর্বপ্রথম পরমাণুর ভেতরটা দেখার চেষ্টা করেছিলেন আর্নেস্ট রাদারফোর্ড, সেই ১৯১১ সালে। আমরা পরমাণু দেখতে পাই না এবং বৈশিষ্ট্য অপরিবর্তিত রেখে তাদেরকে একাধিক ভাগে ভাগও করতে পারি না। দেখতে পারি না, ভাগ করতে পারি না, তার মানে এই না যে পরমাণুর অভ্যন্তর ভাগটা দেখতে কীরকম তা ‘বুঝতে’ পারবো না। বিজ্ঞানীরা যখন কোনোকিছুকে সরাসরি দেখতে বা অনুধাবন করতে পারেন না, তখন তারা ‘বৈজ্ঞানিক মডেল’ প্রদানের মাধ্যমে তার সম্ভাব্য ব্যাখ্যা ও ভবিষ্যদ্বাণী প্রদান করেন। উপযুক্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে পরবর্তীতে সেই মডেল সত্য বলে প্রমাণিত হয় কিংবা বাতিল বলে গণ্য হয়।
রাদারফোর্ডেরও আগে পদার্থবিদ জে. জে. থমসন পরমাণুর গঠনের একটি মডেল প্রদান করেন। সেটি ছিল ঊনিশ শতকের একদম শেষ দিকের কথা। থমসনের এই মডেলে কিছু ত্রুটি বিদ্যমান ছিল। পরবর্তীতে থমসনের ছাত্র আর্নেস্ট রাদারফোর্ড তার মডেল থেকে কিছুটা উন্নত ও কম ত্রুটিসম্পন্ন মডেল প্রদান করেন। রাদারফোর্ড ছিলেন থমসনের যোগ্য ও কৃতি ছাত্র, ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক এবং পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার অর্জনই তার যোগ্যতার প্রমাণ। তবে পরবর্তীতে রাদারফোর্ডের মডেলেও কিছু সীমাবদ্ধতা/ত্রুটি দেখা যায়। এই ত্রুটিগুলো সংশোধন করে এর থেকেও উপযুক্ত মডেল প্রদান করেন তারই ছাত্র নিলস বোর।
রাদারফোর্ড বা বোর মডেল অনুসারে পরমাণুগুলো দেখতে অনেকটা সৌরজগতের মতো। পরমাণুর অভ্যন্তরে একটি ভারী কেন্দ্র আছে এবং এই কেন্দ্রকে বলা হয় নিউক্লিয়াস। নিউক্লিয়াসের অভ্যন্তরে প্রোটন ও নিউট্রন থাকে। ইলেকট্রনগুলো নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে বাইরের দিক থেকে সৌরজগতের গ্রহের মতো করে ঘুরছে। রাদারফোর্ড বা বোর পরমাণু মডেল অনুসারে পরমাণুর অভ্যন্তরে বেশিরভাগ স্থানই ফাঁকা। এক সারি পরমাণুর মধ্যে এক নিউক্লিয়াস থেকে আরেক নিউক্লিয়াসের মাঝে বেশ বড় একটি ফাঁকা স্থান বিরাজ করে।
এখানে বলে রাখা ভালো, বড় বা ছোট এই ব্যাপারগুলো আসলে আপেক্ষিক। প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে খুব বড় নগণ্য হতে পারে আবার প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে অতি-অল্প দূরত্ব বা আকারও বড় বা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হতে পারে। যেমন- মহাজাগতিক গ্রহ-নক্ষত্রের ক্ষেত্রে শত শত বা হাজার হাজার কিলোমিটারও গণনার বাইরে ‘ক্ষুদ্র’ বলে প্রতিভাত হতে পারে, আবার পারমাণবিক স্কেলে এক সেন্টিমিটারের এক কোটি ভাগের এক ভাগও (ন্যানোমিটার) ‘বড়’ বা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।
পাশাপাশি সাজিয়ে রাখা পরমাণুর নিউক্লিয়াসকে যদি একটি সাধারণ ফুটবলের আকার বলে ধরে নেওয়া হয়, তাহলে পরমাণুর গুচ্ছে এক নিউক্লিয়াস থেকে আরেক নিউক্লিয়াসের দূরত্ব হবে ১৫ কিলোমিটারের মতো! এটি হিসাব করা হয়েছে হীরকের পরমাণু কার্বনের ক্ষেত্রে। ভারী পরমাণুতে তথা বড় পরমাণুতে এর দূরত্ব আরো বেশি হতে পারে। ফুটবলের নিউক্লিয়াসের চারদিকে অর্থাৎ ১৫ কিলোমিটার ফাঁকা স্থানে ফুটবলকে কেন্দ্র করে ইলেকট্রনগুলো আবর্তন করে। ফুটবলের তুলনায় ইলেকট্রনগুলো হবে বালুকণার মতো ক্ষুদ্র। ইলেকট্রনগুলোও আবার অন্য ইলেকট্রন থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরত্ব বজায় রেখে চলে।
বলা হয়ে থাকে হীরক হচ্ছে প্রকৃতির সবচেয়ে দৃঢ় বস্তু, সহজে গলানো যায় না একে। হীরক গঠিত কার্বন নামক পরমাণু দিয়ে। যেহেতু পরমাণুর বেশিরভাগটাই ফাঁকা, তার মানে দাঁড়াচ্ছে, বিশ্বের সবচেয়ে দৃঢ় পদার্থের ভেতরের প্রায় সবটাই ফাঁকা। একই ব্যাপার অন্যান্য দৃঢ় বস্তুর বেলাতেও প্রযোজ্য। পাথরের বেলাতেও প্রযোজ্য, সীসার বেলাতেও প্রযোজ্য, লোহার বেলাতেও প্রযোজ্য এবং শক্ত-পোক্ত কাঠের বেলাতেও প্রযোজ্য। এমনকি তোমার-আমার-আপনার সকলের বেলাতেও প্রযোজ্য।
আমাদের কল্পনায় নিউক্লিয়াসকে ফুটবলের সাথে তুলনা করেছিলাম। নিউক্লিয়াস আসলে ফুটবলের মতো না। আমরা যদি আমাদের কল্পনাকে মডেল হিসেবে বিবেচনা করি, তাহলে এটা হবে জঘন্যতম অবাস্তব মডেল। আসল কথা হচ্ছে, এর আকৃতি আসলে ফুটবলের মতো মসৃণ বা গোল নয়। নিশ্চিত করে এটাও বলা যাবে না যে, এর নির্দিষ্ট কোনো আকৃতি আছে।
প্রতিটি নিউক্লিয়াস আবার প্রোটন ও নিউট্রন নামের দুটি অতিক্ষুদ্র মৌলিক কণিকা দিয়ে গঠিত। চিন্তার সুবিধার জন্য কেউ যদি চায়, তাহলে এদের আকৃতিকেও গোল বলে ধরে নিতে পারবে, কিন্তু আদতে এদেরও নির্দিষ্ট কোনো আকৃতি নেই। আকারের দিক থেকে প্রোটন ও নিউট্রন প্রায় একই। অবশ্যই এরা খুব ক্ষুদ্র কিন্তু তারপরও এরা ইলেকট্রনের এক হাজার গুণ বড়।
ভরের দিক থেকে ইলেকট্রন এতটাই নগণ্য যে, পরমাণুর ভর গণনার সময় প্রোটন ও নিউট্রনের ভরকে গণনা করলেই হয়ে যায়, ইলেকট্রনকে গণনায় আনতে হয় না। ‘ভর’ মানে কী? কোনো বস্তুর ভর কত হবে, তা নির্ভর করে বস্তুটিতে বিদ্যমান সকল প্রোটন ও নিউট্রনের উপর। অর্থাৎ এক প্যাকেট লবণের ভর কত হবে তা নির্ভর করে লবণের প্যাকেটের সবগুলো পরমাণুতে ঠিক কতগুলো প্রোটন ও নিউট্রন আছে তার উপর। একই প্রকারের পদার্থের সবগুলো নিউক্লিয়াসে একই পরিমাণ প্রোটন থাকে। যেমন- লবণের মধ্যে গাঠনিক উপাদান হিসেবে থাকে সোডিয়াম। লবণে যতগুলো সোডিয়াম আছে তার সবগুলোর নিউক্লিয়াসেই একই পরিমাণ প্রোটন আছে। প্রোটনের সমান সংখ্যক ইলেকট্রন পরমাণুর অভ্যন্তরে ঘুরছে নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে।
কোনো পরমাণুর ভেতর যতগুলো প্রোটন থাকে, সেটি হচ্ছে ঐ মৌলের পারমাণবিক সংখ্যা। কোনো মৌলের পারমাণবিক সংখ্যা দিয়েও ঐ মৌলকে শনাক্ত করা যায়। যেমন- ৬ নম্বর পরমাণু হচ্ছে কার্বন, ৮২ নম্বর পরমাণু হচ্ছে সীসা (লেড)। এরকম সংখ্যাগত বৈশিষ্ট্যের জন্যই পরমাণুগুলোকে গোছালোভাবে পর্যায় সারণীতে সাজানো যায়।
পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছিল, যখন কোনো বস্তুকে ক্ষুদ্রতর অংশে ভাগ করা হয়, তখন একপর্যায়ে সেটি পরমাণু নামক সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম অংশে গিয়ে পৌঁছায়। এরপর পরমাণুকে যদি ভাঙা হয়, তাহলে সেটি আর ঐ নির্দিষ্ট পদার্থের পরমাণু থাকে না, অন্য কোনো পরমাণু বা অন্য কোনো মৌলিক কণা হয়ে যায়। যেমন- সীসার পরমাণু ৮২টি প্রোটন নিয়ে গঠিত। একে যদি ভাঙা হয় বা আরো ক্ষুদ্র করা হয় তাহলে প্রোটনকে বিভক্ত করতে হবে। যখনই প্রোটনগুলো দু’ভাগে বিভক্ত হবে কিংবা এখান থেকে এক বা একাধিক স্থানে সরিয়ে নেয়া হবে তখন সেটি আর সীসা থাকবে না, অন্য কোনো মৌলের পরমাণু হয়ে যাবে। কোনো পরমাণুকে সীসা হতে হলে, তার মধ্যে অবশ্যই ৮২টি প্রোটন থাকতে হবে।
আর ইলেকট্রন সরিয়ে নিলে কী হবে? পরমাণুর ইলেকট্রনের এদিক সেদিক করলে তা পরমাণুতে প্রভাব ফেললেও, পরমাণুর আত্মপরিচয় নিয়ে টান দেয় না। কারণ ইলেকট্রনের ভর একদমই নগণ্য।
নিউট্রন আবার কিছুটা ভিন্নরকম আচরণ করে। পরমাণুর ভেতর নিউট্রনের সংখ্যা কত হবে, তা প্রোটনের মতো এতটা নির্দিষ্ট নয়। ক্ষেত্রবিশেষে একই পরমাণুতে ভিন্ন ভিন্ন সংখ্যক নিউট্রন থাকতে পারে। যেমন- কার্বন পরমাণু, এতে সবসময়ই ৬টি প্রোটন থাকে। কিন্তু কার্বনের নিউট্রন ৩ ধরনের হতে পারে- ৬টি, ৭টি ও ৮টি। একই ধরনের পদার্থের ভিন্ন ভিন্ন সংখ্যক নিউট্রন ধারণকারী পরমাণুকে ‘আইসোটোপ’ বলে। এই হিসেবে কার্বনের আইসোটোপ আছে ৩টি। কার্বন-১২, কার্বন-১৩ ও কার্বন-১৪। এখানে ১২, ১৩ ও ১৪ সংখ্যা দ্বারা কার্বনের ভর সংখ্যাকে বোঝানো হচ্ছে। কোনো মৌলের প্রোটন ও নিউট্রন সংখ্যার যোগফলকে ভর সংখ্যা বলে। ৬ + ৬ = ১২, ৬ + ৭ = ১৩ ও ৬ + ৮ = ১৪; এই তিনটি ভিন্ন সংখ্যার নিউট্রন নিয়েই হয় কার্বনের ৩টি আইসোটোপ।
কিছু কিছু আইসোটোপ আছে যারা তেজস্ক্রিয়তা প্রদর্শন করে। এর মানে হচ্ছে, এরা তেজস্ক্রিয় বিকিরণ সম্পন্ন করে ধীরে ধীরে অন্য একটি পরমাণুতে রূপান্তরিত হয়ে যায়। কার্বন-১৪ একটি তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ। আইসোটোপের এই তেজস্ক্রিয়তার ধর্মকে কাজে লাগিয়ে বিজ্ঞানীরা ফসিলের বয়স নির্ণয় করতে পারেন। অধিকাংশ ফসিলের বয়স নির্ণয় করার জন্য কার্বন-১৪ আইসোটোপ ব্যবহার করা হয়। যেমন- ডুবে যাওয়া প্রাচীন কোনো জাহাজের বয়স বা সময়কাল নির্ণয় করতে কার্বন-১৪ ব্যবহার করা হয়।
তো, ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রন পর্যন্ত পৌঁছেই কি আমাদের পরমাণু অন্বেষণ শেষ? এতটুকুই কি বস্তুর ক্ষুদ্রতম অংশ? না! এমনকি মৌলিক কণা প্রোটন ও নিউট্রনকেও বিশ্লিষ্ট করা যায়। নিউট্রনকে বিশ্লিষ্ট করলে পাওয়া যায় কোয়ার্ক। প্রকৃতিতে ছয় ধরনের কোয়ার্ক আছে- আপ কোয়ার্ক, ডাউন কোয়ার্ক, টপ কোয়ার্ক, বটম কোয়ার্ক, চার্ম কোয়ার্ক ও স্ট্রেঞ্জ কোয়ার্ক। দুটি আপ কোয়ার্ক (u) এবং একটি ডাউন কোয়ার্ক (d) মিলে প্রোটন গঠন করে, অন্যদিকে একটি আপ ও দুটি ডাউন কোয়ার্ক মিলে নিউট্রন গঠন করে।
কোয়ার্কই কি শেষ? পদার্থবিদরা ধারণা করেন, না। একটি অনুকল্প অনুসারে, কোয়ার্কগুলো অতিক্ষুদ্র তন্তু বা স্ট্রিং দিয়ে গঠিত। এই অনুকল্পটি ‘স্ট্রিং থিওরি’ নামে বিশ্ববিখ্যাত। এখন পর্যন্ত এটিই বস্তুর সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম অংশ বলে বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছেন।