মানবগঠিত সমাজের নানান ধরনের মানুষই এর চালিকাশক্তি। সমাজে মানুষের উপস্থিতির সাপেক্ষে একে শক্তির মানদণ্ডে যাচাই করা হলেও কখনো কখনো অধিকতর মানুষের উপস্থিতি অভিশাপ বয়ে আনতে পারে। বর্ধিষ্ণু জনশক্তি সুরক্ষিত ভবিষ্যৎ গড়ার হাতিয়ার হলেও তা রোপণ করতে পারে ধ্বংসের বীজ। সমাজে সচ্ছল আরামদায়ক জীবনযাপনে অভ্যস্ত লোকজন এটি একেবারেই জানে না যে কীভাবে সামান্য স্খলনই ঘুরিয়ে দিতে পারে সামাজিক ভারসাম্যের চাকা। সভ্যতার অংশ আধুনিক সমাজের চাকচিক্যময় আবরণের আড়ালে যে কতটা ধ্বংস লুকিয়ে থাকতে পারে, ১৯৭২ সালে যেন তারই এক আভাস পেয়েছিলেন প্রাণী আচরণবিদ জন ক্যালহন। প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে অবলোকন করেছিলেন তিনি কীভাবে অধিক জনসংখ্যার কুপ্রভাবের ফলে ধ্বংস হয়ে যায় স্বপ্নপুরীর ন্যায় স্বর্গরাজ্য। এই ‘সব পেয়েছির দেশ’ এর নাম ‘ইউনিভার্স ২৫’, যার অস্তিত্বের উপাখ্যান এবং কীভাবে ধ্বংস হয়ে যায় এই ক্ষুদে ব্রহ্মাণ্ড, তা-ই জানবো এখানে।
ইউনিভার্স ২৫ কী?
ঘটনাপ্রবাহের পটভূমি ১৯৬৮-৭২ সাল। আমেরিকান প্রাণী-আচরণ বিশেষজ্ঞ জন বি. ক্যালহন (১৯১৭-১৯৯৫) আবদ্ধ অঞ্চলে ইঁদুরের ব্যবহারবিধি নিয়ে ক্রমাগত পরীক্ষা করে যাচ্ছিলেন। তার পরীক্ষণ অঞ্চল তথা এই আবদ্ধ স্থানগুলোকে তিনি ডাকতেন ‘ইউনিভার্স’ বা ব্রহ্মাণ্ড নামে। তার আবদ্ধ জগতের পরীক্ষার ২৫তম সংস্করণ এই ‘ইউনিভার্স ২৫’। ইউনিভার্স ২৫ নামক এই আবদ্ধ অঞ্চলে ইঁদুরের ব্যবহারবিধি পর্যবেক্ষণ করেন তিনি। মাত্র কয়েক জোড়া ইঁদুর থেকে শুরু হওয়া এক বসতি যাত্রা ক্রমে এসে দাঁড়ায় ২০০ জনের আবাসভূমিতে। কিন্তু জনসংখ্যার এই বিপুল বৃদ্ধি তাদের প্রারম্ভিক ও গতানুগতিক সামাজিক ব্যবস্থা, আচরণ এমনকি প্রজননেও বিরূপ প্রভাব ফেলে দেয়।
এই আচরণগত পরিবর্তন ও এর ধ্বংসাত্মক পরিণতি এ কাজে তার পূর্বাভিজ্ঞতা ও আশঙ্কামূলক তত্ত্বকেই প্রতিষ্ঠিত করে। নরওয়েতে আরো ছোট পরিসরে ইঁদুরের ওপর কাজ করা এই বিজ্ঞানীর তত্ত্বানুসারে, মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যা সামাজিক কার্যকলাপ ও সমাজের কর্মক্ষমতায় ফাটল ধরিয়ে দেয়, যার সর্বশেষ পরিণতি হিসেবে দেখা দেয় বিলুপ্তি।
যদিও তার এই তত্ত্ব যখন জনসমক্ষে প্রকাশিত হয়, তখন তা নিয়ে বিতর্কের ঝড় বয়ে যায়। অনেকে এটাও ভাবতে শুরু করেন, ক্যালহনের ইউনিভার্স ২৫ কি শেষ পর্যন্ত মানুষের ভবিষ্যৎ পরিণতি কী হতে পারে সে পথেরই প্রতিরূপ? তবে বিতর্কের পাশাপাশি এই ‘সুখ-সুবিধাপূর্ণ ইঁদুরের স্বর্গরাজ্যের প্রকল্প’টি বিশ্বব্যাপী নগর পরিকল্পনা পরিষদ, স্থপতি এবং নানা সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে আগ্রহের বিষয়ে পরিণত হয়।
পূর্বকথা: ইউনিভার্স ২৫ এর পূর্বসূরী গবেষণাসমূহ
ক্যালহনের ছেলেবেলা কাটে টেনেসিতে। ছোটবেলা থেকেই ব্যাঙ, কচ্ছপ, পাখির প্রতি তার টান ছিল এবং শেষ পর্যন্ত তিনি জীববিজ্ঞানে ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জন করেন। অতঃপর তিনি চাকরিসূত্রে বালটিমোরে আসেন এবং সেখানেই সে শহরের অন্যতম প্রধান বালাই নরওয়ের ইঁদুর নিয়ে তাকে কাজ করতে বলা হয়।
‘রডেন্ট’ গোত্রীয় প্রাণীদের নিয়ে ক্যালহন তার গবেষণা ও পর্যবেক্ষণ শুরু করেন ১৯৪৭ সালে। তখন ম্যারিল্যান্ডের রকভিলে একদল আবদ্ধ নরওয়ের ইঁদুরের উপর গবেষণা করেন তিনি। ২৮ মাসের এই পরীক্ষায় তিনি আশা করেছিলেন, অফুরন্ত খাদ্য ও পানির যোগানপ্রাপ্ত এ ইঁদুরগুলোর জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় পাঁচ হাজারে। কিন্তু এই সংখ্যাটি দু’শতেই আটকে যায় এবং এই জনগোষ্ঠী ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে যেতে থাকে, যার প্রতিটিতে বারোজনের অধিক সদস্য ছিল কিনা সন্দেহ আছে।
এই সকল পর্যবেক্ষণ চলাকালীনই ১৯৫০ সালে ক্যালহন আরো জটিলতর আবদ্ধ আবাসস্থলের সৃষ্টি করেন। এটি নির্মাণের উদ্দেশ্য ছিল ইঁদুরের পরবর্তী দলগুলো একটি জীবাণুমুক্ত ও শিকারীবিহীন পরিবেশে কেমন আচরণ করে তা দেখা। শুরুতে বাইরে পরীক্ষা চালানো ক্যালহন ১৯৬০ সালের শুরুর দিকে তার ইঁদুর নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ‘ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ মেন্টাল হেলথ’ এ চালানোর সুযোগ পান। এই সকল পরীক্ষণের ঘটনাপ্রবাহ ও পরিণাম পূর্বঘটিত ফলাফলের মতোই পুনর্ঘটিত হতে থাকে। প্রাপ্ত ফলাফল অনুসারে ইঁদুরগুলোর জীবনযাত্রার ছক অনেকটা এরকম:
- ইঁদুরগুলো পরস্পর পরিচিত হবে এবং প্রজননের মাধ্যমে সংখ্যায় বৃহদাকারে বৃদ্ধি পেতে থাকবে।
- অতঃপর আসে স্থিতাবস্থা তথা ভারসাম্য।
- এরপর ধীরে ধীরে তারা হয় অবন্ধুত্বপূর্ণ, দলস্বার্থ অন্তঃপ্রাণ জীবন বেছে নেবে অথবা নিষ্ক্রিয়, নিস্পৃহ, অসামাজিক জীবনে ধাবিত হবে।
- ধীরে ধীরে এই জনসমষ্টি বিলুপ্তির দিকে এগিয়ে যাবে।
ক্যালহনের এই পর্যবেক্ষণলব্ধ ফলাফল ১৯৬২ সালে ‘পপুলেশন ডেনসিটি এন্ড সোশ্যাল প্যাথোলজি’ শিরোনামে সায়েন্টিফিক আমেরিকান গবেষণাপত্রে প্রকাশিত হয়। এই নিবন্ধে তিনি ‘বিহেভিওরাল সিঙ্ক’ তথা আচরণগত অবক্ষয় নামক কথাটির প্রথম উল্লেখ করেন। এই ব্যবহারবিধির অবক্ষয় তথা বিহেভিওরাল সিঙ্ক কথাটির মাধ্যমে তিনি মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যাপ্রসূত কুপ্রভাবের প্রতি আলোকপাত করেছেন, যেমন: সামাজিক কার্যকারিতা ব্যবস্থার ভেঙে পড়া এবং আবদ্ধ ইঁদুর জনসমষ্টির বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া।
এই ব্যাপারটি জনসমাজে বড় ধরনের আলোড়ন ফেলে দেয়। অনেকেই এই প্রকাশিত নিবন্ধে বর্ণিত ঘটনাবলিকে বর্তমান হারে জনসংখ্যা বেড়ে চললে ভবিষ্যতে তার কী ফলাফল হতে পারে তারই পূর্বাভাস হিসেবে ভাবতে থাকেন। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত এই সম্পর্কিত কাজেই নিয়োজিত থাকেন ক্যালহন।
ইউনিভার্স ২৫: ক্যালহনের পরীক্ষামূলক ‘সব পেয়েছির দেশ’
একজন মানুষের বেঁচে থাকতে কী লাগে? খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষার মতো মৌলিক অধিকারের পাশাপাশি স্বাধীনতা, চিত্তবিনোদন, দুশ্চিন্তাহীন জীবন-যাপনের কথা অনেকেই ভাবতে পারেন। কেমন হতো যদি স্বর্গের ন্যায় এমন অভাবনীয় জীবন নেমে আসতো মর্ত্যে? তাহলে কি পৃথিবীও পরিণত হতো স্বর্গে? নাকি মানুষ তার কর্মফলের দরুন এখানে প্রতিষ্ঠিত করবে এক খণ্ড নরক? বস্তুত, সরাসরি মানুষের ক্ষেত্রে এর সদুত্তর পাওয়া না গেলেও ইঁদুরের ক্ষেত্রে পাওয়া গেছে। এবং সেটি সুখকর তো নয়ই বরং এ ফলাফল অপ্রীতিকর বার্তাই বয়ে আনে। চলুন পাঠক ঘুরে আসি ইঁদুরের স্বর্গরাজ্য ‘ইউনিভার্স ২৫’ থেকে।
পূর্ববর্তী পরীক্ষাদি ও পর্যবেক্ষণ ফলাফল অনুসারে, ক্যালহন তার চূড়ান্ত পরীক্ষাটির পরিকল্পনা করেন। তার এই পরিকল্পনার বাস্তব রূপই ইউনিভার্স ২৫ (ক্যালহনের ২৫তম আবদ্ধ পরীক্ষণ স্থান), যেখানে ২.৭ বর্গ মিটার আবদ্ধ স্থানে ইঁদুরের বসতি গড়ে তোলার ব্যবস্থা ছিল। এই এলাকায় চারটি খুপরির ভেতরে মোট ২৫৬টি আবাস প্রকোষ্ঠ ছিল এবং পাশাপাশি ছিল ১৬টি ছিদ্রযুক্ত সুড়ঙ্গপথ, যার মাধ্যমে খাদ্য ও পানি সরবারহের ব্যবস্থা ছিল।
পরিকল্পনামাফিক, ১৯৬৮ সালের ৯ই জুলাই ক্যালহন আটটি সাদা ইঁদুর ইউনিভার্স ২৫ এ অবমুক্ত করেন। এই ইঁদুরগুলো ছিল উজ্বল এবং স্বাস্থ্যবান এবং এদের জন্য নিয়ন্ত্রিত আবহাওয়া ও অঢেল খাদ্য-পানীয়ের পাশাপাশি ছিল অসংখ্য আবাসন প্রকোষ্ঠ এবং কুচোনো কাগজ ও গুঁড়ো করা ভুট্টার অভ্যন্তরীণ অংশ দেয়া আরামদায়ক মেঝে।
প্লেগবিহীন ও প্রচুর আরামদায়ক পরিবেশ ও কোনো প্রকার শিকারীর আশঙ্কামুক্ত আবহে অফুরান খাদ্য-পানীয়ের সম্ভারে বসবাসরত ‘ইউনিভার্স ২৫’ এর ইঁদুরগুলো আধুনিক মানুষের মতই খুবই আরাম-আয়েশ ও জৌলুসপূর্ণ জীবন উপভোগ করবে বলে ভাবা হয়েছিল। আদতে সেখান কী হয়েছিল তা পাঠক এখনই জানতে পারবেন।
ক্যালহনের পরীক্ষাটি শুরু হয়েছিল চারটি পুরুষ ও চারটি নারী ইঁদুরকে ইউনিভার্স ২৫ এ অবমুক্ত করে। ২.৭ বর্গ মিটারের আবদ্ধ অঞ্চলে সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার ভার ন্যস্ত ছিল তাদের ওপর। তারা সেটি কীভাবে পেরেছিল এবং তাদের আখেরে কিসের মোকাবেলা করতে হয়েছিল এই ঘটনাদি নিম্নলিখিত শ্রেণীতে ভাগ করা যায়।
সংগ্রামী সময় (Strive period)
প্রথম ১০৪ দিন এই ইঁদুরগুলো তাদের নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টায় থাকে। এ সময় তারা নিজ নিজ এলাকা বেছে নিয়ে সেখানে বসবাস করতে শুরু করে। খাপ খাইয়ে নেয়ার সংগ্রামরত জীবনের এই সময়কে ক্যালহন ‘Strive Period’ দশা বলে অভিহিত করেন।
সুযোগ-সুবিধার পূর্ণ ব্যবহার দশা (Exploit Period)
খাপ খাইয়ে নেবার পর ইঁদুরগুলো ইউনিভার্স ২৫ এর সুযোগ-সুবিধাগুলো পূর্ণ উদ্যমে কাজে লাগাতে শুরু করে এবং ফলত তাদের জনসংখ্যা প্রতিনিয়ত বেড়ে চলে। প্রতি ৫৫ দিনে তাদের জনসংখ্যা দ্বিগুণ হতে শুরু করে এবং ৩১৫ দিনের মাথায় ইউনিভার্স ২৫ এর জনসংখ্যা দাঁড়ায় ৬২০ জন ইঁদুরে।
পুরোটা এলাকা জুড়ে যদিও যথেষ্ট পরিমাণে ফাঁকা স্থান ছিল, প্রতি প্রকোষ্ঠে সর্বোচ্চ ১৫টি ইঁদুর থাকতে পারতো এবং পুরো ব্যবস্থাটির ধারণক্ষমতা ছিল ৩,০০০টি ইঁদুরের, তা সত্ত্বেও বেশিরভাগ ইঁদুরই নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় জমায়েত হতে শুরু করলো এবং একই খাবারের উত্স থেকে খাদ্য গ্রহণ শুরু করলো। এই একই স্থানে অধিক জনসমাগম এবং একই উত্স থেকে খাদ্য আহরণকে সামাজিকতার অংশ হিসেবেই ধরে নেয়া যায়। অর্থাৎ একটি সামাজিক ব্যবস্থার গোড়াপত্তন করতে তারা সক্ষম হয়েছিল বলা যায়।
কিন্তু এ সকল জমায়েতের ঘটনা শেষ পর্যন্ত প্রজনন হার কমিয়ে দেয় এবং তাদের নতুন সদস্য জন্মানোর হার কমে তাদের প্রারম্ভিক জন্মহারের এক-তৃতীয়াংশ হয়ে যায়। ইঁদুরদের মধ্যে একপ্রকার সামাজিক ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়:
- এক-তৃতীয়াংশ সংখ্যক ইঁদুর সামাজিকভাবে ক্ষমতাশালী হয়।
- বাকী দুই-তৃতীয়াংশ অন্যদের তুলনায় কম সামাজিক হয়ে ওঠে।
যেহেতু ইঁদুরদের মধ্যে সামাজিক বন্ধন কমে যায়। ফলত, ইউনিভার্স ২৫ ধীরে ধীরে ধীরে অপ্রতিরোধ্য ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। কী ঘটে চলেছিল ইউনিভার্স ২৫ এ তা জানতে হলে তাদের সামাজিক ব্যবস্থা থেকে একটু ঘুরে আসা যাক।
ইউনিভার্স ২৫ এর সামাজিক ব্যবস্থা
৩১৫ তম দিনের মধ্যে উচ্চ ও নিম্ন সামাজিক মর্যাদাসম্পন্ন ইঁদুরগুলোর নধ্যবর্তী আচরণগত বিভেদ আরো বেশি প্রকট হয়ে উঠতে থাকে। নারী সংসর্গের প্রাধান্য তালিকায় স্থান না পেয়ে নিম্নস্তরভুক্ত ইঁদুরসমূহ নিজেদেরকে নারীদের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হিসেবে আবিষ্কার করে এবং নিজেদের প্রজনন থেকে পুরোপুরি দূরে সরিয়ে নেয়। ইঁদুরসমাজে কোনো ধরনের ভূমিকা না থাকায় এই সমাজ বিতাড়িত পুরুষ ইঁদুরগুলো বড় বড় দলগুলোর থেকে আলাদা হয়ে ইতিউতি ঘুরে বেড়াতো, একা একাই খাবার গ্রহণ করতো ও ঘুমিয়ে যেত এবং মাঝেমধ্যে নিজেদের মধ্যে লড়াইয়ে লিপ্ত হতো।
আলফা পুরুষ ইঁদুর
প্রতিটি দলেরই প্রভাবশালী পুরুষ ইঁদুরগুলো (আলফা পুরুষ ইঁদুর) আরো আক্রমণাত্মক ও লড়াইপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং কোনো ধরনের উস্কানি ও উদ্দেশ্য ছাড়াই প্রায়শই নানা ধরনের সংঘাত ও বিধ্বংসী কাজকর্মে মত্ত হয়ে ওঠে। মাঝে মাঝে এই ইঁদুরগুলো চারপাশে ঘুরে বেড়াতো এবং লিঙ্গ নির্বিশেষে অন্য ইঁদুরদের ধর্ষণে লিপ্ত হতো।
বিটা পুরুষ ইঁদুর
বিটা গোত্রীয় পুরুষ ইঁদুরগুলোর অবস্থান আলফা ইঁদুর ও দল বিতাড়িত ওমেগা ইঁদুরগুলোর মাঝখানে। এই ইঁদুরগুলো নিষ্ক্রিয় ও আত্মবিশ্বাসবিহীন এবং বিভিন্ন দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ফলে আহত হয়ে যায় এরা। অনেক ঘটনায়ই দেখা যায় এসব রক্ত-সংঘাত শেষপর্যন্ত গড়ায় জয়ীদের দ্বারা বিজিত ও নিহত স্বজাতির মাংস ভক্ষণ উত্সবে।
পুরুষ ইঁদুরগুলো যখন নিজেদের মতো এভাবে ব্যস্ত ছিল, তখন মেয়ে ইঁদুরগুলো কোনো প্রকার সাহায্য ব্যতিরেকে একরকম একা একাই বাসস্হান ও নিজেদের দেখভাল করতে করতে ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে আরো আক্রমণাত্মক মনোভাব দেখা দেয়। কখনো কখনো সেটি এতটাই বেড়ে যেতো যে তা তাদের শিশুদের প্রতিই প্রকাশ পেতো। অন্য মায়েরাও তাদের মাতৃসুলভ কর্তব্য থেকে বিরত থাকতে শুরু করেছিল এবং তাদের শিশুদের পরিত্যাগ করা শুরু করেছিল। পাশাপাশি তারা নিজেদের প্রজননব্যবস্থা থেকেও দূরে সরিয়ে নেয়, যার ফলাফল ছিল বেশ সাংঘাতিক রকমের।
ভারসাম্য/স্থিতিশীল দশা (equilibrium/stagnation phase)
এ সময়ে কিছু কিছু আবাসিক প্রকোষ্ঠে শিশু মৃত্যুর হার বেড়ে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত চলে যায়। ক্যালহন ইঁদুরগুলোর আক্রমণাত্মক ও নিষ্ক্রিয় ব্যবহারের কারণ হিসেবে দায়ী করেন সামাজিক দায়িত্বশীলতার ভাঙন এবং ক্রমপ্রসারমান মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যাকে।
মৃত্যু দশা (Death Phase)
এ সময়ে মৃত্যুর হার বেড়ে সর্বোচ্চ হয়ে যায়। ইঁদুরবিশ্ব ইউনিভার্স ২৫ এর ৫৬০ তম দিনের মাথায় সেখানে মৃত্যুর হার শতকরা ১০০ ভাগে পৌঁছে যায় এবং ফলবশত জনসংখ্যার বৃদ্ধি পাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। এই সময়কে ‘মৃত্যুকাল’ বা ‘মরণদশা’ হিসেবে অভিহিত করা হয়।
সকল সহিংসতা, অরাজকতা ও প্রজননের অনুপস্থিতিতে একটি নতুন প্রজন্ম গড়ে উঠছিল। এই প্রজন্মগুলো প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছিল এমন একটি পরিবেশের মধ্য দিয়ে যেখানে কোনো স্বাভাবিক সুন্দর ও আদর্শ সম্পর্কের দৃষ্টান্ত ছিল না। প্রজনন, পিতৃ-মাতৃসুলভ আচরণ কিংবা নতুন ঠিকানায় বসবাসের কোনোপ্রকার জ্ঞান ব্যতীত বেড়ে ওঠা এই ইঁদুরগুলো নিজেদের জেগে থাকার পুরোটা সময় পার করতো খাদ্য-পানীয় গ্রহণ ও নিজেদের পরিপাটি করে সাজিয়ে রাখতে। তাদের নিখুঁত ও পরিপাটি চেহারার জন্য ক্যালহন এই ইঁদুরগুলোর নাম দেন “সুন্দর ইঁদুর’। অন্যান্য ইঁদুরদের থেকে দূরে সরে থাকায় সে এলাকায় হওয়া সংঘাত ও সহিংসতা থেকে দূরে ছিল এই ইঁদুরগুলো। তথাপি তারা সমাজে কোনোপ্রকার অবদান রাখতে সক্ষম হয়নি। এভাবেই ইউনিভার্স ২৫ এর সকল ইঁদুর এগিয়ে যাচ্ছিল এক অবধারিত বিলুপ্তির দিকে।
ক্যালহনের মতে, মৃত্যুদশাটি সংঘটিত হয়েছিল দুটি স্তরে: প্রথম ও দ্বিতীয় মৃত্যুস্তর।
প্রথমস্তরের মৃত্যু
এটিকে প্রকৃতপক্ষে আত্মিক মৃত্যু বলে অভিহিত করা যায়। এক্ষেত্রে শুধু শারীরিক অস্তিত্ব বাদে জীবনের কোনো মানেই থাকে না, বেঁচে থাকাটাই অর্থহীন হয়ে যায় এই ইঁদুরদের ক্ষেত্রে। কেননা তাদের ছিল না কোনো প্রজননেচ্ছা, সন্তান পালন কিংবা সমাজে কোনো দায়িত্ব পালনে আগ্রহ। এই আত্মিক মৃত্যু বলতে ‘সুন্দর ইঁদুর’গুলোর উদ্যমহীন ও নিস্পৃহ জীবনযাপনকেই বোঝানো হয়েছে।
দ্বিতীয় স্তরের মৃত্যু
এই মৃত্যু সত্যিকারের জীবনাবসান ও দেহান্তরকেই নির্দেশ করে এবং এর মাধ্যমে আনীত ইউনিভার্স ২৫ এর বিলুপ্তিকেও।
ইউনিভার্স ২৫ এর অস্তমিত সূর্য ও ক্যালহনের অভিমত
‘সুদর্শন ইঁদুর’গুলোর উপর পর্যবেক্ষণ করার পর ক্যালহন মতামত দেন যে, মানুষের মতো ইঁদুররাও পৃথিবীর বুকে পরিচয় ও উদ্দেশ্য সাপেক্ষে বেড়ে ওঠে। তিনি বলেন দুশ্চিন্তা, অবসাদ, চাপ, উদ্বিগ্নতা এবং টিকে থাকার প্রয়োজনীয়তার মতো অভিজ্ঞতার প্রভাবই মানুষকে সামাজিকভাবে জড়িয়ে পড়তে সাহায্য করেছে। যখন সকল চাহিদাই পূর্ণ হয়ে যায় এবং কোনো দ্বন্দ্ব থাকে না, বেঁচে থাকার মানে তখন খাওয়া ও ঘুমের মতো একেবারেই মৌলিক শারীরিক চাহিদায় এসে আটকে যায়।
ক্যালহনের দৃষ্টিভঙ্গিতে, কাজ কিংবা দ্বন্দ্ব ব্যতীত জীবনের গতিপথ এমনই পরষ্পরবিরোধী তত্ত্বের ওপর অধিষ্ঠিত। যখন মানুষের অনুভূতি থেকে সকল জিনিসের প্রয়োজনীয়তাই হারিয়ে যায়, জীবনে এগিয়ে যাবার কোনো উদ্দেশ্য থাকে না। ফলত জীবন স্থবির হয়ে যায়। যার ফলাফল ব্যক্তির আত্মিক মৃত্যু।
ইউনিভার্স ২৫ এই ঘটনাপ্রবাহ এদিকেই গড়িয়েছিল। ধীরে ধীরে, যে সকল ইঁদুরগুলো প্রজনন ও সামাজিক কাজে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিল দিন দিন তাদের সংখ্যাই বাড়তে লাগল। আর সামাজিক তথা নানা দলের অন্তর্ভুক্ত, স্বজাতি-ভোজী, ধর্ষিত ও লুণ্ঠিত ইঁদুরের সংখ্যা কমতে থাকলো। ইউনিভার্স ২৫ এর অন্তিম গর্ভধারণ হয়েছিল এর ৯২০তম দিনে, যা নির্দেশ করে তার জনসংখ্যা আটকে গিয়েছিক মোট ২,২০০ জনে। অথচ পুরো ইউনিভার্স ২৫ এর সর্বমোট ধারণক্ষমতা ছিল ৩,০০০ জনের, যেখানে অফুরান যোগান ছিল খাদ্য, পানীয় এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় উৎসের।যেদিন থেকে এখানে আচরণগত অবক্ষয়ের সূচনা সেদিন থেকেই ইউনিভার্স ২৫ এগিয়ে গেছে এক অবধারিত স্বনির্মিত ধ্বংসের দিকে। খুব দ্রুতই তাই দেখা গেল, ইউনিভার্স ২৫ এর আবদ্ধ অঞ্চলে আর একটিও জীবিত ইঁদুর অবশিষ্ট নেই।
উদ্ধারপ্রচেষ্টা এবং আরেকটি শেষের শুরু
ইঁদুর বিশ্বটি পুরোপুরি ধ্বংসের পূর্বে ক্যালহন কিছু ‘সুদর্শন ইঁদুর’কে ইউনিভার্স ২৫ থেকে সরিয়ে নেন। তার উদ্দেশ্য ছিল এটি পর্যবেক্ষণ করে দেখা যে, তাদেরকে যদি নতুন সমাজে অবমুক্ত করা হয় যেখানে কোনো সামাজিক বিবাদ ও হত্যাকাণ্ড নেই, তাহলে তারা ফলপ্রসূ ও অর্থপূর্ণ জীবনযাপন করবে কিনা। নতুন একটি ব্যবস্থাপনায় বাস করা কিছু সংখ্যক ইঁদুরের সাথে ইউনিভার্স ২৫ থেকে আগত ইঁদুরগুলোকে রাখা হলে তারা ইউনিভার্স ২৫ এর আদি ইঁদুরজোড়গুলোর মতোই আচরণ করতে থাকে। ক্যালহন আশা করেছিলেন হয়তো নতুন পরিবেশ ও সমাজে এসে এই ‘সুন্দর ইঁদুর’ এর দল তাদের অসামাজিকতা থেকে মুক্ত হয়ে প্রজননের মাধ্যমে জনসংখ্যায় ভূমিকা রাখবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, সকল পুনর্বাসিত ইঁদুরের দলের আচরণগত প্রকৃতিতে সামান্যতম পরিবর্তনও দেখায়নি। সঙ্গমে লিপ্ত হওয়া দূরে থাক, তারা তাদের নতুন প্রতিবেশীদের সাথে সামান্য ভাবের আদানপ্রদানেও যায় নি। ফলে এই সামাজিকভাবে নিষ্ক্রিয় ইঁদুরের দল একসময় প্রাকৃতিকভাবে মারা যায় এবং এই অপরিপক্ব মানসিকতার সদস্যদের সমাজব্যবস্থাটি কোনো নতুন প্রাণের দেখা না পেয়েই গুটিয়ে যায়।
ইউনিভার্স ২৫ এর পরীক্ষালব্ধ ফলাফল ও সিদ্ধান্ত
ক্যালহনের দৃষ্টিভঙ্গিতে, ইউনিভার্স ২৫ এর উত্থান ও পতন ইঁদুর সম্পর্কে নিম্নলিখিত মৌলিক তথ্য দেয়:
১) ইঁদুর খুব সাধারণ প্রাণী হলেও এদের প্রণয়, শিশু লালন-পালন, বাসস্থানের সুরক্ষা এবং পারিবারিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে অবদান রাখার জন্য কিছু দক্ষতামূলক বৈশিষ্ট্যের প্রয়োজন। তারা যদি এই দক্ষতা বা যোগ্যতাগুলো অর্জন না করতে পারে তাহলে কোনো ইঁদুরই প্রজনন কিংবা সামাজিক কর্তব্য পালনে ভূমিকা রাখতে পারবে না।
২) ইঁদুরের ক্ষেত্রে তাই সকল প্রজাতি বুড়িয়ে যাবে এবং ধীরে ধীরে মৃত্যুবরণ করবে। এমন কোনো তথ্য তাদের হাতে নেই যা নিরঙ্কুশভাবে প্রমাণ করে দিতে পারে যে- মানবসমাজেও ইউনিভার্স ২৫ এর ন্যায় ঘটনাপ্রবাহ ও ধ্বংস ধেয়ে আসবে না।
৩) যদি যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষের সংখ্যা সমাজের ধারণক্ষমতার অপ্রতিরোধ্যভাবে সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও বিচ্ছিন্নতাদেখা দেবে। এই বিচ্ছিন্ন সমাজে বেড়ে ওঠা মানুষগুলির বাস্তবিক জগত্ এর সাথে কোনো সম্পর্ক থাকবে না। শারীরবৃত্তীয় চাহিদা পূরণ ও তৃপ্তিই তাদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াবে।
৪) ইঁদুর যেমন নানান জটিল আচরণের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠে, তেমনি সমাজে গড়ে ওঠা মানুষের জন্য মানুষের সহমর্মিতা ও পারষ্পরিক বোঝাবুঝি প্রজাতি হিসেবে মানুষের টিকে থাকার জন্য বাঞ্ছনীয়। মানব সভ্যতায় এগুলোর অনুপস্থিতি বাজিয়ে তোলে ধ্বংসের দামামা।
ক্যালহনের ইউনিভার্স ২৫ এর পরীক্ষণ-পরবর্তী কাজসমূহ
১৯৭৩ সালে ক্যালহন তার পর্যবেক্ষণলব্ধ ফলাফলগুলিকে ‘ডেথ স্কয়্যারড: দ্য এক্সপ্লোসিভ গ্রোথ এন্ড ডেমিজ অফ আ মাউস’ শীর্ষক নিবন্ধে উপস্থাপন করেন। তার সেই নিবন্ধটি ছিল অনেকটা কঠোর কেতাবি চালের। কেননা তিনি কোনো কথায় জোর দিতে হলে তা ইটালিক করে দিতেন, যেমন: “to kill with the sword and with famine and with pestilence and by wild beasts.” এমনকি তার আবিষ্কারগুলোকে তিনি বিচিত্র চিত্তাকর্ষক নাম দিতেন। তার কয়েকটি নমুনা হলো:
- প্রজনন ভুলে যাওয়া ইঁদুর- সুন্দর/সুদর্শন ইঁদুর (beautiful ones)
- পানির বোতলের আশপাশে ভিড় জমানো ইঁদুরের দল- সামাজিক পানকারী (social drinkers)
- পুরো সামাজিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়া- আচরণগত অবক্ষয় (behavioral sink)
অন্যভাবে বলা যায়, এটা ঠিক সেই ধরনের রচনা, যা আপনি ইঁদুরের এ ধ্বংসপুরী তৈরির কাজকে সারাজীবন ধরে নিঁখুতভাবে চালিয়ে যাওয়া একজনের থেকে আশা করতেই পারেন।
ইঁদুর ও মানবসমাজের যে ঐকতান তিনি খুঁজে পেয়েছেন, তা সবচেয়ে আশঙ্কাজনক। তার ভাষ্যমতে, “আমি সিংহভাগ ক্ষেত্রে ইঁদুরের কথাই বলব, কিন্তু আমার চিন্তাভাবনা মানুষ নিয়ে।” দু’ধরনের প্রজাতিরই দু’ধরনের মৃত্যু হতে পারে- আত্মিক ও শারীরিক। যদিও ক্যালহন শারীরিক হুমকিসমূহ ইউনিভার্স ২৫ থেকে নির্মূল করেছিলেন তবুও শেষরক্ষা হয়নি। কেননা, আত্মিকভাবে অস্বাস্থ্যকর হয়ে পড়েছিল ইউনিভার্স ২৫ এর পরিবেশ, যা পরিপূর্ণ ছিল অতিরিক্ত জনসংখ্যা, অতি-উদ্দীপনা এবং অপরিচিত ইঁদুরের সাথে যোগাযোগ হওয়ায়। পরিচিত ঠেকছে? ঠিক যেন অনেকটা শহুরে সমাজব্যবস্থার মতোই, যা দিনকে দিন আরো জনবহুল হয়ে চলেছে।
সিনেটরগণ নানান সভায় এটি উত্থাপন করেন। এমনকি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী ও কমিক বইগুলোতেও এটি স্থান পায়। এমনকি খ্যাতিমান লেখক টম উলফেও নিউইয়র্ক সিটির বর্ণনা দিতে গিয়ে ক্যালহনের প্রচলনকৃত শব্দসমূহ ব্যবহার করেন।
ক্যালহনের মনে হয় তিনি একটি সমস্যা ধরতে পেরেছেন, তাই তিনি দ্রুততার সাথে তার ইঁদুরের মডেলগুলো নিয়ে কাজ শুরু করেন এবং তা সমাধানের চেষ্টা করেন। তার মতে, যদি মানুষ ও ইঁদুরকে যথেষ্ট পরিমাণে ফাঁকা স্থানে না রাখা হয় তথা সংকীর্ণ স্থানে রাখা হয় হয়তো তারা আত্মিক ও মানসিক সংকীর্ণতা কাটিয়ে ওঠে- সৃজনশীলতা, শিল্পদক্ষতায় মেতে উঠবে এবং সাম্যতাবিহীন সমাজ সৃষ্টি হবে না। তার পরবর্তী ‘ব্রহ্মাণ্ড’গুলোর নকশা এমনভাবে করা হয়েছিল, যেন ইঁদুরের শারীরিকভাবে ঘোরাফেরা ও নড়াচড়া নিয়ন্ত্রণ করে তাদের সুখের মাত্রাকে বাড়িয়ে দেয়া যায়। এক্ষেত্রে তিনি পূর্বকৃত কাজের সময় দেখা পাওয়া কিছু ইঁদুরের থেকে কিঞ্চিৎ আশাবাদী হন, যারা সুড়ঙ্গ তৈরির এক নতুন পন্থা উদ্ভাবন করেছিল এবং সেখানে তারা ধূলো-ময়লা গুটিয়ে বলের মতো বানাতো।
তিনি এ নিয়ে সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনার পাশাপাশি মানুষের ব্যাপারেও ভেবেছেন এবং ‘পরিবেশগত নকশাকরণ’ এবং এইচ. জি. ওয়েলসের ‘বিশ্বভিত্তিক মস্তিষ্ক’ তত্ত্বের (আন্তর্জাতিক তথ্য-যোগাযোগ ব্যবস্থা যাকে আধুনিক ইন্টারনেটের পূর্বসূরীরূপে ভাবতে পারেন) সমর্থন করেন।
কিন্তু জনতা তার পূর্ববর্তী কাজ নিয়েই মেতে ছিল। রামসডেন ও এডামসের মতে, “সবাই শুধু সমস্যা নিরূপণে আগ্রহী, সমস্যার সমাধান সম্পর্কে কেউই জানতে চায় না।” তাই ধীরে ধীরে ক্যালহনের পরবর্তী কাজ নিয়ে মানুষের আগ্রহ, মনোযোগ, লেগে থাকার উত্সাহ হারিয়ে যায় এবং ক্যালহনের অর্থনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতাও বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৮৬ সালে তাকে জোরপূর্বক ‘ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ মেন্টাল হেলথ’ থেকে অবসরে পাঠানো হয়। নয় বছর পর তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে যান।
ক্যালহনের কাজের ওপর ভিত্তি করে অনেক বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী যেমন- ‘সয়লেন্ট গ্রীন’, ‘২০০০এডি’ এর মতো কমিক তৈরি করা হয়। এছাড়াও ‘মিসেস ফ্রিসবি এন্ড দ্য র্যাটস অফ এনআইএমএইচ’ নামক শিশুতোষ বইও ক্যালহনের কাজের ওপর ভিত্তি করেই তৈরি।
বিতর্ক ও নির্ভরযোগ্যতা
ক্যালহনের পরীক্ষণ অসংখ্য সম্ভাব্যতা ও বিতর্কের ঝড় তুললেও বর্তমানে একে আগের মতো অর্থে দেখা হয় না। ইংগলিস-আর্কেলের মতে যে আবাসস্থল ইঁদুরের জন্য তৈরি করা হয়েছিল তা আসলে অধিক জনসংখ্যাপূর্ণ ছিল না বরং তাদের মধ্যবর্তী দূরত্বের কারণে উগ্রপন্থী ইঁদুরের দল স্থান দখল করা শুরু করে এবং তার ফলে ‘সুন্দর ইঁদুর’গুলো হয়ে পড়ে বিচ্ছিন্ন। তিনি লেখেন, “জনসংখ্যা সমস্যার পরিবর্তে অনেকে এ তর্ক করতেই পারেন যে আসলে ইউনিভার্স ২৫ এ সুষমবন্টন-সমস্যা ছিল।”
এছাড়াও আমরা এটা ভেবে স্বস্তি পেতেই পারি যে, মানুষ ইঁদুর নয়। চিকিৎসাবিজ্ঞান সম্পর্কিত ইতিহাসবিদ এডমুন্ড রামসডেনের মতে, “ইঁদুর অধিক জনসংখ্যার ফলে ওভাবে ভুগতে পারে কিন্তু মানুষ পারে তা মানিয়ে নিতে। ক্যালহনের পরীক্ষাটি শুধু প্রশ্নবিদ্ধই ছিল না, তা বিপজ্জনক হিসেবেও দেখা হতো”। জোনাথন ফ্রিডম্যান নামক এক গবেষক সত্যিকার অর্থে মানুষের ওপর পর্যবেক্ষণ করেন। তারা সকলেই ছিল হাই স্কুল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তার গবেষণার ফলাফল এক ভিন্ন আঙ্গিকের অর্থই নির্দেশ করে। রামসডেনের মতে, “মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘনবসতি থেকে হয় না বরং অতিমাত্রার সামাজিক যোগাযোগ ও ভাবের আদানপ্রদান”। বলা হয় ইঁদুরগুলো অতিরিক্ত সামাজিক যোগাযোগের ভার না নিতে পারলেও মানুষ তা ঠিকই নিয়ন্ত্রণে সক্ষম। “ক্যালহনের সব ইঁদুরই উচ্ছন্নে যায়নি বরং যারা নিয়ন্ত্রিতভাবে নির্দিষ্ট স্থানে বসবাস করেছে তারা অপেক্ষাকৃত স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পেরেছে।”
ক্যালহনের কাজ আমাদের অনেক প্রশ্নেরই উত্তর দিতে পারেনি। কিন্তু একটিমাত্র কিংবা একগুচ্ছ একই ধাঁচের পর্যবেক্ষণ কোনো নিশ্চিত ফলাফল দিতে পারে না বলেই ধারণা করা হয়।
ইউনিভার্স ২৫ অতিরিক্ত জনসংখ্যার কুপ্রভাব সম্পর্কে আমাদের অবহিত করে, জানায় কী করে আচরণগত অবক্ষয়ের দরুণ সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। যদি সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা ও আগ্রহ পাওয়া যেতো, হয়তো ক্যালহন এ সমস্যার সমাধান পেতেও পারতেন। এখন সত্যিই ইঁদুর সমাজের এই ছোট্ট-কাব্য মানুষের ভবিষ্যতেরই অবিকল প্রতিরূপ কিনা তা নিয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে, তবে অতিরিক্ত জনসংখ্যাস্ফীতি এবং মানুষে মানুষে মানসিক দূরত্ব ও পারষ্পরিক বোঝাপড়ার অভাব যে হিতকর কিছু বয়ে আনবে না, তা নিশ্চিত হয়েই বলা যায়।
ফিচার ছবিসূত্র: atlasobscura.com