ভারতের আসাম রাজ্যের ডিমা হ্যাসাও জেলার পার্বত্য উপত্যকায় অবস্থিত এক গ্রাম জাতিঙ্গা। প্রায় ২,৫০০ আদিবাসী মানুষের বসবাস আর অপার সৌন্দর্য ও মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক পরিবেশে সমাহার এই গ্রামকে করেছে প্রশংসনীয়। কিন্তু এই সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ গ্রামেই ঘটে এক রহস্যময় কাণ্ড। প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট সময়ে এখানে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি আসে। কিন্তু খাবারের সন্ধানে কিংবা বাসা তৈরীর জন্য নয়। তারা এখানে আসে আত্মহত্যা করতে, অন্তত সেটি আত্মহত্যা কিনা তা এখনি বলা সম্ভব নয়। তবে ধরে নেয়া হয় যে তারা আত্মহত্যা করতে আসে এখানে। আর একারণেই এই গ্রামের নাম হয়েছে পাখিদের ‘ভ্যালি অফ ডেথ’ বা মৃত্যু উপত্যকা। ব্যাপারটা কি রহস্যময় নয়?
মানুষের মধ্যে আত্মহত্যা করার প্রবণতা সম্পর্কে আমরা যথেষ্ট অবগত। কোনো কারণে চরমভাবে হতাশ হলে বা কষ্টে থাকলে মানুষের মধ্যে আত্মহত্যা করার প্রবণতা দেখা যায়। কিন্তু মানুষের বাইরে যদি আমরা চিন্তা করি অর্থাৎ পশুপাখির কথা যদি আমরা বলি তাহলে দেখা যায় যে তাদের মস্তিষ্ক এতটাও উন্নত নয় যে তারা আত্মহত্যা করতে পারে।
এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম আছে অবশ্যই। যেমন নিউফাউন্ডল্যান্ড কুকুরের মধ্যে এরকম আত্মহত্যা করার প্রবণতা আছে। এরা পানিতে লাফিয়ে পড়ে এবং না সাঁতরে হাত-পা অচল রাখার চেষ্টা করে। তাদের উদ্ধার করা হলেও তারা পরবর্তীতে আবার একই কাজের পুনরাবৃত্তি করে। এরকম গরু, মহিষ কিংবা হরিণের ক্ষেত্রেও হতে পারে, তবে এদের সংখ্যা নিতান্তই নগণ্য। আত্মহত্যা করার প্রবণতার তালিকায় আরেক আছে ডলফিন।
কিন্তু মুশকিল হচ্ছে পাখিদের ক্ষেত্রে এটি কখনো হয় না। অর্থাৎ, গবেষকগণ বলছেন যে পাখিদের মস্তিষ্কে আত্মহত্যা করার মতো কোনো পরিকল্পনা থাকার কথা না। তাহলে বিষয়টা একটা রহস্য হয়ে দাঁড়ায় যে কি কারণে জাতিঙ্গাতে পাখিরা এভাবে ঝাঁকে ঝাঁকে মৃত্যুবরণ করে অর্থাৎ আত্মহনন করে?
আসলে এটি একটি রহস্যই বটে। কারণ এ বিষয়টা প্রাকৃতিক এবং এর সঠিক ব্যাখ্যা দেয়া এখনো সম্ভব হয় নি। প্রতিবছর একটি বিশেষ সময়ে অতিথি পাখিদের সাথে সাথে স্থানীয় পাখিরা এই আত্মহননের ঘটনা ঘটিয়ে থাকে। কিছু নির্দিষ্ট কারণ এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, যেমন কুয়াশা, ধোয়াশা কিংবা মেঘের কারণে এমনটা হতে পারে। বর্ষা মৌসুমের মাঝামাঝি থেকে শেষ দিকে অর্থাৎ সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বরের মধ্যবর্তী সময়ে এবং সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১০টার মধ্যে এই ঘটনা ঘটনা ঘটে থাকে।
অথচ অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, এই সময়টায় পাখিগুলোর নীড়ে ফিরে বিশ্রাম নেয়ার কথা। আবার পুরো জাতিঙ্গা জুড়েই যে পাখিদের এরকম আত্মহননের ঘটনা দেখা যায় এমন না। এটি গবেষণা দ্বারা প্রতিষ্ঠিত যে পুরো জাতিঙ্গা পাখিদের এরূপ আচরণের জন্য আকৃষ্ট করেনা। উপত্যকার দেড় কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ও ২০০ মিটার প্রস্থের সুনির্দিষ্ট স্ট্রাইপে এই ঘটনা ঘটে।
স্থানীয় আদিবাসী মানুষের প্রাচীন ধারণা অনুযায়ী এই ঘটনার পেছনে আছে অদৃশ্য প্রেতাত্মাদের হাত। এই সময়টায় তারা আকাশে উড়ে বেড়ায় এবং যেসব পাখি প্রজাতি এসকল প্রেতাত্মাদের বিরোধীতা করে সেসব প্রজাতিকে প্রেতাত্মারা মাটিতে ছুড়ে ফেলে। কিন্তু বিজ্ঞানের এই যুগে এই বিশ্বাস নিয়ে আসলে গবেষণা করাতো সম্ভব না। চাই বিজ্ঞানভিত্তিক তত্ত্ব ও ফলাফল।
তো বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা শুরু করলেন বিজ্ঞানী ও গবেষকগণ। বিশেষ করে পাখি বিশেষজ্ঞগণ এক্ষেত্রে অনেক গবেষণা চালিয়েছেন পাখিদের এই অস্বাভাবিক আত্মহত্যা প্রবণতার কারণ খুঁজতে। তারা দেখলেন, কতিপয় স্থানীয় প্রজাতির পাখি যেমন মাছরাঙা কিংবা কোঁচ বক সাধারণত এই ধরনের আচরণ প্রদর্শন করে। পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা দ্বারা দেখা যায় যে, বর্ষার শেষাংশে আসামের এই অঞ্চলের জলাশয়গুলো বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়। তখন এই পাখিগুলো তাদের প্রাকৃতিক আবাসস্থল হারায়। ফলে তাদের অন্য এলাকায় বসবাসের উদ্দেশ্যে অতিথি পাখি হিসেবে পাড়ি জমাতে হয়।
জাতিঙ্গা গ্রামটি তাদের এই অভিবাসন পথের মাঝখানে পড়ে। ১৯৮৮ সালের দিকে আসামে বেশ কয়েকবার বন্যা হয়েছিলো। তখন পাখিদের এই আত্মহত্যার খবর পাওয়া গিয়েছিলো সবথেকে বেশি। যদিও কিছু পাখি যারা অনেক দূরে অভিবাসিত হয় তাদের ক্ষেত্রে এই আত্মহত্যা প্রবণতা দেখা যায়নি। যে পাখিগুলো আত্মহত্যা করে সেগুলো নিকটবর্তী উপত্যকা কিংবা পাহাড়ের ঢালে বসবাসকারী পাখি যারা ক্ষুদ্র দূরত্বের এলাকায় অভিবাসিত হয়।
জাতিঙ্গাতে পাখিদের এই আত্মহত্যার প্রবণতা আবিষ্কৃত হয়েছে অনেক বছর আগে। এই ঘটনা গ্রামবাসী সর্বপ্রথম প্রত্যক্ষ করে ১৯০৫ সালে। গ্রামবাসীরা সবাই মিলে তখন একটি মহিষের খোঁজ করছিলো যেটাকে বাঘে ধরে নিয়ে যায়। তো মহিষকে খুঁজতে গিয়ে গ্রামবাসী আবিষ্কার করে যে আগুনের মশালগুলোর কারণে পাখিগুলো এক অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করে দিয়েছে।
এরপর আস্তে আস্তে মানুষের ব্যবহৃত আলোক উৎস আগুনের মশাল থেকে বৈদ্যুতিক বাতি এবং কতিপয় প্রাকৃতিক অবস্থার সমন্বয়ের কারণে পাখিদের এই আত্মহত্যার পুনরাবৃত্তি ঘটতে দেখা যায়। প্রতিবছর এই বিশেষ সময়েই এমনটা ঘটে। যদিও এখন আত্মহত্যা করতে আসা পাখিদের সংখ্যা কিছুটা কমে গেছে। কিন্তু গবেষকগণের গবেষণামতে প্রায় ৪৪ প্রজাতির পাখি এই আত্মহনন ক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে।
তারা চাঁদবিহীন রাতে সেই নির্দিষ্ট সময়ে অর্থাৎ সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১০টার মধ্যে আকাশে ইতস্তত উড়তে থাকে। আলোক উৎস যেমন আগুনের মশাল কিংবা ওয়াচ টাওয়ারের ফ্লাড লাইটের আলো দেখে এরা বিক্ষিপ্ত আচরণ শুরু করে। তাদের দেখে মনে হয় যে, তারা মাতালদের মতো টলছে এবং এরা তখন আলোক মশালের ঝলকানিতে এতটাই বিক্ষিপ্ত থাকে যে, এরা ঝাঁকে ঝাঁকে আছড়ে পড়তে থাকে মাটিতে কিংবা সজোরে আঘাত করতে থাকে গাছের সাথে। অনেকটা হিপনোসিসগ্রস্ত দেখা যায় এদেরকে।
তবে গ্রামবাসীদের কারণে এদের মৃত্যুটা আরো একটু বেশি হয়, কারণ যখন পাখিগুলো আলোক উৎসের উপরে ঘুরতে থাকে তখন গ্রামবাসী বাঁশের লাঠি দ্বারা এদের আঘাত করে, ফলে এসব সম্মোহিত পাখি বাঁশের আঘাতে ভূপাতিত হয় বেশি। গ্রামবাসী মনে করে যে, এটি তাদের জন্য ভালো। কারণ তাদের ধারণা এই পাখিগুলো প্রেতাত্মাদের দ্বারা কলুষিত। তাই তাদের মেরে ফেলা উচিৎ। যদিও দিবাকালীন পাখিদের ক্ষেত্রে এই ধরনের কোনো সমস্যা বা প্রবণতা নেই। কারণ তারা সন্ধ্যা হওয়ার আগেই ফিরে আসে এবং রাতের আঁধারে কোনো বিক্ষিপ্ত আচরণ করে না।
স্থানীয় গ্রামবাসীদের এই ধারণাকে বিজ্ঞান স্বীকার করবে না সেটাই স্বাভাবিক। তাই এই সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক গবেষণা কম হয় নি। বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রেক্ষিতে বলা হয় যে, পাখিদের মস্তিষ্ক আত্মহত্যা প্রবণতার জন্য উপযুক্ত না। কিন্তু কতিপয় প্রাকৃতিক কারণ এখানে ভূমিকা পালন করতে পারে। যেমন কুয়াশা বা ধোঁয়াশা কিংবা আকাশের মেঘ। সেই সাথে চাঁদবিহীন রাত এবং হালকা বৃষ্টি। যখন এর সাথে যুক্ত হয় গ্রামের আলোর উৎসগুলো তখন তৈরী হয় এক ঐন্দ্রজালিক পরিবেশের।
এই পাখিগুলোর অধিকাংশই অভিবাসিত পাখি। আগেই বলা হয়েছে যে বন্যার সময় এরা এদের বাসস্থান হারিয়ে ফেলে। তখন এরা নতুন বাসস্থানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। এখন যখন পথিমধ্যে এরা জাতিঙ্গার উপর দিয়ে যায় তখন কুয়াশা কিংবা ধোঁয়াশার কারণে এদের দিকবিভ্রম ঘটে এবং এরা বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়। এই অবস্থায় যখন এরা নিচে গ্রামে জ্বলন্ত আগুনের মশাল কিংবা বৈদ্যুতিক বাতি দেখে তখন এরা প্রাণপণে সেদিকে ছুটতে থাকে। এমনিতে অন্ধকার রাত তার উপর দিক হারিয়ে ফেলা। যখন এরা পুরোদমে ছুটে যায় আলোর দিকে তখন একদিকে গাছের সাথে এরা আঘাতপ্রাপ্ত হয়, অন্যদিকে মাটিতেও আছড়ে পড়ে এবং বেশিরভাগ পাখি মারা পড়ে।
আবার আরো এক গবেষণায় বলা হয় যে, জাতিঙ্গার অস্বাভাবিক আবহাওয়ার কারণে জলাশয়ের নিচের চৌম্বকীয় পরিবেশের সৃষ্টি হয়। এই পরিবর্তন কোনো একভাবে এই পাখিগুলোকে প্রভাবিত করে এবং এর ফলে পাখিগুলো অস্বাভাবিক আচরণ করতে শুরু করে। তবে কেবল জাতিঙ্গার ওই নির্দিষ্ট অঞ্চলেই যে পাখিদের এরূপ অস্বাভাবিক আচরণ দেখা যায় এমন নয়। এই ঘটনা আরো দেখা যায় ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া এবং ভারতের আরেক প্রদেশ মিজোরামে।
যদিও জাতিঙ্গাতে পাখিদের এই আত্মহনন (কিংবা একে আদৌ আত্মহনন বলা যায় কিনা!) ক্রিয়ার কোনো সুনির্দিষ্ট ও সঠিক তত্ত্ব পাওয়া যায় না। যেসব তত্ত্ব পাওয়া গিয়েছে সেসবও যে যথেষ্ট না সেকথা গবেষকগন বলে দিয়েছেন। কিন্তু পাখিদের এই বিশেষ মনস্তত্ত্ব বোঝার জন্য প্রয়োজন আরো বিস্তৃত গবেষণার।