১৯৭৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের কেপ কেনাভারাল এয়ার ফোর্স স্টেশন থেকে উৎক্ষেপণ করা হলো একটি রকেট, যার মধ্যে সুরক্ষিত রয়েছে একটি স্পেস প্রোব; নাম- ভয়েজার ১।
পৃথিবীর আকর্ষণ শক্তিকে উপেক্ষা করে ছুটে যেতে থাকে Titan IIIE নামের রকেটটি, যার ভেতর রয়েছে মানব ইতিহাসে নতুন অধ্যায় রচনা করার সেই বস্তু। একটি নির্দিষ্ট সময় পর রকেটের ভেতর থেকে মহাশূন্যে বেরিয়ে আসে ভয়েজার ১। এরপরই গন্তব্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে অসীম এই মহাকাশের বুকে। মূলত স্পেস প্রোব হচ্ছে কম্পিউটার চালিত মহাকাশযান, যা সৌরজগতের গ্রহ-উপগ্রহ পর্যবেক্ষণের জন্য পাঠানো হয়।
মূল মিশন
এই মিশনের উদ্দেশ্য ছিল আমাদের সৌরজগতের বৃহৎ দুই গ্রহ— বৃহস্পতি, এবং শনি সম্পর্কে আরো তথ্য জোগাড় করা। এছাড়া বৃহস্পতির চাঁদ টাইটানের আবহাওয়া, ম্যাগনেটিক ফিল্ড, এবং অন্যান্য উপগ্রহগুলো পরীক্ষা করাও ছিল এই মিশনের অংশ।
৫ই মার্চ ১৯৭৯ সালে এটি গ্যাস দানব বৃহস্পতির সবচেয়ে কাছে চলে যায়। বৃহস্পতির বায়ুমণ্ডলে যে রিং সিস্টেম রয়েছে, তা আমরা এই মিশন থেকে পাঠানো ছবি থেকে প্রথম জানতে পারি। এছাড়া বৃহস্পতি গ্রহে প্রায় ৩৫০ বছর ধরে ঘটে চলা ঘূর্ণিঝড় ‘গ্রেট রেড স্পট’-এর ছবি এবং ছোট ভিডিও সংস্করণ তুলে পাঠায় ভয়েজার। ঝড়টি এতই বড় যে, এতে অনায়াসে পৃথিবীর মতো গ্রহ ঢুকিয়ে রাখা যাবে। ভয়েজার ১ কেবল বৃহস্পতিরই প্রায় ১৯ হাজার ছবি তুলে পৃথিবীতে প্রেরণ করে।
এই মিশন আরো জানায়- বৃহস্পতির চাঁদ আইও-তে রয়েছে জীবন্ত আগ্নেয়গিরি, যার লাভা উদগীরণ ঘটে প্রায় ১৬০ কিলোমিটার পর্যন্ত ওঠে। এছাড়া ইউরোপা ও গ্যানিমেড পর্যবেক্ষণে জানা যায়, এদের পুরু সারফেসের নিচে রয়েছে তরল সমুদ্র। এটি বিভিন্ন উপগ্রহের ছবিও পাঠায়।
১২ নভেম্বর ১৯৮০ সালে এটি শনিগ্রহের কাছে পৌঁছে যায়। এরপর শনির রিং বা বলয়ের হাই রেজুলেশন ছবি পৃথিবীতে পাঠাতে থাকে।
ভয়েজার শনির উপগ্রহ টাইটানের বহু ছবি তোলে এবং এর আবহাওয়া নিয়েও পরীক্ষা করে। টাইটান আকারে আমাদের সৌরজগতের দ্বিতীয় বৃহত্তম উপগ্রহ, আবার সৌরজগতের একমাত্র ঘন বায়ুমণ্ডলবিশিষ্ট উপগ্রহ। এর বায়ুমণ্ডল মূলত নাইট্রোজেন দিয়ে তৈরি। ঘন বায়ুমণ্ডলের কারণে তাই এর সারফেস পর্যবেক্ষণ করা খুবই কষ্টসাধ্য। তবে এর নিচে মিথেনের নদী থাকতে পরে বলে ধারণা হয়।
এরপর ভয়েজার ১ শনি গ্রহের আকর্ষণ শক্তিকে কাজে লাগিয়ে সৌরজগত অতিক্রম করার মতো গতিশক্তি লাভ করে। অবশেষে ২০১২ সালের আগস্ট মাসে এটি আমাদের সৌরজগত অতিক্রম করে ইন্টারস্টেলার স্পেসে প্রবেশ করে। ইন্টারস্টেলার স্পেস হচ্ছে দুটি তারার মধ্যবর্তী দূরত্ব যেখানে কোনো গ্রহ-উপগ্রহ বা অন্যান্য অনেক কিছুর অস্তিত্ব নেই। এর প্রায় ৯০-৯৫ শতাংশই অন্ধকার।
যোগাযোগ ব্যবস্থা
ভয়েজার ১ তৈরির সময় যে প্রযুক্তি ছিল তার সর্বোচ্চ দিয়েই এটি তৈরি করা হয়েছিল। এতে রয়েছে ১২ ফুট ব্যাসের একটি এন্টেনা। এছাড়া আছে একটি রেকর্ড, যা সর্বোচ্চ ৬৭ মেগাবাইট তথ্য ধারণ করতে পারে। ব্যাপারটি আমাদের কাছে বর্তমানে কিঞ্চিৎ মনে হলেও আদতে এটি অনেক বেশি গুরুত্ব বহন করে। ভয়েজার ১ প্রাপ্ত তথ্য এই অল্প জায়গাতেই জমা করে রাখে এবং পরে তা পৃথিবীতে পাঠায়। এর ক্যামেরা ও অন্যান্য কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করছে এর মধ্যে থাকা একটি ডিজিটাল কম্পিউটার। মূলত এর সমস্ত কাজ করা এবং একে নিয়ন্ত্রণ করার সকল নির্দেশনা এই কম্পিউটারে আগে থেকেই প্রোগ্রাম করে রাখা হয়েছে। এছাড়া এতে রয়েছে অতিবেগুনি রশ্মি, কসমিক রশ্মি ও প্লাজমা তরঙ্গ মাপার যন্ত্রসহ আরো অনেক উপকরণ। এটি প্রায় ৬৫,০০০ আলাদা আলাদা যন্ত্রের সমন্বয়ে গঠিত।
এর সিগনাল পৃথিবীতে আসতে প্রায় ২০ ঘণ্টা সময় লাগে। এই তথ্য গ্রহণ করতে বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বসিয়েছেন কিছু রাডার। এসব রাডার থেকে ২০ কিলোওয়াট ক্ষমতার রেডিও সিগন্যাল পাঠানো হয় ভয়েজার ১ এর দিকে এবং তা ২০ ঘণ্টা পর ভয়েজার ১ এর কাছে পৌঁছায়। ভয়েজার ১ এই সিগন্যাল পাওয়ার পর ফিরতি আরো একটি সিগন্যাল পৃথিবীর দিকে পাঠায়। কিন্তু তা পৃথিবীতে আসতে আসতে এতটা দুর্বল হয়ে পরে যে তা ডিটেক্ট করা খুবই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। তাই নাসার বিজ্ঞানীরা ডিপ স্পেস নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে সেই ফ্রিকোয়েন্সি সঠিকভাবে ডিকোড করতে পারেন।
দীর্ঘ ৪৪ (নভেম্বর-২০২১ অনুসারে) বছরের যাত্রায় ভয়েজার ১ এর অনেক যন্ত্রাংশই পুরনো হয়ে গিয়েছে। তাই বিজ্ঞানীরা এর কিছু যন্ত্রাংশ বন্ধ করে দিয়েছেন। যেহেতু বর্তমানে এটি অন্ধকার জগতে, তাই এর ক্যামেরা বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে একে গরম রাখার জন্য এর কিছু কিছু যন্ত্রাংশ চালু রাখা হয়েছে। এর চারটি কম্পোনেন্ট এখনো চালু রাখা আছে যা ম্যাগনেটিক ফিল্ড ও সোলার উইন্ড পরীক্ষার কাজে ব্যবহৃত হয়।
ভয়েজার ১ আমাদের সৌরমণ্ডল অতিক্রম করার কয়েক মুহূর্ত আগে নিজের ক্যামেরাটি আমাদের পৃথিবীর দিকে ঘুরিয়ে নেয়। এরপর এটি আমাদের পৃথিবীর একটি ছবি তুলে পাঠায়। পাঠক, আপনারা নিচের ছবিতে যে ছোট বিন্দু দেখতে পাচ্ছেন, তা-ই হচ্ছে আমাদের এই নীল গ্রহ পৃথিবী।
ছবির এই বিন্দুকে বলা হয়— পেইল ব্লু ডট। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়- এই বিশাল মহাবিশ্বে আমাদের অবস্থান কতটাই না ক্ষুদ্র। ছবিটি ১৯৯০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি পৃথিবী থেকে প্রায় ৬০০ কোটি কিলোমিটার দূরে তোলা হয়। এরপর ভয়েজার ১ আমাদের সৌরজগতের সীমানা অতিক্রম করে প্রবেশ করে ইন্টারস্টেলার স্পেসে।
ভয়েজার ১ এর ভবিষ্যৎ
আনুমানিক আগামী ৩০০ বছরের মধ্যে ভয়েজার ১ ওর্ট ক্লাউডে (Oort Cloud) প্রবেশ করবে। ওর্ট ক্লাউড অতিক্রম করতে প্রায় ৩,০০০ বছর লাগবে। এই ওর্ট ক্লাউড হচ্ছে সূর্যের চারদিক থেকে প্রায় এক লক্ষ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিট দূরে অবস্থান করা ধূমকেতু এবং গ্রহাণুপুঞ্জের বেষ্টনী। উল্লেখ্য, অ্যাস্ট্রোনোমিকাল ইউনিট হলো পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্বের সমান পথ, যা প্রায় ১৫ কোটি কিলোমিটার। সেকেন্ডে প্রায় ১৭ কিলোমিটার বেগে এটি মহাকাশে ছুটে চলেছে। এই ওয়েবসাইটে গিয়ে আপনি চাইলে দেখে আসতে পারেন ভয়েজার ১ এর রিয়েল টাইম জার্নি সম্পর্কে।
নাসার বিজ্ঞানীদের মতে, ভয়েজার ১ তার নিজস্ব গতিতেই এগিয়ে যাবে। আর মহাকাশের কোনো বস্তুর সঙ্গে এর আঘাত লাগার সম্ভাবনা নেই। কারণ এটি নিজে থেকেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করছে। ভয়েজার ১-কে শক্তি সরবরাহে ব্যবহৃত হয়েছে প্লুটোনিয়াম। তবে এর শক্তি ক্রমশ কমে আসছে। তাই শীঘ্রই এর সাথে আমাদের যোগাযোগ শেষ হতে চলেছে। এটি বড়জোর ২০২৫ সাল পর্যন্ত এর ন্যূনতম ১টি যন্ত্র সচল রাখতে পারবে।
গোল্ডেন রেকর্ড
দুটো ভয়েজার মহাকাশযানের সাথেই রয়েছে একটি গোল্ডেন রেকর্ড। এই গোল্ডেন রেকর্ড হলো স্বর্ণের প্রলেপ দেয়া তামার তৈরি ডিস্ক, যাতে আমাদের পৃথিবীর বিভিন্ন তথ্য রেকর্ড করে দেয়া হয়েছে।
এই ডিস্কে বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রাণীর শব্দসহ অন্যান্য শব্দ, গান, পৃথিবীর ৫৪টি ভাষার সম্ভাষণ এবং বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক তথ্য রেকর্ড করে দিয়েছেন। এতে বাংলা ভাষায় রেকর্ড করা আছে— “নমস্কার, বিশ্বে শান্তি হোক”।
সৌরজগতে পৃথিবীর অবস্থান কোথায় সেই বিষয়ে উল্লেখ আছে এতে। বিজ্ঞানীদের আশা- মহাবিশ্বের কোনো বুদ্ধিমান প্রাণী যদি এই গোল্ডেন রেকর্ড পেয়ে থাকে, তবে তারা আমাদের পৃথিবী এবং আমাদের সম্পর্কে জানতে পারবে। তারা যাতে এটি চালাতে পারে তার সমস্ত কিছুর নির্দেশনা এই ডিস্কে দেওয়া হয়েছে। বিজ্ঞানী কার্ল সাগানের নেতৃত্বে এই কাজটি করা হয়।
শেষ কথা
ভয়েজার ১ তার মিশন শেষ করে ফেলেছে, কিন্তু এখনও অসীমের দিকে এগিয়ে চলেছে বিরামহীনভাবে। এটি আমাদের সৌরজগতের পরিধি অতিক্রম করে প্রবেশ করেছে ইন্টারস্টেলার স্পেসে, যেখানে আছে কেবলই অন্ধকার। অসীম মহাকাশের বুকে অন্তিম যাত্রা করতে থাকবে এটি, আর বহন করতে থাকবে পৃথিবীবাসীর ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং সৃষ্টি।