মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। অন্যান্য প্রাণীর চেয়ে মানুষের পার্থক্য বুদ্ধিমত্তায়। মানুষ তার বুদ্ধিমত্তা দিয়ে অন্যান্য প্রাণীকে নিয়ন্ত্রণ করছে। আজ যে মানুষ পৃথিবীর সীমানা পেরিয়ে মঙ্গলে বসতি স্থাপনের স্বপ্ন দেখছে, তা তার বুদ্ধিমত্তার জোরেই। বুদ্ধির কারণেই আজ উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছেছি আমরা।
প্রাণীজগতের সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী হলেও সকল মানুষের বুদ্ধিমত্তা (IQ) সমান নয়। কারো আইকিউ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি, কারো কম। যাদের আইকিউ বেশি, তারা সাধারণত খুবই প্রতিভাবান মানুষ হন। উচ্চ আইকিউসম্পন্ন ব্যক্তিদের স্নায়ুগুলো মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের সাথে বেশি যুক্ত থাকে। অন্যদিকে কম আইকিউয়ের মানুষদের স্নায়ুপথ তুলনামূলক সরল ও ছোট হয়ে থাকে। কী কারণে এমন হয়, তা এখনো জানা যায়নি। তবে জানার চেষ্টা চলছে। এটা যদি জানা সম্ভব হয়, তবে তাত্ত্বিকভাবে হলেও মানুষের বুদ্ধিমত্তা বাড়ানোর উপায় জানা যাবে মনে করেন বিজ্ঞানীরা।
মানুষের গড় আইকিউ ১০০। প্রতিভাবানদের আইকিউ অবশ্যই এর চেয়ে বেশি। ধারণা করা হয়, বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটনের আইকিউ ছিল ২০০। যদিও তিনি কখনো আইকিউ পরীক্ষায় অংশ নেননি। ইউনিভার্সিটি অভ ওয়াশিংটনের সাইকোলজির সাবেক অধ্যাপক আর্ল হান্টের মতে, প্রতি দশ বিলিয়ন মানুষের মধ্যে মাত্র একজন মানুষের আইকিউ ২০০। বর্তমানে বিশ্বের জনসংখ্যা সাত বিলিয়ন। এখন পর্যন্ত পৃথিবীতে ২০০ আইকিউধারী কোনো ব্যক্তি পাওয়া যায়নি।
হঠাৎ করে সব মানুষের আইকিউ ২০০ হয়ে গেলে কেমন হবে? বিশ্বজুড়ে ৭.৭ বিলিয়ন মানুষের সবাই নিউটনের মতো আইকিউধারী হলে কেমন হবে তাদের জীবনযাপন?
স্নায়ুবিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরেই মানুষের বুদ্ধিমত্তা বাড়ানোর সম্ভাবনা নিয়ে কাজ করছেন। একদিন হয়তো আমরা আরো স্মার্ট হয়ে যাবো। কেমন হবেন সেই সময়ের মানুষরা, সেটি নিয়েই আজকের আয়োজন।
দ্রুত শেখার ক্ষমতা
স্নায়ুবিজ্ঞানী রিচার্ড হাইয়ারের মতে, বুদ্ধিমত্তা দ্বিগুণ হলে নতুন কিছু শেখার ক্ষেত্রে মানুষ আরো কম সময়েই তা সম্পন্ন করতে পারবে। দ্রুত শেখার পাশাপাশি মানুষের স্মরণশক্তিও বাড়বে বলে মনে করেন হাইয়ার। তখন কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই মানুষ একটি নতুন ভাষায় দক্ষ হয়ে ওঠতে পারবে। চিন্তা করুন, আপনার চার বছরের স্নাতক কোর্স দুই বছরের আগেই সেরে ফেলছেন!
হাইয়ার বলেন,
উচ্চ আইকিউধারী মানুষ হওয়া সবার জন্য হবে দারুণ একটি ব্যাপার! তখন হয়তো তারা বই পড়া, জ্ঞান অন্বেষণ করায় বেশি আগ্রহী হবে। বিভিন্ন জিনিস সম্পর্কে তাদের উপলব্ধি ক্ষমতা বাড়বে। চিন্তাশক্তির দক্ষতাও বাড়বে তখন। তখন মানুষ তার আগ্রহের বিষয়সমূহ নিয়েই ক্যারিয়ার গড়বে। নিজের পছন্দের ক্ষেত্রেই কাজ করবে।
গড় আয়ু বৃদ্ধি
মানুষের বুদ্ধি বাড়লে তাদের গড় আয়ুও বাড়বে। চিন্তা করুন, মানুষ ১০০ বছরেরও বেশি সময় বেঁচে থাকছে! একই সাথে তারা সুস্বাস্থ্যের অধিকারীও হবে। ভাবছেন, বুদ্ধিমত্তার সাথে স্বাস্থ্যের সম্পর্ক কী?
বুদ্ধিমত্তা উন্নত হলে মানুষ নিজের সম্পর্কে আরো সচেতন হয়ে ওঠবে। জীবনযাত্রার মান আরো বৃদ্ধি পাবে। তখন খুব স্বাভাবিকভাবেই তারা স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন করতে শুরু করবে। ডায়বেটিসের মতো দীর্ঘমেয়াদী রোগ যাতে চেপে না বসে, সেজন্য আগেই সচেতন থাকবে। ফলে রোগবালাই কম হবে। মৃত্যুহারও কমে যাবে। এতে মানুষের আয়ুও বৃদ্ধি পাবে।
সামাজিক দক্ষতার অভাব
সামাজিক দিক দিয়ে বুদ্ধিমত্তার প্রভাব খুব একটা পড়বে না বলেই মনে করেন হাইয়ার। মানুষের বুদ্ধিমত্তা বাড়লেও অন্যের প্রতি সহযোগিতার মনোভাব না-ও থাকতে পারে। বুদ্ধিমান মানুষদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, তারা বন্ধুবান্ধবের সাথে বেশি যোগাযোগ রাখা পছন্দ করেন না। সেখানে সমাজের সবাইই যদি বুদ্ধিমান হন, তখন একে অন্যের সাথে কতটুকু সামাজিকতা রক্ষা করবেন তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক।
রিচার্ড হাইয়ার এই প্রসঙ্গে বলেন,
বুদ্ধিমত্তা ব্যক্তিত্ব ও আবেগ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। একজন মানুষ অনেক বুদ্ধিমান হলেও বদ্ধ উন্মাদের মতো আচরণ করতেই পারেন। প্রত্যেকের আইকিউ যদি ২০০ হয়, তখনো হয়তো মানুষের মধ্যে এমন ব্যক্তিত্ব দেখা যেতেই পারে। কারণ এটা নির্ভর করে আপনি কেমন সমাজে বসবাস করছেন তার ওপর। সবাই নিশ্চয়ই খুব সুন্দর সমাজ ব্যবস্থা বা পরিবার থেকে আসবে না।
অপরাধের পরিমাণ হ্রাস
মানুষের বুদ্ধিমত্তা বৃদ্ধি পেলে অপরাধ প্রবণতা কমে যাবে। কারণ, অপরাধীরা অনেক সময় তাদের পরিণতির কথা চিন্তা না করেই অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। চিন্তাশক্তি বৃদ্ধি পেলে এটি কমে যাবে বলে ধারণা করছেন বিজ্ঞানীরা। তবে খুনাখুনির মতো অপরাধ কমলেও কর্পোরেট সন্ত্রাসের মতো অপরাধের আশঙ্কা থেকে যাবে।
বড় বড় প্রযুক্তি কোম্পানি, ব্যাংক, ওষুধ কোম্পানিগুলো আরো চতুর হয়ে উঠবে। তারা সরকার ও জনগণকে বিভিন্নভাবে প্রতারণার ফাঁদে ফেলবে। তবে সরকারও বসে থাকবে না। তারা এর প্রতিরোধের জন্য একইরকম দক্ষ বাহিনী গড়ে তুলবে। তবে বেশিরভাগ সময়ে কোন পক্ষের জয় হবে তা অত্যন্ত আগ্রহ জাগানিয়া বিষয় হবে।
উদ্ভাবনী ক্ষমতা বৃদ্ধি
বুদ্ধিমত্তা বাড়ায় নিত্যনতুন উদ্ভাবনী ক্ষমতাও বৃদ্ধি পাবে মানুষের। বড় বড় সমস্যার সমাধানে মানুষ বিভিন্ন জিনিস আবিষ্কার করবে খুব দ্রুত। পৃথিবী ভর্তি প্রতিভাবান মানুষ হয়তো তখন বর্তমানের অনেক অমীমাংসিত রহস্যের সমাধান করে ফেলবে। হয়তো সমুদ্রের লবণাক্ততা দূর করে ফেলতে সক্ষম হবে তখনকার মানুষ। ১০ জন প্রকৌশলীর চেয়ে ১০০ জন প্রকৌশলী তখন দারুণ কোনো উদ্ভাবনী ধারণা নিয়ে আসতে পারবেন।
চেহারায় আভিজাত্য
কোনো জ্ঞানী মানুষ সম্পর্কে চিন্তা করলে আমাদের চোখের সামনে একটি সাধারণ চেহারা ভেসে ওঠে। তাদের চোখে থাকে বিরাট চশমা, হাতে বই, বেশভূষা সম্পর্কে অসচেতন। কিন্তু মানুষ যখন আরো বুদ্ধিমান হবে, তখন নিজের চলাফেরা সম্পর্কে আরো সচেতন হয়ে ওঠবে। কারণ তখন সবারই স্পষ্ট ধারণা থাকবে যে, চাকরি বা দাওয়াতে তাদের পোশাক, বেশভূষা, চেহারার সৌন্দর্য ভালো প্রভাব ফেলে। তখন সবচেয়ে গড়পড়তা চেহারার একজন মানুষও দেখতে স্মার্ট হবে। অর্থাৎ, তখনকার মানুষ আরো বেশি ফ্যাশন সচেতন হবে।
শেষ কথা
মানুষের বুদ্ধিমত্তা বাড়লে কী হতে পারে না পারে, সবই তাত্ত্বিক কথাবার্তা। আদৌ কখনো মানুষের বুদ্ধিমত্তা বাড়ানো সম্ভব হবে কি না তা ভবিষ্যতই ভালো বলতে পারবে। যদি সম্ভব হয়, উপরের সম্ভাবনাগুলো মিলতেও পারে, না-ও মিলতে পারে। বিজ্ঞানীরা আশা করছেন এমন কিছু হলে তাতে মানুষের উপকারই হবে বেশি। তবে শঙ্কার কথাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না।
বুদ্ধিমত্তা বাড়ানো সম্ভব হলেও, একসাথে সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষের বাড়বে কি না তা নিয়ে আছে অনিশ্চয়তা। হয়তো সমাজের ধনীরাই শুধু বিপুল অর্থের বিনিময়ে সুযোগ পেল নিজেদের বুদ্ধিমত্তা বাড়িয়ে নেয়ার, গরিবরা বঞ্চিত থাকল। তখন একটি তীব্র শ্রেণী বৈষম্যের সৃষ্টি হতে পারে। সমাজের দশ শতাংশ মানুষ হয়তো নিজেদের পাওয়া সুবিধাগুলো দিয়ে বাকি নব্বই শতাংশ মানুষের ওপর প্রভাব বিস্তার করবে। তাই এসব নিয়ে কাজ করার সময় নৈতিকতার দিকেও মনোযোগ দেওয়া জরুরি।