একটা কাজ ভালোভাবে রপ্ত করার জন্য অনুশীলনের কোনো বিকল্প নেই। এই কাজটি হতে পারে কোনো খেলা, পড়াশোনার কোনো বিষয় কিংবা কোনো নতুন বাদ্যযন্ত্র বাঁজাতে শেখা। ক্রীড়াবিদরা নিজেদের খেলায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন কিন্তু এই অনুশীলনের জন্যই। একজন সাঁতারুকে দৈনিক ছয় ঘণ্টা অনুশীলনের জন্য পানিতেই কাটিয়ে দিতে হয়। তাদের শরীরের গড়ন, পেশীগুলোও তাই সেভাবে তৈরি হয়ে যায়। একই সাথে তাদের দ্রুততা ও শক্তি বৃদ্ধি পায়।
ক্রিকেটাররা তাদের মূল খেলার আগে একটানা নেটে অনুশীলন করে থাকেন। একজন ভালো ক্রিকেটার, যিনি একটানা ভালো খেলে আসছেন, তার আবার এত অনুশীলনের দরকার কেন? এমন প্রশ্ন আসাটা স্বাভাবিক। এর উত্তর হলো প্রত্যেক খেলোয়াড়ের নিজ নিজ জায়গায় উন্নতির প্রয়োজন হয়। আর খেলাধুলার মতো প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক জায়গায় উন্নতি না করলে নিজের জায়গা অন্য আরেকজনের জন্য ছেড়ে দিতে হয়।
এবার আসা যাক বাদ্যযন্ত্রে। ধরুন একজন মানুষ নতুন নতুন গিটার বাজানো শিখতে চায়। শুরুর দিকে এই যন্ত্রটি সঠিক ভাবে ধরা শিখতেই তার অনেক সময় লেগে যেতে পারে। কিন্তু যতই সময় পার হতে থাকে, মানুষটি ততই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে শুরু করে। ধীরে ধীরে তার দক্ষতা বাড়তে থাকে এবং একরকম হাত চলে আসে এই বাদ্যযন্ত্রটিতে।
কাজেই বলা যাচ্ছে, কোনো কিছুতে পারদর্শী হওয়ার পেছনে অনুশীলনের কোনো বিকল্প নেই। এটি এক প্রকার অলিখিত নিয়মই বলা যেতে পারে। তবে এই অলিখিত নিয়মের কিন্তু ঠিকই লিখিত ব্যাখ্যা রয়েছে। এই লেখাটিতে আমরা সেই ব্যাখ্যা নিয়েই আলোচনা করব।
খেয়াল করে দেখবেন, আমরা যখন নতুন কিছু শিখতে যাই, তখন শুরুতে আমাদের অনেক মনোযোগ দিতে হয়। এরপর ধীরে ধীরে বস্তুটি আয়ত্তে চলে আসলে আর আগের মতো মনোযোগ দেওয়ার দরকার হয় না। একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যাক।
রুবিকস কিউব সম্পর্কে আমরা সবাই কম-বেশি জানি। এটি যখন কেউ প্রথমবার মেলাতে শেখে, তখন কিউবগুলোর বিন্যাস দেখে বুঝতে হয় যে পরবর্তী ধাপ কী হবে। এখানে ব্যক্তিকে প্রথমে কিউবটির বর্তমান অবস্থা দেখতে হচ্ছে। তারপর সে তাতে কি পরিবর্তন করবে তা চিন্তা করতে হচ্ছে। আর শেষে সেই অনুযায়ী সে কিউবটিকে ঘোরাতে থাকবে। একজন সদ্য রুবিকস কিউব মেলাতে শেখা লোকের জন্য কাজটি সময়সাপেক্ষ। কিন্তু এই একই কাজ তিনি যতবার করতে থাকবেন, তার চিন্তা ও হাতের গতি ততই বাড়তে থাকবে। হাতের এই গতি বৃদ্ধিকে আমরা ‘মাসল মেমোরি’ বলে থাকি। প্রকৃতপক্ষে এই মাসল মেমোরি বলতে আসলে কিছু নেই। আমাদের পেশীর কোনো নিজস্ব স্মৃতিশক্তি থাকে না। এটি আমাদের মস্তিষ্কেরই একটি কারসাজি বলতে পারেন। এ বিষয়ে আমরা আরো বিস্তারিতভাবে আলোচনা করছি।
আমাদের মস্তিষ্ক অনেক বিস্ময়কর একটি বস্তু। এটি নিয়ে রহস্যের শেষ নেই। তাই এই বস্তুটি নিয়ে আলোচনা করতে বসলেও তা কখনো শেষ হবে না। তবে একজন মানুষ কীভাবে অনুশীলনের মাধ্যমে একটি কাজে পারদর্শী হয়ে ওঠেন, তার সমস্ত কৃতিত্ব কিন্তু মস্তিষ্ককে দিতে হবে।
প্রথমেই আমাদের এই মস্তিষ্ক সম্পর্কে কিছু প্রাথমিক জ্ঞান আহরণ করা জরুরী। যারা স্কুলজীবনে জীববিজ্ঞান পড়েছিলেন, তারা নিজেদের পুরনো বিদ্যা একটু ঝালাই করে নিতে পারেন। আর যারা পড়েননি, তাদেরও বিশেষ চিন্তার কিছু নেই। পুরো বিষয়টি অনেক সহজ।
আমাদের মস্তিষ্কের প্রধান উপাদান হলো স্নায়ুকোষ বা নিউরন। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আমাদের সকল স্মৃতির ধারক ও বাহক হলো এই নিউরন। নিউরনের রয়েছে তিনটি অংশ। এগুলো হলো: কোষদেহ, অ্যাক্সন ও ডেনড্রাইট। নিউরনকে একটি স্কুল হিসেবে বিবেচনা করলে কোষদেহ হলো সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক। অন্যান্য উপাদানগুলো ঠিকভাবে কাজ করছে কিনা তার দেখাশোনা করে এই কোষদেহ। অ্যাক্সন হলো তারের মতো লম্বা বস্তু যা কোষদেহ থেকে বের হয়। এটির কাজ হলো একটি নিউরন থেকে অন্য নিউরনে তথ্য পাঠানো। আর ডেনড্রাইট হলো কোষদেহ থেকে বের হওয়া ছোট ছোট প্রবৃদ্ধি। একটি নিউরনের ডেনড্রাইট অন্য একটি নিউরনের অ্যাক্সনের সাথে সংযোগ স্থাপন করে। এই সংযোগস্থলের নাম হলো সিন্যাপ্স। এখানে অ্যাক্সন তার নিজ নিউরন থেকে যে তথ্য পাঠায় তা অন্য নিউরনের ডেনড্রাইট গ্রহণ করে। এভাবে আমাদের মস্তিষ্কে কয়েক বিলিয়ন নিউরন একে অপরের সাথে যুক্ত।
আমাদের মস্তিষ্ক থেকে স্পাইনাল কর্ডের মাধ্যমে সারা শরীরে স্নায়ু টিস্যু বা নার্ভ টিস্যু ছড়িয়ে রয়েছে। আমাদের যখন কোনো মশা কামড় দেয়, তখন কোনো রকম চিন্তা ছাড়াই আমাদের হাত সরাসরি মশাটি মারার জন্য উদ্যত হয়। এখানে আসলে যা ঘটে তা হলো, প্রথমে আমাদের শরীরে যে অঙ্গে মশাটি কামড় দিয়েছে, সেখান থেকে ব্যথা পাওয়ার অনুভূতি মস্তিষ্ক গ্রহণ করে। এরপর এটি নিউরনের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যমে সরাসরি হাতে সেই মশার অবস্থান সম্পর্কে তথ্য দেয়। তারপর হাত সেই নির্দিষ্ট অঙ্গে থাবা বসিয়ে মশাটি মেরে ফেলে। এখানে পুরো ব্যাপারটা অনেক দ্রুত হয় বলে আমাদের চিন্তা করার প্রয়োজন পড়ে না।
ইতিমধ্যে মস্তিষ্কের নিউরন ও এর কাজ সম্পর্কে আমাদের যতটুকু জানা দরকার আমরা জেনেছি। এবার আসা যাক অনুশীলনের সময় মস্তিষ্ক কীভাবে কাজ করে সেই বিষয়ে।
আমাদের মস্তিষ্ক দুই ধরনের পদার্থ দিয়ে তৈরি। এগুলোকে বলা হয় গ্রে ম্যাটার ও হোয়াইট ম্যাটার। দুটি পদার্থের ভিন্ন ভিন্ন কাজ রয়েছে। আমাদের পেশী চালনা, সিদ্ধান্ত নেওয়া, দেখা, কথা বলা ও শোনার অনুভূতি, আবেগ ইত্যাদি নিয়ন্ত্রিত হয় মস্তিষ্কের গ্রে ম্যাটার সমৃদ্ধ অংশগুলো থেকে। আর হোয়াইট ম্যাটারের কাজ হলো এই সকল গ্রে ম্যাটার সংলগ্ন অংশগুলোর মাঝে যোগাযোগ তৈরি করা। মূলত নিউরনের কোষদেহ গ্রে ম্যাটার ও অ্যাক্সন হোয়াইট ম্যাটারে পরিপূর্ণ থাকে।
আমরা বারংবার যেই ‘তথ্য’ আদান-প্রদানের কথা বলছি, এই তথ্য বলতে আসলে বৈদ্যুতিক সংকেতকে বোঝায়। আমাদের মস্তিষ্কে সকল কাজ এই সংকেতের আদান-প্রদানের মাধ্যমেই হয়ে থাকে।
এখন আমরা অ্যাক্সনকে একটি বৈদ্যুতিক তারের সাথে তুলনা করতে পারি। বৈদ্যুতিক তারের পরিবাহী অংশে প্লাস্টিক বা অন্য অপরিবাহী পদার্থের প্রলেপ দেওয়া হয়। এই প্রলেপ বা ইনসুলেশনের মূল উদ্দেশ্য হলো বিদ্যুৎ সরবরাহ যেন সঠিকভাবে হয় এবং তারের মধ্যে যাতে বৈদ্যুতিক গোলযোগ না থাকে। অনুশীলনের ক্ষেত্রেও আমাদের নিউরনগুলোর অ্যাক্সনে ঠিক একই রকম ঘটনা ঘটে। আর এক্ষেত্রে প্রাকৃতিক ভাবে অ্যাক্সনে এক প্রকার প্রলেপ তৈরি হয়। যেই পদার্থ দিয়ে এই প্রলেপ তৈরি হয়, তার নাম হলো মায়েলিন। আর এই প্রক্রিয়াকে বলে মায়েলিনেশন।
আমরা যখন অনুশীলনের মাধ্যমে একই কাজের পুনরাবৃত্তি করি, তখন আমাদের নিউরনের অ্যাক্সনগুলোতে মায়েলিনের নতুন স্তর তৈরি হতে থাকে। কাজেই মায়েলিনের স্তর যত বৃদ্ধি পায়, নির্দিষ্ট কিছু নিউরনের মাঝে সংকেত পরিবহণের গতিও বাড়তে থাকে। ঠিক এই কারণেই প্রথমবারের মতো কিছু শেখার সময় আমাদের সময় বেশি লাগে। অর্থাৎ মায়েলিনের নতুন স্তর তৈরি হতে থাকে। আর ধীরে ধীরে চর্চা চালিয়ে গেলে আমাদের গতিও বেড়ে যায়। কাজেই যারা নিজেদের কাজে অনেক দক্ষ, তাদের এই দক্ষতার পেছনে মূল কারণ হলো, তারা অনুশীলন করেছে। আর অনুশীলনের কারণে তাদের মস্তিষ্ক ঐ নির্দিষ্ট কাজটি দ্রুত ও সুচারুভাবে সম্পন্ন করতে পারে।
এখন কথা এখানেই শেষ নয়। মায়েলিনেশনের এই প্রক্রিয়া একটি নবজাতকের গর্ভে থাকা অবস্থাতেই প্রাকৃতিক ভাবে শুরু হয়। ছোট বাচ্চাদের মস্তিষ্কে মায়েলিনেশন সবচেয়ে দ্রুত হয়। আর বয়স বাড়ার সাথে সাথে এর হার কমতে শুরু করে। তবে এটি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় না। গ্লিয়া কোষ নামে মস্তিষ্কে এক বিশেষ ধরণের কোষ ঠিকই এই মায়েলিনের প্রলেপ তৈরি করতে থাকে। বিজ্ঞানীরা বলে থাকেন যে, ২৫ বছর বয়স পর্যন্ত আমাদের মস্তিষ্কের ক্রমবিকাশ ঘটে। তবে কথাটি সব ক্ষেত্রে সত্যি নয়।
এই মায়েলিন নামক বস্তুটি মূলত হোয়াইট ম্যাটার দিয়ে তৈরি। কাজেই যেসব দক্ষ ক্রীড়াবিদ, গায়ক, কম্পিউটার প্রোগ্রামাররা নিয়মিত চর্চা করেন, তাদের মস্তিষ্কে হোয়াইট ম্যাটারের তারতম্য হওয়ার কথা। গবেষকরা তাই ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স ইমেজিংয়ের সাহায্য নিয়ে একটি গবেষণা চালান। এই গবেষণাটিতে তারা ক্রীড়াবিদ ও সাধারণ মানুষদের মস্তিষ্ক পরীক্ষা করে দেখেন। এখানে দেখা যায় যে, ক্রীড়াবিদ ও সংগীতজ্ঞদের মস্তিষ্কের কিছু কিছু অংশে হোয়াইট ম্যাটারের আধিক্য বেশি। মস্তিষ্কের এই অংশগুলো তাদের সংশ্লিষ্ট কাজের সাথেই সম্পর্কিত। অর্থাৎ নিয়মিত প্রশিক্ষণের কারণে তাদের মস্তিষ্কের প্রয়োজনীয় জায়গাগুলোতে মায়েলিনেশন ঘটেছে।
পরিমিত ঘুম অনেক জরুরী। এখানে হুট করে ঘুমের কথা এজন্য বলা হচ্ছে, কারণ মায়েলিনেশনের প্রক্রিয়াটি আমাদের ঘুমের মাঝেই ঘটে। কাজেই একজন ছাত্র যতই পড়াশোনা করুক, একজন ক্রীড়াবিদ যতই প্রশিক্ষণে সময় দিক না কেন, ঠিকমতো না ঘুমালে তার প্রভাব শরীরে পড়বে না। শেখার কাজটা বলতে পারেন, তার দিয়ে বিভিন্ন জায়গায় সংযোগ সৃষ্টি করার মতো। একাধারে অনেকক্ষণ অনুশীলন করলে আমরা কাজটা আয়ত্তে আনতে পারি ঠিকই। কিন্তু মস্তিষ্কে একরকম তারের জঞ্জালের মতো অবস্থা তৈরি হয়। ঘুমের মধ্যে মস্তিষ্ক নিজে নিজে এই জট খুলে সব তথ্য সুন্দরভাবে গুছিয়ে রাখে। কোনো কিছু শেখার সময় মূলত অ্যাক্সন থেকে অন্য নিউরনের কোষদেহে বৈদ্যুতিক চার্জ পরিবাহিত হয়। তবে ঘুমানোর সময় ঠিক উল্টো দিকে এই পরিবহণ ঘটে। এতে করে কোষগুলোর মাঝে যোগাযোগ ব্যবস্থা আরো দ্রুত ও মজবুত হয়।
অনেকে অভিযোগ করতে পারেন, “আমরা তো অনেক পরিশ্রম করি, কিন্তু উন্নতি তো তেমন হয় না”। এই প্রশ্নের উত্তর আসলে অনেক সহজ। আমাদের প্রত্যেকের মস্তিষ্কই ভিন্নভাবে কাজ করে। এখানে জেনেটিক বা বংশগত ব্যাপারটা যেমন দায়ী, তেমনি শেখার পরিবেশেরও একটা প্রভাব রয়েছে। কোনো নতুন কৌশল রপ্ত করার সময় আমরা যদি একই পদ্ধতি বারংবার প্রয়োগ করি, তবে এক জায়গায় এসে মায়েলিনেশন থেমে যায়। অর্থাৎ আমাদের উন্নয়ন একটা জায়গায় এসে থমকে দাঁড়ায়। এ কারণে অবশ্যই কিছু নতুনত্ব প্রয়োগ করা জরুরী। ঠিক যেমন একজন দাবাড়ু নিজের থেকে ভালো প্রতিদ্বন্দ্বীদের সাথে বারবার খেলে নিজের খেলার উন্নতি করে।
নির্দিষ্ট একটা কাজে অন্য সবার থেকে ভালো হওয়ার সমীকরণটা আসলে অনেক সহজ। আমরা যে কাজে যত বেশি সময় দিব, তাতে আমরা তত ভালো করব। যেই ছাত্র অন্যদের তুলনায় বেশি পড়াশোনা করে, তার পরীক্ষার ফলাফল এ কারণে ভালো হয়। যেই প্রোগ্রামার দিন-রাত নিত্যনতুন প্রোগ্রামিং সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে, সে তত ভালো প্রোগ্রামার হয়। একজন মানুষের পেশাগত দক্ষতাও নির্ভর করে সে কাজটিতে কতটুকু মনোযোগ ও সময় দিচ্ছে তার উপর। এই সকল কাজের কাজি হলো আমাদের মাথার উপরে দেড় কেজি ওজনের বস্তুটি। এই রহস্যময় অঙ্গটি প্রতিনিয়ত নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টায় রত থাকে।
একুশে বইমেলা ‘২০ উপলক্ষে রোর বাংলা থেকে প্রকাশিত বইগুলো কিনতে এখনই ক্লিক করুন নিচের লিঙ্কে-
১) ইহুদী জাতির ইতিহাস
২) সাচিকো – নাগাসাকির পারমাণবিক বোমা হামলা থেকে বেঁচে যাওয়া এক শিশুর সত্য ঘটনা
৩) অতিপ্রাকৃতের সন্ধানে