মানবসভ্যতার উল্লেখযোগ্য বিবর্তনের পেছনে রয়েছে অগণিত আবিষ্কার। সেই আগুন থেকে শুরু করে আপনার-আমার হাতের স্মার্টফোন পর্যন্ত সবকিছুই ধীরে ধীরে মানবজাতিকে আজকের পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। কিন্তু এই আবিষ্কারগুলো সবসময় সবার জন্য সুফল বয়ে আনেনি। সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হলো কিছু ক্ষেত্রে আবিষ্কার কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে খোদ আবিষ্কারকের জন্যই! নিজের কষ্টে গড়া কিছু কিংবা অনেক সাধনায় পাওয়া কোনো পন্থাই যদি মৃত্যু ডেকে আনে, এর চেয়ে বেদনাদায়ক আর কি হতে পারে? ইতিহাসে নজির আছে এমনই কিছু আবিষ্কারকের, যাদের প্রাণনাশের কারণ হয়েছিল তাদেরই কিছু আবিষ্কার। চলুন জেনে আসি তাদের সম্পর্কে।
উড়ন্ত দর্জি
ফরাসি দর্জি ফান্স রেইচেল্ট (Franz Reichelt) কাপড়ের প্যারাসুট বানান এবং দাবী করেন সেটি সফলভাবে কাজ করে। নিজের এই দাবী সত্য প্রমাণের জন্য তিনি জনসম্মুখে সেটি নিয়ে উঁচু জায়গা থেকে লাফ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। প্যারাসুটটি পরীক্ষার জন্য ডামি ব্যবহার করা হবে- এই মিথ্যে কথা দিয়ে ফরাসি পুলিশকে অন্ধকারে রেখে তিনি আইফেল টাওয়ার থেকে পরীক্ষাটি করার অনুমতি আদায় করেন।
নিজের আবিষ্কারের উপর তার এতই বিশ্বাস ছিল যে তার এই ‘উদ্বোধনী লাফ’ দেখার জন্য তিনি মিডিয়াকেও আমন্ত্রণ জানান। ১৯১২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি নিজের বানানো কাপড়ের প্যারাসুট পরে আইফেল টাওয়ার থেকে লাফ দেন রেইচেল্ট। বলা বাহুল্য, সেই লাফই ছিল তার জীবনের শেষ লাফ। মিডিয়া পুরো ব্যাপারটি ভিডিওতে ধারণ করে।
আধুনিক ছাপাখানার আবিষ্কারক
উইলিয়াম বুলককে আধুনিক ছাপাখানার আবিষ্কারক ধরা হয়। ১৮৬৩ সালে তিনি ছাপাখানার একটি উন্নত সংস্করণ তৈরী করেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে সেই ছাপাখানাই কাল হয়ে দাঁড়ায় তার জন্যে। ১৮৬৭ সালে ছাপাখানায় কাজ করার সময় তার পা চলন্ত মেশিনে আটকে বাজেভাবে থেঁতলে যায়। পায়ের ঐ অংশটুকুতে দ্রুতই গ্যাংগ্রীন সংক্রমণ হয় এবং কেটে বাদ দেয়ার প্রয়োজন হয়। ১৮৬৭ সালের ১২ এপ্রিল সেই সার্জারীর সময়েই তার মৃত্যু হয়।
টাইটানিকের ‘প্রকৃত নায়ক’
টাইটানিকের প্রধান স্থপতি ছিলেন থমাস অ্যান্ড্রু এবং সম্মান প্রদর্শনপূর্বক তাকে টাইটানিকের প্রথম যাত্রায় সামিল করা হয়। কিন্তু কে জানত টাইটানিকে এই প্রথম যাত্রাই তার শেষ যাত্রা হবে! প্রধান নকশাকার হিসেবে টাইটানিকের খুঁটিনাটি তার জানা ছিল। তিনি জানতেন বরফ ছাওয়া পানিতে চলাচলে টাইটানিকের পারদর্শিতা খুব বেশি নয়। এজন্য তিনি জাহাজটিতে দ্বি-স্তরের কাঠামো দেওয়া এবং অন্তত ছেচল্লিশটি লাইফ জ্যাকেট রাখার কথা বলেন। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা যায়, কেবল বিশটি লাইফ জ্যাকেটই জাহাজে নেয়া হয়েছিল। এই গাফিলতির কারণে হাজারেরও বেশি মানুষ মারা যায়, মারা যান জাহাজের নকশাকারও। শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত তিনি জাহাজের যাত্রীদের সাহায্য করছিলেন লাইফ জ্যাকেট খুঁজতে, লাইফ বোটে চড়তে। তাকে শেষবারের মতো ফার্স্ট ক্লাস স্মোকিং লাউঞ্জে একদৃষ্টিতে একটি পেইন্টিংয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখা যায়। হয়ত বিষণ্ন চোখ বেয়ে নেমে এসেছিল দু-এক ফোঁটা অশ্রুও। পরবর্তীতে তার মৃতদেহ আর উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
উড়ন্ত গাড়ি
বিভিন্ন সায়েন্স ফিকশনে উড়ন্ত গাড়ির কথা প্রায়ই পড়ে থাকি আমরা। কিন্তু অনেকেই জানি না বাস্তবে একটি উড়ন্ত গাড়ির অস্তিত্ব ছিল বৈ কি! ১৯৭১ সালের দিকে আমেরিকার দুই ইঞ্জিনিয়ার হেনরি স্মোলিন্সকি ও তার সঙ্গী হ্যাল ব্লেক এ ভি ই মিযার (AVE Mizar) নামে একটি উড়ন্ত গাড়ি তৈরী করেন, যার পাখাগুলো ইচ্ছেমতো খুলে নেয়া যেত।
গাড়িটি মূলত এ চিন্তায় বানানো হয় যে, তা যেন মোটামুটি কয়েকশ মাইলের মতো চলাচলে সক্ষম হয়। মূলত মিনি হেলিকপ্টারের মতো স্থানীয় এয়ারপোর্টগুলোর মধ্যে চলাচল করতে পারে। তবে হেলিকপ্টারের সাথে পার্থক্য হচ্ছে এয়ারপোর্টে নেমেই পাখাগুলো আলাদা করে সাধারণ গাড়ির মতো চলাচল শুরু করা যাবে। ভাবতে কী চমৎকার মনে হচ্ছে, তাই না? কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে পরীক্ষামূলকভাবে গাড়িটি ওড়ানোর সময় মাঝপথেই পাখাগুলো খুলে যায়। ফলে গাড়িটি মুখ থুবড়ে পড়ে নিচে আর মৃত্যু ঘটে গাড়িতে বসে থাকা দুই আবিষ্কারকের। এরপর আর কেউ গাড়িটির দ্বিতীয় কোনো মডেল বানানোর চেষ্টা করেনি।
গ্লাইডার কিং
রাইট ভাইদের কাহিনী কে না জানে! কিন্তু অনেকেই জানে না যে, রাইট ভাইয়েরা অর্থাৎ অরভিল রাইট ও উইলবার রাইট আকাশে ওড়ার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন অটো লিলিয়েনথেলের কাছ থেকে, যাকে ‘গ্লাইডার কিং’ও বলা হয়ে থাকে। লিলিয়েনথেলই সর্বপ্রথম সফলভাবে গ্লাইডারে উড়ে নিরাপদে মাটিতে নামেন। তার এই প্রচেষ্টার আগে মানুষের উড়তে চাওয়াকে অসম্ভব কাজ হিসেবে দেখা হতো, যা ছিল ‘শুধু স্বপ্নচারী আর বোকাদের জন্য’।
লিলিয়েনথেল মোট আঠারো ধরণের গ্লাইডার বানিয়েছিলেন, ছোট ছোট উড্ডয়ন সংখ্যাও ছিল প্রায় দুই হাজারের কাছাকাছি। দুই হাজার বার ওড়ার অভিজ্ঞতা যার, সেই ব্যক্তিই জীবনের শেষ উড্ডয়নে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একদম খাড়াভাবে মাটিতে পড়েন। ফলে ভেঙে যায় তার মেরুদন্ড এবং কিছুদিন পরে ঘটে মৃত্যু। হাসপাতালে শায়িত অবস্থায় তার শেষ বাক্য ছিল “Opfer müssen gebracht werden!” অর্থাৎ “উৎসর্গ আবশ্যক!”
উড়তে চাওয়ার নেশা
উড়তে চাওয়ার নেশায় প্রাণ হারানোর ঘটনা শুধু একটি নয়। তৎকালীন নিশাপুর নামে পরিচিত বর্তমান ইরাকে দশম শতাব্দীর দিকে একজন বিখ্যাত মুসলিম পন্ডিত ও অভিধানলেখক ছিলেন আবু নাসর ইসমাইল ইবনে হাম্মাদ আল- জওহারি। তাকে প্রধানত মনে রাখা হয় একটি আরব অভিধানের রূপকার হিসেবে। উড়তে চাওয়ার প্রবল বাসনা থেকে তিনি তৈরী করেন পালকে আবৃত কাঠের দুটি পাখা। পাখা দুটিকে নিজের পিঠ ও হাতের সাথে বেঁধে মসজিদের ছাদ থেকে লাফ দেন। ওড়া তো হয়ই নি, বরং জীবনটাও হারাতে হয়ে তাকে।
অনন্ত যৌবনের আকাঙ্ক্ষায় মৃত্যু
আলেক্সান্দার বোগদানভ ছিলেন একজন রাশিয়ান চিকিৎসক এবং একইসাথে একজন রাজনীতিবিদ। ১৯১৭ সালের বলশেভিক আন্দোলনে তিনি অন্যতম মূখ্য ভূমিকা পালন করেন এবং জেলে যান। ভাগ্যক্রমে মৃত্যুদণ্ড থেকে বেঁচে ফেরেন এবং চিকিৎসার দিকে মনোনিবেশ করেন। গবেষণা করতে করতে তিনি অনন্ত যৌবন ধরে রাখার ব্যাপারে প্রায় পাগলপ্রায় হয়ে যান। তিনি দাবী করেন, যুবক ব্যক্তির রক্ত শরীরে গ্রহণের মাধ্যমে যৌবন ধরে রাখা সম্ভব।
১৯২০ সালের দিকে তিনি রক্ত গ্রহণের এই পরীক্ষা করা শুরু করেন। এগারোবার এভাবে রক্ত গ্রহণের পর বারোতম বারে তিনি এক ম্যালেরিয়া ও যক্ষা আক্রান্ত যুবকের সাথে রক্ত বদল করেন। এর দু’দিন পরই তার মৃত্যু ঘটে। তবে সেই যুবক ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে। এভাবেই যৌবন পাওয়ার আশায় নিজের জীবনটাই হারিয়ে বসেন বোগদানভ।
হট এয়ার বেলুনের দুর্ঘটনা
শন ফ্রাংকোয়ে পিলাত্রে ডি রজিয়ার, একজন ফরাসি রসায়ন ও পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক, একটি গরম বাতাসে চলা বেলুন তৈরী করেন, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেয়া।
কিছুটা নাটুকে এই আবিষ্কারকের নতুনভাবে হট এয়ার বেলুন বানানোর পেছনে কারণ ছিল মূলত ঈর্ষা। তৎকালীন সময়ে দুজন ব্যক্তি বেলুনে চড়ে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে বেশ খ্যাতি জমান। যদিও তাদের অভিযান খুব সুখকর ছিল না, ডুবতে ডুবতে বেঁচে যান তারা। এই খ্যাতি দেখে রজিয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি বেলুনের উন্নত সংস্করণ বানাবেন যাতে ঐ সমস্যাগুলোর সম্মুখীন তাকে না হতে হয়। কিন্তু ভাগ্যে ছিল না তার ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেয়া, বেলুনের কিছু সমস্যার কারণে মাঝপথেই ডুবে যায় রজিয়ার ও বেলুনের অন্য যাত্রীরা।
‘পাঁচটি পীড়া’র আবিষ্কারক
খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০ অব্দের দিকে চায়নার কিন রাজবংশের আচার্য ছিলেন সি লি। তার আবিষ্কৃত পাঁচ পীড়া বা The Five Pain ছিল মূলত অত্যাচারের এক অভিনব পদ্ধতি। এই অত্যাচার পদ্ধতির প্রথমে অত্যাচারিত ব্যক্তির কপালে ট্যাটু বা ছাপ আঁকা হত। এরপর তার নাক কেটে নেয়া হত। এরপর তার পায়ের পাতা কেটে ফেলা হত। তারপর তাকে করা হত খোজা। চূড়ান্ত পর্যায়ে তাকে হত্যা করা হত।
সম্রাট কিন শি হুয়াংয়ের মৃত্যুর পর সি লি এবং ঝাও গাও নামে আরেকজন সম্রাটের শেষ ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে নিজেদের পছন্দের ব্যক্তিকে যুবরাজ করতে চাইলে রাজদ্রোহী হিসেবে দুজনকেই মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে নিজের আবিষ্কৃত The Five Pain অনুযায়ী সি লি’র মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
মারি কুরির নোবেলজয়ী আবিষ্কার
মারি কুরির নাম শোনেনি এমন লোক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তিনি রেডিয়াম ও পোলোনিয়ামের আবিষ্কারক এবং তেজষ্ক্রিয়তা সংক্রান্ত অসংখ্য অগ্রগতির পথিকৃৎ। এমনকি ‘রেডিওঅ্যাক্টিভিটি’ শব্দটিও তিনিই প্রথম ব্যবহার করেন। নোবেলজয়ী প্রথম নারী এবং রসায়ন ও পদার্থবিজ্ঞান দুই ক্ষেত্রেই নোবেল পুরষ্কার পাওয়া একমাত্র নারী মারি কুরি।
কিন্তু এই গবেষণার বেশ ভারী মূল্যও পরিশোধ করতে হয়েছে তাকে। প্রচুর তেজষ্ক্রিয়তার মাঝে কাজ করার খেসারতস্বরূপ তিনি আক্রান্ত হন লিউকেমিয়ায়। ১৯৩৪ সালে এই লিউকেমিয়াতেই তার মৃত্যু হয়।
ফিচার ইমেজ- How It Works