শিরোনাম দেখে অনেকেই ভুরু কোচকাবে। কী ব্যাপার? কিং কং নিয়ে এত চলচ্চিত্র দেখেছি, গরিলার মতো দেখতে এই প্রাণী কখনও হওয়া সম্ভব নয়? এমনকি যদি ধরে নিই কিং কং একটি কাল্পনিক প্রাণী, সেই কল্পনাটিও কীভাবে হতাশাজনক হয়? কল্পনা তো কল্পনাই। যদিও National Geographic–এ খবর এসেছিল যে ১ লক্ষ বছর আগে গিগান্টোপিথেকাস বলে একটি ফসিল পাওয়া যায়, যেটা ইঙ্গিত দেয় যে কিংকং ছিল, কিন্তু শরীরের দিক দিয়ে অনেক বড় হওয়ার কারণে তা বিলুপ্ত হয়ে যায়।
১৯৩৩ সালে চলচ্চিত্র পরিচালক মেরিয়ান সি কুপার প্রথম কিংকং এর মতো বিরাট প্রাণীর ধারণা আনেন। ১৯৩৩ সালে কিং কং নামে একটি চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়। সেখানে দেখানো হয় একটি দ্বীপে বিরাট একটি প্রাণীর খোঁজে বেরিয়ে পড়ে কয়েকজন। সেই প্রাণীটির নাম ছিল কং। কং সেই দলের একজন মেয়ের প্রেমে পড়ে যায়। কোনোভাবে সেই মেয়ে সেখান থেকে বেঁচে যায় এবং সেই দল কংকে নিউ ইয়র্কে নিয়ে আসে এবং খাঁচায় বন্দী করে সেটাকে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করে। এরপর সেখান থেকে বের হয়ে কং পুরো শহরকে ধ্বংস করতে শুরু করে এবং পছন্দের মেয়েটিকে নিয়ে পালাতে চায়। এটির পরও কিং কং নিয়ে অনেক চলচ্চিত্র এবং টিভি সিরিজ তৈরি হয়েছে। এখনো হলিউডে কিং কং বেশ জনপ্রিয়।
কিন্তু বৈজ্ঞানিকভাবে এ ধরনের প্রাণী কল্পনা করা অনুচিত। বাস্তবে কিং কংয়ের মতো প্রাণী হওয়া সম্ভব নয়। টেলিভিশনে আমরা বিভিন্ন সময়ে কিং কং নিয়ে ছবি দেখেছি, আমাদের মধ্যে একটা ফ্যান্টাসি কাজ করে এই প্রাণীটি নিয়ে। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি এটা পুরোটাই কাল্পনিক।
বিভিন্ন চলচ্চিত্রে পাঁচ ফুট লম্বা কোনো গরিলাকে ধরে নিয়ে সেটা স্কেল দিয়ে পরিমাপ করে সেটার গাণিতিক অনুপাত ঠিক রেখে সেটাকে ত্রিশ ফুট লম্বা একটি প্রাণীতে পরিণত করা হয়েছে। পুরোটাই আসলে মানুষের ভিশন, গণিত এবং ক্যামেরার কারসাজিতে করা। কিন্তু এত বড় প্রাণী সত্যিই হওয়া অস্বাভাবিক। এবং যদি কখনো হয়েও থাকে তাহলেও সেটা কিং কংয়ের মতো পুরো পৃথিবী জুড়ে তাণ্ডব ঘটাতে সক্ষম হতে পারবে না। বিজ্ঞানের কিছু ধারণা দিয়েই এটা ব্যাখ্যা করা যায়। তার জন্য আমাদের প্রয়োজন হবে কোনো প্রাণীর ভর, বল, ক্ষেত্রফল এবং তার শক্তি সম্পর্কে একটি বৈজ্ঞানিক ধারণা। এগুলোর সাহায্যেই প্রমাণ করা যাবে যে, কিংকং শুধু হলিউডের একটি অবাস্তব কাল্পনিক প্রাণী মাত্র।[১]
এর ব্যাখ্যার জন্য দরকার পড়বে জ্যামিতির সদৃশতার ধারণা। বস্তুর মধ্যে যদি জ্যামিতিক সদৃশতা পরিমাপ করতে হয়, তাহলে সেগুলোকে একই ধরনের পদার্থ দিয়ে তৈরি হতে হবে, সেগুলোর ওজন ভরের সমানুপাতিক হতে হবে এবং ভরকে আয়তনের সমানুপাতিক হতে হবে। এক্ষেত্রে আমরা একটি ঘনকের কথা চিন্তা করতে পারি এবং কিংকংকে একটি ঘনকের ন্যায় মনে করতে পারি। কিংকং এর শরীর অনেকগুলো ছোট ছোট কিউব দিয়ে গঠিত।
কোনো প্রাণীর ভর সহ্য করার ক্ষমতা সে প্রাণীর ভেতরের হাড়গুলোর ক্ষেত্রফলের সমানুপাতিক। এর ফলেই প্রাণীটি তার নিজের ভর নিজে নিতে পারবে এবং এই ভর পুরো শরীরের ক্ষেত্রফলের সমানুপাতিক হবে। উপরে ‘আকার’ বলতে কোনো প্রাণী বা বস্তুর মাত্রাকে বোঝানো হয়েছে, অর্থাৎ উচ্চতা কিংবা দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ইত্যাদি। এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে উচ্চতা। যেহেতু কিংকং সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে, তাই তার মেরুদণ্ড এবং হাড়গুলোকে কিংকং এর ওজন ধরে রাখতে হবে এবং চলাচল করার সময় ভার বহন করতে হবে। ওজন, উচ্চতা এবং শক্তি নিয়ে এখানে কিছু ব্যাপার ঘটে। সেটা নিচে আলোচনা করা হলো।
কোনো বস্তুর ওজন তার আকারের ঘনকের সমানুপাতিক। আবার কোনো প্রাণীর ভর সহ্য করার ক্ষমতা তার আকারের বর্গের সমানুপাতিক। এভাবে আমরা ধরে নিয়ে যদি পাঁচ ফুট গরিলাকে জ্যামিতিক সাদৃশ্যতা মেনে এর আকার বাড়াতে থাকি, তাহলে সেটার ওজন এবং শক্তি দুটোই বাড়তে থাকবে। কিন্তু এখানে ওজন এবং শক্তি একসাথে বাড়লেও এ দুটির মধ্যে কোনটি দ্রুত বাড়বে সেটাও দেখার বিষয়। এখানে দেখা যাচ্ছে, আকার বাড়ার সাথে সাথে শক্তির তুলনায় ওজন অনেক দ্রুত বাড়তে থাকে। আকার যদি ২ একক বাড়ে, তাহলে সূত্রমতে ওজন বাড়বে ৮ একক, আবার আকার যদি ২ একক বাড়ে তাহলে শক্তি বাড়বে ৪ একক।
তাই এখান থেকে বোঝা যাচ্ছে, বাস্তবের যে গরিলাকে নিয়ে তার আকার সমানুপাতিক হারে বাড়িয়ে দিয়ে কিংকং বলে কল্পনা করা হচ্ছে এবং চলচ্চিত্রে দেখানো হচ্ছে, সেই পাঁচ ফুট গরিলার আকার বাড়াতে থাকলে সেটার ওজন অনেক বেড়ে যাবে। কিং কংয়ের আকারের মতো যদি আমরা মেনেও নিই, তাহলে তো সে নিজের ভার নিজেই বহন করতে পারবে না। কারণ কিং কংয়ের শরীরের হাড়গুলোর এত ওজন নিতে সক্ষম হওয়ার কথা নয়, এটা বৈজ্ঞানিকভাবে মেলে না। তাই কিং কংয়ের মতো যদি গরিলার আকার বাড়তেই থাকে, তাহলে একটি নির্দিষ্ট সীমার পর সে নিজের ওজন আর না নিতে পারার কারণে ভেঙে পড়বে।[২]
এই সীমা কিন্তু বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর জন্য বিভিন্ন হবে। সাধারণত এই সীমা ৮-১০ ফুট উচ্চতার মধ্যেই থাকে। এই কারণেই প্রাণীকুলের কেউই অসীম হারে বাড়তে পারে না। কোনো প্রাণীর উচ্চতার তারতম্য হতে পারে, আবার উচ্চতায় অনেক বাড়তেও পারে, যেমন- ডায়নোসর। কিন্তু শরীরের অন্যান্য অংশের আকারের পরিবর্তন সাধন না করে কোনো প্রাণী নিজের ভর ধরে রাখার কারণে এবং হাড়ের ক্ষেত্রফলের কারণে অনেক বেশি উচ্চতার হতে পারে। এজন্যই কোনো ইঁদুর প্রজাতির প্রাণী হাতি হতে পারবে না। কারণ হাতির পা যেটা এর পুরো শরীরের ভার বহন করে সেটা ইঁদুরের নিজের পায়ের তুলনায় অনেক বেশী মোটা এবং ইঁদুরের ছোট পায়ের আকারের সাথে হাতির পায়ের কোনো জ্যামিতিক সাদৃশ্যতা নেই। তাই ইঁদুরের পা জ্যামিতিক নিয়মে বৃদ্ধি করাও যাবে না।
তথ্যসূত্র
[১] Adam, J.A. (2009 ). A Mathematical Nature Walk, Princeton University Press.
[২] Bonner, J.T. (2007) Why Size Matters: From Bacteria to Blue Whale, Princeton University Press
ফিচার ইমেজ: Digital trends