যারা সাপকে ভয় পায়, তাদের জন্য এটা একটা দুঃস্বপ্ন। আর যদি সাপটি এমন হয় যেটা উড়ে উড়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে পারে, তাহলে তো কথাই নেই। এই সাপ তাদের ঘুম হারাম করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। এমন একধরনের সাপ হচ্ছে উড়ন্ত সাপ।
প্রাণীজগতে যেসব প্রাণীর উড়ে বেড়ানোর ক্ষমতা আছে, তারা গবেষকদের কাছে সবসময়ই আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। পাখি, বাদুড়, পোকা-মাকড়দের উড়ে বেড়ানো নিয়ে কম গবেষণা হয়নি। এসব প্রাণীর সৃতিবিদ্যা (Kinematics) নিয়ে গবেষণার সাথে সাথে এদের বাতাসে ভেসে চলার গতি নিয়েও গবেষণা হয়েছে। কিন্তু যেসব প্রাণীর ডানা নেই, যেমন সাপ, তারা কীভাবে বাতাসে ভেসে চলে সেটা অনেক দেরীতে আকর্ষণে পরিণত হয়েছে। এদের বাতাসে ভেসে যাওয়ার গতি গবেষকদের সবচেয়ে বেশী আশ্চর্য করেছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় গাছে বসবাসরত ৫ প্রজাতির সাপের মধ্যে একধরনের সাপ হচ্ছে এই উড়ন্ত সাপ। ইংরেজিতে এই সাপের পরিচিত নাম হচ্ছে Paradise tree snake। সাপটির বৈজ্ঞানিক নাম Chrysopelea paradise। অনেকে এই সাপকে গেছো সাপ বলে। সাধারণত সবুজ রঙের হয় সাপগুলো, কিন্তু অন্য রঙেরও হতে পারে। সাপগুলোর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এরা গাছে উঠতে পারে, উঁচু স্থান থেকে লাফ দিতে পারে, মসৃণ গতিতে উঁচু স্থান থেকে নিচু জায়গায় উড়ে যেতে পারে। এমনকি উড়ন্ত অবস্থায় এই সাপগুলো নিজের যাত্রাপথ পরিবর্তনও করতে পারে! এভাবে এক গাছ থেকে আরেক গাছে যাতায়াত করে এই গাছ সাপগুলো। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- কীভাবে একটি সাপ কোনো প্রকার ডানা ছাড়া বাতাসে উড়তে পারে? কী এমন ঘটে এদের শরীরে যেটা এদেরকে বাতাসে ভাসিয়ে রাখতে সাহায্য করে?
এই সাপগুলো প্রথমে গাছের কোনো এক শাখায় পেঁচিয়ে অবস্থান করে। সাপের সামনের দিকের অংশ গাছের শাখার সাথে ঝুলে থাকে। বাতাসে ঝাঁপ দেয়ার আগমুহূর্তে সাপগুলো একটু উপর দিক করে ঝাঁপ দেয় এবং একজায়গা থেকে আরেক জায়গায় উড়ে চলে যায়। গাছের শাখা থেকে যখন সাপগুলো ঝুলে পড়ে, তখন এরা শরীরের সামনের অংশ ‘J’ আকৃতির করে ফেলে এবং এরপর উপরের দিকে ত্বরণ তৈরি করে বাতাসে ঝাঁপ দেয় [১]।
এই সাপগুলোর সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে এরা বাতাসে ভেসে থাকতে পারে। কীভাবে এরা নিজেদের ভার উত্তোলন (Lifting) করে শুধুমাত্র আঁকাবাঁকা পথ তৈরি করে সামনের দিকে এগিয়ে যায়? এই আশ্চর্য প্রক্রিয়ার ব্যাখ্যা বৈজ্ঞানিকভাবে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিজ্ঞানও এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ধাঁধার মধ্যে পড়ে গিয়েছে।
একটু সহজ করে ব্যাখ্যা দিতে হলে এই সাপের গতিপথকে কাগজের বিমানের সাথে তুলনা করা যায়। গাছের শাখা থেকে বের হয়ে সাপগুলো যখন গতিপ্রাপ্ত হয় তখন এরা একটু অন্যরকম আচরণ করে। বাতাসে এরা ‘S’ আকৃতির রূপ নেয় এবং আনুভূমিকভাবে দু’পাশে তরঙ্গায়িত হতে থাকে। গবেষণা থেকে জানা গিয়েছে, এই তরঙ্গায়িত হবার ফলে যে কম্পনের সৃষ্টি হয় সেটা ১.৩ হার্জের। অর্থাৎ এক সেকেন্ডে ১.৩ বার কম্পন সৃষ্টি হয়। এরকম হবার সাথে সাথে সাপের গতিপথ (Gliding path) ছোট হয়ে আসে। এরকম দোলন বা তরঙ্গ প্রাপ্ত হবার কারণে কোনো একভাবে সাপের নিজের ভারবহন ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। বাতাসে এই সাপগুলোর গড় গতি প্রতি সেকেন্ডে ৮ মিটার এবং নিচের দিকে নামার সময় এদের গতি হয় সেকেন্ডে ৫ মিটার। এই সাপগুলো ৩০ ডিগ্রি কোণ বরাবর গ্লাইড করে এগিয়ে যায় [২]।
উড়ন্ত সাপগুলোর গতি নিয়ে যেসব গবেষণা হয়েছে তাদের মধ্যে বেশিরভাগ গবেষণাই করা হয়েছে এর ভেসে থাকা অবস্থায় ত্রিমাত্রিক গতি নিয়ে। এ সাপগুলো নিজেদের যাত্রাপথও পরিবর্তন করতে পারে। সাপের পুরো শরীরের স্পন্দন হয় এটা আগেই বলা হয়েছে। সাপগুলোর মাথার দিক পরিবর্তনের সাথে সাথে এর শরীরের পেছনের অংশ কাত হয়ে যায় এবং দিক পরিবর্তন করে অন্য জায়গায় যায়। এই সাপের এরকম স্পন্দন বা তরঙ্গায়িত হবার বিষয়টি এখনও স্পষ্ট নয়। তবুও বিজ্ঞানীরা অনুমান করেন, এ ধরনের সাপের পেছনের ভাগে যে অবতল আকৃতির সৃষ্টি হয় সেটার বাম-ডানে গতি বা স্পন্দনের কারণে সাপের নিচের দিকের অবস্থান পরিবর্তন হয়। সাপের গতিপথের ভিডিও দেখলে বোঝা যাবে যে, আসলেই লেজের দিকের অবস্থান বাম এবং ডান দিকে পরিবর্তন হয়। বিজ্ঞানীরা অনুমান করেন, যদি শরীরের পেছনের অংশ একটু কাত হয়ে একবার বামে এবং একবার ডানে যায়, তাহলে সাপের নিজস্ব ভারোত্তোলন ক্ষমতা বেড়ে যায়, অর্থাৎ শরীরের লিফটিং কাজ করে বেশী [৩]।
মেরুদণ্ডী প্রাণীদের মধ্যে কিছু কিছু প্রাণী আছে যারা নিজেদের পাখনা ব্যবহার করে উড়তে পারে, যেমন উড়ন্ত কাঠবিড়ালী। কিন্তু উড়ন্ত সাপের ক্ষেত্রে নিজের ভার উত্তোলন করে বাতাসে ভেসে চলাচল করার কোনো মাধ্যম নেই। বাতাসের ভিতর দিয়ে একস্থান থেকে অন্যস্থানে যাতায়াত করা মাটির উপর দিয়ে চলাচল করার থেকে অনেক বেশী জটিল। কারণ বাতাসে পাখা ছাড়া ওড়ার কারণে নিজেকে গ্লাইডিং করতে হয় এবং সাপের শরীর বেঁকে গিয়ে পার্শ্বীয় তরঙ্গ সৃষ্টি করে। সাথে সাথে বাতাসে অবতল আকৃতিও বজায় রাখতে হয়। এ দুটি কাজ একসাথে কোনো সাপ করতে পারে কিনা জানা নেই। হয়তো এ দুটি কাজ একসাথে করার জন্য কোনো বিশেষ স্নায়বিক পেশীর নিয়ন্ত্রণের দরকার পড়ে।
বাতাসে ভেসে চলাচল করা প্রাণীদের মধ্যে শিকার ধরে নিজের খাদ্য সংস্থান করে এমন, জানা মতে, Chrysopelea paradise অর্থাৎ উড়ন্ত সাপ এবং Draco নামক লিজার্ড। ভেসে চলাচলের ক্ষেত্রে অনেক গবেষক ড্রাকোকে বেশী দক্ষ বলে মনে করেন। কিন্তু উড়ন্ত সাপগুলো দ্রুতগতিতে ভেসে চলতে পারে। ড্রাকো দিক পরিবর্তন করলে এর গতি অনেকখানি কমে যায়, কিন্তু উড়ন্ত সাপের ক্ষেত্রে এমনটি হয় না।
তবে কিছু কিছু বিষয়ের সমাধান এবং উত্তর এখনও জানা যায়নি, যেমন উড়ন্ত সাপগুলোর বাতাসে ঝাঁপ দেয়ার ধরন দেখলে বোঝা যাবে অনেকটা বিশৃঙ্খল এবং আকস্মিকভাবে এরা লাফ দেয়। এরকম লাফ দেয়াটা শুধু যে শিকার দেখা দিলেই হয় তা কিন্তু না, সবসময়ই। এর পেছনে কী কারণ এবং প্রভাবক কাজ করে তা বিজ্ঞানীরা এখনও জানতে পারেন নি। উড়ন্ত সাপগুলো বিভিন্ন সময়ে নিজেদের শরীরকে বিভিন্ন লুপ আকৃতির তৈরি করে এরপর লাফ দেয়। সাপের এরকম লাফিয়ে ভেসে যাওয়ার মধ্যে দুটি গতি থাকে। একটি হচ্ছে আনুভূমিক গতি, অপরটি হচ্ছে উলম্ব গতি। এই দুই গতির ধরন কী এক নাকি আলাদা সেটা এখনও জানা যায়নি। সাপের লাফ দেয়ার পেছনে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হিসেবে ধরা হয় গাছের শাখাগুলোকে। এই শাখাগুলোর দৈর্ঘ্য, ব্যাস, আকৃতি, নমনীয়তা সাপের উড়ে যাওয়াতে কতটুকু প্রভাব বিস্তার করে সেটিও একটি গবেষণার বিষয়।
এ বিষয়গুলো সম্পর্কে জানতে পারলে আমাদের পরিবেশের বাস্তুসংস্থানের নতুন এবং অজানা কোনো দিক সম্পর্কে আমরা জানতে পারবো। বিশেষ করে সাপের ডানা ছাড়া উড়ে যাবার কৌশল আরও বিস্তারিতভাবে জানতে পারলে বায়ুগতিবিদ্যাতে এর কলাকৌশল নিয়ে নতুন দিক তৈরি হবে [৪]।
তথ্যসূত্র
[১] Holden, D., Socha, J.J., Cardwell, N.D, and Vlachos, P.P. (2014). Aerodynamics of the flying snake Chrysopelea paradisi: how a bluff body cross-sectional shape contributes to gliding performance. The Journal of Experimental Biology, 2014, pp.382-394.
[২] Walker, J. (2007). The Flying Circus of Physics, John Wiley & Sons, Inc.
[৩] Socha, J. J. (2002). Gliding flight in the paradise tree snake,” Nature, 418, 603-604.
[৪] Socha, J.J. (2006) Becoming airborne without legs: the kinematics of take-off in a flying snake, Chrysopelea paradise. The Journal fo Experimental Biology, 209, pp. 3357-3369.
ফিচার ইমেজ: ABC.net.au