মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সির সঙ্গে দুধের কী সম্পর্ক?

আমরা পৃথিবীর বাসিন্দারা ‘মিল্কি ওয়ে’ নামে একটি গ্যালাক্সির অংশ। পৃথিবী সহ সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহদের নিয়ে এই গ্যালাক্সিকে আবর্তন করছে সূর্য। শহর থেকে দূরে গ্রামের দূষণমুক্ত আকাশে একটু লক্ষ্য করলে মিল্কি ওয়ের দেখা পাওয়া যাবে। চাঁদ উঠেনি কিংবা উঠলেও উজ্জ্বলতা একদমই অল্প, এরকম কোনো রাতে লক্ষ্য করলে আকাশের এ মাথা থেকে ও’ মাথা পর্যন্ত বিস্তৃত একটি প্রণালী দেখা যাবে। মনে হবে, অনেকগুলো তারার লম্বা একটি লাইন। আর এই লাইনের তারাগুলোর উজ্জ্বলতাও বেশি। মনে হবে, পুরো আকাশকেই ঘিরে রেখেছে এই লাইন বা প্রণালীটি। এটিই মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সি। আরো সঠিকভাবে বলা যায়, মিল্কি ওয়ের অংশবিশেষ। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে গ্যালাক্সির এরকম নাম কেন? খাবারের নামে গ্যালাক্সির নাম কেন হলো? আর এত কিছু থাকতে সেখানে মিল্ক বা দুধই বা কেন আসলো?

গ্যালাক্সির নাম সাধারণত এরকম হয় না। নতুন নতুন যত গ্যালাক্সি, নক্ষত্র ও গ্রহ আবিষ্কৃত হয়, সেগুলো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে নামকরণ করা হয়। তবে কিছু কিছু গ্যালাক্সি বা নাক্ষত্রিক বস্তু আছে, যেগুলো প্রাচীনকালের মানুষেরাও আলাদাভাবে শনাক্ত করতে পেরেছিল। গ্যালাক্সি যে আসলে অনেকগুলো নক্ষত্রের সমাহার, তারা হয়তো সেটি জানতো না। কিন্তু এগুলো যে আকাশের অন্যান্য সাধারণ তারা থেকে আলাদা, সেটি তারা ঠিকই বুঝতে পেরেছিল। আকাশে বসবাসকারী বিশেষ বিশেষ এই বস্তুগুলোকে তারা আলাদা আলাদা নাম দিয়েছিল।

দৃষ্টিনন্দন ওয়ার্লপুল গ্যালাক্সি। আকাশলোকের এরকম বিশেষ কিছু বস্তুকে প্রাচীন মানুষেরা আলাদা আলাদা নাম দিয়েছিল; source: My Astrology Book

আকাশের এসব বস্তুকে তারা দেব-দেবী বলে মনে করতো এবং সে অনুসারে নাম প্রদান করতো। আমরা যে গ্রহটিকে ‘শুক্র’ গ্রহ বলে জানি সেটি ছিল প্রেম ও সৌন্দর্যের দেবী ভেনাসের নামে। এন্ড্রোমিডা নামে একটি গ্যালাক্সি আছে, যার নামকরণ হয়েছিল গ্রীক পুরাণের দেবীর নামে। বৈজ্ঞানিকভাবে এন্ড্রোমিডা গ্যালাক্সির নাম হচ্ছে M31। তেমনই মিল্কি ওয়ের নামও এসেছে পৌরাণিক কাহিনী থেকে।

গ্রীক পুরাণে দেবতাদের রাজা হচ্ছে জিউস এবং তার স্ত্রী হচ্ছে হেরা। হেরার অজান্তে দেবরাজ জিউস সম্পর্ক গড়ে তোলেন মর্ত্যের এক নারীর সাথে। সে নারীর গর্ভে জন্ম নেয় একটি ছেলে সন্তান। এই সন্তানটি অনেক বিখ্যাত, নাম হারকিউলিস। আকাশের দেব-দেবীরা অমর, আর মর্ত্যের মানুষেরা মরণশীল। পিতা অমর ও দেবতা অন্যদিকে মাতা মরণশীল ও সাধারণ মানুষ, এই দোটানায় হারকিউলিস না হয়েছে অমর, না হয়েছে মরণশীল; না হয়েছে মানুষ, না হয়েছে দেবতা। সে পড়ে গেছে মাঝামাঝিতে।

শিশু হারকিউলিসের মূর্তি; source: উইকিমিডিয়া কমন্স/Marie-Lan Nguyen (2006)

তবে জানা গেল, পুরোপুরি দেবতা ও অমর হবার জন্য একটা রাস্তা খোলা আছে। হারকিউলিসকে যদি আকাশলোকের দেবী হেরার মাতৃত্ব দেয়া হয় এবং তার দুধ খাওয়ানো হয়, তাহলে সে অমর হতে পারবে এবং দেবতার সম্মান লাভ করতে পারবে। সেজন্য দেবরাজ জিউস তার সন্তানকে নিয়ে এলেন আকাশলোকে। কিন্তু বেঁকে বসলেন জিউসের স্ত্রী দেবী হেরা। তার সাথে প্রতারণা করে মর্ত্যের মানুষের সাথে যে সন্তানের জন্ম দিয়েছেন জিউস, তাকে তিনি নিজের দুধ খাওয়াবেন না কোনোক্রমেই।

উপায় না দেখে জিউস অন্য পন্থার কথা ভাবলেন। হেরা যখন ঘুমিয়ে থাকবে তখন সুযোগ বুঝে দুধ খাইয়ে নেবেন হারকিউলিসকে। ঘুমন্ত অবস্থান যখন দুধ খাওয়াতে গেলেন, তখন এক পর্যায়ে হেরা জেগে উঠলেন এবং শিশু হারকিউলিসের কাছ থেকে দ্রুত নিজের স্তন ছাড়িয়ে নিলেন। তড়িঘড়ি করার কারণে ছাড়িয়ে নেবার মুহূর্তে স্তন হতে কিছু পরিমাণ দুধ ছিটকে গিয়ে সমস্ত আকাশে ছড়িয়ে পড়ল।

বড় একটি আধারে দুধ রেখে যদি তাতে ছোট একটি ছিদ্র করা হয়, তাহলে ছিদ্র দিয়ে লম্বা একটি ধারায় দুধ পড়তে থাকবে। ছোট ছোট দুগ্ধকণা ছড়িয়ে গিয়ে একটি শ্বেত-শুভ্র প্রণালী তৈরি করবে। ঠিক এরকমই হয়েছিল দেবী হেরার স্তন থেকে নির্গত দুধের বেলায়। শ্বেত-শুভ্র দুগ্ধ তিরতির করে ছড়িয়ে আকাশের এ মাথা থেকে ও’ মাথাব্যাপী লম্বা একটি প্রণালী তৈরি করে। দুধ থেকে সৃষ্ট এই প্রণালী বা রাস্তাকেই তখনকার মানুষ নাম দিয়েছিল ‘দুগ্ধ প্রণালী’ বা ‘মিল্কি ওয়ে’।

মিল্কি ওয়ে নামটি এসেছে রোমান শব্দ থেকে। রোমানরা এই গ্যালাক্সির নাম দিয়েছিল ভায়া লেকটা (Via Lactea)। এর অর্থ হচ্ছে দুধের রাস্তা (Road of milk)। তবে রোমানরাই প্রথম নয় যারা এরকম নাম দিয়েছিল। রোমানরা এই শব্দটি পায় গ্রীক শব্দ Galaxias Kyklos থেক। এর অর্থ হচ্ছে দুগ্ধময় বৃত্ত (Milky Circle)।

এদিক থেকে বিবেচনা করলে ‘গ্যালাক্সি’ ও ‘মিল্কি ওয়ে’ শব্দ দুটি একই অর্থ বহন করে। যদিও মিল্কি ওয়ে হচ্ছে কোটি কোটি গ্যালাক্সির মাঝে একটি। বাস্তবেও মানুষ মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সিকে শুধুমাত্র ‘গ্যালাক্সি’ বলে ডাকে। এমনকি জ্যোতির্বিজ্ঞানের বড় বড় লেখকেরাও আমাদের গ্যালাক্সিকে শুধুমাত্র ‘গ্যালাক্সি’ বলে ডাকেন। যেমন বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলামও তার বই The Ultimate Fate of the Universe-এ আমাদের মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সিকে শুধু গ্যালাক্সি বলে ডেকেছেন।

মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সির জন্য এরকম কাহিনী কল্পনা করে নেয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ এটি দেখতে আসলেই বেশ উজ্জ্বল, দুধের মতো শুভ্র। প্রণালীও অনেক লম্বা। মিল্কি ওয়ের মতো আরো ৭/৮টি গ্যালাক্সি আছে যাদের নাম এমন ব্যতিক্রমী ধরনের।

দুগ্ধময় বৃত্ত আমাদের এই গ্যালাক্সি; source: EarthSky

একেক এলাকায় মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সির একেক নাম। কারণ সারা পৃথিবী থেকেই এটি দেখা যায়। তাই পরস্পর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন আলাদা আলাদা এলাকার মানুষ আলাদা আলাদা নামকরণ করবে এটাই স্বাভাবিক। ভারতবর্ষে এই গ্যালাক্সিটির নাম ‘আকাশ গঙ্গা’। প্রাচীন ভারতের আকাশ পর্যবেক্ষকদের কাছে এটিকে নদীর ধারার মতো মনে হয়েছিল। তাদের বিশ্বাস অনুসারে গঙ্গা একইসাথে মর্ত্যলোকে এবং আকাশলোকে বিরাজমান। আকাশের ‘আকাশ গঙ্গা’ আর ভূমির ‘গঙ্গা’ একই ধারায় প্রবাহিত। সেজন্যই গঙ্গা নদীকে অনেক সম্মান করা হয় সনাতন ধর্মে।

আকাশের প্রণালী ও মর্ত্যের প্রণালী একই ধারায় প্রবাহিত; source: quotev.com

যে অংশটি দেখে মিল্কি ওয়ের নামকরণ করা হয়েছিল, সেটি আসলে পুরোপুরি মিল্কি ওয়ে না। ছোট একটি অংশ মাত্র। মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সি সর্পিলাকার। এর ব্যাস প্রায় এক লক্ষ আলোক বর্ষ। কেউ যদি দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা কোনো প্রকার বিরতি না দিয়ে প্রতি সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিলোমিটার করে ভ্রমণ করে, তাহলে মিল্কি ওয়ের এ মাথা হতে ও’ মাথায় যেতে এক লক্ষ বছর লেগে যাবে!

মিল্কি ওয়ের সর্পিল আকৃতি; source: শাটারস্টক

মিল্কি ওয়েতে কম করে হলেও ১০০ বিলিয়ন নক্ষত্র আছে। ধারণা করা হয়, এখানে ৪০০ বিলিয়ন পরিমাণ নক্ষত্রও থাকতে পারে। এই গ্যালাক্সির মূল সর্পিল আকৃতি আর বিস্তৃতির পরিমাণ সম্বন্ধে যদি তখনকার মানুষ জানতো, তাহলে এর নাম মনে হয় না কখনো ‘মিল্কি ওয়ে’ রাখতো।

ফিচার ছবি: w-dog.net

Related Articles

Exit mobile version