বলপয়েন্ট কলম আসার আগে বাংলার বিখ্যাত সব লেখকের কালজয়ী সাহিত্যকর্মগুলোর সঙ্গী ছিল ফাউন্টেন পেন, যার আরেক নাম ঝর্ণা কলম। আমজনতা দোয়াত-নিবের কলম ব্যবহার করলেও অভিজাতরা দৈনন্দিন প্রয়োজনে ব্যবহার করতেন সেকালের নামীদামী সব ফাউন্টেন পেন। ভিস্কন্টি, মন্টব্লাঙ্ক, সেফার, ওয়াটারম্যান কিংবা পার্কার- এই নামগুলো ছিল তখন একরকম আভিজাত্যের প্রতীক।
এখন দিন বদলেছে। ফাউন্টেন পেন এখন কিংবদন্তিতে রূপ নেওয়ার উপক্রম হয়েছে। একসময় যা ছিল আভিজাত্যের প্রতীক, এখন তা কেবলই স্মৃতি। তবে হ্যাঁ, পুরোপুরি হারিয়ে এখনো যায়নি। এখনও কিছু মানুষের ‘রাজকীয় শখ’ রয়ে গেছে, নামীদামী পুরনো বা নতুন ফাউন্টেন পেন সংগ্রহ করাই তাদের নেশা।
এই শখই প্রমাণ করে, এখনও ঝর্ণা কলমের আবেদন পুরোপুরি ফিকে হয়ে যায়নি। নতুন প্রজন্মের কাছে যথাযথ ও পরিপূর্ণভাবে এর ইতিহাস, ব্যবহার ও প্রচলন করলে এখনও ফাউন্টেন পেন তথা আমাদের লেখালেখির ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখা সম্ভব। আর ফাউন্টেন পেন সংগ্রহকারী ও নতুন প্রজন্মের মধ্যে মেলবন্ধন তৈরির এই চমৎকার কাজটি করে যাচ্ছে ‘ফাউন্টেন পেনস বাংলাদেশ’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। তাদের মূল উদ্দেশ্য ফাউন্টেন পেনের সাথে বর্তমান প্রজন্মকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। আন্তর্জাতিক ফাউন্টেন পেন কমিউনিটি ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ইভেন্টে অংশগ্রহণের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বাংলাদেশকে তুলে ধরতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এই প্রতিষ্ঠানটি। নিয়মিত পেন মিটিংয়ের মাধ্যমে ফাউন্টেন পেন সংগ্রাহকদের সাথে আগ্রহীদের অভিজ্ঞতা বিনিময়ের সুযোগ করে দেওয়ার মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ফাউন্টেন পেনের জনপ্রিয়তা বহুলাংশে বৃদ্ধি করেছে তারা, যার ফলস্বরূপ তরুণ প্রজন্মের কাছে ফাউন্টেন পেন সংগ্রহ বেশ আকর্ষণীয় একটি ট্রেন্ড এখন।
অল্প ক’জন শৌখিন মানুষ নিয়ে তৈরি হওয়া প্রতিষ্ঠানটির সদস্য এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাড়ে ছ’হাজার ছাড়িয়ে গেছে। ব্যাপকভাবে ফাউন্টেন পেনকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি ও প্রতিযোগিতারও আয়োজন করে ফাউন্টেন পেনস বাংলাদেশ। সম্প্রতি যার মধ্যে ছিল গত ফেব্রুয়ারি মাসে হয়ে যাওয়া ‘পাইলট হ্যান্ড রাইটিং কম্পিটিশন -২০২১’, অংশ নেওয়া প্রতিযোগীরা পরিচিত হতে পেরেছেন হরেক রকমের ঝর্ণা কলম ও চমৎকার সব ঝর্ণা কলমের সংগ্রাহকদের সাথে। এসব বিষয়ে কথা হয়েছিল ফাউন্টেন পেনস বাংলাদেশের কিছু সম্মানিত সদস্যদের সঙ্গে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সিদ্ধার্থ গৌতম বলেন, “ফাউন্টেন পেনস বাংলাদেশ মূলত কাগজে কলমে লিখিয়েদের একটি সংগঠন। যারা চমৎকার করে লিখতে চায় এবং তা নিয়ে আসতে চায় সবার সামনে এ সংগঠন তাদের স্বাগত জানায়। এ সংগঠন আয়োজিত ‘পাইলট হ্যান্ড রাইটিং কম্পিটিশন’ প্রতিযোগিতার মূল লক্ষ্য হাতের লেখাকে আরও সুন্দর করে একটা শিল্পীত আভা ছড়ানো। সেই সঙ্গে এই সংগঠন আরও একটি বিষয়কে উৎসাহিত করে, তা হলো, ফাউন্টেন পেনের ব্যবহার।”
সিলেটের এম.সি. কলেজের গণিত বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন তাঁর অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন এভাবে, “২০১১ সালের বিবিসির একটা জরিপে দেখেছি আমাজনে ফাউন্টেন পেন বিক্রি ২০১০ এর তুলনায় দ্বিগুণ বেড়েছে। বাজারে ভাল কলমের ছড়াছড়ি, অনেক সময় দেখি দাম নাগাল ছাড়ানো। যাঁরা এ ভালবাসায় জড়িয়ে আছেন, যেমন- বিডি পেনস, পেন গ্যালাক্সি বিডি, কালি’র দোয়াত, তাঁরা সাশ্রয়ের দিকটা নোটিশ করলে ফাউন্টেন পেনের ব্যবহারকারি বাড়বে। আমি পাইলট ট্যাঙ্ক নামের একটা ফাউন্টেনপেন দিয়ে ভীষণ স্বাচ্ছন্দে লিখছি, মেট্রোপলিটনটাও লিখছে বেশ। তিনটে পারকার, একটা করে সেইলর, শেফার, হাংডিয়ান, ল্যামি স্টুডিও, হিরো কলম আছে আমার, আমি সবক’টাতেই লিখে সপ্তাহ পার করি।”
একটি স্বনামধন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, তানভীর হোসেন, যিনি একইসাথে একজন মাস্টার ক্যালিগ্রাফার বটে, তিনি জানান, “ফাউন্টেন পেনের কালির নতুন ব্যবহার খুঁজে পাই আমি ক্যালিগ্রাফিতে আর এটা আমার জন্য একধরনের মুক্তির আনন্দ বয়ে আনে। ক্যালিগ্রাফি শেখার সময়টা আমার একধরনের একান্ত ব্যক্তিগত সময় অথবা হবিও বলা যায়। উপলব্ধি করি যে জীবনের একটা বড় সময় চলে গিয়েছে পড়াশোনা আর জীবন গড়ার ব্যস্ততায়, জীবন কেটেছে “লেখাপড়া করে যে, গাড়িঘোড়া চড়ে সে” ধরনের কথা শুনে। কিন্তু এখন মাঝেমাঝেই মনে হয় নিজের মনের শান্তির জন্য কিছু সময় বের করতে হবে। এসব মিলিয়েই আমার ক্যালিগ্রাফি শেখার গল্প। এদিকে ফেসবুকে ফাউন্টেন পেন গ্রুপগুলিতে অনেকেই আমার কাজ দেখে খুব প্রশংসা করেন, এতে ভীষণ ভালো লাগে, আগ্রহ আরো অনেক বেড়ে যায়।”
এসবের পিছনে একজনের নাম না বললেই নয়। তিনি বিডি পেনস এবং ফাউন্টেন পেনস বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা জনাব আতিকুর রহমান, নিভৃতে থেকে যিনি দেখাশোনা করেন এই সমস্ত আয়োজনের। তার মুখ থেকেই শোনা যাক বিডি পেনস প্রতিষ্ঠার পেছনের কারণ, “দীর্ঘদিন বাংলাদেশের বাজারে মানসম্পন্ন কলম, কালি বা কাগজ পাওয়া যেত না। বাজার ছেয়ে গিয়েছিল নিম্নমানের ও নকল পণ্যে। এতে পুরাতন হবিস্টরা আগ্রহ হারাচ্ছিলেন, আর নতুন প্রজন্মকে আমরা বঞ্চিত করছিলাম। বিডি পেনস এর প্রতিষ্ঠা করা হয় একটি নতুন বিপ্লবের উদ্দেশ্যে। বাংলাদেশে ফাউন্টেন পেনের পুনর্জাগরণের বিপ্লব।”
বাংলাদেশে এলিগ্যান্ট স্টেশনারির নতুন মার্কেট তৈরি হচ্ছে। আমরা পাচ্ছি সফল তরুণ উদ্যোক্তা ও উদ্যোগ। ঝর্ণা কলম, কালি, কাগজ এবং অন্যান্য এলিগ্যান্ট স্টেশনারির জন্য বাংলাদেশের প্রথম এবং সবচেয়ে বড় মার্কেটপ্লেস বিডি পেনস। বাংলাদেশে তারা পাইলট, ডায়ামিন ইঙ্ক, কাভেকো পেনস এর অথোরাইজড ডিস্ট্রিবিউটর। রোডিয়া, ল্যামি এবং পার্কার (ফ্রান্স) এর অথোরাইজড রিটেইলার। তাদের ওয়েবসাইট বিডি পেনস ডট কম (www.bdpens.com) থেকে দেশের সকল প্রান্তের কলমপ্রেমী পছন্দমতো কলম/স্টেশনারি অর্ডার করে পেয়ে যাচ্ছেন খুবই সহজে এবং দ্রুত।
একজন সত্যিকারের উৎসাহী হিসেবে ফাউন্টেন পেনের প্রতি ভালোবাসা এবং নির্ভরযোগ্য উপকরণের অভাব থেকেই ২০১৮ সালে পেন গ্যালাক্সি বিডি নামের একটি অনলাইন পেজ খোলার সিদ্ধান্ত নেন জিয়াউল আসিফ চৌধুরী। আর কারও কোনো ধরনের সহায়তা ছাড়াই তৈরি এই পেজ স্রেফ শখের জায়গা থেকে এখন পরিণত হয়েছে অনলাইন ব্যবসায়। এখন তারা বাংলাদেশে আমদানী করছে রোডিয়া, ল্যামি ও পার্কারের মত বড় তিন ব্র্যান্ডের ফাউন্টেন পেন।
স্রেফ সাধারণ কলম নয়; অনেকের পছন্দই হলো নিজের পছন্দের ডিজাইনের বা ব্র্যান্ডের কলম। কিন্তু দুষ্প্রাপ্যতা বা বিশ্বাসযোগ্যতার সমস্যার কারণে চাইলেও সম্ভব হয় না এই শখ পূরণের। এ সমস্যা সমাধানে এগিয়ে এসেছে ‘কালির দোয়াত’। ৬০০ জন সমমনা ফাউন্টেন পেন অনুরাগী নিয়ে করোনা মহামারির ভেতরেই যাত্রা শুরু করা এই ফেসবুক গ্রুপের চেষ্টা, যে ব্র্যান্ডগুলো বাংলাদেশে সচরাচর পাওয়া যায় না এবং যাদের এখনো বিশ্বস্ত ডিস্ট্রিবিউটর নেই, তা সব রকম বাজেটের ক্রেতার নিজস্ব পছন্দ অনুযায়ী কাস্টমাইজ করে নিয়ে আসার। দিনশেষে এর লক্ষ্য ফাউন্টেন পেন সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য, রিভিউ আলোচনা, ক্যালিগ্রাফি, সুন্দর হাতের লেখা, ফাউন্টেন পেন ফটোগ্রাফি ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়ে অভিজ্ঞ এবং নতুনদের মাঝে মেলবন্ধন গড়ে তোলা।
পৃথিবীর সবচেয়ে নামকরা কলমের ব্র্যান্ডগুলোর মাঝে অন্যতম হলো পাইলট। বাংলাদেশীদের ভালো কলমের প্রতি আগ্রহ দেখে, জাপানে তৈরি এই পাইলট কলম বাংলাদেশেও এসেছে অনেকদিন। বর্তমানে আমাদের কলমপ্রেমীদের খুবই পছন্দের এই ব্র্যান্ড ব্যাবহার করা হয় সকল সরকারি দপ্তরেও। গেল ফেব্রুয়ারিতে হয়ে যাওয়া ‘পাইলট হ্যান্ড রাইটিং কম্পিটিশন -২০২১’ এর স্পন্সরশিপ বহনও করেছে পাইলট কোম্পানিই।
বলপয়েন্ট-টাইপিং এর যুগে ফাউন্টেন পেন স্বচক্ষে দেখেছে, এমন মানুষ পাওয়াই দুষ্কর হয়ে যাচ্ছে। অথচ দুই প্রজন্ম আগেও ফাউন্টেন পেনের আবেদন ছিল আকাশছোঁয়া। সেই আবেদন এখন আবেগপূর্ণ স্মৃতি। শৈশব, কৈশোর, যৌবন বা বার্ধক্যের স্মৃতি। নিজের সাথে নিজের স্মৃতি।
ফাউন্টেন পেনের চল আবার ফিরে আসুক। স্রেফ স্মৃতির পাতায় না থেকে ঘরে ঘরে চলুক কালির ঝর্ণা, ঝরঝরে মুক্তোর মতো লেখাতে ভরে উঠুক খাতার পাতা আর নোটবুক। ইতিহাসের অংশ হতে চায় সবাই-ই, আর ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে রাখতে ফাউন্টেন পেনের চেয়ে ভালো কী হতে পারে!