আজকের আধুনিক সময়ে এসে যদি প্রশ্ন করা হয়, মানবসভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন কোনটি? সেক্ষেত্রে কী হবে আপনার উত্তর? আপনি হয়তো ভাবতে বসবেন, কম্পিউটার নাকি মোবাইল- কোনটিকে এগিয়ে রাখা যায়। কিংবা আরেকটু এগিয়ে গিয়ে আপনি হয়তো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কিংবা ভার্চুয়াল রিয়েলিটির কথাও ভাবতে পারেন।
কিন্তু না, এগুলো হয়তো দূর ভবিষ্যতে কোনো এক সময় মানবসভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন হিসেবে বিবেচিত হবে। তবে এখন পর্যন্ত, এই ২০১৯ সালে দাঁড়িয়েও, যেই উদ্ভাবনটিকে শীর্ষস্থানে রাখতেই হবে, তা হলো চাকা।
তবে এত কিছু থাকতে চাকা কেন? কারণ- চাকাই হলো সেই জিনিস, যা মানুষের মন্থর জীবনে প্রথম সত্যিকারের গতি সঞ্চার করেছে। একটা সময় পর্যন্ত মানুষের বিচরণক্ষেত্র ছিল খুবই সীমিত। খুব দূরে কোথাও যাওয়া, নতুন কোনো দেশ আবিষ্কার করা, কিংবা নতুন কোনো সম্প্রদায়ের সাথে মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে নিজেদেরকে আরও সমৃদ্ধ করার উপায় অনেকদিন তাদের ছিল না। চাকার মাধ্যমে তাদের সেই অপূর্ণতা দূর হয়। আর আজ মানুষ খুব কম সময়ের মধ্যেই কোনো দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে, এমনকি বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যেতে পারছে। ‘ট্রাক লাগবে’র মতো আধুনিক অ্যাপ দিয়ে এখন মানুষ ঘরে বসে ডেকে নিতে পারে বিশাল সব ট্রাকের মতো চাকানির্ভর গাড়ি। চাকার কল্যাণেই মানুষ নিজেদের বিচরণক্ষেত্রের সীমারেখাকে বিস্তৃত করতে পেরেছে, নিজেদের সীমাবদ্ধতাকে ছুটি দিতে পেরেছে। চাকাই মানুষকে মন্ত্রণা জুগিয়েছে যে, সে-ই এই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অধিবাসী, কোথাও তার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা।
চাকা জিনিসটি কী, তা বোধহয় নতুন করে কাউকে আর বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন নেই। চাকা হলো যানবাহনে ব্যবহৃত সেই বিশেষ বৃত্তাকার যন্ত্রাংশ, যা এর ঠিক মাঝখানে অবস্থিত অক্ষ বরাবর ঘুরতে পারে। আর এই চাকার উপর ভর করেই, যানবাহন তার জায়গা পরিবর্তন করে, মানুষকে নিয়ে যায় দূর থেকে আরও দূরে।
মানবমনের এক অদ্ভূত বৈশিষ্ট্য হলো, সহজ সমাধান ছেড়ে তারা অনেক সময় কঠিন সমাধানটা আগে খুঁজে বের করে। তাই তো চাকার মতো অতি সরল একটি জিনিস উদ্ভাবনের অনেক আগেই তারা সেলাই করার সুঁই, পানির উপর চলাচলের জন্য নৌকা কিংবা বাঁধনের জন্য দড়ির মতো জটিল জটিল সব জিনিস আবিষ্কার করে ফেলেছিল। অথচ মাটির উপর চলাচলের জন্য দীর্ঘকাল পর্যন্ত তারা কেবল বিভিন্ন রকমের জীবজন্তুর সাহায্যই নিয়ে এসেছে। চাকার মতো কিছু একটা দিয়ে যে কাজটি আরও অনেক সহজে করা সম্ভব, দীর্ঘকাল এ ধারণা কারো মাথাতেই আসেনি।
পুরাতন প্রস্তরযুগের (১৫,০০০ থেকে ৭,৫০,০০০ বছর পূর্বের) প্রায় সকল প্রজন্মের মানুষই আবিষ্কার করেছিল যে, ভারী ও গোলাকার বস্তুকে সহজেই গড়িয়ে তার জায়গার পরিবর্তন করা যায়। এই উপলব্ধি হওয়ার পরেই তারা বিভিন্ন ভারী বস্তুর নিচে গাছের গুঁড়ি দিয়ে সেগুলোকে দ্রুত এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যেত। কিন্তু যেকোনো কারণেই হোক, চাকার ব্যাপারটি বারবারই মানুষের মস্তিষ্ক থেকে পিছলে বেরিয়ে গেছে।
আরও মজার ব্যাপার হলো, শেষপর্যন্ত যদিও বা মানুষ চাকা আবিষ্কার করেছিল, কিন্তু প্রাথমিকভাবে তা যানবাহনে ব্যবহারের জন্য নয়, বরং কুমোরদের কাজে লাগানোর উদ্দেশ্যে! সেটি খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০ অব্দের কথা। আর জায়গাটি ছিল প্রাচীন মেসোপটেমিয়া। এরও ৩০০ বছর পরে, খ্রিস্টপূর্ব ৩২০০ অব্দে এই প্রাচীন মেসোপটেমিয়াতেই প্রথম ঘোড়ার গাড়ি টানার কাজে ব্যবহৃত হয়েছিল চাকা।
তবে অনেক বিশেষজ্ঞ এমনও দাবি করেন, খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০ অব্দ নয়, বরং সেই খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০ অব্দেই প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় চাকা আবিষ্কৃত হয়েছিল। এছাড়া ককেশাসের উত্তর দিকে বেশ কিছু কবর পাওয়া গেছে যাতে খ্রিস্টপূর্ব ৩৭০০ অব্দ হতে ঠেলাগাড়িতে করে মৃতদেহ কবর দেওয়ার নমুনা পাওয়া গেছে। দক্ষিণ পোল্যান্ডে এমন একটি মাটির পাত্র পাওয়া গেছে, যেখানে একটি চার চাকার গাড়ির ছবি আছে। ধারণা করা হচ্ছে, মাটির পাত্রটি হয়তো খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০ অব্দের কাছাকাছি কোনো এক সময়ই নির্মিত হয়েছিল।
ইউরোপ ও পশ্চিম এশিয়াতে চাকার ব্যবহার ছড়িয়ে পড়ে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ সহস্রাব্দের মধ্যেই। ভারতীয় উপমহাদেশের সিন্ধু সভ্যতায় চাকার ব্যবহার শুরু হয় এর পরের সহস্রাব্দে। আর চীনে চাকার ব্যবহার দেখা যায় খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ অব্দে, তখন সেখানে চাকাযুক্ত গাড়ির প্রচলন শুরু হয়। তবে চীনা ইতিহাসের গবেষক, অধ্যাপক অ্যান্থনি বারবিয়েরি-লো এর মতে আরো আগে থেকেই, সেই খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের দিক থেকেই চীনে চাকার প্রচলন ছিল।
বিস্ময়কর হলেও সত্য, যানবাহনকে দ্রুতগতিসম্পন্ন করে তুলতে চাকার কার্যকারিতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়া সত্ত্বেও, পৃথিবীর অনেক অঞ্চলের মানুষই শুরুতে চাকার যানবাহনে চড়া বা মালামাল পরিবহনে উৎসাহ দেখায়নি। যেমন- মধ্যপ্রাচ্যের মানুষেরা এজন্য উট ব্যবহার করেই বেশি খুশি ছিল। তারাও চাকা ব্যবহার করত বটে, তবে তা কুমোরের কাজ, কৃষিকাজ কিংবা ঘানি ভাঙার কাজে।
চাকার চারিদিকে লোহার বেড় পরানোর সূচনা হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ অব্দের দিকে, সেল্টিক ঘোড়ার গাড়িতে। কিন্তু সেই থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত চাকার ইতিহাসে তেমন উল্লেখযোগ্য অগ্রগতিই হয়নি। তবে ১৮০২ সালে এই খরা কাটান জি এফ বাউয়ার। তিনিই প্রথম পেটেন্ট নেন ধাতব তার সমৃদ্ধ স্পোকের। তবে আরও অনেক বছরের প্রচেষ্টার পর, গোলাকার ধাতব তারের স্পোক একটি ভদ্রস্থ পর্যায়ে পৌঁছায়। এখনো সাধারণ বাইসাইকেলে এই স্পোকের চাকাই ব্যবহৃত হয়।
ধাতব তারের স্পোকের পরবর্তী ধাপ ছিল নিউম্যাটিক টায়ার, অর্থাৎ যেসব টায়ারের ভিতরে বায়ু প্রবেশের মাধ্যমে স্ফীত করা হয়। ১৮৪৫ সালে আর ডব্লিউ থম্পসন এধরনের টায়ারের পেটেন্টের জন্য নিবন্ধন করেন। এই টায়ারকে আরও উন্নত করে তুলেন জন ডানলপ। সেসময়ে ব্যবহৃত শক্ত রাবারের বদলে তিনি তার নিজের তৈরি নিউম্যাটিক টায়ার ব্যবহার করেন এবং সেটির পেটেন্ট নেন। উনিশ শতকের শেষদিকে আন্দ্রে ও এডোয়ার্ড মিকেলিন মিলে গড়ে তোলেন বিখ্যাত টায়ার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান মিকেলিন টায়ার কোম্পানি। ১৯১০ সালে বি এফ গুডরিচ কোম্পানি রাবারের সাথে কার্বন যোগ করে, যাতে করে টায়ারের দীর্ঘস্থায়ীত্ব নিশ্চিত হয়।
১৯২৬-২৭ সালে প্রথম ইস্পাতের ঢালাই করা স্পোকের চাকা উদ্ভাবিত হয়। এরপরও চাকার অগ্রগতি অব্যহত থাকে। এবার আগমন ঘটে ডিস্ক বা চাকতির চাকার, যার সাথে একদম শুরুর দিকের শক্ত চাকার সাদৃশ্য ছিল। ইস্পাতের চাকা তৈরিতে খরচ পূর্বাপেক্ষা অনেক কম হতো বলে, চাকা শিল্পে নতুন জাগরণ সৃষ্টি হয়।
আজকাল আমরা অটোমোবাইলে মূলত দুই ধরনের চাকা দেখতে পাই: সংকর ধাতুর চাকা এবং ইস্পাতের চাকা। শুরুর দিকের অটোমোবাইলে মোটাসোটা এবং ভারী চাকা ব্যবহৃত হতো। সে তুলনায় বর্তমান সময়ের চাকা অনেক বেশি হালকা।
স্থলভাগে চলতে হলে যানবাহনের চাকা লাগবেই। তবে সব যানের চাকার সংখ্যা সমান হয় না। এক চাকার মনোসাইকেল যেমন আছে, তেমনই আছে দুই চাকার বাইসাইকেল, তিন চাকার মোপেড, রিকশা, রিকশাভ্যান ইত্যাদিও। বাসে সাধারণত ব্যবহৃত ছয় চাকা। আর ট্রাকে ১৮ চাকা পর্যন্তও ব্যবহৃত হয়! এছাড়া রেলগাড়ি, উড়োজাহাজ, নৌকা, জাহাজে তো চাকার ব্যবহার আছেই।
যাতায়াতে চাকার ব্যবহার শুরু হয়েছিল পশুটানা গাড়ি- যেমন ঘোড়ার গাড়ি ও গরুর গাড়ির মাধ্যমে। এছাড়া মানুষের হাতে ঠেলা ঠেলাগাড়িতেও ব্যবহৃত হতো চাকা। তবে চাকা সেদিন থেকেই মানুষকে আরও বেশি গতিশীল করতে করে তোলে, যেদিন থেকে মানুষ নিজ শক্তি কিংবা কোনো গৃহপালিত পশুর বদলে যন্ত্রের সাহায্যে চাকাকে ঘোরাতে শুরু করে। বর্তমানে ইঞ্জিনকেই বিবেচনা করা হয় গাড়ি, বাস, ট্রাকসহ সকল যানের মেরুদণ্ড হিসেবে। ইঞ্জিনের বদৌলতেই আধুনিক সময়ে একটি চাকার প্রতি সেকেন্ডের ঘূর্ণনের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে, আর সেই সাথে মানুষ লাভ করছে অভাবনীয় মাত্রার গতি।
চাকার কল্যাণে মানুষ সবচেয়ে বেশি আধুনিক হয়েছে যে বিশেষ ক্ষেত্রে, তা হলো পণ্য পরিবহন। উন্নত চাকা ও ইঞ্জিনের কল্যাণেই উদ্ভাবন ঘটেছে বিশাল বিশাল সব পণ্যবাহী ট্রাক, পিক-আপ, কাভার্ড ভ্যান প্রভৃতির, যার মাধ্যমে মানুষ তাদের পণ্য দ্রুততম সময়ের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছে দিতে পারছে। এভাবেই মানুষ ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রভূত উন্নতি থেকে শুরু করে বাসা-বদলের ঝক্কি-ঝামেলা পর্যন্ত কমিয়ে ফেলছে সহজে। চাকায় ভর করে অল্প সময়ের মধ্যে নির্দিষ্ট ঠিকানায় পৌঁছে যাওয়ায় কৃষিজাত খাদ্যসামগ্রীও থাকছে টাটকা ও তরতাজা।
চাকার বদৌলতে মানুষের জীবনকে সহজ করে দিতে বিশাল বিশাল সব যানের আগমন ঘটেছে ঠিকই, কিন্তু আমাদের দেশে এখনো রয়ে গেছে যথাযথ ব্যবস্থাপনার অভাব। তাই বাসা-বদল কিংবা বাণিজ্যিক প্রয়োজনে ট্রাক খুঁজতে গিয়ে অনেকেরই হয় নাজেহাল অবস্থা। অনেকেই হয়তো জানেন না, সেই ঝামেলা থেকে পরিত্রাণের সহজ একটি সমাধান এখন আমাদের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। আপনাকে স্রেফ ইনস্টল করে নিতে হবে ‘ট্রাক লাগবে‘ নামের একটি অ্যাপ। আর এটি দিয়েই দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে ঘরে বসে স্মার্টফোনের মাধ্যমে পিক-আপ, কাভার্ড ভ্যান কিংবা খোলা ট্রাক ভাড়া করতে পারবেন আপনি। ট্রাক মালিকরাও এই অ্যাপ দিয়ে হতে পারবেন দারুণ লাভবান, কেননা অন্য কাজ করে ফিরতি পথেও ভর্তি থাকবে তাদের ট্রাক।
সে যা-ই হোক, চাকা ছাড়া কি আর আধুনিক সভ্যতার কথা কল্পনা করা যায়? সবধরনের যানবাহনেই কোনো না কোনো ধরনের চাকার উপস্থিতি থাকে। তাই চাকা যদি না থাকত, তাহলে বর্তমান সভ্যতা হয়তো থমকে যেত।
একবার কল্পনা করে দেখুন, চাকা না থাকলে বর্তমান পৃথিবীর চিত্র ঠিক কেমন হতো। মানুষজন উন্নত যানবাহনে চেপে দূর-দূরান্তে, দেশে-বিদেশে ঘুরে বেড়াতে পারত না। পাশাপাশি ভারী মালামাল দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পৌঁছে দেয়াও হয়ে পড়ত অসম্ভব ব্যাপার। ফলে আধুনিক সভ্যতার প্রধান যে দুইটি বৈশিষ্ট্য, অর্থাৎ নগরায়ন ও শিল্পায়ন, দুই-ই মুখ থুবড়ে পড়ত। তাই চাকার কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। অদূর ভবিষ্যতে আরও যত উন্নত প্রযুক্তিই আসুক না কেন, নিঃসন্দেহে চাকা আবিষ্কারের ইতিহাস তার শ্রেষ্ঠত্ব অক্ষুণ্ন রাখতে পারবে। কারণ, মানবসভ্যতার বিকাশে চাকা কখনোই বিলাসিতা ছিল না, এটি ছিল একটি বিকল্পহীন প্রয়োজনীয়তা, এবং এখন সেই প্রয়োজনীয়তা অন্য যেকোনো সময়ের চেয়েও হাজারগুণ বেশি।