মনের ভাব সূক্ষ্মতমভাবে প্রকাশের ক্ষেত্রে লেখার বিকল্প নেই। কিন্তু এই লেখার কাজটি মানুষ শুরু করেছিল কীভাবে? মানুষ যখন থেকে ভাব আর চিন্তাকে প্রকাশ করতে শিখেছে, তখন থেকেই সেগুলো প্রকাশের জন্য নানান ধরনের কৌশল অবলম্বন করেছে। সর্বপ্রথম মানুষ লেখার প্রচলন শুরু করে নিজের হাতের আঙুল ব্যবহার করে। তারপর ধীরে ধীরে কাঠ কিংবা শক্ত কোনো হাতিয়ার দিয়ে তারা লিখতে থাকে।
মধ্যযুগের দিকে পাখির পালকের নিচের অংশ ফালি করে তা চেঁছে তীক্ষ্ণ করে লেখার কাজে ব্যবহার করা শুরু হয়। এধরনের কলমকে বলা হয় কুইল পেন। আঠারো শতকের দিকে স্টিল ডিপিং পেনের উদ্ভব ঘটলে কুইল পেনের প্রচলন কমে যায়, কেননা স্টিল ডিপিং পেনকে বারবার চেঁছে তীক্ষ্ণ করতে হতো না। যদিও স্টিল ডিপিং পেন এবং কুইল পেন উভয় কলমেরই আলাদা কালির দোয়াতের প্রয়োজন হতো।
এই আলাদা কালির দোয়াতের সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে নিউ ইয়র্কের ইনস্যুরেন্স এজেন্ট লুইস এডসন ওয়াটারম্যান ১৮৮৪ সালে নিয়ে আসেন প্রথম বাণিজ্যিক ও ব্যবহারিক ফাউন্টেন পেন। ফাউন্টেন পেনের প্রধানতম সুবিধাজনক বৈশিষ্ট্য হলো, এতে কালি ধরে রাখার জন্য নিজস্ব কন্টেইনার আছে। তাই লেখার সময় একে বারবার কালির দোয়াতে ডুবিয়ে কালি নিতে হতো না। এই কলমের গঠন প্রকৃতি ছিল অন্য কলমগুলো থেকে ভিন্ন। এতে পিতলের নিব প্লাস্টিকের ছোট্ট ছাঁচে আটকানো থাকে। নিবের প্রথম অংশ একটু কাটা থাকে এবং মাঝে একটি ছিদ্র থাকে যেখান দিয়ে কালি বের হয়। কলমের সামনের প্যাঁচ দেওয়া অংশের পরের অংশেই থাকে কালির রিজার্ভার। সেখানেই জমা থাকে লেখার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে কালি। শেষ হয়ে গেলে আবার তা পূর্ণ করে নিতে হয়।
ফাউন্টেন পেনের আদিরূপের আবিষ্কারক হিসেবে অবশ্য কৃতিত্ব পাবেন মিশরের শাসক ফাতিমীয় খলিফা মা’দ আল-মুয়িজ। তিনি ৯৫৩ সালের দিকে এমন একটি কলমের কথা চিন্তা করেন, যে কলমের ভেতর কালি জমা করে রাখা যায়। এতে দোয়াতের কালি পড়ে গিয়ে কাপড়-চোপড় নষ্ট হবার সম্ভাবনা থাকে না। সেই চিন্তা থেকেই প্রথম ফাউন্টেন পেনের আবিষ্কার হয়েছিল বলে জানা যায়। ১৮৮৪ সালে এসে লুইস ওয়াটারম্যানের হাত ধরে এটি বাণিজ্যিক রূপ পায়। ১৯৩৮ সালে বলপয়েন্ট কলম বাজারে আসার আগপর্যন্ত ফাউন্টেন পেনই ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে সফলতম লেখার মাধ্যম। প্রচলিত আছে, ঝর্ণার মতো কালি ঝরানোয় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর নাম অনুবাদ করে দিয়েছিলেন ‘ঝর্ণা কলম’।
আজকের দিনে বহু সময় ধরে বাজারে বলপয়েন্ট কলম সহজলভ্য হওয়ায় প্রতিদিনের সাধারণ কাজে এটিই সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। কিন্তু ফাউন্টেন পেন এখনও রয়ে গেছে শৌখিনতা, আভিজাত্য আর রুচিশীলতার প্রতীক হিসেবে। গত শতকেও ফাউন্টেন পেন ছিল আভিজাত্যের অন্যতম নিদর্শন। কথিত আছে, একসময় ব্যাংকের চেকের কাগজে বল পয়েন্টের স্বাক্ষর গ্রহণ করা হতো না! কবি-সাহিত্যিকদের কেউ কেউ একটি ফাউন্টেন পেন দিয়ে একটা উপন্যাস লিখে তারপর সেই কলমে আর লিখতেন না। আবার কেউ কেউ একটি কলম দিয়েই সারাজীবন লিখে গেছেন। উপহার বা প্রতিযোগিতার পুরষ্কার হিসেবে প্রচলন ছিল ফাউন্টেন পেন দেওয়ার। এই কলমে ধীরে সুস্থে লিখতে হয় বলে হাতের লেখা সুন্দর হয়। তাই শিশুদের এই কলম দিয়ে হাতের লেখা অনুশীলন করানোরও প্রচলন ছিল বিংশ শতকের গোড়ার দিকে।
কালের পরিক্রমায় ফাউন্টেন পেনের ব্যবহার কমে এসেছে। অভিজাত পরিবার ব্যতীত এই কলম দেখেছেন এমন লোকের সংখ্যাও এখন যেন হাতে গোনা যায়। তবে রুচিশীল মানুষের কাছে এর চাহিদা কিন্তু ঠিকই আছে। তারই প্রমাণ পাওয়া যায় ‘ফাউন্টেন পেনস বাংলাদেশ’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ থেকে। তারা বাংলাদেশের তরুণ সমাজের মধ্যে ফাউন্টেন পেনের ব্যবহার ফিরিয়ে আনার কাজ করছেন, যাদের মূল উদ্দেশ্য হলো, ফাউন্টেন পেন সংগ্রহকারীদের মাঝে একটি সম্মিলন ঘটিয়ে অতীতের সাথে বর্তমানের মেলবন্ধন তৈরি করা। ফাউন্টেন পেন সংগ্রহের মতো চমৎকার শখটি যারা ধারণ করেন, তাদের সাথে নিয়ে নতুন এবং আগামী প্রজন্মের কাছে এই কলমের আবেদন পৌঁছে দেওয়ার কাজটি করে যাচ্ছেন তারা। এভাবে করে আন্তর্জাতিক ফাউন্টেন পেন কমিউনিটিতে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার পাশাপাশি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ইভেন্টে বাংলাদেশের হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করাও এই প্রতিষ্ঠানটির অন্যতম লক্ষ্য। আর এজন্য ফাউন্টেন পেনস বাংলাদেশ বেশ কিছু উদ্যোগও হাতে নিয়েছে। নিয়মিত ‘পেন মিটিং’-এর আয়োজন এবং অভিজ্ঞতা বিনিময়ের মাধ্যমে এই প্রতিষ্ঠানটি তরুণদের মাঝে ফাউন্টেন পেনের জনপ্রিয়তা বাড়াতে কাজ করে যাচ্ছে। বর্তমানে ফাউন্টেন পেন সংগ্রহ হয়ে দাঁড়াচ্ছে একটি নতুন ট্রেন্ড, এবং তরুণ-তরুণীরা ঝুঁকছেন এই ট্রেন্ডের দিকে। ফলে আগ্রহী হচ্ছে নতুন নতুন ফাউন্টেন পেন বিক্রয় ও আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানও, যা সমৃদ্ধ করছে এদেশের ফাউন্টেন পেনের বাজারকে।
গত ১৫-২০ সেপ্টেম্বর পাঁচ দিন ব্যাপী ক্যালিগ্রাফি প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে ফাউন্টেন পেনস বাংলাদেশ। এ আয়োজনের লক্ষ্য ছিল তরুণদের কাছে ফাউন্টেন পেনকে নতুনভাবে পরিচয় করানো এবং তাদের মধ্যে এই শখকে ছড়িয়ে দেওয়া, যেন ফাউন্টেন পেনের প্রসার আরও বৃদ্ধি পায়। এই প্রতিযোগিতার পুরষ্কার হিসেবেও ছিল বিভিন্ন ধরনের আকর্ষণীয় ফাউন্টেন পেন। এই আয়োজন ছাড়াও সারাবছর ফাউন্টেন পেন হ্যান্ডরাইটিং কম্পিটিশনসহ নানা ধরনের আয়োজন করে থাকে ফাউন্টেন পেনস বাংলাদেশ।
ফাউন্টেন পেনস বাংলাদেশের যাত্রাটা শুরু হয়েছিল অল্প ক’জন শৌখিন মানুষকে নিয়ে। তারপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে মাত্র দু’বছরের মাথায় তাদের সদস্য সংখ্যা প্রায় চার হাজার ছাড়িয়ে গেছে। এখন এখানে নতুন সংগ্রহকারী থেকে শুরু করে অভিজ্ঞ এবং খুবই সিরিয়াস ফাউন্টেন পেন সংগ্রহকারীও রয়েছেন।
ফাউন্টেন পেন সংগ্রহ করার কাজটি পরিচিত ‘জেনটলম্যান’স হবি’ হিসেবে। এটি বিবেচিত হয় একটি অভিজাত শখ হিসেবে। সারা পৃথিবীর মতো বাংলাদেশেও এমন অনেক সংগ্রাহক আছেন, যাদের ব্যক্তিগত সংগ্রহ ঈর্ষা করার মতো। এমনই একজন সংগ্রাহক হচ্ছেন এই প্রতিষ্ঠানের একজন সম্মানিত অভিভাবক চট্টগ্রামের অধিবাসী জনাব শামীম মজুমদার। তার ব্যক্তিগত সংগ্রহশালায় রয়েছে ভিস্কন্টি, মন্টব্লাঙ্ক, সেফার, ওয়াটারম্যান ও পার্কার-সহ নতুন এবং অ্যান্টিক হাজারও বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডের কলম ও কালির সমাহার। চল্লিশ বছর ধরে তৈরি করা তার এই সংগ্রহে ঈর্ষান্বিত হন আন্তর্জাতিক সংগ্রহকারীরাও।
ফাউন্টেন পেনের প্রচলন ছিল এমন দেশগুলোতে অনেক পরিবারে ফাউন্টেন পেনের সাথে পরিবারের বৃদ্ধদের এক ধরনের আবেগীয় সম্পর্ক দেখা যায়। অনেকে এই কলম ব্যবহার করেই হয়তো বসবাসরত জমির দলিলে দস্তখত করে জমিটি ক্রয় করেছিলেন, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম পর্যন্ত আশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে তার পরিবারকে। মৃত্যুর সময় অনেকে এই কলমটি হস্তান্তর করেছিলেন পরিবারের পরের প্রজন্মের হাতে, যেন তিনি না থাকলেও তার স্মৃতিটা থেকে যায়, থেকে যায় ঐতিহ্য। এভাবে করে ফাউন্টেন পেন হয়ে উঠেছে স্মৃতি আর ঐতিহ্যের প্রতীক।
আমাদেরও এমন বহু প্রিয় মুহূর্তের স্মৃতি নিশ্চয়ই জড়িয়ে থাকে কলমের সাথে। হতে পারে সেটা বিয়ের কাবিননামায় সই কিংবা প্রেমিকার কাছে প্রথম চিঠি অথবা বাড়ির দলিলে স্বাক্ষর। এমন স্মৃতিগুলোকে আরও মনোমুগ্ধকর করে রাখতে পারে একটি ফাউন্টেন পেনের ব্যবহার। শত শত বছরের ঐতিহ্যের সাথে নিজেকে জড়িয়ে নেওয়ার চেয়ে অভিজাত শৌখিনতা আর কী হতে পারে!