গ্রাম-বাংলা চিরকালীন রূপ আর সেই বাংলার মানুষের হাতের কারুকার্য যেন একই মুদ্রার দুটো পিঠ, দুটি দিকই যেন পরস্পরের সাথে মিশে আছে পরম সৌন্দর্য নিয়ে। হোক সেটা নকশী কাঁথার মাঠে কিংবা হোক সেটা সোজন বাদিয়ার ঘাটে, হস্তশিল্পের আবেদন চিরকালীনই মিশে আছে বাংলাদেশের প্রকৃতি আর মানুষের সাথে। এই মুহূর্তে সারা দুনিয়ায় কিন্তু হস্তশিল্পের কদরটা বাড়ছেই। এই যেমন, ২০১৭ সালেই হস্তশিল্পের কারুকার্যজাত পণ্যের বৈশ্বিক বাজারের মূল্য কম করে হলেও ছিল ৫০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার! আর এর মধ্যেই পরবর্তী পাঁচ বছরের হিসেবটাও বোঝা যাচ্ছে, এই অংকটি বেড়ে চলেছে ১১% চক্রবৃদ্ধি হারে!
তবে সত্যি কথা হলো, বাংলাদেশের জিডিপি বা প্রবৃদ্ধির খুব কম অংশ জুড়েই আছে হস্তশিল্পের অবদান। অবশ্য এ থেকে ভাবার কোনই কারণ নেই যে, বাংলাদেশে কারুশিল্পে সৃজনশীলতার অভাব আছে। কারণ, আবহমান কাল থেকেই অঞ্চলভেদেই রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন রকমের হস্তশিল্প বা কুটিরশিল্পের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য, আর সে ঐতিহ্য এই অঞ্চলগুলো বয়ে চলেছে শত শত বছর ধরে। এত কিছুর পরেও, এই শিল্প কিন্তু পূর্ণরূপে বিকশিত হতে পারছে না। আর এর জন্য দায়ী কিছু কাঠামোগত সমস্যা, যেমন- অর্থনৈতিক অক্ষমতা, উপযুক্ত বাজার, প্রশিক্ষণের অভাব ইত্যাদি।
ঠিক এই জায়গাটিতেই বলতে হয় বাগডুমের ‘কৃষ্টি’ প্রোজেক্টের কথা। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে International Development Enterprise এর একটি অংশ Women’s Economic Empowerment through Strengthening Market Systems (WEESMS) এর সাথে যুগ্মভাবে ‘কৃষ্টি’ কাজ করে যাচ্ছে গ্রাম বাংলা আর মফস্বলের নারীদের কুটিরশিল্পে সহায়তাদানে। আর সেই সাথে তারা কাজ করছে বাংলার এই অতুলনীয় ঐতিহ্য সংরক্ষণের চেষ্টাতেও। আগে যেখানে কুটিরশিল্পের সাথে জড়িতরা উপযুক্ত বাজার পেত না, সেখানে বাগডুম চেষ্টা করছে উদ্যোক্তাদের সাথে এই বাজারের সরাসরি যোগাযোগ করিয়ে দেবার ব্যবস্থা করতে, যা আসলে একটি বড় সমস্যার সমাধান। বাগডুমের ওয়েবসাইটে গেলেই দেখতে পাওয়া যাবে, প্রত্যেক উদ্যোক্তার আলাদা আলাদা পেজ আছে, আর তার সাথে বিক্রয় ড্যাশবোর্ডের রয়েছে সরাসরি সংযোগ। কারিগররা সেখানেই সরাসরি তাদের দামসহ আপলোড করে দিতে পারে তাদের পণ্য।
এ প্রোজেক্টে যে উদ্যোক্তারা কাজ করছেন, তারা সকলেই নারী। বাসা-বাড়ি সাজাবার সামগ্রী থেকে শুরু করে প্রাত্যহিক কাজের জন্য দরকারি সব জিনিসই তারা বানিয়ে থাকেন। এ পণ্যতালিকায় আছে ঝুড়ি, ব্যাগ, কুশন কভার, শতরঞ্জি, কম্বল, গিফট কার্ড, ফুলদানি, পাটের নানা সামগ্রী সহ হরেক রকম পণ্য-দ্রব্য। প্রতিটি জিনিসই যেন অতুলনীয় সৌন্দর্যময়। জিনিসগুলোর চমৎকার নকশা কিংবা ছিমছাম কারুকার্যের পাড়- ইত্যাদি সবই বানানো হয় গ্রাম-বাংলার বিভিন্ন উপকরণের সৃজনশীল ব্যবহারের মধ্য দিয়ে।
বাগডুমের ওয়েবসাইটের সবচেয়ে বড় সুবিধাটি হলো, এতে মধ্যস্বত্বে বড়পকরণের সৃজনশীল ব্যবহারের মধ্য ম সৌন্দর্য নিয়েভোগীর কোনো প্রয়োজন হয় না। আগে দেখা যেত, যিনি বানাচ্ছেন আর যিনি কিনছেন তাদের মধ্যকার সেই তৃতীয় পক্ষই অধিকাংশ লভ্যাংশ নিয়ে যেত। আর এখন বাগডুমের মাধ্যমে ক্রেতারা সরাসরি উদ্যোক্তাদের কাছ থেকেই কিনতে পারেন। কথা হচ্ছিল তেমনই একজন উদ্যোক্তা রংপুর ক্রাফটসের স্বপ্না রানী সেনের সাথে। তিনি বললেন, “আমি আমার ব্যবসার একজন গর্বিত মালিক। রংপুরের সেরা হাতে নির্মিত সামগ্রী বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে বাগডুম ডট কমের সাহায্যে পৌঁছে দিতে পারাটা আমার জন্য খুবই আনন্দের বিষয়!”
বাগডুমের ওয়েবসাইটের সবচেয়ে বড় সুবিধাটি হলো, এতে মধ্যস্বত্বে বড়পকরণের সৃজনশীল ব্যবহারের মধ্য ম সৌন্দর্য নিয়েভোগীর কোনো প্রয়োজন হয় না। আগে দেখা যেত, যিনি বানাচ্ছেন আর যিনি কিনছেন তাদের মধ্যকার সেই তৃতীয় পক্ষই অধিকাংশ লভ্যাংশ নিয়ে যেত। আর এখন বাগডুমের মাধ্যমে ক্রেতারা সরাসরি উদ্যোক্তাদের কাছ থেকেই কিনতে পারেন। কথা হচ্ছিল তেমনই একজন উদ্যোক্তা রংপুর ক্রাফটসের স্বপ্না রানী সেনের সাথে। তিনি বললেন, “আমি আমার ব্যবসার একজন গর্বিত মালিক। রংপুরের সেরা হাতে নির্মিত সামগ্রী বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে বাগডুম ডট কমের সাহায্যে পৌঁছে দিতে পারাটা আমার জন্য খুবই আনন্দের বিষয়!”
মনসুরা জুট হ্যান্ডিক্রাফটের মোসাম্মৎ মনসুরা বেগম বলেন, “সোনালি আঁশ দিয়ে বাসা-বাড়ি সাজাবার জিনিস বানানোর কাজ আমার জীবনটাই বদলে দিয়েছে। আমার নিজের একটা পরিচয় তৈরি হয়েছে, এখন আমি আমার মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারছি। আমার পণ্য স্থানীয় বাজারে বিক্রি তো করছিই, আবার ছড়িয়ে দিচ্ছি সারা দেশে, বাগডুম ডট কমের সাহায্যে।”
বাগডুম আরেকটি যে কাজ করছে, সেটি হলো নির্মাতাদের আর্থিক সুবিধার ব্যবস্থা করা। তারা প্রতিটি ছোট আর মাঝারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য প্রস্তুত করছে আলাদা আলাদা ডিজিটাল অর্থ আদানপ্রদানের প্রোফাইল। আর এ কাজে উদ্যোক্তাদের উপযুক্ত আর্থিক সুবিধাও দিচ্ছে তারা। পণ্যের গুণগত মান বৃদ্ধি করবার জন্য তারা আয়োজন করে চলেছে বিভিন্ন কর্মশালার। আর ব্যবসার প্রচার-প্রসার, পণ্যের ডিজাইন কিংবা সংরক্ষণের কাজ আরও ভালোভাবে করতে সাহায্যের জন্য সদাপ্রস্তুত একটি দল তো আছেই।
যেসব নারী বিভিন্ন ক্ষুদ্র, ছোট আর মাঝারি ব্যবসা চালাচ্ছেন তারা এই কৃষ্টি প্রোজেক্ট থেকে সরাসরি লাভবান হতে পারেন। আগে যেখানে নানা আর্থ-সামাজিক কারণে সফল ব্যবসা দাঁড়া করাতে খেই পাওয়া যেত না, সেখানে বাগডুম কাজটি করে দিচ্ছে অনেক সহজ। শত শত নারী এখন এখানে কাজ করছেন আর আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। কয়েকজন নারী তো নিজেদের কারখানাই দিয়ে দিয়েছেন! ২০১৯ সালের শেষ নাগাদ, অন্তত এমন ১০০০ উদ্যোগ চলে আসবে বাগডুমের সেবার আওতায়।
আগে যেখানে সেই রাজশাহী বা দিনাজপুর থেকে পণ্য ঢাকার বাজারে বিক্রির কথা চিন্তা করতেই কষ্ট হতো, আজ সেখানে গ্রামের নির্মাতারা পৌঁছে যাচ্ছেন দেশের সকল প্রান্তে। একটি কুটিরশিল্পের কাঠামোহীন বাজারকে ডিজিটাল বাংলাদেশের উপযোগী করে তুলতে বাগডুমের এই উদ্যোগ সত্যিই একটি সফল আর সময়োপযোগী কাজ। কৃষ্টি প্রোজেক্টের কল্যাণে বাংলাদেশের মুখ থুবড়ে পড়া কুটিরশিল্প যেন নতুন করে দেখছে আলোর মুখ।
আর এই অসাধারণ পথচলার স্বীকৃতি হিসেবে বাগডুম ডট কম ২০১৮ সালে অর্জন করে নিয়েছে দ্য ডেইলি স্টার আইসিটি অ্যাওয়ার্ড। ‘ডিজিটাল কমার্স অফ দ্য ইয়ার’ হিসেবে বাগডুমের এই স্বীকৃতির পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছে তাদের অভাবনীয় উদ্যোগ কৃষ্টি।
চলুন শুনে আসি এই দারুণ প্রচেষ্টার কর্ণধার বাগডুমের সিইও মিরাজুল হকের ভাবনাগুলো।
“এই গ্রামের কুটিরশিল্পের সাথে জড়িত নারীরা যতই মেধাবী কিংবা দক্ষ হন না কেন, ব্যবসার বাজার কিংবা সাপ্লাই চেইনের উপর কোনো নিয়ন্ত্রণই ছিল না তাদের। ডিজিটাল মাধ্যমে উপস্থিত থাকার কথা তো তাদের কল্পনাতেও ছিল না। বিক্রেতারা খুব কমই পারতেন তাদের ক্রেতাদের কাছে পৌঁছুতে। IDE (WEESMS) কে ধন্যবাদ কৃষ্টি প্রোজেক্টের সাথে থাকবার জন্য, কৃষ্টির কারণেই আমরা প্রথমবারের মতো এই নারীদের পরিচিত করেছি ডিজিটাল ব্যবস্থার সাথে, যার সাহায্যে তারা স্বাবলম্বী হয়েছেন। এখন তারা দূর-দূরান্তে পৌঁছে দিতে পারছেন তাদের পণ্য। তারা পণ্যের বাজার, সৌন্দর্য, সাপ্লাই চেইন ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি সবকিছু নিয়েই একটা সামগ্রিক ধারণা পাচ্ছেন এখান থেকে। এতদিন পর যেন আমরা সঠিক কাজটা করতে পেরেছি, যাদের উপযুক্ত সম্মান এবং মর্যাদা প্রাপ্য, তাদের তা আমরা দিতে পারছি। আর হ্যাঁ, এর মাধ্যমেই কিন্তু আপনারা ঘরে বসেই সবচেয়ে কম খরচে পেয়ে যাচ্ছেন বাংলাদেশের সেরা হস্তনির্মিত পণ্যগুলো!”