‘তরুণদের আগ্রহ কীসে’- এই প্রশ্নটির জবাবে এই মুহূর্তে গোটা পৃথিবীতে সবচেয়ে জনপ্রিয় উত্তরগুলোর একটি হলো, ‘উদ্যোক্তা হওয়া এবং উদ্যোগ নেওয়া’। স্টিভ জবস তো ছিলই, এখন জেফ বেজোস, বিল গেটস, মার্ক জাকারবার্গ, জ্যাক মা কিংবা রিচার্ড ব্র্যানসনদের নাম আজকের সময়ের মানুষদের মুখে মুখে, কারণ এই নামগুলো এখন সফল উদ্যোক্তার সফলতম প্রতিশব্দ।
ঠিক এই মুহূর্তে আমাদের এই অঞ্চলে কারা কারা এমন সফল উদ্যোক্তাদের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠতে চেষ্টা করছেন? এরকম একটা প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে যাদের নাম আসছে, তাদেরই একজনকে নিয়ে আমাদের আজকের আয়োজন।
অসম্ভব সাহসী এই উদ্যোক্তা বয়সে তরুণ। এর মধ্যেই প্রায় এক যুগের সাফল্যমণ্ডিত ক্যারিয়ার তৈরি হয়েছিল তার। শুরুটা হয়েছিল গ্রামীনফোণে, সেখান থেকে একে একে নোকিয়া, এরিকসন, কিউবি- কোথায় ছিলেন না তিনি! যখন যেখানে দেখেছেন নিজের বিকাশের সুযোগ, লুফে নিয়েছেন। তবে এত বড় বড় জায়গায় কাজ করার পরেও তার মনের এক কোণায় একটা খটকা থেকেই যাচ্ছিল। ভাবছিলেন, যেসব জায়গায় কাজ করছেন, কতটুকু পদচিহ্ন-ই বা তার থাকছে সেখানে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনোটিই তার নিজের কিছু নয়, তাই সেগুলোর সাথে সেই অর্থে একাত্মতাও অনুভব করছিলেন না তিনি। এই চিন্তার দোলাচল থেকেই তিনি স্বপ্ন দেখছিলেন নিজেই কোনোকিছু প্রতিষ্ঠা করার, যেই প্রতিষ্ঠান দিয়ে তিনি নিজ হাতে কিছু একটা করতে পারবেন সমাজ কিংবা মানুষের জন্য।
কিন্তু কীভাবে সমাজকে বদলাবেন? মানুষের কোন সমস্যার সমাধান করবেন তিনি? সাধারণ মানুষের পরিস্থিতি বোঝার জন্য তিনি তাকালেন নিজের জীবনে উপলব্ধি করা সমস্যাগুলোর দিকে। কর্পোরেট জগতে থাকার কারণে তার সপ্তাহের প্রতিটি দিনই ছিল প্রচুর কর্মবহুল। তিনি তাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন শুক্রবারটির জন্য, সেদিন হয়তো পরিবারের সাথে একটু নিশ্চিন্তে সময় কাটাবেন, নিজের কাজের ধকলকে ঝেড়ে ফেলে একটু আয়েশ করবেন। অথচ দেখা যেত, বেশিরভাগ সময়ই এই দিনটায় এসে তার বাসার ভাঙা জানালা বা পাইপের লিক ঠিক করার জন্য লোক খুঁজে বের করার মতো কাজগুলো করতে হচ্ছে। খেয়াল করে দেখলেন, এ সমস্যা শুধু তার নয়, তার সব কলিগও এ ব্যাপারটি নিয়ে বেশ বিরক্ত। কারণ, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দৈনন্দিন জীবনের এইসব সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে পেশাদারিত্বের খুবই অভাব। না আছে সহজলভ্যতা, না আছে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা, না আছে কোনো ধরাবাঁধা দরদাম।
তিনি খেয়াল করলেন, এই সাধারণ সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য এখনো কোনো প্রতিষ্ঠানই এগিয়ে আসছে না। এই নিয়েই ভাবলেন তারপর। এরপর লক্ষ্য ঠিক করলেন- প্রতিদিনের জীবনের এই ছোট্ট সমস্যাগুলো তিনি সাধারণের জীবন থেকে একদম নাই করে দেবেন।
কিন্তু স্বপ্ন দেখা আর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার মাঝখানের পথটা আসলে অনেক বন্ধুর। প্রথম কাজটা হয়তো অনেকেই করে, কিন্তু পথটা পাড়ি দেয় খুব কম কিছু মানুষ। তবে তাদেরকেই মনে রাখে ইতিহাস। হয়তো তেমনই কেউ হতে চেয়েছিলেন আমাদের গল্পের সাহসী মানুষটি। লক্ষ্য ঠিক করার পর তার মনে এসেছিল অনেক সন্দেহ, নানা ধরনের ভীতি। তখন তিনি কিউবির মতো একটি নামকরা প্রতিষ্ঠানে ভালো পদে কাজ করছেন। মাসে মাসে একটি স্থির আয়ের উৎস আছে। পরিবার, বাবা-মা, দুই পুত্রের ভবিষ্যৎ সবই তার উপর নির্ভর করছে। এর মধ্যে তিনি যদি নিজের একটি প্রতিষ্ঠান শুরু করতে যান, বর্তমান এই চাকরিটা তার ছেড়ে দিতে হবে। তার আয় হয়ে যাবে সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। তিনি তার বড় ভাইয়ের মতামত চাইলেন। তিনি বললেন, “তোমার যে গাড়িটা আছে সেটা হয়তো তোমার বিক্রি করে দিতে হবে। তোমার বাচ্চাগুলো যে মানের স্কুলে এখন পড়ছে সামনে হয়তো তারা আর পড়তে পারবে না। এই ঝুঁকি নেবার জন্য কি প্রস্তুত তুমি?” শুনে তিনি আরো দু’মাস সময় নিলেন। তারপর একসময় চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে নেমে পড়লেন কাজে। এমনকি কিউবির অধিকর্তা তাকে প্রস্তাব দিলেন, তুমি চাইলে সপ্তাহে দুইদিন করে কনসাল্টেন্টের কাজ করতে পারো এখানে। কিন্তু তিনি তা নিলেন না, কারণ এরকম ব্যাকআপ প্ল্যান থাকলে হয়তো তিনি কখনোই তার সর্বোচ্চটা দিতে পারবেন না তার নিজের প্রতিষ্ঠানে।
ঝুঁকি নিয়েই শুরু হলো এভাবে। ২০১৫ সালের দিকে তিনি শুরু করলেন তার প্রতিষ্ঠানের পূর্ণ কার্যক্রম এবং দল তৈরির প্রক্রিয়া। এবং তার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুকে সাথে নিয়ে দাঁড় করিয়ে ফেললেন তার স্বপ্নের উদ্যোগ। সেবছরের জুনে শুরু হলো তাদের কাজ। ২০১৬ সালের ১৬ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে পদচারণা শুরু করল প্রতিষ্ঠানটি। আর আজ দু’বছর পর এই প্রতিষ্ঠানটির তত্ত্বাবধানে কাজ করছে প্রায় ১,৪০০-র বেশি কোম্পানি! সেইসাথে বছরে ৮,০০০ চাকরি তৈরির সামর্থ্য অর্জন করে ফেলেছে তারা! জাতীয় আর আন্তর্জাতিক নানান পুরষ্কার বাগিয়ে এটি এখন বাংলাদেশের অন্যতম সেরা স্টার্টআপ।
আমাদের এই সাহসী স্বপ্নদ্রষ্টার নাম আদনান ইমতিয়াজ হালিম। আর প্রতিষ্ঠানের নাম ‘Sheba.xyz।’ এখানে ‘সেবা’ মানে আপনাদের জন্য সেবা, আর ‘এক্সওয়াইজেড’ মানে এর কার্যকারিতা একদম এ থেকে জেড পর্যন্ত, অর্থাৎ সব ধরনের সেবা দেওয়ার লক্ষ্যেই কাজ করে এ প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে আদনান ইমতিয়াজ হালিম আছেন প্রতিষ্ঠানটির চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার হিসেবে। সাথে চেয়ারম্যান হিসেবে আছেন ইলমুল হক সজীব, যিনি প্রতিষ্ঠানটির চিফ অপারেটিং অফিসারের দায়িত্বও পালন করছেন; আর আবু নাসের শোয়েব আছেন চিফ টেকনোলজি অফিসারের দায়িত্বে। সেইসাথে আছে সেবার বিশাল টিম।
Sheba.xyz প্রকৃতপক্ষে একটি অনলাইন সেবাভিত্তিক মার্কেটপ্লেস বা অনলাইন সার্ভিস মার্কেট। প্রতিদিন মানুষের যত ধরনের সেবা নেওয়ার দরকার হতে পারে তার প্রায় সবই পাওয়া যাবে এই মার্কেটে। আর এই সেবাগুলো দেওয়ার জন্য মার্কেটে যুক্ত আছে ৩,০০০ এর বেশি দক্ষ সেবাদাতা। মোবাইল অ্যাপ এবং ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যে কেউ সেবার জন্য অর্ডার করতে পারবে এখানে। এছাড়াও তাদের রয়েছে নিজস্ব কল সেন্টার যার মাধ্যমে ফোনেই সেবা দিয়ে থাকে প্রতিষ্ঠানটি। এই গ্রাহক সেবা কেন্দ্রের নাম্বার হলো ১৬৫১৬। সেবার অ্যাপটি নামিয়ে নেওয়া যাবে গুগলের প্লে-স্টোর আর অ্যাপলের অ্যাপ স্টোর থেকে।
সামাজিক উদ্যোগ হিসেবে যাত্রা শুরু করা এই সার্ভিস প্লাটফর্মে বর্তমানে যুক্ত তিন হাজারের বেশি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা বাসা-বাড়ি কিংবা অফিসের জন্য বিভিন্ন সার্ভিস পৌঁছে দিচ্ছেন গ্রাহকের দোরগোড়ায়। ঘরে বসেই এখান থেকে নেওয়া যাবে ইলেকট্রনিক্স ঠিক করা, বাসা শিফটিং, মোবাইল-ল্যাপটপ সার্ভিসিং, বিউটি সার্ভিস, খাবার, লন্ড্রি, পেস্ট কন্ট্রোল, গাড়ি, এমনকি চাহিদামাত্র ড্রাইভার নেওয়ার সুবিধা!
মোবাইল অ্যাপ, ওয়েবসাইট বা কলসেন্টারে অর্ডার দেওয়ার পর Sheba.xyz সেই অর্ডারটি কনফার্ম করবে সেবাগ্রহীতাকে। তার বাসা বা অফিসের ঠিকানায় একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে লোক পৌঁছে যাবে সেবার পক্ষ থেকে। সমস্যা সমাধান হয়ে গেলে হাতে হাতে অথবা বিকাশ, রকেটের মাধ্যমেও বিল পরিশোধ করতে পারবেন সেবাগ্রহীতা।
২০১৬ সালে সেবার শুরু হয়েছিল শুধুমাত্র মিরপুর ডিওএইচএস এলাকায় সেবা প্রদানের মাধ্যমে। ২০১৭ সালে সেটা ছড়িয়ে গেছে সারা ঢাকায়। ২০১৮ এর মধ্যে পুরো বাংলাদেশে সেবা দেবার লক্ষ্যে বর্তমানে কাজ করে যাচ্ছে Sheba.xyz। তাদের নতুন লক্ষ্য হলো, ২০২১ সালের মধ্যে তাদের সেবাকে গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া জুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া।
সেবার এই বেড়ে ওঠার গল্পের মাঝে বেশ কিছু স্বীকৃতিও তারা পেয়েছে। পেয়েছে জিপি এক্সিলারেটর, ইনোভেশন এক্সট্রিম এর স্বীকৃতি, পেয়েছে একিলিওন টপ এশিয়া ১০০ পুরস্কার। তবে তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্বীকৃতিটা ছিল বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সাধারণ মানুষদের জীবনযাত্রা সহজ করায় জাতীয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি পুরস্কার ২০১৭ অর্জন করেছে Sheba.xyz।
তবে এত এত সাফল্যের মাঝেও আদনান ইমতিয়াজ হালিমের টিম কিন্তু তাদের মূল লক্ষ্যটি ভুলে যায়নি। তারা চেয়েছিল সমাজকে বদলে দিতে। Sheba.xyz একটি সামাজিক উদ্যোগ হয়ে উঠবে, এটাই এখনও তাদের স্বপ্ন। আদনান ইমতিয়াজের ভাষায়, “আমরা আর্থিক মু্নাফার চেয়ে সামাজিক জীবন মানোন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখায় গুরুত্বারোপ করছি। আমরা জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সাত, আট এবং নয় নম্বর টপিক নিয়ে কাজ করছি। সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে নতুন কর্মসুযোগ সৃষ্টি, দারিদ্র্য বিমোচন এবং কর্মের অবকাঠামো তৈরি করছি আমরা।”
পরিবর্তন হচ্ছেও বটে। অনেক শ্রমজীবী মানুষ এখন এই প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে সঠিক মূল্যায়ন পাচ্ছেন তাদের শ্রমের। দেশজুড়ে অনেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাকে নিজেদের তত্ত্বাবধানে এনে জীবনমানের পরিবর্তনের সুযোগ করে দিচ্ছে Sheba.xyz। হাজার হাজার কর্মক্ষম মানুষকে তারা নিয়ে আসছে একটি প্রযুক্তিগত অবকাঠামোর নিচে। তাদের এই সাফল্যের পথটা যদি সামনেও উর্ধ্বগামীই থাকে, তবে তাদের হাত ধরেই আসতে পারে দেশের একটি বড় মাপের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন। আমাদের আশা, Sheba.xyz থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে আরও অসংখ্য তরুণ হয়ে উঠবেন সাহসী উদ্যোক্তা, দেশে তৈরি হবে উদ্যোক্তা নির্মাণের একটি শক্তিশালী সংস্কৃতি, বদলে যাবে বাংলাদেশ।