পৃথিবীর অসংখ্য মানুষের কাছে চা নিতান্তই একটি সাধারণ পানীয় হতে পারে, কিন্তু বাঙালির কাছে চা কেবল চা-ই নয়। এই দেশের মানুষের কাছে চা একটি আবেগ, এটি তাদের জীবনেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। শীতের সকালে কুয়াশার ফাঁকে আসা রোদের ওম নিতে নিতে, বিকেলে বন্ধুদের সাথে জমে ওঠা আড্ডাকে আরও প্রাণবন্ত করে তুলতে, কিংবা সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে সারাদিনের সব ক্লান্তি এক নিমিষে দূর করে দিয়ে চাঙ্গা হয়ে উঠতে চা-ই যেন বাঙালির দৈনন্দিন রোমান্টিসিজমের শেষ কথা। আমাদের কাছে চা যেন এক পেয়ালা ভরা স্বপ্ন, যার প্রতি চুমুকেই থাকে একেকটি মহাকাব্যিক মুহূর্তের গল্প।
চায়ের মর্ম যেহেতু এদেশের মানুষের চেয়ে বেশি আর কেউ বোঝে না, তাই চায়ের বৈচিত্র্যকেও বাঙালিই পারবে সবচেয়ে বেশি সাদরে গ্রহণ করতে। তাদের প্রাত্যহিক তালিকায় কত ধরনের চা যে থাকে! কেবল দুধ চা, রং চা-ই নয়, পাশাপাশি আদা চা, লেবু চা, মরিচ চা, মাল্টা চা, মালাই চা আরও কত কী!
ইদানিং গ্রিন টি-ও বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে স্বাস্থ্য সচেতন মানুষদের কাছে। নতুন আরেকটি যে বিশেষ ধরনের চা-য়ের অদূর ভবিষ্যতে আমাদের পছন্দের তালিকায় শীর্ষে চলে আসার সম্ভাবনা রয়েছে, সেটি হলো হোয়াইট টি বা সাদা চা।
চায়ের ক্ষেত্রে যারা খানিকটা খুঁতখুঁতে, অর্থাৎ সবচেয়ে অপরিবর্তিত রূপে যারা একে গ্রহণে আগ্রহী, তাদের জন্য দারুণ পছন্দের হতে পারে হোয়াইট টি। পৃথিবীতে এই মুহূর্তে যত ধরনের চা পাওয়া যায়, তার মধ্যে হোয়াইট টি-ই হলো সবচেয়ে কম প্রক্রিয়াজাত। খুবই সংক্ষিপ্ত প্রক্রিয়ায়, কোনো প্রকার গাঁজন বা অন্যান্য প্রক্রিয়া ছাড়া কেবল শুকানোর মাধ্যমেই, উৎপন্ন হয় এই চা। ফলে এই হোয়াইট টি-তে চায়ের আদি ও অকৃত্রিম সকল গুণাগুণই থাকে অটুট। আর এর যে অসাধারণ ঘ্রাণ, যেকোনো প্রকৃত চা-প্রেমীই যে তাতে মুগ্ধ হবেন, সে নিশ্চয়তা দেওয়া যায় অনায়াসেই!
হোয়াইট টি প্রস্তুত করা হয় ক্যামেলিয়া সাইনেসিস গাছের কুঁড়ি ও পাতা থেকে। একই গাছ থেকে অন্য সব ধরনের চা উৎপন্ন হয়। তবে কেউ যদি নাম শুনে মনে করেন হোয়াইট টি সাদা বর্ণের, তাহলে কিন্তু ভুল করবেন। এটি মূলত রূপালী ছাই বর্ণের। তাহলে হোয়াইট টি নামকরণ কি কোনো কারণ ছাড়াই? তা-ও নয়। এর নামে হোয়াইট আছে কারণ, ক্যামেলিয়া সাইনেসিস গাছের অনুদ্ঘটিত কুঁড়ির উপরে যে আঁশ থাকে, তা সূর্যের আলো ও তাপে প্রক্রিয়াজাত হয়ে ধীরে ধীরে রূপালী সাদা আভা ধারণ করে। এরপর ‘সানড্রাই’ করার পর শুকনো কলিগুলো রূপালী সুঁইয়ের আকার ধারণ করে দেখেই একে Silver Niddle White Tea বলা হয়।
হোয়াইট টি উৎপাদনের সূচনা হয়েছিল চীনে, বিশেষ করে ফুজিয়ান প্রদেশে। এর সাথে মিশে আছে প্রাচীন চীনের এক অসাধারণ মানবিক ইতিহাস। চীনে কেউ কারও বাড়িতে বেড়াতে গেলে, তাকে চা দিয়ে আপ্যায়ন করার রেওয়াজ আছে। কিন্তু কিছু কিছু মানুষ ছিল যারা এতটাই দরিদ্র যে, চা কেনার পয়সাটুকুও তাদের ছিল না। কিন্তু সমাজে টিকে থাকতে গেলে সামাজিক রীতিনীতি তো মেনে চলতেই হবে। তাই তারা করতো কী, সাধারণ পানি ফুটিয়ে এনে অতিথিদেরকে ‘হোয়াইট টি’ নামে পরিবেশন করতো। এবং অতিথিরাও এমন ভাব দেখাত যেন তারা সত্যি সত্যিই হোয়াইট টি খাচ্ছে।
আসলে তখন হোয়াইট টি ছিল চীনের খুবই অভিজাত একটি পানীয়। সাধারণ মানুষ এই চায়ের নাগাল পেত না। এমনকি একদম শুরুতে তো প্রচুর ধনসম্পদ থাকলেও যে যে-কেউ চাইলেই এই চা পান করতে পারবে, তেমনটাও ছিল না। তখন চা অভিজাতভাবে মজুদ থাকত কেবলই চীনের সম্রাটের জন্য।
চীনে হোয়াইট টি-র প্রচলন শুরু হয় সেই ট্যাং সাম্রাজ্যের (৬১৮-৯০৭ খ্রিষ্টাব্দ) সময়কাল থেকে। এরপর সং সাম্রাজ্য (৯৬০-১২৭৯ খ্রিষ্টাব্দ) এবং সর্বশেষ চিং সাম্রাজ্যেও (১৬৪৪-১৯১১) ক্রমাগত হোয়াইট টি-র বিস্তার বাড়তে থাকে। তবে কেবলমাত্র ১৮৮৫ সাল থেকেই নির্দিষ্ট কিছু চা গাছের পাতা থেকে ‘সিলভার নিডল’ ও অন্যান্য হোয়াইট টি প্রস্তুত করা শুরু হয়।
ক্যামেলিয়া সাইনেসিস গাছ থেকে মূলত চার রকমের হোয়াইট টি পাওয়া যায়। প্রথমটি হলো সিলভার নিডল হোয়াইট টি (Baihao Yinzhen), শুধুমাত্র একদম নতুন কুঁড়ি থেকে তৈরি হয় এই চা। আরেকটি ধরন হলো হোয়াইট পিওনি টি (Bai Mudan)। নতুন অঙ্কুরিত একটি কুঁড়ির সাথে আরও দুটো সতেজ পাতা তুলে পাওয়া যায় এই চা। পাতাগুলো আরেকটু পরিণত হবার পর তুলে যে চা পাওয়া যায় সেটি হলো ট্রিবিউট আই-ব্রো টি (Gong Mei)। আবার পাতাগুলোকে প্রাকৃতিকভাবে শুকিয়েই এক ধরনের হোয়াইট টি পাওয়া যায়, যার নাম হলো লং লাইফ আই-ব্রো টি (Shou Mei)। এদের মধ্যে সবচেয়ে মসৃণ আর মোলায়েম স্বাদটা পাওয়া যায় সিলভার নিডল হোয়াইট টি থেকে, হোয়াইট পিওনি আরেকটু কড়া, ট্রিবিউট আই-ব্রো আরেকটু বেশি আর লং লাইফ আই-ব্রো হলো হোয়াইট টি’র মধ্যে সবচেয়ে গাড় লিকারের চা। বলাই বাহুল্য, পৃথিবীজুড়ে চা-প্রেমীদের কাছে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় হোয়াইট টি হলো সিলভার নিডল।
শুরুটা চীনে হলেও, এখন পূর্ব নেপাল, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, শ্রীলংকা এবং ভারতেও উৎপাদন করা হচ্ছে হোয়াইট টি। অবাক হওয়ার মতো বিষয় হলো, সেই সাথে আনন্দেরও; বাংলাদেশেও এখন দেশীয় চা বাগান থেকেই প্রস্তুত করা হচ্ছে ‘সিলভার নিডল’ হোয়াইট টি!
চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি ও সীতাকুণ্ডর উঁচু পাহাড়ের সারির মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে বিশ্ববিখ্যাত নদী হালদা। আর এই হালদা নদীতীরের উপত্যকাতেই গড়ে উঠেছে অনিন্দ্যসুন্দর কিছু চা-বাগান। সেইসব সবুজের সমারোহে, পর্যাপ্ত বৃষ্টি ও সূর্যের আলোর সান্নিধ্যে উৎপন্ন হচ্ছে ক্যামেলিয়া গাছ, যা দিয়ে ‘সিলভার নিডল’ হোয়াইট টি প্রস্তুত করছে ‘হালদা ভ্যালি‘।
গ্রিন টি-কে যেখানে প্যানে বা মেশিনে বসিয়ে রোস্ট করা হয়, হোয়াইট টি-কে সেখানে খুবই সীমিত পরিসরে প্রাকৃতিকভাবে শুকানো হয় এর পলিফেনল অক্সিডেস নিষ্ক্রিয় করার জন্য। একারণে এর অক্সিডেশন প্রক্রিয়াও খুব কম হয়, এবং এতে রং চা বা গ্রিন টি-র চেয়েও বেশি পরিমাণে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ফ্ল্যাভোনয়েড থাকে, যা আমাদের স্বাস্থ্য রক্ষায় হতে পারে দারুণ উপকারী।
‘সিলভার নিডল’ হোয়াইট টি-র কুঁড়িগুলো আকারে বড় ও মোটা হয়, আর রূপালী-সাদা আঁশ দ্বারা আবৃত থাকে। খুবই হালকা, মিষ্টি, ফুলের মতো গন্ধ হয় এই চায়ের, ঠিক বুনোফুলের সাথে মধুর সংমিশ্রণে যে গন্ধের সৃষ্টি হয় তেমন। চায়ের স্বাদটা তেমন একটা কড়া নয়, বরং হালকা, মিষ্টি ও সতেজ।
হোয়াইট টি আপনার স্বাদেন্দ্রিয়কে যেন আমন্ত্রণ জানাবে খুব কড়া স্বাদের চেয়ে বরং একটা মোলায়েম আর সূক্ষ্ম অনুভূতি গ্রহণ করতে। এই চায়ের সাথে মিশে আছে আভিজাত্যের ছোঁয়া, যেটা চা-প্রেমীদের ডাকবে একটু ভিন্ন কিছুর স্বাদ নেবার। অন্য সব চায়ের চেয়ে হোয়াইট টি-র ধরনটা অনেক মোলায়েম, অনেক স্বাচ্ছন্দ্যময়। এর সতেজ আর হালকা মিষ্টি স্বাদটা চায়ের জগতে একদম নতুন কাউকে যেমন বিমোহিত করবে, তেমনি প্রশংসা আদায় করে নেবে চায়ের সমঝদারদেরও।
এই চা কমাতে পারে ক্যান্সার ও হৃদরোগের ঝুঁকি; সহায়তা করবে ওজন কমাতে। সেইসাথে দাঁতকে রক্ষা করবে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ থেকে। হোয়াইট টি ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের শরীরের প্লাজমা গ্লুকোজের মাত্রা বৃদ্ধি করে, শরীরে অপেক্ষাকৃত অধিক ইনসুলিন উৎপন্ন করে এবং ঘন ঘন পিপাসার প্রবণতা কমায়। একই সাথে এটি অস্টিওপোরোসিস নামক হাড়ের রোগ থেকে রক্ষা করতে পারে। এই চা রোধ করবে ত্বকের আপাত বয়স বৃদ্ধিকেও; হ্রাস করবে রিউমাটয়েড আরথ্রাইটিস রোগের জ্বলুনি। এমনকি পারকিনসন ও অ্যালঝেইমার রোগ থেকে সুরক্ষার জন্যও কাজ করবে হোয়াইট টি।
হোয়াইট টি থেকে চা বানানোর প্রক্রিয়াটা একটু অন্যরকম। প্রথমে চা বানানোর পাত্রটিকে গরম পানি দিয়ে গরম করে নিতে হবে। এরপর ওই পানি ফেলে দিতে হবে। এরপর পাত্রটিতে গরম পানি ঢালতে হবে। তারপর তিন মিনিট ধরে চা পাতা পানিতে ভেজাতে হবে। এরপর চায়ের পাতা পুরোপুরি পাত্রের তলানিতে চলে গেলে পান করতে হবে চা। মনে রাখতে হবে, হোয়াইট টি গরম পানির ক্ষেত্রে খুবই স্পর্শকাতর। তাই পানি বেশি গরম হলে (বলক আসার মতো) বা অনেকক্ষণ পানিতে ভিজিয়ে রাখলে চায়ের স্বাদ তিতকুটে হতে পারে, এবং অ্যান্টি অক্সিডেন্ট ভেঙে যেতে পারে।
এমনিতে আমাদের যখন তখন যেকোনো ধরনের চা হলেই চলে। কিন্তু চা যখন হয় অনুভূতিকে উপভোগের বিষয়, চা যখন হয় একটা দারুণ পানীয়ের জন্য বিশেষ ভালোবাসার বিষয়; তখন সত্যিই দরকার হয় একটা ভালোমানের চায়ের পাতা, যার স্বাদ আর গন্ধ মনে করিয়ে দেবে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের কথা। আমাদের প্রতিদিনের পাওয়া অধিকাংশ চায়েই যেমন চায়ের প্রকৃত স্বাদ পাওয়া যায় না, তেমনই ওইসব চা স্বাস্থ্যের জন্যও অত্যন্ত ক্ষতিকর। কিন্তু এই দুইদিক থেকেই হোয়াইট টি একদমই ব্যতিক্রম। এই চা পান করে যেমন চা-প্রেমীরা পারবেন চায়ের শতভাগ খাঁটি স্বাদ আস্বাদন করতে, পাশাপাশি এটি নিশ্চিত করবে তাদের সুস্বাস্থ্যও। আর এই মুহূর্তে যখন আমাদের দেশের বুকেই তৈরি হচ্ছে এই চা, তাহলে এমন একটা অসাধারণ আনন্দ থেকে বঞ্চিত হওয়া কি ঠিক হবে?
কোথায় পাবেন? স্বপ্ন, ইউনিমার্ট, আগোরা, মীনা বাজার, ল্যাভেন্ডার, আড়ত-এর মতো সুপার শপ আর বিখ্যাত ই-কমার্স সাইটগুলোতেই পাবেন সিলভার নিডল হোয়াইট টি। আরও কিছু জানতে ঘুরে আসুন www.haldavalley.com থেকে।