প্রায় প্রতিটি বড় আসরেই এমন এক বা একাধিক আন্ডারডগ দল থাকে, যারা প্রচলিত হিসাবের সমীকরণকে দুমড়েমুচড়ে দিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই আন্ডারডগদের চমকে দেওয়ার সীমাটা কোয়ার্টার ফাইনাল কিংবা সেমিফাইনাল পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকে, শিরোপা জেতার মতো পরিস্থিতি এলে তারা চাপ সামলাতে পারে না। তবে সবসময় যে এমনটাই হয়ে এসেছে তা কিন্তু নয়, আন্ডারডগ হয়ে আসর শুরু করা দলের শিরোপা জেতার বেশ কয়েকটি নজির রয়েছে। এর মধ্যে ১৯৯২ সালে ডেনমার্কের ইউরো জয় অনেকদিক থেকেই আলাদা, আজ সেই ঐতিহাসিক শিরোপা জয়ের গল্পই তুলে ধরা হবে।
বর্তমানে ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নেয় ২৪টি দল। তবে ২৮ বছর আগে ইউরোপসেরা হওয়ার আসরে সুযোগ পেত মাত্র আটটি দল! তাই স্বাভাবিকভাবেই বাছাইপর্বের বাধা পার হওয়াটা বেশ কঠিন ছিল। ১৯৯২ ইউরোর স্বাগতিক ছিল সুইডেন। ফলে তারা সরাসরি মূল আসরে খেলার সুযোগ পেয়েছিল। বাকি সাতটি দল নির্ধারণ করার জন্য ৩৩ দলকে ভাগ করা হয় সাতটি গ্রুপে, যেখান থেকে প্রত্যেক গ্রুপের সেরা দল সুযোগ পাবে মূল আসরে। গ্রুপ ফোরে নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, ফারাও আইল্যান্ড ও তৎকালীন যুগোস্লাভিয়ার সাথে আরেক দল ছিল ডেনমার্ক।
গ্রুপ ফোরে ডেনমার্ক ও যুগোস্লাভিয়ার মাঝে মূল পর্বে যাওয়ার লড়াইটা জমে ওঠে। ঘরের মাঠে যুগোস্লাভিয়ার কাছে ০-২ গোলে হারলেও ফিরতি লেগে বেলগ্রেডে গিয়ে ২-১ গোলের জয় তুলে নেয় ড্যানিশরা। তবে অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রতিপক্ষ নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ড্র করার মাশুল গুনতে হয় ডেনমার্কে, তাদের চেয়ে মাত্র ১ পয়েন্টে এগিয়ে থেকে মূল আসরে খেলা নিশ্চিত করে যুগোস্লাভিয়া।
কিন্তু হায়! ইউরো শুরুর অল্প কিছুদিন আগে যুগোস্লাভিয়ায় বেজে ওঠে গৃহযুদ্ধের দামামা। এই গৃহযুদ্ধের কারণে আসর শুরুর মাত্র দশদিন আগে যুগোস্লাভিয়াকে নিষিদ্ধ করা হয়। ফলে গ্রুপ ফোরের রানার্স আপ হিসেবে আচমকা ইউরোতে খেলার সুযোগ পেয়ে যায় ডেনমার্ক!
এদিকে তৎকালীন ড্যানিশ কোচ রিচার্ড নিয়েলসেনের সাথে মতবিরোধের কারণে ১৯৯০ সাল থেকেই জাতীয় দল থেকে দূরে ছিলেন দলের সেরা তারকা মাইকেল লাউড্রপ। ইউরোতে সুযোগ পাওয়ার পর তাকে আবারো জাতীয় দলে ফিরে আসার জন্য অনুরোধ করা হয়, কিন্তু ওই আসরে ড্যানিশদের সাফল্য পাওয়ার সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ মনে হওয়ায় ছুটিতে থাকাই শ্রেয় মনে করেছিলেন তিনি। এতসব প্রতিকূলতার মাঝেই কোচ নিয়েলসেন দলকে গুছিয়ে আনার চেষ্টা করছিলেন। এমতাবস্থায় টুর্নামেন্টে নিজেদের প্রথম ম্যাচে শক্তিশালী ইংল্যান্ডের সাথে গোলশূন্য ড্র ড্যানিশদের জন্য বেশ সম্মানজনক ফল ছিল। স্বাগতিক সুইডেনের সাথে পরের ম্যাচে অবশ্য তারা পেরে ওঠেনি, ০-১ গোলে হেরে যায় তারা।
সেমিফাইনালে যাওয়ার জন্য কঠিন এক পরীক্ষার সামনে তখন ডেনমার্ক, ফ্রান্সের বিপক্ষে জিতলেই বেঁচে থাকবে সেই আশা। লঁরা ব্লা, এরিক ক্যান্টোনা, ইমানুয়েল পেটিট, জিয়ান-পিয়েরে প্যাপিনদের মতো তারকাদের নিয়ে গড়া ফ্রান্সের সেই দলটি বেশ শক্তিশালী ছিল। এমন বাঁচা-মরার ম্যাচে আট মিনিটের মাথায় গোল করে ডেনমার্ককে এগিয়ে দেন হেনরিক লারসেন। খেলার ৬০ মিনিটে গোল করে ফ্রান্সকে সমতায় ফেরান প্যাপিন। এর কিছুক্ষণ পরেই দলকে এগিয়ে নেওয়ারে দারুণ সুযোগ পেয়েছিলেন প্যাপিন, তবে তার নেওয়া শট লক্ষ্যভ্রষ্ট হলে সেই যাত্রায় বেঁচে যায় ডেনমার্ক।
৭৮ মিনিটে ডেনিশরা অবশ্য সেই ভুল করেনি। ডান প্রান্ত থেকে ফ্লেমিং পোলসেনের বাড়িয়ে দেওয়া পাস থেকে গোল করে দলকে ২-১ গোলে এগিয়ে দেন বদলি খেলোয়াড় লার্স এলস্ট্রাপ। ফ্রান্সের বিপক্ষে দারুণ এই জয়ে স্বাগতিক সুইডেনের ঠিক পিছনে থেকে গ্রুপ রানার্স হিসেবে সেমিফাইনালে চলে যায় ডেনমার্ক।
সেখানেও তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল কঠিন পরীক্ষা, আগের আসরের চ্যাম্পিয়ন নেদারল্যান্ডস নামে-ভারে সবদিক থেকেই বেশ এগিয়ে ছিল। তবে দলীয় ঐক্যে বলীয়ান ডেনমার্ক এ ম্যাচেও দ্রুত গোলের দেখা পেয়ে যায়, ৫ মিনিটের মাথায় ব্রায়ান লাউড্রপের দারুণ এক ক্রসে মাথা ছুঁইয়ে ড্যানিশদের এগিয়ে দেন লারসেন। খেলার ২৩ মিনিটের মাথায় ডেনিস বার্গক্যাম্পের দারুণ এক গোলে খেলায় সমতা ফেরায় নেদারল্যান্ডস। এর দশ মিনিট পরেই আবারো এগিয়ে যায় ডেনমার্ক, এবারো গোলদাতা সেই লারসেন।
২-১ গোলের লিড ধরে রেখে প্রাণপণে রক্ষণ সামলে যাচ্ছিল ডেনমার্ক, তবে ৮৫ মিনিটে ফ্রাঙ্ক রাইকার্ডের গোলে আবারো খেলায় ফিরে আসে ডাচরা। এরপর অতিরিক্ত ৩০ মিনিটেও কোনো গোল না হলে খেলা গড়ায় টাইব্রেকে, সেখানে ভ্যান বাস্তেনের নেওয়া পেনাল্টি ঠেকিয়ে দিয়ে দলকে ফাইনালে নিয়ে যান পিটার স্মাইকেল।
শিরোপা নির্ধারণী লড়াইয়ে তৎকালীন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন জার্মানির মুখোমুখি হয় ড্যানিশরা। তাই স্বাভাবিকভাবেই ফাইনালেও আন্ডারডগ হিসেবে খেলতে নামে ডেনমার্ক। ম্যাচের শুরু থেকেই আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে খেলতে থাকে জার্মানি। মাঝমাঠ থেকে দূরপাল্লার এক শটও নিয়েছিলেন এফেনবার্গ। তবে তার সেই শট বেশ ভালোভাবেই সামলে নেন স্মাইকেল। জার্মানির এমন আক্রমণাত্মক ভঙ্গির বিপরীতে হাই প্রেসিং ফুটবল খেলার দিকেই নজর ছিল ডেনমার্কের। বিশেষ করে জার্মানির ডিফেন্স লাইন থেকে বল কেড়ে নিয়ে আচমকা আক্রমণ চালানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল তারা।
এই কৌশল অনুসরণ করে ১৮ মিনিটে জার্মান লেফটব্যাক আন্দ্রেস ব্রেহমেকে দারুণ এক ট্যাকল করে বল কেড়ে নেন ড্যানিশ সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার কিম ভিলফোর্ট। ঐ ট্যাকলের ফলে বল চলে যায় পোলসেনের কাছে, ডান প্রান্ত থেকে কিছুটা ভেতরে ঢুকে পেনাল্টি বক্সের একদম শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা জন ইয়েনসেনের দিকে বল বাড়িয়ে দেন তিনি। তারপর ইয়েনসেনের জোরালো শট, ১-০ গোলে এগিয়ে ডেনমার্ক!
আচমকা এই গোল খেয়ে কিছুটা হতভম্ব হয়ে যায় জার্মানি, তবে পিছিয়ে পড়ে আবার খেলায় ফিরে আসার ব্যাপারে তো তারা বরাবরই সিদ্ধহস্ত। তাই এবারও সেই প্রত্যাবর্তনের আশায় টানা আক্রমণ চালাতে থাকে জার্মানরা। কিন্তু ড্যানিশদের দৃঢ় রক্ষণভাগের কাছে প্রতিটি আক্রমণই শেষ মুহূর্তে খেই হারিয়ে ফেলছিল। প্রথমার্ধে জার্মান সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার ম্যাথিয়াস স্যামার দূরপাল্লার এক শট নিয়েছিলেন, তবে দারুণ দক্ষতায় সেই শট ফিরিয়ে দেন স্মাইকেল।
প্রথমার্ধের মতো দ্বিতীয়ার্ধেও বল পজেশন ও শট নেওয়ায় জার্মানদের দাপট অব্যাহত ছিল, কিন্তু কিছুতেই যেন কিছু হচ্ছিল না। উল্টো পাল্টা আক্রমণ থেকে ড্যানিশরা ব্যবধান দ্বিগুণ করতে পারত। কিন্তু ভিলফোর্টের শট গোলবারের বাইরে চলে যায়। এরপরেই ম্যাচে ফিরে আসার সেরা সুযোগ পায় জার্মানি। কিন্তু ইয়ুর্গ্যান ক্লিন্সম্যানের নেওয়া দারুণ হেডার অসাধারণ দক্ষতায় ঠেকিয়ে দেন স্মাইকেল।
ম্যাচের ৭৮ মিনিটে হাফ লাইনের কাছাকাছি হেডের মাধ্যমে বল জেতেন বদলি খেলোয়াড় ক্লস ক্রিশ্চিয়ানসেন। সেখান থেকে বল পেয়ে এগিয়ে যেতে থাকেন ভিলফোর্ট। তখনও তাকে ঘিরে ছিল দুই জার্মান ডিফেন্ডার আন্দ্রেস ব্রেহমি ও থমাস হেলমার। তবে দারুণ এক টার্ন নিয়ে তাদের বোকা বানিয়ে শট নেন ভিলফোর্ট। তার নেওয়া সেই শট গোলপোস্টে লেগে জালে জড়ালে ২-০ গোলে এগিয়ে যায় ডেনমার্ক।
এই গোলের সাথে সাথেই ড্যানিশ রূপকথার শেষ পৃষ্ঠাটাও যেন লেখা হয়ে যায়, বাছাইপর্বের বাধা পার হতে না পারা ডেনমার্ক আসর শেষ করে চ্যাম্পিয়ন হিসেবে! গোটেনবার্গে ড্যানিশ অধিনায়ক লার্স ওলসেনের শিরোপা হাতে উল্লাস এখনও ড্যানিশদের ফুটবল ইতিহাসের সর্বোচ্চ সাফল্য। মাত্র এক সপ্তাহের প্রস্তুতি নিয়ে খেলতে আসা ডেনমার্কের এমন সাফল্য আসর শুরুর আগে হয়তো কেউই চিন্তা করতে পারেনি। তাদের এই শিরোপাজয়ের বড় কারণ ছিল কোচ রিচার্ড নিয়েলসেনের দুর্দান্ত ট্যাকটিস, বিশেষ করে তার বদলি খেলোয়াড়েরা যেভাবে জাদুর মতো খেলার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল তা এককথায় অসাধারণ। এছাড়া প্রত্যাশার কোনো চাপ না থাকাটা তাদের অনেকখানি নির্ভার রেখেছিল, এ ব্যাপারে দলের এই সাফল্যের অন্যতম প্রধান কারিগর কিম ভিলফোর্ট বলেন,
মাত্র এক সপ্তাহের মাঝে ইউরোর মতো বড় আসরের জন্য নিজেদের তৈরি করাটা শুরুর দিকে আমাদের কাছেও অসম্ভব মনে হচ্ছিল। তবে টুর্নামেন্টে অংশ না নিয়ে পিছিয়ে যাওয়ার কথা আমরা একবারও চিন্তা করিনি, কারণ এমনটা করলে উয়েফা ও ড্যানিশ ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের মধ্যকার সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্থ হতো। যেহেতু আমাদের নিয়ে কারো তেমন কোনো প্রত্যাশা ছিল না, তাই আমাদের তো আসলে হারানোর কিছুই ছিল না। প্রত্যাশার কোনো চাপ ছাড়া নির্ভার হয়ে খেলতে পারাটা আমাদের অনেক সাহায্য করেছিল।
তবে শুধু চাপহীন হয়ে খেলতে পারাটা তো আর এত বড় শিরোপাজয়ের একমাত্র নিয়ামক হতে পারে না, পুরো দলের একজোট হয়ে খেলাটাও ড্যানিশদের সাফল্যের বড় একটা কারণ ছিল। এ ব্যাপারে ভিলফোর্ট বলেন,
আমাদের ওই স্কোয়াডের দশজন খেলোয়াড়ই ব্রন্ডবি ক্লাবের সাথে যুক্ত ছিল, ইউরোর এক বছর আগেই উয়েফা কাপের সেমিফাইনাল খেলেছিল ব্রন্ডবি। তাছাড়া দলের অনেক খেলোয়াড়ই অনুর্ধ্ব-২১ আর অলিম্পিকে একসাথে খেলে এসেছিল। এর ফলে আমাদের দলীয় বোঝাপড়াটা দারুণ ছিল, যা আমাদের শিরোপা জয়ের ক্ষেত্রে অনেক বড় ভূমিকা রেখেছিল। আমাদের হয়তো সেরা খেলোয়াড় ছিল না কিন্তু আমাদের দলটি সেরা ছিল।
বড় কোনো শিরোপা জয়ের ক্ষেত্রে দলীয় এই বোঝাপড়া ঠিক কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে ১৯৯২ ইউরোর ডেনমার্ক ইতিহাসের পাতায় উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। তাছাড়া অধিকাংশ আন্ডারডগদের সাফল্যগাঁথায় ভাগ্যের মারপ্যাঁচে দুর্বল প্রতিপক্ষ পাওয়া বড় অবদান রাখে। এক্ষেত্রেও ডেনিশ রূপকথা ব্যতিক্রম; ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি- এমন তিনটি পরাক্রমশালী দলকে হারিয়ে শিরোপাজয় চাট্টিখানি কোনো কথা নয়। আন্তর্জাতিক ফুটবলে আন্ডারডগদের সকল কীর্তির মাঝে ড্যানিশদের এই রূপকথা তাই সবদিক থেকেই অনন্য।