খ্রিষ্টাব্দ গণনার শুরু থেকে দুই হাজার বাইশতম বারের মতো সূর্যকে প্রদক্ষিণ করা সম্পন্ন করল পৃথিবী। দুই হাজার তেইশতম ঘূর্ণন শুরুর প্রাক্কালে আরেকবার পেছন ফিরে তাকানো যাক, দেখে নেওয়া যাক ক্রীড়াঙ্গনের দশটি বিশেষ মুহূর্ত।
১. মেসির আর্জেন্টিনার বিশ্বজয়
আর্জেন্টিনার ছত্রিশ বছরের অপেক্ষা আর মেসির আজন্মলালিত স্বপ্ন, দুটো অপূর্ণতাই পূর্ণতা পেলো আঠারো ডিসেম্বর রাতে। কাতারের লুসাইল স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ফাইনালের নির্ধারিত সময়ে ৩-৩ গোলে সমতা থাকার পর টাইব্রেকারে ফ্রান্সকে ৪-২ গোলে পরাজিত করে আকাশি-সাদা জার্সিতে তৃতীয় তারকা যুক্ত করলেন লিওনেল স্কালোনির শিষ্যরা।
পুরো টুর্নামেন্টে দুর্দান্ত খেলে সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার গোল্ডেন বল জিতে নেন আর্জেন্টিনার অধিনায়ক লিওনেল মেসি। সর্বোচ্চ আটটা গোল করে গোল্ডেন বুট জেতেন ফ্রান্সের কিলিয়ান এমবাপে। সেরা তরুণ খেলোয়াড় আর সেরা গোলরক্ষকের পুরস্কার দুটোও যায় আর্জেন্টিনার ঘরে, যথাক্রমে এনজো ফার্নান্দেজ আর এমিলিয়ানো মার্টিনেজ জিতে নেন ঐ দুটো পুরস্কার।
২. পেলের বিদায়
কারো মতে তিনি ফুটবলের রাজা, কারো মতে তিনি অবিসংবাদিত সম্রাট। তবে যিনি যে নামেই ডাকুন না কেন, ‘কালো মানিক’ হিসেবে খ্যাত পেলেকে হারানোটা ধাক্কা হয়েই এসেছে সবার কাছে। ৮২ বছর বয়সে অনন্তলোকের পথে পা বাড়নো পেলে অসুস্থ ছিলেন অনেক দিন ধরেই, তবুও তার বিদায়ে ম্যূহমান হয়েছে ফুটবলবিশ্ব।
তিনবার জিতেছেন বিশ্বকাপ, ৭৭ গোল করে হয়েছেন ব্রাজিলের সর্বোচ্চ গোলদাতা, স্বীকৃত ফুটবলে করেছেন সাত শতাধিক গোল, তবুও পেলের মহত্বকে পরিসংখ্যান দিয়ে বোঝানো প্রায় অসম্ভব। ফুটবলকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গিয়েছিলেন এই কিংবদন্তি, একটা খেলাকে করে তুলেছিলেন শান্তি আর ভালোবাসা ছড়ানোর মাধ্যম। জীবন-নদীর ওপারে চলে গেলেও পেলেকে তাই ফুটবলের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন হিসেবে মনে রাখবে ফুটবলবিশ্ব।
৩. টি-টোয়েন্টির বিশ্বসেরা ইংল্যান্ড
২০২১ সাল পর্যন্ত টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে দুইবার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার কৃতিত্ব ছিল মাত্র একটা দলের, ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ২০২২-এ এসে সেই গৌরবে ভাগ বসাল ইংল্যান্ড। অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে অনুষ্ঠিত ফাইনালে পাকিস্তানকে পরাজিত করে দ্বিতীয়বারের মতো শিরোপা উঁচিয়ে ধরল জস বাটলারের দলটি।
সেমিফাইনালে রোহিত শর্মার ভারতকে ১০ উইকেটে উড়িয়ে দিয়ে ফাইনালে উঠেছিল ‘তিন সিংহ’রা। ফাইনালে বেন স্টোকসের অপরাজিত ৫২ রানের ইনিংসে ভর করে পাকিস্তানের ছুঁড়ে দেওয়া ১৩৮ রানের লক্ষ্য পেরিয়ে যায় তারা, ফাইনালের সেরা খেলোয়াড় হয়ে ৬ বছর আগের ‘পাপের’ প্রায়শ্চিত্ত করেন স্টোকস, কলকাতার যে ফাইনালে তাঁর করা শেষ ওভারে টানা চারটি ছক্কা মেরে শিরোপা ছিনিয়ে নেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের কার্লোস ব্রাথওয়েট। ছয় বছর পরে এসে, আরেক টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে, সব আলো নিজের দিকে টেনে নিলেন স্টোকস। টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় হয়েছিলেন স্যাম কারেন।
৪. পেশাদার টেনিসকে ফেদেরারের বিদায়
একটা গোটা প্রজন্ম যাকে দেখে টেনিসে আকৃষ্ট হয়েছে, সেই রজার ফেদেরার পেশাদার টেনিসকে বিদায় বলে দিলেন এই ২০২২-এ। চোট থেকে সেরে উঠে ২০২২ এর শেষভাগে আবার টেনিসে ফিরবেন, এমনটাই ধারণা সবার। কিন্তু সেই ধারণায় জল ঢেলে ফেদেরার ঘোষণা দেন, ২০২২ এর লেভার কাপই হবে তার শেষ পেশাদার টুর্নামেন্ট।
ঐ টুর্নামেন্টে টিম ওয়ার্ল্ডের বিপক্ষে ডাবলস ম্যাচটাই হয় ফেদেরারের পেশাদার ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ, যে ম্যাচে ফেদেরারের সঙ্গী ছিলেন তার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ও বন্ধু রাফায়েল নাদাল। ঐ ম্যাচে হেরে গেলেও দারুণ সব মুহূর্তের জন্ম দেন দুইজন, যার শেষটা হয় ম্যাচ শেষের দুই বন্ধুর বাঁধভাঙ্গা কান্নায়। দুইজনের অশ্রুসজল চেহারা চোখ ভেজায় কোটি কোটি ক্রীড়াপ্রেমীর।
৫. ফেদেরার-জোকোভিচকে ছাড়িয়ে নাদাল
২০২১ সালেও গ্র্যান্ড স্ল্যাম শিরোপা সংখ্যায় রজার ফেদেরার আর নোভাক জোকোভিচের সমান্তরালে ছিলেন রাফায়েল নাদাল। ইনজুরির কারণে একের পর এক টুর্নামেন্ট মিস করায় তাদের দুইজনকে ছপিয়ে যাওয়াটা নিছক কল্পনা বলে মনে হচ্ছিল এক সময়ে। তবে ২০২২ এর শুরুতে অস্ট্রেলিয়ান ওপেন আর ফ্রেঞ্চ ওপেন জিতে জোকোভিচ-ফেদেরারকে ছাড়িয়ে গেলেন এই স্প্যানিশ কিংবদন্তি।
রাফায়েল নাদালের বর্তমান গ্র্যান্ড স্ল্যাম সংখ্যা ২২টা। ২১ ও ২০টা গ্র্যান্ড স্ল্যাম নিয়ে যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে আছেন নোভাক জোকোভিচ আর রজার ফেদেরার।
৬. ইউরোপের সেরা রিয়াল মাদ্রিদ, বিশ্বের সেরা করিম বেনজেমা
শিরোপা সংখ্যায় ইউরোপের সর্বকালের সেরা দল তারাই, তবে রিয়াল মাদ্রিদের এবারের শিরোপাটা নিশ্চিতভাবেই বিশেষ হয়ে থাকবে ভক্ত-সমর্থকদের কাছে। ‘প্রত্যাবর্তনের অবিশ্বাস্য গল্প’ বলতে যা বোঝায়, সেটার পুরোপুরি প্রয়োগ করেই চৌদ্দতমবারের মতো শিরোপা ঘরে তুলল মাদ্রিদের অভিজাতরা।
রাউন্ড অব সিক্সটিন, কোয়ার্টার ফাইনাল এবং সেমিফাইনালে যথাক্রমে পিএসজির বিপক্ষে অ্যাগ্রিগেটে ০-২ এ পিছিয়ে পড়ে ৩-২ এ জয়, চেলসির বিপক্ষে অ্যাগ্রিগেটে ২-৩ এ পিছিয়ে পড়ে ৪-৩ এ জয়, এবং ম্যানচেস্টার সিটির বিপক্ষে অ্যাগ্রিগেটে ৩-৫ এ পিছিয়ে পড়েও শেষ মুহূর্তে দুই গোল করে সমতা ফেরানো, এরপর ৬-৫ এ জয়, রিয়ালের জন্য যাত্রাটা এর চেয়ে কঠিন আর রোমাঞ্চকর হতে পারত না। এরপর ফাইনালে লিভারপুলকে ১-০ গোলে পরাজিত করে আরেকবার ইউরোপের বুকে মাদ্রিদ-সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা।
আর এই চ্যাম্পিয়নস লিগের পাশাপাশি লা লিগায় দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করে প্রথমবারের মতো ব্যালন ডি’অর জিতে নেন ফরাসি ফরোয়ার্ড করিম বেনজেমা।
৭. কার্লোস আলকারাজের স্বপ্নের বছর
তার বয়স মাত্র উনিশ, তবে এই উনিশ বছর বয়সেই কার্লোস আলকারাজ মোটামুটি স্বপ্নের বছর কাটিয়ে ফেলেছেন। ২০২২ এর ইউএস ওপেনের ফাইনালে ক্যাস্পার রুডকে পরাজিত করে আলকারাজ জিতে নিয়েছেন তার প্রথম গ্র্যান্ড স্ল্যাম শিরোপা।
এখানেই শেষ নয়, এই স্প্যানিশ তরুণ বছরটা শেষ করেছেন র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে থেকে। মাত্র উনিশ বছর চার মাস বয়সে পুরুষদের সিঙ্গেলসের র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে ওঠা, তার আগে এত কম বয়সে এই কীর্তি অর্জন করতে পারেননি কেউ।
৮. শিরোপা ধরে রাখলেন ভারস্টেপেন
২০২১ এর পর ২০২২ মৌসুমেও এফ ওয়ানের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপাটা নিজের কাছে রাখলেন ম্যাক্স ভারস্টেপেন। ১৫টি জয়, এর সাথে ৪৫৪ পয়েন্ট নিয়ে প্রতিযোগিতা শেষ করেন নেদারল্যান্ডসের এই তারকা, সাথে নাটকীয়ভাবে পরাজিত করেন লুইস হ্যামিল্টনকে।
তাতে ফেরারীকে প্রায় ২০০ পয়েন্টের ব্যবধানে দ্বিতীয় স্থানে ঠেলে অনেক বছর পর রেড বুল জিতে নিল কনস্ট্রাকটরস টাইটেল।
৯. এনবিএ-এর সেরা গোল্ডেন স্টেট ওয়ারিয়র্স
২০২১-২২ মৌসুমে এনবিএ-এর চ্যাম্পিয়নের ট্রফিটা নিজেদের ঘরে তুলেছিল গোল্ডেন স্টেট ওয়ারিয়র্স। এর মাধ্যমে টুর্নামেন্টের ৭৬তম মৌসুমে এসে নিজেদের মুকুটে সপ্তম পালক যুক্ত করলো তারা, সর্বশেষ আট বছরের মধ্যে চতুর্থবার।
ফাইনালে বোল্টন সেল্টিককে ৪-২ এ পরাজিত করে গোল্ডেন স্টেট ওয়ারিয়র্স।
১০. রোনালদোর সৌদি-গমন
২০২২ ছিল ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর ক্যারিয়ারের বিশেষ একটা বছর। ‘২১-‘২২ মৌসুম শেষ করেছিলেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সর্বোচ্চ গোলসংগ্রাহক হিসেবে। এরপর ইউনাইটেডের নতুন কোচ হিসেবে এরিক টেন হ্যাগের আগমন, রোনালদোর সাথে তাঁর বিবাদের গুঞ্জন, পিয়ার্স মরগানকে দেওয়া তাঁর বিস্ফোরক সাক্ষাৎকার, ইউনাইটেড কর্তৃক কন্ট্রাক্ট-টার্মিনেশন, বিশ্বকাপে হতশ্রী পারফরম্যান্স, আর সব শেষে সৌদি আরবের ক্লাব আল নাসেরের সাথে চুক্তি করা, রোনালদোর জন্য ঘটনাবহুল এক বছর হয়ে থাকবে ২০২২।
বয়স সাঁইত্রিশ হয়ে গেলেও রোনালদোর এখনই ইউরোপ ছাড়ার কথা হয়তো তার ভক্তরাও ভাবেননি। কিছুটা অপ্রত্যাশিতভাবেই, বিশেষ করে পিয়ার্স মরগানের সাক্ষাৎকারে এখনই ইউরোপীয় ফুটবল ছাড়তে অনাগ্রহ জানানোর পর রোনালদোর এই সৌদি-গমন নিঃসন্দেহে অবাক করেছে ফুটবলপ্রেমীদের।