আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ইতিহাসে প্রথম দল হিসেবে এক হাজার টেস্ট ম্যাচ খেলার কৃতিত্ব অর্জন করলো ইংল্যান্ড। বার্মিংহামে ১লা আগস্ট ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে এই মাইলফলক স্পর্শ করে তারা।
সবকিছুতে সবাই প্রথমজনকেই বেশি মনে রাখে। যেমন- টেস্ট ক্রিকেটের প্রথম সেঞ্চুরিয়ান কে? অধিকাংশ ক্রিকেট ভক্ত এই প্রশ্নের উত্তরে বলবে, চার্লস ব্যানারম্যান। কিন্তু দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে কে শতক হাঁকিয়েছেন, এমন প্রশ্নে অনেকেরই চোখ কপালে উঠবে।
এই লেখাতেও ইতিহাসের প্রথম ব্যক্তিদেরকে নিয়েই আলোচনা হবে। ইংল্যান্ডের এক হাজারতম টেস্ট উপলক্ষে তাদের টেস্ট ক্রিকেটের অগ্রদূতদের নিয়ে এই লেখা।
প্রথম টেস্ট ম্যাচ
১৮৭৭ সালের ১৫ই মার্চ, মেলবোর্নে ইংল্যান্ড বনাম অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে ইতিহাসের প্রথম টেস্ট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। আন্তর্জাতিক টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসের সেই প্রথম ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার কাছে ৪৫ রানে পরাজিত হয় ইংল্যান্ড।
মেলবোর্নে টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে অস্ট্রেলিয়া ২৪৫ রান সংগ্রহ করে। অজি ওপেনার চার্লস ব্যানারম্যান একাই করেন ১৬৫ রান। জবাবে ইংল্যান্ড নিজেদের প্রথম ইনিংসে ১৯৬ রান করে। অস্ট্রেলিয়া দ্বিতীয় ইনিংসে ১০৪ রানে গুটিয়ে গেলে জয়ের জন্য ইংল্যান্ডের ১৫৪ রান প্রয়োজন পড়ে। জয়ের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে টম কেন্ডলের বোলিং তোপের মুখে পড়ে ১০৮ রানে সবকটি উইকেট হারায় ইংল্যান্ড। কেন্ডল ৫৫ রানের বিনিময়ে ৭ উইকেট শিকার করেন।
প্রথম অধিনায়ক
ইংল্যান্ডের ঐতিহাসিক প্রথম টেস্ট ম্যাচে দলকে নেতৃত্ব দেন সাসেক্সের বাঁহাতি অর্থোডক্স বোলার জেমস লিলিহোয়াইট জুনিয়র। তার নেতৃত্বে সেই ম্যাচ না জিতলেও দ্বিতীয় টেস্ট ম্যাচে জয় পায় ইংল্যান্ড।
মেলবোর্নে একই সিরিজের ২য় টেস্ট ম্যাচে অস্ট্রেলিয়াকে ৪ উইকেটে পরাজিত করে ইংল্যান্ড। অধিনায়ক লিলিহোয়াইট দ্বিতীয় ইনিংসে ৪ উইকেটসহ ম্যাচে ৬ উইকেট শিকার করেন।
তিনি ইংল্যান্ডকে এই দুটি টেস্টেই নেতৃত্ব দেন। তার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের স্থায়িত্বও ছিলো এই দুই ম্যাচের। জেমস লিলিহোয়াইট খেলোয়াড়ি জীবন শেষে আম্পায়ার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।
প্রথম টেস্ট জয়
টেস্ট ক্রিকেটে জয়ের স্বাদ পেতে খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি ইংল্যান্ডকে। নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচেই অস্ট্রেলিয়াকে ৪ উইকেটে পরাজিত করে ইংল্যান্ড।
মেলবোর্নে ১৮৭৭ সালের ৩১শে মার্চ, সিরিজের দ্বিতীয় টেস্ট ম্যাচে টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেয় অস্ট্রেলিয়া। প্রথম ইনিংসে অস্ট্রেলিয়াকে ১২২ রানে গুটিয়ে দিয়ে ইংল্যান্ড নিজেদের প্রথম ইনিংসে ২৬১ রান সংগ্রহ করেছিলো। দলের পক্ষে সর্বোচ্চ ৫২ রানের ইনিংস খেলেন জর্জ ইউলিট।
প্রথম ইনিংসে মাত্র ১২২ রানে গুটিয়ে গেলেও দ্বিতীয় ইনিংসে ঘুরে দাঁড়ায় অস্ট্রেলিয়া। টপ অর্ডারের ৪ ব্যাটসম্যানের প্রত্যেকে ত্রিশোর্ধ্ব ইনিংস খেলার ফলে দ্বিতীয় ইনিংসে অস্ট্রেলিয়া ২৫৯ রান সংগ্রহ করে। এতে করে জয়ের জন্য ইংল্যান্ডের প্রয়োজন পড়ে ১২১ রানের।
জয়ের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে মাত্র ৯ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে বসে ইংল্যান্ড। সেখান থেকে দলকে টেনে তোলেন প্রথম ইনিংসে অর্ধশতক হাঁকানো জর্জ ইউলিট। তার ৬৩ রানের উপর ভর করে অস্ট্রেলিয়াকে ৪ উইকেটে পরাজিত করে ইংল্যান্ড।
প্রথম উইকেট শিকারি
টেস্ট ক্রিকেটে ইংল্যান্ডের হয়ে প্রথম উইকেট শিকার করেন ডানহাতি পেসার অ্যালেন হিল। মেলবোর্নে অজি ওপেনার ন্যাট থমসনকে মাত্র এক রানে ফিরিয়ে দিয়ে তিনি এই কৃতিত্ব অর্জন করেন। ঐ ইনিংসে এটিই তার একমাত্র উইকেট ছিলো। ১টি উইকেট শিকার করেই ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নিয়েছেন।
অ্যালেন হিল ইংল্যান্ডের হয়ে দুটি টেস্ট ম্যাচ খেলেছেন। নিজের দ্বিতীয় ম্যাচের প্রথম ইনিংসে তিনি মাত্র ২৭ রান খরচায় ৪ উইকেট শিকার করেছিলেন। ইয়র্কশায়ারের এই পেসার মাত্র দুটি টেস্ট ম্যাচ খেললেও কাউন্টিতে ১৯৩টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ খেলেছেন। ১৯৩ ম্যাচে তার উইকেট সংখ্যা ৭৪৯।
প্রথম ডিসমিসাল
ইংল্যান্ডের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে সাজঘরে ফেরেন জন সেলবি। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ঐতিহাসিক টেস্ট ম্যাচের দ্বিতীয় দিনে জন হজেসের বলে কুপারের হাতে ক্যাচ দেন সেলবি। ইংল্যান্ডের এ উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান আউট হওয়ার আগে ১৮ বলে ৭ রান করেন।
জন সেলবি প্রথম ইংলিশ ব্যাটসম্যান হিসেবে সাজঘরে ফিরলেও এরপর আরও পাঁচটি টেস্ট ম্যাচ খেলেন। তিনি মোট ছয়টি টেস্ট ম্যাচ খেলে দুটি অর্ধশতকের সাহায্যে ২৩.২৭ ব্যাটিং গড়ে ২৫৬ রান করেন।
প্রথম শতক
ইংল্যান্ডের হয়ে প্রথম শতক হাঁকান ডব্লিউ. জি. গ্রেস। ক্রিকেটের প্রথম সুপারস্টার ডব্লিউ. জি. গ্রেস যোগ্য ব্যক্তি হিসেবেই ইংল্যান্ডের প্রথম সেঞ্চুরিয়ানের খেতাব অর্জন করেন।
সেসময়কার ক্রিকেটের আইকন জি. গ্রেসের ঐতিহাসিক উদ্বোধনী টেস্টে ইংল্যান্ড দলে না থাকাটা ছিলো আশ্চর্যজনক। অবশ্য ঐ ম্যাচটি আগে থেকে আন্তর্জাতিক ম্যাচের স্বীকৃতি পায়নি। কেউই আগে থেকে জানতো না, মেলবোর্নের ঐ টেস্ট ম্যাচটিই হতে যাচ্ছে প্রথম আন্তর্জাতিক টেস্ট ম্যাচ।
১৮৮০ সালের ৬ সেপ্টেম্বর, লন্ডনে সিরিজের একমাত্র টেস্ট ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার মুখোমুখি হয় ইংল্যান্ড। এই ম্যাচের মধ্য দিয়ে টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে জি. গ্রেসের। নিজের অভিষেক ম্যাচের প্রথম ইনিংসে ২৯৪ বলে ১২টি চার হাঁকিয়ে ১৫২ রানের ইনিংস খেলেন তিনি। এই কিংবদন্তি ক্রিকেটারের ইংল্যান্ডের হয়ে দুটি টেস্ট শতক রয়েছে। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে তিনি ১২৪টি সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন।
প্রথম সিরিজ জয়
ইংল্যান্ড তাদের প্রথম সিরিজ জয় করে ১৮৮০ সালে ঘরের মাটিতে। কেনিংটন ওভালে সফরকারী অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে একমাত্র টেস্ট ম্যাচে ৫ উইকেটের জয় পায় ইংল্যান্ড। এই ম্যাচেই ইংল্যান্ডের হয়ে প্রথম টেস্ট শতক হাঁকান ডব্লিউ. জি. গ্রেস।
টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করে স্কোরবোর্ডে ৪২০ রান জমা করে ইংল্যান্ড। জি. গ্রেস উদ্বোধনী উইকেট জুটিতে তার বড় ভাই এডওয়ার্ড গ্রেসের সাথে ৯১ রান যোগ করেন। এডওয়ার্ড ৩৬ রান করে ফিরে গেলেও জি. গ্রেস থামেন ১৫২ রানে। ইংল্যান্ডের ৪২০ রানের জবাবে অস্ট্রেলিয়া নিজেদের প্রথম ইনিংসে মাত্র ১৪৯ রানে গুটিয়ে গিয়ে ফলো-অনে পড়ে।
ফলো-অনে ব্যাট করতে নেমে দ্বিতীয় ইনিংসে উইলিয়াম মারডকের অপরাজিত ১৫৩ রানের উপর ভরে ৩২৭ রান সংগ্রহ করে অস্ট্রেলিয়া। ফলে জয়ের জন্য ইংল্যান্ডের প্রয়োজন পড়ে ৫৭ রানের। শেষপর্যন্ত ৫ উইকেট হাতে রেখে জয়ের লক্ষ্যে পৌঁছে যায় ইংল্যান্ড।
প্রথম পাঁচ উইকেট শিকারি
বাঁহাতি স্পিনার আলফ্রেড শ ঐতিহাসিক প্রথম টেস্ট ম্যাচের দ্বিতীয় ইনিংসে ৩৮ রানের বিনিময়ে ৫ উইকেট শিকার করেন। তিনিই প্রথম ইংলিশ বোলার হিসেবে ৫ উইকেট শিকারের কৃতিত্ব অর্জন করেন। তার শিকারে পরিণত হয়ে সাজঘরে ফেরেন ন্যাট থমসন, টম গ্যারেট, ব্রান্সবি কুপার, জ্যাক ব্লাকহ্যাম এবং ডেভ গ্রেগরি।
ঐ টেস্টের প্রথম ইনিংসেও তিনি ৩ উইকেট শিকার করেন। আলফ্রেড শ এরপর আরও ৬টি টেস্ট ম্যাচ খেলে মাত্র ৪ উইকেট শিকার করেছিলেন। তিনি ১৮৮২ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর সময় ৭ ম্যাচে ১২ উইকেট শিকার করেছিলেন। তবে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে ৪০৪ ম্যাচে ২,০২৭ উইকেট শিকার করেছেন।
এক ইনিংসে দশ উইকেট শিকারি
এক ইনিংসে বিপক্ষ দলের সবকটি উইকেট শিকার করা চাট্টিখানি কথা না। এরকম ঘটনা ক্রিকেটে খুব বেশি দেখা যায় না। এই কীর্তি দেখার জন্য ক্রিকেট বিশ্বকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। প্রথম বোলার হিসাবে এই কীর্তি গড়েন ইংল্যান্ডের জিম লেকার। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এক ইনিংসে ১০ উইকেট শিকারের ঘটনা ঘটেছে দুবার। দ্বিতীয় বোলার হিসাবে এই কীর্তি গড়েন অনিল কুম্বলে।
১৯৫৬ সালের ২৬ জুলাই শুরু ম্যানচেস্টার টেস্টের প্রথম ইনিংসে অস্ট্রেলিয়ার ৯ জন ব্যাটসম্যানকে সাজঘরে পাঠিয়েছিলেন জিম লেকার। তিনি ১৬.৪ ওভার বল করে ৩৭ রানের বিনিময়ে ৯ উইকেট শিকার করেন। প্রথম ইনিংসে মাত্র ১ উইকেটের জন্য সবকটি উইকেট নিজের দখলে নিতে না পারলেও দ্বিতীয় ইনিংসে ৫১.২ ওভার বল করে ৫৩ রানের বিনিময়ে ১০ উইকেট শিকার করেন। ম্যানচেস্টার টেস্টে জিম লেকার দুই ইনিংসে প্রতিপক্ষের ২০ উইকেটের মধ্যে ১৯ উইকেট একাই শিকার করেন, যে রেকর্ড এখনো অক্ষুণ্ন রয়েছে।
ফিচার ইমেজ: ICC-CRICKET.COM