২০১৪। মারাকানা। ফাইনাল।
আর্জেন্টিনা সমর্থকদের কাছে এই তিনটা শব্দ পৃথক নয়, বরং এই তিনটা শব্দ মিলে তৈরি করেছে আরেকটি শব্দ, ‘দীর্ঘশ্বাস’। বিশ্বকাপের সোনালি ট্রফিটার খুব কাছে গিয়েও ছুঁয়ে দেখতে না পারার সেই দীর্ঘশ্বাসের প্রতিশব্দ ‘আনহেল ডি মারিয়া’ — মারাকানার ওই ফাইনালে যদি ডি মারিয়া থাকতেন!
উরুর পেশি ছিঁড়ে যাওয়ায় খেলতে পারেননি ঐ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে, নেদারল্যান্ডকে টাইব্রেকারে হারানোর ঐ ম্যাচে ছিলেন না স্কোয়াডেই। কিন্তু ফাইনালে যখন জার্মানির মুখোমুখি আকাশি-সাদারা, স্বপ্নপূরণের এত কাছে এসে কি আর বসে থাকা যায়? যুক্তি দিয়ে চিন্তা করলে ডি মারিয়ার তখন বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম নেওয়ার কথা, ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদ থেকেও না খেলার আহ্বান জানিয়ে চিঠি এসেছিল। কিন্তু স্বপ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মস্তিষ্ক নয়, ডি মারিয়া চিন্তা করলেন তাঁর হৃদয় দিয়ে। সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন, প্রয়োজনে পেইন কিলার নিয়ে হলেও মাঠে নামবেন তিনি।
ফাইনালের আগের রাতে ঘুম হয়নি তার। ফাইনালের উত্তেজনা-উৎকণ্ঠা তো ছিলই, সাথে হোটেলের বাইরে স্থানীয় ব্রাজিলীয়দের আতশবাজি ফোটানো আর হট্টগোলে দু’চোখের পাতা এক করতে পারেননি তিনি। খুব ভোরে বিছানা ছেড়ে দেখা করেছিলেন কোচ আলেসান্দ্রো সাবেয়ার সাথে, জানিয়েছিলেন কোচ চাইলে তিনি যেকোন সময়ে মাঠে নামতে রাজি। তবে ম্যাচের আগের টিম মিটিংয়ে যখন মূল একাদশে তাঁর পরিবর্তে ঘোষিত হলো এনজো পেরেজের নাম, ডি মারিয়া বোধহয় অসন্তুষ্ট হলেন না। কোচ তো তার হাতে থাকা সেরা আর ফিট খেলোয়াড়টিকেই মাঠে নামাবেন!
প্রথম একাদশে সুযোগ না হলেও ডি মারিয়া প্রস্তুত থাকলেন বদলি হিসেবে নামার জন্য। ম্যাচ শুরুর আগে একটা ইনজেকশন নিলেন, মাঝ বিরতিতে আরেকটা। কিন্তু বদলি হিসেবে নামার ডাকটা আর এলো না। আর্জেন্টিনাও ম্যাচটা হেরে গেলো ১-০ গোলে। অন্য সব আর্জেন্টাইন খেলোয়াড়ের মতো ম্যাচশেষে কাঁদলেন আনহেল ডি মারিয়া, বেঞ্চে বসে দলকে হারতে দেখার চেয়ে বেশি কষ্ট আর কী-ই বা হতে পারে! কাঁদতে কাঁদতে ডি মারিয়া হয়তো ফিরে গিয়েছিলেন এগারো বছর আগে, পনেরো বছর বয়সী কিশোর ডি মারিয়াও যে কেঁদেছিলেন এমনই এক নিষ্ফল চাপা ক্ষোভে, দুঃখে।
ডি মারিয়া তখন রোজারিও সেন্ট্রালের যুবদলের হয়ে খেলা শুরু করেছেন। রোগাপটকা শরীরের ডি মারিয়া কোচের আক্রমণাত্মক খেলার সাথে ঠিক মানিয়ে নিতে পারছিলেন না। একদিন অনুশীলনের সময়ে প্রতিপক্ষের বক্সের মধ্যে একটা হেড করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন তিনি, অনুশীলনের পর কোচ তাই ভীষণ বকাবকি করেছিলেন তাকে। আবেগপ্রবণ ডি মারিয়া বাড়িতে ফিরেই ভেঙে পড়েছিলেন কান্নায়, সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আর কখনো ফুটবল না খেলার। ভাগ্যিস, মা সেদিন পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন, সান্ত্বনা দিয়েছিলেন, সাহস যুগিয়েছিলেন! পরদিন আবারও অনুশীলনে গেলেন ডি মারিয়া, আর এবার ঠিকই হেড করে গোল করলেন।
আর্জেন্টিনা ছেড়ে পর্তুগালের বিমান ধরলেন ২০০৭ এর গ্রীষ্মে, লক্ষ্য বেনফিকা। সেখানে তিন বছর কাটিয়ে এরপর পাড়ি জমালেন স্পেনে, রিয়াল মাদ্রিদ হলো তার নতুন ক্লাব। এর আগেই দেশের জার্সিতে জিতে গেছেন প্রথম পদক, অলিম্পিকের স্বর্ণপদক। ফাইনালে মিডফিল্ড থেকে বাড়ানো থ্রু বলটা গোলরক্ষকের মাথার ওপর দিয়ে জালে পাঠিয়ে আর্জেন্টিনার জয়টা এনে দিয়েছিলেন আনহেল ডি মারিয়াই। কে জানত, এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে ১৩ বছর পরে!
বিশ্বকাপের ঐ ফাইনালের সাত বছর পর। মাঝে আরো দুটো কোপা আমেরিকার ফাইনাল খেলেছে আর্জেন্টিনা, দুটোতেই অর্ধেক ফিট হিসেবে মূল একাদশে ছিলেন আনহেল ডি মারিয়া, দুটোতেই চোটে পড়ার কারণে তাকে তুলে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন কোচ, দুটো ফাইনালই গোলশূন্য অবস্থায় গিয়েছিল টাইব্রেকারে, আর হ্যাঁ, দুটো ফাইনালেই পরাজিত দলের নাম ছিল আর্জেন্টিনা। ’১৪, ’১৫, ’১৬ — টানা তিন বছরে একটা বিশ্বকাপ আর দুটো কোপা আমেরিকার ফাইনালে স্ট্রাইকারদের একের পর এক অবিশ্বাস্য মিস আর দুর্ভাগ্যের ফলাফলই আর্জেন্টিনার শিরোপা-খরা আরেকটু প্রলম্বিত হওয়া, সাথে আর্জেন্টিনা ভক্তদের দীর্ঘশ্বাস, ‘যদি ডি মারিয়া ফিট থাকতেন!’
২০২১ সালে তাই যখন আরেকটা কোপা আমেরিকা এলো, আর্জেন্টিনা ভক্তদের প্রার্থনায় তখন গুরুত্ব পেলো আনহেল ডি মারিয়ার সুস্থতাটাও। ডি মারিয়া অবশ্য তখন আর মূল একাদশের ‘অবিসংবাদিত’ অংশ নন, বরং লিওনেল মেসির সাথে লাউতারো মার্টিনেজ আর নিকো গঞ্জালেসের ত্রয়ীকেই গোল করার দায়িত্বটা দিয়েছিলেন কোচ লিওনেল স্কালোনি। দলে ডি মারিয়ার ভূমিকা ছিল তাই অনেকটাই দ্বিতীয়ার্ধে বেঞ্চ থেকে মাঠে নেমে গোলের সুযোগ সৃষ্টি করা। তবে মেসি-মার্টিনেজ নিয়মিত গোল পেলেও গোল পাচ্ছিলেন না নিকো গঞ্জালেস, কোচ স্কালোনিও তাই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে আক্রমণভাগে খেলাচ্ছিলেন তার সব ফরোয়ার্ডকেই। কখনো সার্জিও আগুয়েরো, কখনো আলেহান্দ্রো ‘পাপু’ গোমেজ, কখনো আনহেল ডি মারিয়া, কখনো আনহেল কোরেয়া। তবে টুর্নামেন্টজুড়ে এমন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালালেও ফাইনালে ব্রাজিলের বিপক্ষে স্কালোনি ভরসা রাখলেন ডি মারিয়ার অভিজ্ঞতায়, রদ্রিগো ডি পল, লিয়ান্দ্রো পারেদেস আর জিওভান্নি লো সেলসোর মধ্যমাঠের সামনে আক্রমণভাগে লিওনেল মেসি আর লাউতারো মার্টিনেজের সাথে নামালেন আনহেল ডি মারিয়াকে।
ডি মারিয়া আদৌ নব্বই মিনিট একই গতিতে খেলতে পারবেন কি না বা তার সেই ফিটনেস আছে কি না, এমন নানারকম ‘কু-ডাক’ তখন নিশ্চিতভাবেই ডাকছিল আর্জেন্টিনার সমর্থকদের মনে। আটাশ বছরের শিরোপা-খরা দূর করার প্রশ্নে পুরনো ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতাগুলো মনে ভেসে ওঠাই স্বাভাবিক। ডি মারিয়ার নিজের মনেও হয়তো সেই পুরনো দৃশ্যগুলো ভেসে উঠছিল। তবে দুটো কোপা আমেরিকার ফাইনালে চোটে পড়ে উঠে যাওয়া, বিশ্বকাপের ফাইনালে খেলতে না পারা, সব ছাপিয়ে একটা ভাবনাই ছিল তার মস্তিষ্ক জুড়ে, ‘শাপমোচন’।
তাই ম্যাচের একুশতম মিনিটে মধ্যমাঠ থেকে যখন রদ্রিগো ডি পল বলটা বাড়ালেন তার উদ্দেশ্যে, কালক্ষেপণ না করে রাইট উইং ধরে ছুটতে শুরু করলেন তিনি। তার বুড়ো হাড়ের ভেলকিতে পেছনে পড়ে গেলেন ব্রাজিলের লেফটব্যাক রেনান লোদি, দারুণ চিপটা গোলরক্ষক এডারসনকে ফাঁকি দিয়ে জড়ালো জালে। গোল করেই যখন উদযাপনের জন্য ছুটছেন আনহেল ডি মারিয়া, নিশ্চিতভাবেই এক ঝটকায় ফিরে গিয়েছিলেন বেইজিংয়ে, ২০০৮ এর অলিম্পিক ফুটবলের ফাইনালে, তার এমনই এক গোলে আর্জেন্টিনা সেদিন স্বর্ণপদক জিতেছিল। কিংবা হয়তো ফিরে গিয়েছিলেন সাত বছর আগের মারাকানার সেই স্মৃতিতেও। অঝোরে কেঁদেছিলেন ডি মারিয়া, শেষ বাঁশি বাজার পর কাঁদলেন এদিনও। তবে এই কান্না সুখের কান্না। আটাশ বছরের শিরোপা-খরা দূর করার কান্না, নিজের ফাইনালের অভিশাপ মোচনের কান্না, স্বপ্ন ছোঁয়ার আনন্দের কান্না।
ডি মারিয়া জানতেন, তাঁর কাজটা শেষ হয়নি। একটা বিশ্বকাপ না জিতলে তাঁর ক্যারিয়ারকে যে ঠিক পূর্ণ বলা যায় না! আরেক বিশ্বকাপে ডি মারিয়া তাই আরেকবার ঝাঁপালেন, সর্বশক্তি দিয়ে শেষবারের মতো ঝাঁপালেন। তাতে চোটপ্রবণ শরীরে আবারও ধাক্কা এলো, আরো একবার মাঠের বাইরে চলে যেতে হলো তাঁকে। গ্রুপ পর্বের ম্যাচগুলো খেললেও শেষ ষোলোতে তাঁকে যেতে হলো বিশ্রামে। এরপর দলের প্রয়োজনে কোয়ার্টার ফাইনালে নেমেছিলেন মাত্র আট মিনিটের জন্য, আর টুর্নামেন্টের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের কথা মাথায় রেখে কোচ লিওনেল স্কালোনি তাঁকে বেঞ্চেই রাখলেন সেমিফাইনালে। পুরোপুরি ফিট থাকলে ফাইনালে ফ্রান্সের বিপক্ষে শুরুর একাদশে তিনিই থাকবেন, এটা বোঝা যাচ্ছিল খুব ভালোভাবেই।
ম্যাচের শুরু থেকেই ফ্রান্সের রক্ষণের ডান দিককে তটস্থ করে রেখেছিলেন ডি মারিয়া। তাঁকে আটকাতে নিচে নেমে এসেছিলেন রাইট উইঙ্গার উসমান ডেম্বেলে, ভুল করে তিনি পা চালিয়ে দিয়েছিলেন ডি মারিয়ার পায়ে, সেটাও নিজেদের বক্সে। ফলাফল, পেনাল্টি থেকে মেসির গোল। এর কিছুক্ষণ পর আবারও আর্জেন্টিনার ঝড়ো আক্রমণ, আলভারেজ-মেসি-ম্যাক অ্যালিস্টার হয়ে বল যখন দ্রুতগতিতে পৌঁছে গেলো মারিয়ার পায়ে, তাঁর সামনে তখন হুগো লরিস একা। এসব পরিস্থিতিতে ডি মারিয়া ভুল করেন না, ডি মারিয়া ভুল করেননি। বাম পায়ের শটে আর্জেন্টিনাকে এনে দিলেন দুই গোলের লিড, আর নিজে ভেঙে পড়লেন কান্নায়। আনন্দের কান্না, যে কান্নার জন্য আর্জেন্টিনার অপেক্ষা ছিল ছত্রিশ বছরের, আর ডি মারিয়ার আক্ষেপ ছিল আট বছরের। ৬৪ মিনিটে যখন ডি মারিয়া উঠে যাচ্ছেন মাঠ ছেড়ে, খেলায় তখন আর্জেন্টিনার পরিষ্কার আধিপত্য। এরপরে খেলায় রঙ বদল হলেও লিওনেল মেসি আর এমিলিয়ানো মার্টিনেজের নৈপুণ্যে তৃতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ হয়ে ওঠে আকাশি-সাদা।
কোপা আমেরিকা, ফিনালিসিমা, বিশ্বকাপ। এর সাথে অলিম্পিককেও যোগ করা হলে, চারটা ফাইনালেই স্কোরশিটে লেখা হয়েছে একটা নাম, আনহেল ডি মারিয়া। দেবদূত হয়ে এসে, সহস্র আক্ষেপ মুছে দিয়ে, আর্জেন্টিনার স্বপ্নের রথকে গন্তব্যের পথ দেখানো ‘অ্যাঞ্জেল’!