অস্ট্রেলিয়ার কিংবদন্তী অধিনায়ক রিকি পন্টিং লর্ডস ওয়েবসাইটে দেয়া এক ভিডিও বার্তায় তার দৃষ্টিতে সর্বকালের সেরা একাদশ গঠন করেছিলেন। দু’টি বিশ্বকাপ এবং দু’টি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জয়ী এ অধিনায়ক তার ২০ বছরের প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট ক্যারিয়ারের সতীর্থ এবং প্রতিপক্ষের ক্রিকেটারদের নিয়ে দল সাজিয়েছেন। পন্টিংয়ের একাদশে স্বাভাবিকভাবে পাঁচজন অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটার জায়গা পেয়েছে। তাদের সবাই-ই একসাথে অপ্রতিরোধ্য ছিলেন। ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়ার চিরশত্রু ইংল্যান্ডের কোনো ক্রিকেটার পন্টিংয়ের সেরা একাদশে জায়গা পাননি। তার দলে সাত নাম্বার পজিশনে জায়গা পেয়েছেন অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, এতেই বোঝা যায় তিনি ক্রিকেটের আদি ফরম্যাট টেস্ট ক্রিকেটের জন্যই দল নির্বাচন করেছেন।
১, ২. ম্যাথিউ হেইডেন – জাস্টিন ল্যাঙ্গার (অস্ট্রেলিয়া)
“দু’জন ব্যক্তি আছে, যাদের পেছনে ব্যাট করতে আমি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতাম। দু’জনই আলাদা দুই স্টাইলে ব্যাট করতো।”
পন্টিং তার একাদশের গোড়াপত্তনের দায়িত্ব দেন তার দুই সতীর্থ ম্যাথিউ হেইডেন এবং জাস্টিন ল্যাঙ্গারের হাতে। ম্যাথিউ হেইডেন ইনিংসের শুরু থেকে ফ্রন্ট ফুটে খেলে প্রতিপক্ষের বোলারদের ব্যাকফুটে ঠেলে দিতেন। আর অপরপ্রান্তে ল্যাঙ্গার টেস্ট মেজাজে ব্যাটিং করে ইনিংস বড় করতেন। টেস্ট ক্রিকেটে ম্যাথিউ হেইডেন এবং জাস্টিন ল্যাঙ্গার উদ্বোধনী উইকেট জুটিতে ১২২ ইনিংসে ৫১.৫৩ গড়ে ৬,০৮১ রান যোগ করেছিলেন। আলাদাভাবেও দু’জনের ক্রিকেট ক্যারিয়ার বেশ সমৃদ্ধ।
৩. জ্যাক ক্যালিস (দক্ষিণ আফ্রিকা)
এই পজিশনে রিকি পন্টিং নিজেই সেরাদের একজন। চাইলে নিজের নামও দিতে পারতেন। তবে তার দলে তিন নম্বর পজিশনে দক্ষিণ আফ্রিকার কিংবদন্তী অলরাউন্ডার জ্যাক ক্যালিসের নাম যুক্ত করেছেন। জ্যাক ক্যালিস ১৬৬টি টেস্টে ৫৫.৩৭ ব্যাটিং গড়ে ১৩,২৮৯ রান করেছেন। ৪৫টি টেস্ট শতক এবং ৫৮টি অর্ধশতক হাঁকিয়েছিলেন তার ক্যারিয়ারে। বল হাতেও কার্যকরী ছিলেন ক্যালিস, তার ঝুলিতে ২৯২টি টেস্ট উইকেট আছে।
ক্যালিস দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে তিন নম্বর পজিশনে নিয়মিত ছিলেন না। তিনি চার নম্বর পজিশনেই বেশি ব্যাট করতেন। তিনে ৭৮ ইনিংস ব্যাট করে ৪৯.৭৭ ব্যাটিং গড়ে ৩,৩৩৫ রান করেন তিনি।
৪. শচীন টেন্ডুলকার (ভারত)
বিশ্বের যেকোনো ক্রিকেটারই তার দৃষ্টিতে বিশ্ব একাদশ সাজালে চার নাম্বার ব্যাটিং পজিশনে নির্দিষ্ট একজনকেই রাখবেন। তিনি হলেন শচীন রমেশ টেন্ডুলকার। প্রতিপক্ষের কাছে তিনি ছিলেন দুঃস্বপ্ন। এমনটাই বলেছেন পন্টিং। প্রায় সবধরনের আবহাওয়াতেই সফল ছিলেন টেন্ডুলকার।
আন্তর্জাতিক টেস্ট এবং ওডিআই ক্রিকেটে সর্বাধিক রান সংগ্রাহক পন্টিংয়ের একাদশে জায়গা পেয়েছেন তার ফেভারিট পজিশন চারে। শচীন টেন্ডুলকার টেস্ট ক্রিকেটে ৩২৯ ইনিংসের মধ্যে ২৭৫ ইনিংস ব্যাট করেছেন চার নম্বরে। ২৭৫ ইনিংসে ৫৪.৪০ ব্যাটিং গড়ে ১৩,৪৯২ রান করেছেন। ক্যারিয়ারের ৫১টি শতকের মধ্যে ৪৪টি হাঁকিয়েছেন চার নম্বরে ব্যাট করতে নেমে। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ভারতের অনেক জয়ের নায়ক ছিলেন শচীন টেন্ডুলকার। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৩৯টি টেস্ট ম্যাচ খেলে ৫৫.০০ ব্যাটিং গড়ে ৩,৬৩০ রান করেছিলেন তিনি। নির্দিষ্ট একটি দলের বিপক্ষে সবচেয়ে বেশি ১১টি শতক হাঁকিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেই।
৫. ব্রায়ান লারা (ওয়েস্ট ইন্ডিজ)
“আরেকজন ব্যক্তি, যার কারণে অধিনায়ক থাকাকালীন অবস্থায় দুঃস্বপ্নের মতো মনে হতো, তিনি ওয়েস্ট ইন্ডিজের কিংবদন্তি ক্রিকেটার ব্রায়ান লারা।”
“ব্রায়ান লারা একাই ওয়েস্ট ইন্ডিজকে যত ম্যাচ জিতিয়েছে, তা সম্ভবত অন্য কোনো ক্রিকেটার তার নিজ দেশের হয়ে পারেনি। ব্যাট হাতে তার ক্লাস অবিশ্বাস্য।” – পন্টিং
রিকি পন্টিংয়ের একাদশে পাঁচ নাম্বার পজিশনে জায়গা করে নিয়েছেন ক্রিকেটের বরপুত্র ব্রায়ান লারা। টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে এক ইনিংসে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক লারা তার ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ সময় চার নম্বর পজিশনে ব্যাট করেছিলেন। পাঁচ নম্বর পজিশনে ১৪ ইনিংস ব্যাট করে ৪১.২৩ ব্যাটিং গড়ে ৫৩৬ রান করেছেন। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ব্রায়ান লারা ব্যাট হাতে বেশ সফল ছিলেন। তার ক্যারিয়ারে সবচেয়ে বেশি শতক হাঁকিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। তিনি নয়টি শতকের সাহায্যে ৫১.০০ ব্যাটিং গড়ে ২,৮৫৬ রান করেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে।
৬. কুমার সাঙ্গাকারা: অধিনায়ক (শ্রীলঙ্কা)
শ্রীলঙ্কার হয়ে তিন নম্বর পজিশনে অসাধারণ নৈপুণ্য দেখানো কুমার সাঙ্গাকারা পন্টিংয়ের একাদশে ছয় নাম্বার পজিশনে জায়গা পেয়েছেন। যে পজিশনে তার টেস্ট ক্যারিয়ারে একবারও ব্যাট করেননি তিনি। তবে কুমার সাঙ্গাকারাকেই অধিনায়ক হিসেবে নির্বাচন করেছেন পন্টিং।
আধুনিক ক্রিকেটের কিংবদন্তী ব্যাটসম্যান কুমার সাঙ্গাকারা ১৩৪টি টেস্টে ৫৭.৪০ ব্যাটিং গড়ে ১২,৪০০ রান করেছিলেন ৩৮টি শতক এবং ৫২টি অর্ধশতকের সাহায্যে। শ্রীলঙ্কার হয়ে ১৫টি টেস্টে নেতৃত্ব দিয়ে সাতটি শতক হাঁকিয়েছেন, ব্যাটিং গড়ও ঈর্ষণীয়। ৬৯.৬০ ব্যাটিং গড়ে করেছেন ১,৬০১ রান।
৭. অ্যাডাম গিলক্রিস্ট: উইকেটরক্ষক (অস্ট্রেলিয়া)
শচীন টেন্ডুলকারের মতো অ্যাডাম গিলক্রিস্টও অটো চয়েস। উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান হিসাবে গিলক্রিস্ট অপ্রতিদ্বন্দ্বী। উইকেটের পেছনে দুর্দান্ত সব ক্যাচ লুফে নেওয়াতে তার জুড়ি নেই, সেই সাথে ব্যাট হাতেও বোলারদের তুলোধোনা করতেন সাত নম্বরে ব্যাট করতে নেমে।
তার ধ্বংসাত্মক ব্যাটিংয়ের দরুন প্রতিপক্ষ চোখের পলকেই ম্যাচ থেকে ছিটকে পড়ে যেতো। সাত নম্বরে বরাবর ১০০ ইনিংস ব্যাট করে ৪৬.৪৪ ব্যাটিং গড়ে ৩,৯৪৮ রান করেছিলেন। এই পজিশনে গিলক্রিস্টকে টক্কর দেওয়ার মতো অপশন খুব কমই আছে।
৮. শেন ওয়ার্ন (অস্ট্রেলিয়া)
পন্টিংয়ের দলে একমাত্র স্পেশালিষ্ট স্পিনার হিসাবে জায়গা করে নিয়েছেন তার সতীর্থ শেন ওয়ার্ন। লেগ স্পিন শিল্পের দিন বদলের নায়ক শেন ওয়ার্নই পন্টিংয়ের দেখা সেরা স্পিনার। তাই তার একাদশে টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে সর্বোচ্চ উইকেট সংগ্রাহক মুত্তিয়া মুরালিধরনের বদলে শেন ওয়ার্ন জায়গা করে নিয়েছেন।
শেন ওয়ার্ন টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে প্রথম বোলার হিসাবে সাতশ’ উইকেট শিকার করেছিলেন। তিনি তার বোলিং জাদুতে বিশ্বের নামিদামি ব্যাটসম্যানদেরও নাস্তানাবুদ করেছেন।
শেন ওয়ার্ন ১৪৫টি টেস্টে ৭০৮ উইকেট শিকার করেছেন। টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী তিনি।
৯. ওয়াসিম আকরাম (পাকিস্তান)
“খুব সম্ভবত আমি যাদের বিপক্ষে খেলেছি, তাদের মধ্যে সবচেয়ে দক্ষ বোলার ছিলো ওয়াসিম আকরাম। শুধুমাত্র নতুন বলেই নয়!” – পন্টিং
ওয়াসিম আকরাম ঘন্টায় প্রায় ১৫০ কিলোমিটার গতিতে বল দু’দিকে সুইং করাতে পারতেন। পুরাতন বলে তার রিভার্স সুইং বেশ কার্যকরী ছিলো। ১০৪ টেস্টে ৪১৪টি উইকেট এবং ৩৫৬টি ওডিআইতে ৫০২ উইকেট শিকার করেন ওয়াসিম আকরাম। তার বিপক্ষে কোনো ব্যাটসম্যানই স্থিতিশীল হতে পারতো না। তার বৈচিত্র্যময় বোলিংয়ের কাছে সে যুগের দাপুটে ব্যাটসম্যানরাও নাজেহাল হতো।
বল হাতে অবদান রাখার পাশাপাশি ব্যাট হাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার সামর্থ্য রাখেন তিনি। টেস্ট ক্রিকেটে এক ইনিংসে সর্বোচ্চ ২৫৭* রান সহ প্রায় তিন হাজার রান সংগ্রহ করেছেন তিনি। ক্রিকেটের ইতিহাসে সেরা বোলারদের একজন ওয়াসিম আকরাম সেরা বাঁহাতি পেসারদের তালিকায় সবার উপরে থাকবেন।
১০. স্যার কার্টলি অ্যামব্রোস (ওয়েস্ট ইন্ডিজ)
ছ’ফুট সাত ইঞ্চি উচ্চতাসম্পন্ন অ্যামব্রোস গত শতকের নব্বইয়ের দশকে অন্যতম সেরা বোলার ছিলেন। কোর্টনি ওয়ালশের সাথে জুটি বেঁধে প্রতিপক্ষের ব্যাটিং লাইনআপের উপর তাণ্ডব চালাতেন প্রতিনিয়ত।
অ্যামব্রোস সবসময় নিখুঁত লাইন-লেংথে বল করতেন। এতে করে ব্যাটসম্যানরা সবসময় চাপে থাকতো। রিকি পন্টিং ভিডিও বার্তায় বলেছেন, তাকে বিপাকে ফেলা বোলারদের তালিকায় অ্যামব্রোস একজন। শুধুমাত্র পন্টিং নন, টেস্ট ক্রিকেটে ৯৮ ম্যাচে ৪০৫টি উইকেট শিকার করেছেন কিংবদন্তী পেসার অ্যামব্রোস। ডানহাতি এই পেসার ক্রিকেটে অসামান্য অবদান রাখার দরুন নাইটহুড অ্যাওয়ার্ডও পেয়েছিলেন।
১১. গ্লেন ম্যাকগ্রা (অস্ট্রেলিয়া)
আধুনিক ক্রিকেটের অন্যতম সেরা পেসার অস্ট্রেলিয়ান গ্লেন ম্যাকগ্রা। তিন স্পিনার মুরালি, ওয়ার্ন এবং কুম্বলের পর টেস্ট ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি উইকেট শিকারের তালিকায় চতুর্থ স্থানে আছেন ম্যাকগ্রা। ১২৪ টেস্টে তার শিকার সংখ্যা ৫৬৩টি!
তার বলে খুব বেশি গতি ছিলো না। ঘন্টায় ১৩০ কিলোমিটারের আশেপাশে বল করতেন তিনি। তার বোলিংয়ের প্রধান অস্ত্র ছিলো সুইং। ভালো জায়গায় বল করে দুদিকেই সুইং করানোর ক্ষমতা ছিলো ম্যাকগ্রার কাছে। পন্টিংয়ের দীর্ঘদিনের সতীর্থ ম্যাকগ্রাও যেকোনো কন্ডিশনে অধিনায়কদের প্রথম চয়েস থাকবেন।