বিজ্ঞান, বুদ্ধিমত্তা আর সাথে একটু শিল্পের ছোঁয়া, সব এক করলে পাওয়া যায় দাবা! ক্ষুরধার মস্তিষ্কের এই খেলার সর্বোচ্চ অর্জন হলো বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়া। ক্লাসিক্যাল দাবায় ১৪ তম বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ভ্লাদিমির ক্রামনিক ২০০৫ সালের এক সাক্ষাৎকারে স্মরণ করেছিলেন তার পূর্ববর্তী সকল বিশ্ববিজেতাকে। সেই উইলহেল্ম স্টেইনিজ থেকে শুরু করে সেসময়ের সদ্য সাবেক হওয়া বিশ্বচ্যাম্পিয়ন গ্যারি ক্যাসপারভ পর্যন্ত সবার কথাই আলোচিত হয়েছে। রুশ চেস ম্যাগাজিন e3e5-এ প্রকাশিত সেই সাক্ষাৎকারের আজকে থাকছে দ্বিতীয় পর্ব। উপস্থাপক হিসেবে ছিলেন ইন্টারন্যাশনাল মাস্টার ভ্লাদিমির বারস্কি। প্রথম পর্বে আমরা প্রথম তিন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন সম্পর্কে আলোচনা করেছি, আজ থাকছে পরবর্তী চারজন।
বারস্কি: অ্যালেখাইনের অধ্যাবসায়ই তাকে কাপাব্লাঙ্কার বিপক্ষে জিততে সহায়তা করেছে।
অ্যালেক্সান্ডার দ্য ডাইন্যামিক
ক্রামনিক: পাশাপাশি তার ইতিবাচক মনোভাব এবং দৃষ্টিভঙ্গিও সহায়ক হয়েছে। অ্যালেক্সান্ডার অ্যালেখাইনও দারুণ প্রতিভাবান ছিলেন। তবে এতদসত্ত্বেও কাপাব্লাঙ্কাকে তিনি হারিয়েছেন এটা মানতে কষ্ট হয়। সম্ভবত ক্যাসপারভের সাথে আমিও একমত হব, কাপাব্লাঙ্কা তীব্র মানসিক চাপ নিতে পারতেন না। ল্যাস্কারের বিপক্ষে তিনি শুধু আক্রমণ করে গেছেন, আর ল্যাস্কার প্রতিহত করে গেছেন। কিন্তু অ্যালেখাইন শুধু প্রতিহতই করেননি, ঘুরেও দাঁড়িয়েছেন! অ্যালেখাইন সেই চাপ ঘুরে কাপাব্লাঙ্কার দিকেও ঠেলে দিয়েছেন। কাপাব্লাঙ্কা বলতে গেলে তুমুল চাপের মুখে ভেঙে পড়েছেন।
বারস্কি: অ্যালেখাইনই কি প্রথম আধুনিক ওপেনিং প্রিপারেশন নেওয়া শুরু করেছিলেন?
ক্রামনিক: অ্যালেখাইন ছিলেন একজন প্রকৃত পরিশ্রমী। তার স্ট্র্যাটেজিগত ট্যালেন্ট যেমন ছিল, তেমনি ছিল পজিশনাল অ্যাডভান্টেজ সংক্রান্ত জ্ঞান। তিনি দাবায় গতির ব্যাপারটা ভালোভাবে ধরতে পেরেছিলেন। ল্যাস্কার প্রথম এ নিয়ে কাজ করলেও পুরোদমে একে দাবার চৌষট্টি খোপে ব্যবহার করেন অ্যালেখাইনই। খেলার প্রথম মুভ থেকেই উপর্যুপরি আক্রমণ শুরু করতেন তিনি, একের পর এক থ্রেটে নাকাল হত প্রতিপক্ষের দাবাড়ুগণ।
বারস্কি: বিংশ শতকের বিশ-ত্রিশের দশক ছিল বলতে গেলে পুরোই অ্যালেখাইনের আধিপত্য।
ক্রামনিক: সেসময়টা আসলে দাবার ভুবনে কিছুটা শূন্যতা কাজ করছিল। ল্যাস্কার, কাপাব্লাঙ্কারা তখন আর তেমন খেলতেন না। অন্যদিকে বতভিনিক, কেরেসরা তখনও সেরকম শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হয়ে উঠতে পারেননি। আর তাদের প্রশিক্ষকগণ তাদের ফর্ম হারিয়ে ফেলেছেন ততদিনে। সেকারণেই বলতে গেলে অ্যালেখাইন একচেটিয়াভাবে ম্যাচগুলো নিজের করে নিয়েছেন, এমনটাই আমার মনে হয়।
বারস্কি: পঞ্চম বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ম্যাক্স উ-র ব্যাপারে কিছু বলুন। অনেকের মতেই নাকি তিনি আকস্মিকভাবে চ্যাম্পিয়ন হয়ে যান। তিনি নাকি বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপের এই রাজমুকুট ডিজার্ভ করেন না?
ম্যাক্স দ্য ইউনিভার্সাল
ক্রামনিক: ম্যাক্স উ দারুণ খেলোয়াড় ছিলেন। অনেকেই বলে থাকে মডার্ন চেস প্রিপারেশনের জনক বতভিনিক, তবে আমি মনে করি উ। তিনি ওপেনিং এর গুরুত্ব বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন, তাই প্রস্তুতিতে জোর দিতেন বেশি। এবং ওপেনিং আইডিয়াতে কীভাবে ভ্যারিয়েশন এনে উন্নত করতে হয়, সেটাও তিনি বুঝতেন। অ্যালেখাইন যথেষ্ট পরিশ্রম করতেন বটে, তবে মাঝেমধ্যেই কিছু অদ্ভুত খেলতেন। অপরপক্ষে, ম্যাক্সের ওপেনিং হত বরাবরই খুব সলিড এবং যৌক্তিক। ওপেনিং বিবেচনায় তিনি ছিলেন যথেষ্ট কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বী।
বারস্কি: উ-ই প্রথম অন্যান্য গ্র্যান্ডমাস্টারদের (যেমন ফ্লোরকে) নিজের সেকেন্ড হিসেবে আমন্ত্রণ জানান।
ক্রামনিক: ম্যাক্স উ-র খেলার ধরন ছিল পুরদস্তুর পেশাদার। তিনি বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। শুধু একধাঁচের খেলা তিনি খেলতেন না, এ কারণে তাকে মূল্যায়ন করা কঠিন, আর আমি মনে করি এজন্যই তিনি আন্ডাররেটেড। তার এই বহুমুখী খেলার ধরনের কারণে আমি তাকে নাম দিয়েছি ইউনিভার্সাল। তার প্লেইং স্টাইল আমি নিজেও আজ পর্যন্ত ঠিকভাবে বুঝে উঠতে পারিনি। সম্ভবত তার মূল লক্ষ্য ছিল অন্যসব ধাঁচের সংমিশ্রণ। সাথে ছিল তার তীক্ষ্ণ মেধা আর স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন। তিনি খুব শান্ত আর ভারসাম্যপূর্ণ মানুষ ছিলেন। এ সবকিছু মিলেই তাকে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন বানিয়েছে, আর আমি মনে করি তিনি সেটার যোগ্যও।
বারস্কি: এর মধ্য দিয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম বতভিনিক পর্যন্ত, প্রথম কোনো বিশ্বচ্যাম্পিয়ন যাকে আপনি ব্যক্তিগতভাবে চেনেন।
মিখাইল দ্য কনচেপ্টচুয়াল
ক্রামনিক: অবশ্যই বতভিনিক নতুন এক যুগের কর্ণধার ছিলেন, তিনিই প্রথম দেখিয়েছিলেন যে খেলার ফলাফল শুধু চেস প্রিপারেশনের উপর নির্ভর করে না। তাকে আমি বলি প্রথম প্রকৃত পেশাদার দাবাড়ু। তিনি গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচগুলোর আগে পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতি নিতেন। শুধু দাবার ওপেনিং-ই না, পরিমিত ঘুম, সঠিক খাদ্যাভ্যাস আর শারীরিক ব্যায়ামও যে প্রস্তুতির অংশ সেটি দাবার দুনিয়াকে হাতে-কলমে শিখিয়েছেন মিখাইল ময়সেভিচ বতভিনিক।
বর্তমান খেলোয়াড়দের কাছে অ্যালেখাইন-উ ম্যাচগুলোর অবস্থা শুনলে হাস্যকর ঠেকতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ধরুন কোনো ম্যাচ পিছিয়ে দেয়া হলো। তারপর একজন দেখা গেল দেদারসে মদ্যপান করে চলেছেন, অন্যজনের হয়তো জরুরি কোনো বিজনেস মিটিং পড়ে গেল, পরের গেমের ঠিক আগমুহূর্তে! কিন্তু এমন কিছু বতভিনিকের সাথে ঘটা অসম্ভব ছিল।
বারস্কি: বতভিনিকের ব্যাপারে জনশ্রুতি আছে, তিনি শুধু তার ব্যক্তিত্ব আর ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির জন্য চ্যাম্পিয়ন হতে পেরেছিলেন। তাছাড়া সে যুগেই তার থেকে ভালো আরও চেস ট্যালেন্ট ছিল …
ক্রামনিক: একটা পর্যায় পর্যন্ত আমি এই কথার সাথে একমত। আবার আপনাকে এটাও মানতে হবে যে, অন্যসব উপকরণ ছাড়া ট্যালেন্ট একাই কিছু অর্জনও করতে পারে না। ট্যালেন্ট বা প্রতিভা জিনিসটা কিছুটা সম্মোহনী! এমনও অনেক দাবাড়ু আছেন, যাদের ব্যাপারে লোকে বলে তারা ট্যালেন্টেড; যদিও তারা ক্যারিয়ারে তেমন কিছু অর্জন করতে পারেননি। অন্যসব পেশার মতোই দাবাতেও ট্যালেন্ট বিষয়টা বাকিসব প্রভাবকের মতো অন্য আরেকটা নিয়ামক। তাই যখন কেউ বলে, সে খুব ট্যালেন্টেড হলেও তার দুর্বল ব্যক্তিত্বের কারণে খুব বেশি কিছু অর্জন করতে পারেনি, সেটা খুব বেশি কিছু বোঝায় না।
বতভিনিক হয়তো কাপাব্লাঙ্কার মতো ট্যালেন্টেড ছিলেন না, তবে তার নিজস্ব শক্তিমত্তার জায়গাগুলো দিয়ে বাকিদের থেকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, প্রগাঢ় প্রস্তুতি এগুলো অত সহজে অর্জন করার বিষয় নয়। আমি শুধু একটা কথাই বলবো, বতভিনিক জিনিয়াস না হতে পারেন, তবে তার দাবার ক্যারিয়ার নিঃসন্দেহে জিনিয়াস!
বারস্কি: সপ্তম বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ভাসিলি ভাসিলিয়েভিচ স্মিস্লভকে আপনি কীভাবে সংজ্ঞায়িত করবেন?
ভাসিলি দ্য ফিলিগ্রি
ক্রামনিক: স্মিস্লভ ছিলেন বলতে গেলে দ্য ট্রুথ অফ চেস। ভাসিলি খুব সহজাতভাবেই সঠিক দাবা খেলতেন। তার খেলা কিন্তু মোটেই কাপাব্লাঙ্কা বা তালের মতো মোহনীয় ছিল না। স্মিস্লভের ম্যাচে তাদের খেলার মতো জাদুকরী ইন্দ্রজাল সৃষ্টি হত না বটে, তবে কার্যকরী ছিল। তিনি কোনোমতেই চেস আর্টিস্ট ছিলেন না, তার খেলা তেমন মন্ত্রমুগ্ধকারী ছিল না; তবে আমার পছন্দের ঘরানার তিনি একজন। নবীনদের আমি পরামর্শ দিই স্মিস্লভের খেলা থেকে শিখতে, কেননা তিনি যখন যেমন প্রয়োজন, তেমন খেলতেন। প্রতিটি চালে সবচেয়ে শক্তিশালী দানটাই দিতেন। এই বিচারে তিনি যে কাউকে টেক্কা দিতে পারঙ্গম। পেশাদার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করলে আমি বলতে পারি, ভাসিলি আসলেই অবমূল্যায়িত হয়েছেন।
তিনি যেমন উচ্চ পর্যায়ের দাবা খেলতেন, তেমনি এন্ডগেমেও পটু ছিলেন। তার খেলাগুলোকে আমি শুধুই গানের সাথে তুলনা করতে পারি। শুধু মোৎসার্ট স্টাইলকেই তুলনা করা যায় তার সাথে। এত অনায়াসে, বিনা ক্লেশে তিনি ঘুঁটি চালতেন, যেন মনে হত খবরের কাগজ পড়া বা কফি পান করার মতো সহজ কাজ করছেন। এ কারণেই আমি স্মিস্লভকে আর তার খেলাগুলোকে পছন্দ করি।
বারস্কি: বতভিনিক আর স্মিস্লভ প্রায় একশ’র মতো গেম খেলেছেন একসাথে, যার মধ্যে ছিল তিনটি বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ। আধুনিক দাবার মানদণ্ডে পরিমাপ করলে সেগুলো কি যথেষ্ট মানসম্পন্ন?
ক্রামনিক: হ্যাঁ, সেগুলো আসলেই উচ্চমানের ছিল। অবশ্যই কিছু ভুলও ছিল, তবে ম্যাচের ব্যাপ্তির তুলনায় সর্বোপরি খেলার মান অনেক ভালো ছিল। তারা কদাচিৎ ব্লান্ডার যে করতেন না, এমন নয়, তবে সার্বিকভাবে মূল্যায়ন করতে গেলে সেটুকু প্রভাব রাখে না আসলে। গড়ে প্রতিটি চালের কোয়ালিটি ছিল অতি উচ্চ।
বারস্কি: তারা একে অপরের যোগ্য প্রতিপক্ষ ছিলেন বটে …
ক্রামনিক: অবশ্যই, তাদের টক্করটা হত প্রায় সমানে-সমান। এটা দুঃখের যে, স্মিস্লভ বেশিদিন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন থাকতে পারেননি। তবে তিনি সর্বোচ্চ মানসম্পন্ন একজন দাবাড়ু ছিলেন, তার প্রমাণ মেলে ৬৩ বছরেও তিনি ক্যান্ডিডেট টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলেছেন। তিনি গভীরভাবে দাবাকে বুঝতেন।
বারস্কি: স্মিস্লভ কি তার পূর্ববর্তী কারও মতো খেলতেন?
ক্রামনিক: না, তিনি ভিন্নরকম দাবা খেলতেন, তার নিজস্ব ঘরানার। পজিশনাল গেমে তার দখল ছিল, আর এই শক্তিমত্তায় তিনি আগের সবাইকে ছাপিয়ে গিয়েছিলেন। ওপেনিংয়ে তার ভালো দখল ছিল, তবে তিনি সেরা ছিলেন কনসেপ্টচুয়াল বিষয়গুলোতে, সেসব তিনি খেলেছেন ফিলিগ্রি প্রিসিশনের সাথে। উল্লেখ্য, ফিলিগ্রি বলতে বিভিন্ন ধাতবপদার্থে করা কারুকাজকে বোঝায়, যেমন- গয়না। তিনি ছিলেন প্রথম আলট্রা ক্লিন খেলোয়াড়। তিনি নিজস্ব এক খেলার ধরন তৈরি করেছিলেন, যা পরবর্তীতে কারপরভের মাঝে আমরা দেখতে পাই। কৌশলটা হলো, পজিশনাল প্রেশার ক্রমাগত বাড়াতে থাকা, আর ক্যালকুলেশনের দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে ছোটখাট অ্যাডভান্টেজকে বড় সুবিধাতে পরিণত করা।
চলবে …