উইম্বলডন শেষ হয়ে গেছে।
ঘাসের কোর্টে একমাত্র গ্র্যান্ডস্লাম অন্য সব বছরের মতোই অসাধারণ টেনিসের পসরা বসিয়েছিলো। এস, ভলি, ব্যাক হ্যান্ড, ফোরহ্যান্ড; এমন ক্রিকেটীয় শট নিয়েও এবার উইম্বলডনে আলোচনা হয়েছে। অভিজাত এই টুর্নামেন্ট খুঁজে পেয়েছে তার নতুন রাজা ও রানীকে। আর এরই ভেতর দিয়ে দুই বছর পর আবার একটি গ্র্যান্ডস্লাম জিতে নিজের অস্তিত্বের ঘোষণা দিয়েছেন অ্যাঞ্জেলিক কারবার। প্রথমবারের মতো তিনি জিতেছেন উইম্বলডন।
কারবারের ছোটবেলার গল্পটা একটু বিচিত্র। লোকেরা পোল্যান্ডে জন্ম নিয়ে জার্মানিতে বসতি গড়ে। কিন্তু এঞ্জেলিক কারবারের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ভিন্ন হয়েছে। তার জন্ম জার্মানির ব্রেমেন শহরে।
বাবা স্লাওমির কারবার একজন পোলিশ নাগরিক। মা বিয়েটা কারবারও পোল্যান্ডের মানুষ। একটা ছোট বোন ও বাবা-মায়ের সাথে বড় হয়ে উঠেছেন জার্মানির আরেক শহর কিয়েলে। মাত্র ৩ বছর বয়সেই টেনিস খেলা শুরু করেন। পেশাদার টেনিসে ঢোকার পর, ২০১২ সালে কারবার নিজেদের আদি বাড়ি পোল্যান্ডের পোজান শহরে ফিরে যান। তবে বসবাস শুরু করেন নানার কাছে। কারণ, নানার বাসায় একটি ইনডোর টেনিস কোর্ট ছিলো। এটারই সুবিধা নিতে ও রাত-দিন পরিশ্রম করে নিজেকে আগে এগিয়ে নিতে পোল্যান্ডে বসবাস শুরু করেন তিনি। তবে আন্তর্জাতিক টেনিসে জার্মানিরই প্রতিনিধিত্ব করেন কারবার।
ছোটবেলা থেকে পরিবারের সমর্থনে জার্মানি ও পোল্যান্ডের অজস্র টুর্নামেন্টে অংশ নিয়েছেন। কিন্তু ২০০৩ সালের আগে তিনি কখনো কোনো শিরোপা জিততে পারেননি। সে বছর ১৫ বছর বয়সে এসে প্রথম শিরোপা জেতেন। নিজের জার্মান ও পোলিশ পরিচয় নিয়ে কারবারের কোনো দ্বিধা নেই।
তিনি বলেছেন, তিনি পোল্যান্ডকে ভালোবাসেন। কিন্তু নিজেকে পুরোপুরি জার্মান বলে মনে করেন,
‘আমি একজন জার্মান। আমি জার্মানির হয়ে খেলি। আমি জার্মানিতে জন্মেছি, জার্মানিতে বড় হয়ে উঠেছি। আমার হৃদয় জার্মানির জন্য আন্দোলিত হয়। হ্যাঁ, আমার হৃদয় পোল্যান্ডের কথাও বলে।’
২০০৭ সালে কারবারের গ্র্যান্ডস্লাম অভিষেক হয়। সে বছর ফ্রেঞ্চ ওপেনে অংশ নিয়ে প্রথম রাউন্ডেই বাদ পড়েন তিনি। একই বছর ইউএস ওপেনে শুরু করেন সেরেনা উইলিয়ামসের বিপক্ষে। সেখানেও সরাসরি সেটে হেরে বিদায় নেন। প্রথম সাফল্যের জন্য ২০১৬ সাল অবধি অপেক্ষা করতে হয়েছে তাকে। সেই গল্পই শুনিয়েছেন কারবার।
এবারের উইম্বলডন জয়ের পর ভোগ ম্যাগাজিনের সাথে একান্তে কথা বলতে গিয়ে এঞ্জেলিক স্মরণ করেছেন নিজের সেই ফেলে আসা দিনগুলোর কথা। এই জার্মান টেনিস তারকা বলছিলেন, ২০১১ সালের দিকে তিনি টেনিস ছেড়ে দেওয়ার কথাও ভেবেছিলেন,
‘২০১১ সালে আমি প্রতিটা টুর্নামেন্টের প্রথম রাউন্ডেই হেরে বসছিলাম। তখন আমি ভাবলাম, এর চেয়ে বরং আমার থেমে যাওয়া ভালো। আর ক্যারিয়ারে অন্য কিছু করার চেষ্টা করা ভালো।’
তবে এরপরই আবার ভিন্ন চিন্তাটা এসেছিলো তার মাথায়,
‘কিন্তু আমি নিজেকেই বললাম, না। আমার আসলে টেনিসকে আগের মতো উপভোগ করাটা জরুরি। আমার লক্ষ্য ছিলো সেরা খেলোয়াড় হওয়া। সেটা আমি জানতাম, আমি একদিন পারবো।’
সাফল্য ও শ্রেষ্ঠত্বের জন্য কারবারের এই যে অদম্য চেষ্টা সেটা প্রথম সাফল্যের মুখ দেখেছিলো পেশাদার টেনিসে অভিষেকের আট বছর পর এসে। ২০১১ ইউএস ওপেন শুরু করেছিলেন ৯২ নম্বর র্যাংকিং নিয়ে। সেখানেই একটার পর একটা বিস্ময়কর জয় দিয়ে পৌঁছে গেলেন সেমিফাইনালে। আর এই সাফল্যের ফলে ওই বছরটা শেষ করলেন ৩২ নম্বর র্যাংকিংয়ে থেকে।
ততক্ষণে কারবার আগের মতো টেনিসটা উপভোগ করতে শুরু করেছেন। তিনি বলছিলেন, কিভাবে খেলাটায় সাফল্যের জন্য সেই ক্ষুধাটা আবার ফিরে এসেছিলো তার মধ্যে,
‘আমি তখন জার্মানিতে বেড়ে ওঠা সেই বাচ্চাটার মতোই টেনিস আমার উপভোগ করছিলাম। অনেক ধৈয নিয়ে খেলেছি। তার চেয়ে বেশি মজা করেছি ও উপভোগ করেছি। ওই সময় থেকে আমি আমার খেলার ওপর এবং নিজের ওপর বিশ্বাসটা ফিরে পেয়েছি।’
২০১১ সালে কারবার হয়তো নিজের আত্মবিশ্বাসটা খুঁজে পেয়েছিলেন। এই বছর থেকেই হয়তো নিজেকে নতুন করে চিনতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু সাফল্য পেতে বা ক্যারিয়ারের সেরাটা পেতে তাকে অপেক্ষা করতে হলো আরও পাঁচ বছর। ২০১৬ সালে এসে তিনি প্রথম গ্র্যান্ডস্লামের দেখা পেলেন। অস্ট্রেলিয়ান ওপেনে প্রথমবারের মতো উঠে গেলেন গ্র্যান্ডস্লাম ফাইনালে। আর সেখানে তখনকার চ্যাম্পিয়ন সেরেনা উইলিয়ামসকে হারিয়ে জিতলেন ক্যারিয়ারের প্রথম গ্র্যান্ডস্লাম শিরোপা।
সেই শিরোপার প্রসঙ্গ উঠলে এখনও বিনয়ী আর স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন কারবার,
‘আমি জানতাম, এটা আমার গ্র্যান্ডস্লাম জয়ের প্রথম সুযোগ। আর কেউ জানে না, আমিও জানতাম না যে, আর কখনো আমি দ্বিতীয় সুযোগ পাবো কি না। আমি দর্শকের কাছ থেকে শক্তি নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। আর শেষ অবধি ঘটনাটা ঘটেই গেলো।’
ওই বছরই রিও অলিম্পিকে টেনিসের সোনার পদকের ম্যাচে পৌঁছে যান কারবার। কিন্তু ফাইনালে হারের ফলে রুপা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয় তাকে। বছরের শেষ দিকে এসে আরেকটা গ্র্যান্ডস্লাম ঝুলিতে পুরে ফেলেন কারবার- ইউএস ওপেন। আর এসব সাফল্য তাকে এতটা রেটিং পয়েন্ট এনে দেয় যে, উইলিয়ামসকে হটিয়ে বছরের শেষ দিকে র্যাংকিংয়ের এক নম্বর জায়গাটা দখল করে নেন।
কারবার বলছিলেন, তিনি সেই সাফল্যটা বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না। এক নম্বর হওয়া, দুটো গ্র্যান্ডস্লাম জয়; এটা এখনও অবিশ্বাস্য মনে হয় তার কাছে,
‘আমি বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না যে, আমি সত্যিই জিতেছি। আমি ওই সময়টার স্বপ্ন দেখি কেবল। ২০১৬ সালে আমি দুটো গ্র্যান্ডস্লাম জিতেছি, এক নম্বর হয়েছি। আমি এটা কখনোই ভুলবো না। এটা সত্যি যে, আমার মনে হয়, আর ১০ বছর আগে এই সাফল্য পেলে আরও বেশি উপভোগ করতে পারতাম আমি।’
কারবার শুধু তখন টেনিস কোর্টেই ঝড় তুলছেন, তা নয়। মাঠের বাইরেও নানারকম সাফল্য এসে ধরা দিচ্ছে তার হাতে। এর মধ্যে বড় একটা ব্যাপার ছিলো সুইস ঘড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রোলেক্স তাদের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর করলো কারবারকে। ব্যাপারটা তার জন্য ছিলো বিরাট এক প্রাপ্তি।
কারবার মোহিত হয়ে সেই সময়ের কথা বলছিলেন,
‘সেটা আমার জন্য বিরাট একটা ব্যাপার ছিলো। রোলেক্স পরিবারের অংশ হতে পারাটা অনেক বড় ব্যাপার। কারণ, ওখানে সবাই অনেক বড় বড় সাফল্য নিয়ে, অর্জন নিয়ে তবে ওদের সাথে যুক্ত হতে পেরেছে। আমার জন্য এটা বিরাট একটা ব্যাপার ছিলো।’
কারবার জীবনের এই প্রাপ্তি থেকে অনেক কিছু শিখেছেন। মাঝে দুটো বছর আবারও অপ্রাপ্তি ঘিরে ধরেছিলো তাকে। অবশেষে সেই পর্ব সমাপ্ত হয়েছে। এবার জিতে নিয়েছেন সবচেয়ে অভিজাত গ্র্যান্ড স্লাম শিরোপা উইম্বলডন। এই প্রাপ্তি তাকে শিখিয়েছে, কীভাবে জীবনের উত্থান-পতন দুটোই মেনে নিতে হয়,
‘এটাই খুব জরুরি যে, কঠোর পরিশ্রম করে যেতে হবে এবং নিজের পথে কাজ করে যেতে হবে। প্রত্যেকের জীবনে উত্থান-পতন আসে। আমার জীবনের কঠিন সময়গুলো দিয়ে শিখেছি, কখনো হাল ছাড়তে নেই। আর তাহলে সাফল্য একদিন আসবেই।’
ফিচার ইমেজ: Reuters