ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ইংল্যান্ডে যখন থেকে ফুটবলের আধুনিকায়ন হতে শুরু করল, তখন থেকে আর খুব বেশি সময় লাগেনি সমগ্র ইউরোপজুড়ে খেলাটির জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়তে। সে সময় ইংল্যান্ডে চলছে ভিক্টোরিয়ান যুগ, রানী আলেক্সজান্দ্রিয়া ভিক্টোরিয়া সমগ্র ব্রিটেনের এবং আয়ারল্যান্ডের শাসক। বর্ণবৈষম্য ইংল্যান্ডের শাসনব্যবস্থা ও সমাজব্যবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গিয়েছে। বর্ণবৈষম্য দিনে দিনে ‘সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য’ আচরণে পরিনত হয়েছে। ইংল্যান্ড তখন বিশ্বজুড়ে তাদের সাম্রাজ্যের বিস্তার করে চলেছে। ছোট-বড় অনেক দেশকেই ইংল্যান্ড তাদের উপনিবেশ বানিয়ে ফেলছে ধীরে ধীরে তখন। নাক-উঁচু,প্রচন্ড রকম আত্ম-অহমিকায় ভোগা ইংলিশরা কৃষ্ণাঙ্গদের মানুষ বলেই মনে করতেন না। প্রতিনিয়ত বর্ণবাদী মন্তব্য শুনতে হতো কৃষ্ণাঙ্গদের,অভিজাত শ্বেতাঙ্গ সমাজের সাথে মেলামেশার সুযোগ সেভাবে তাদের ছিল না। ব্যতিক্রম ছিল না খেলার মাঠও। তবুও ইংলিশরা বরাবরই খেলাপ্রিয় জাতি,খেলাধুলোর পৃষ্ঠপোষকতা ও আধুনিকায়নে তারা ভূমিকা রেখেছে। যেকোনো খেলায় অংশগ্রহণের সুযোগ ছিল সবারই। তবে খেলাধুলোয় সাফল্য, সম্মান ও যশ পাওয়া শ্বেতাঙ্গদের জন্য যতটা সহজ ছিল,’দাস শ্রেণি’ অথবা ‘শ্রমিক শ্রেণি’র কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য অতটা সহজ ছিলো না। তবুও কিছু মানুষ সব তিক্ত-কটু কথা সহ্য করে, সব বাধা অতিক্রম করে ছিনিয়ে এনেছেন সাফল্য, হারিয়ে দিয়েছেন বর্ণবাদীদের। পথ তৈরি করে দিয়ে গিয়েছেন উত্তরসূরিদের জন্য,সাথে নিজেরাও হয়ে গিয়েছেন ইতিহাসের অংশ।
শুরুটা কাউকে না কাউকে দিয়েই হয়, ফুটবলে কৃষ্ণাঙ্গদের আগমন ঘটেছিল অ্যান্ড্রু ওয়াটসন, রবার্ট ওয়াকার, আর্থার হোয়ার্টনের মাধ্যমে। অ্যান্ড্রু ওয়াটসন ও রবার্ট ওয়াকার স্কটল্যান্ডে খেলতেন; তবে তারাও পেশাদার ফুটবলার ছিলেন না, অ্যামেচার লিগে খেলতেন। কারণ, ১৮৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া ইংলিশ ফুটবল লিগই পৃথিবীর প্রথম পেশাদার লিগ, স্কটিশ ফুটবল লিগ পেশাদার লিগ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দুই বছর পর, ১৮৯০ সালে। এরপরও অ্যান্ড্রু ওয়াটসনকেই অনেক ক্রীড়াবিশেষজ্ঞ প্রথম পেশাদার কৃষ্ণাঙ্গ ফুটবলার হিসেবে দাবি করেন। তবে বেশিরভাগই এখনও পর্যন্ত আর্থার হোয়ার্টনকেই প্রথম পেশাদার কৃষ্ণাঙ্গ ফুটবলার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। আর্থার হোয়ার্টনের জীবন সহজ ছিল না, বারবার বর্ণবাদী আচরণের শিকার হয়েছেন, বারবার ক্ষতবিক্ষত হয়েছে তার মন। তবুও আত্মসম্মানবোধে বলীয়ান আর্থার মাথা উঁচু করে খেলেছেন, নিজের পারফরম্যান্স ও সাফল্যই তার হয়ে জবাব দিয়েছে বর্ণবাদীদের।
শুরুর কথা
১৮৬৫ সালের ২৮ অক্টোবর আফ্রিকার পশ্চিমের দেশ ঘানার (তৎকালীন গোল্ডকোস্ট) রাজধানী আক্রার জেমসটাউনে আর্থার হোয়ার্টন জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা হেনরি হোয়ার্টন ওয়েস্ট ইন্ডিজের গ্রেনাডার বিখ্যাত ধর্মযাজক ও মন্ত্রী ছিলেন। তার বাবা মিশ্র-রক্তের ছিলেন, অর্ধেক গ্রেনাডিয়ান অর্ধেক স্কটিশ। তার মা এনা ফ্লোরেন্স ইজিব্রা ঘানার ফ্যান্টি রাজপরিবারের সদস্য ছিলেন। মামাদের প্রত্যেকেই ছিলেন সফল ব্যবসায়ী। গোল্ডকোস্টের বিখ্যাত পত্রিকা ‘দ্য গোল্ডকোস্ট টাইমস’-এর মালিক ছিলেন আর্থারের মামাদের পরিবারটি। আর্থারের বাবা-মায়ের বংশ দেখে সহজেই অনুমান করা যায়, তিনি উচ্চবংশীয়, স্বচ্ছল এবং অভিজাত পরিবারের ছেলে ছিলেন।
১৮৮৪ সালে ১৯ বছর বয়সে আর্থার হোয়ার্টন ইংল্যান্ডে পড়াশোনা করতে আসেন। ধর্মতত্ত্ব নিয়ে ডার্লিংটনের ক্লিভল্যান্ড কলেজে তিনি পড়াশুনা শুরু করেন। তার বাবা যেমন নামকরা ধর্মযাজক ছিলেন, তারই পদাঙ্কানুসরণ করতে এখানে পড়তে এসেছিলেন। কিন্তু ধর্মপ্রচার নয়, তার ভাগ্যে ঈশ্বর লিখেছিলেন অন্য কিছুই।
পড়াশোনার পাশাপাশি আর্থার হোয়ার্টন কলেজের বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে শুরু করেছিলেন। খুব দ্রুতই ধর্মতত্ত্বের পড়াশুনায় তার মন উঠে যায়, খেলাধুলায় পুরোপুরিভাবে নিমগ্ন হয়ে পড়েন। ক্রিকেট, ফুটবল, সাইক্লিং, রাগবি, দৌড় – সবরকম ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় তিনি অংশ নিয়েছেন। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, যে খেলাতেই তিনি অংশ নিয়েছেন, তাতেই তিনি সাফল্যের দেখা পেয়েছেন। ৬ ফুট লম্বা, পেটানো দেহ এবং অবিশ্বাস্য গতির অধিকারী ছিলেন তিনি। ঈশ্বরপ্রদত্ত সুঠাম দেহ, দৈহিক উচ্চতা এবং গতিই তাকে আর দশজনের থেকে খেলাধুলোয় বাড়তি সুবিধা এনে দিয়েছিল, তিনি তা কাজে লাগিয়েছিলেনও ভালোভাবেই।
দ্য ভার্সেটাইল অ্যাথলেট অ্যান্ড হিজ চ্যালেঞ্জেস
১৮৮৬ সালে ব্রিটেনের অ্যামেচার অ্যাথলেটিক্স অ্যাসোসিয়েশন লন্ডনের স্ট্যামফোর্ড ব্রিজ স্টেডিয়ামে ১০০ গজ দৌড় প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন। সেই প্রতিযোগিতায় আর্থার হোয়ার্টনও অংশ নিয়েছিলেন। ফিনিশিং লাইনে পৌঁছাতে তিনি সময় নিয়েছিলেন মাত্র ১০ সেকেন্ড। ১০ সেকেন্ডেই ১০০ গজ দূরত্ব অতিক্রম করা প্রথম দৌড়বিদ তিনি। এ প্রতিযোগিতা জিতে তিনি বনে যান দেশের দ্রুততম মানব, দৌড় প্রতিযোগিতায় তৈরি করেন নতুন রেকর্ড। কিন্তু শত শত শ্বেতাঙ্গ প্রতিযোগীকে হারিয়ে একজন বহিরাগত এরকম অবিশ্বাস্য কীর্তি স্থাপন করলেন, এটি অনেকেরই হজম হচ্ছিলো না। তারা আর্থার হোয়ার্টনের পিছে লাগেন, সমালোচনা করতে থাকেন। ১৮৮৭ সালে এই একই প্রতিযোগিতায় তিনি আবারও অংশ নেন, এবারও চ্যাম্পিয়ন হন। তখন পত্রপত্রিকায় আরো কঠোর ভাষা ব্যবহার করে তাকে নিয়ে লেখালেখি করা হয়। আর্থার হোয়ার্টন একজন অ্যাথলেটিক শেম্যাচার ( Shame + amateur = Shamateur) এরকম কথাও বলা হয়। তবে আর্থার কখনো সমালোচকদের সাথে সরাসরি বিতর্কে জড়াননি।
এই দৌড় প্রতিযোগিতার সময়কার আরেকটা ঘটনা জানা যায়। আর্থার মাঠে নামার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন, তখন তার বিপক্ষে খেলতে নামবেন এরকম দু’জন অ্যাথলেট আর্থারের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে একজন আরেকজনকে বলছিলেন,
“কী এমন আহামরি খেলোয়াড় এই ডার্কি? ওর মতো খেলোয়াড়কে যখন-তখন হারিয়ে দিতে পারি আমরা, ওকে ভয় পাওয়ার কী আছে?”
আর্থার খুব ঠাণ্ডা মাথায় এ ধরনের বিব্রতকর পরিস্থিতি সামাল দিতেন। সে সময়ের ধারাভাষ্যকাররা আর্থারকে নিয়ে যখনই কিছু বলতেন, ‘ব্রুনেট’, ‘ডার্কি’ এসব শব্দ অহরহ ব্যবহার করতেন। এমনকি পত্রপত্রিকাতেও এসব শব্দ ব্যবহৃত হতো।
আরেকটা ঘটনা এরকম: একবার এক লোক আর্থারকে ২০ ডলার ধরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘তুমি যদি হেরে যাও তোমাকে ২০ ডলার দিব। তুমি হেরে গেলে আমি বাজিতে টাকা জিতবো।’ সে সময় ২০ ডলার নেহায়েত কম অর্থ নয়। কিন্তু আর্থার তাকে ধমক দিয়ে বলেছিলেন, ‘আর কখনো যদি এরকম বাজে প্রস্তাব দাও, তাহলে তোমার কর্তৃপক্ষের কাছে নালিশ করবো।’ অর্থাৎ, আর্থার যদিও অল্প টাকা আয় করতেন, তবুও বড় অংকের অর্থের প্রলোভন তার নৈতিকতা নষ্ট করতে পারেনি।
দৌড় প্রতিযোগিতা জেতার পর বিভিন্ন ক্রীড়া ক্লাব থেকে আর্থার হোয়ার্টন ডাক পেতে শুরু করেন। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে ‘অ্যাপিয়ারেন্স ফি’ হিসেবে অর্থ উপার্জন করতে শুরু করেন।
১৯৮৪ সাল থেকেই আর্থার ডার্লিংটন ক্রিকেট ও ডার্লিংটন ফুটবল উভয় ক্লাবেই যুক্ত ছিলেন। ডার্লিংটন ফুটবল ক্লাবে তিনি গোলকিপার হিসেবে খেলতেন, মাঝে মাঝে উইঙ্গার হিসেবেও খেলেছেন। দৌড়, ফুটবল, সাইক্লিং – এক কথায় আর্থার হোয়ার্টনকে ‘ফার্স্ট ক্লাস অলরাউন্ড অ্যাথলেট’ বলা যায়।
ডার্লিংটনের হয়ে যখন খেলছিলেন, তখন থেকেই তিনি শহরের জনপ্রিয় একজন ফুটবলার হয়ে উঠতে শুরু করেন। একসময় ‘শেম্যাচার’ উপাধি পাওয়া উপেক্ষিত সেই অ্যাথলেটের নামের আশেপাশে ‘ম্যাগনিফিসেন্ট’, ‘ইনভিন্সিবল’, ‘সুপার্ব’ ইত্যাদি নানারকম তকমা উচ্চারিত হচ্ছে। ডার্লিংটনের হয়ে খেলা মোট ৩২টি ম্যাচে তিনি সাধারণ ভক্তদের মন জিতে নিয়েছিলেন। ১৮৮৫-৮৬ সালে ডার্লিংটনের খেলোয়াড় থাকাকালীন তিনি ‘নিউক্যাসল এন্ড ডিস্ট্রিক্ট’ দলের হয়ে খেলার জন্যেও নির্বাচিত হয়েছিলেন। শহরের সেরা খেলোয়াড়দের নিয়ে তৈরি হয়েছিল এই দলটি।
ডার্লিংটন বনাম নর্থ প্রেস্টন এন্ডের একটি ম্যাচে আর্থার খেলতে নেমেছিলেন। তার অ্যাবিলিটি ও স্কিল নর্থ প্রেস্টন এন্ডের অভিজ্ঞ স্কাউটদের চোখে পড়তে সময় নেয়নি। নর্থ প্রেস্টন এন্ড তাকে নিজেদের ক্লাবে খেলতে আমন্ত্রণ জানায়। আর্থারও ডার্লিংটন ছেড়ে কিছুদিনের মধ্যেই সেখানে যোগ দেন। ১৮৮৬ সালে নর্থ প্রেস্টন এন্ড ক্লাবের সাথে সেমি-প্রফেশনাল তথা আধাপেশাদার খেলোয়াড় হিসেবে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন। লিলি হোয়াইটদের হয়ে ১৮৮৬-৮৭ এবং ১৮৮৭-৮৮ এই দুই মৌসুম খেলেন। ১৮৮৬-৮৭ সালের এফএ কাপের সেমিফাইনালে ওঠে প্রেস্টন। প্রেস্টনের এ সাফল্যের পিছনে গোলকিপার আর্থার হোয়ার্টনের ভূমিকাও কম ছিল না। তবে সেমিতে ৩-১ গোলে ওয়েস্ট ব্রমউইচ আলবিয়নের কাছে হেরে যায় আর্থারের দল।
তখনও ইংলিশ ফুটবল লিগ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এফএ কাপই ইংল্যান্ডের সর্বোচ্চ প্রতিযোগিতা। প্রেস্টনের হয়ে এফএ কাপের সেমিতে খেলেছেন, এহেন সাফল্যের পর তার যথেষ্ট নামডাক তো হওয়ারই কথা। বলা হয়ে থাকে, ইংল্যান্ড জাতীয় ফুটবল দলের হয়ে খেলার মতো স্কিলফুল একজন গোলকিপার ছিলেন আর্থার হোয়ার্টন। কিন্তু ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের (এফএ) বর্ণবাদী মনোভাবের কারণেই আর্থারকে কখনো জাতীয় দলের জন্য বিবেচনা করা হয়নি।
দ্য আনঅর্থোডক্স গোল কাস্টোডিয়ান অ্যান্ড হিজ চ্যালেঞ্জেস
গোলকিপার হিসেবে কেমন ছিলেন আসলে আর্থার হোয়ার্টন?
ইতিহাসের বিখ্যাত অনেক গোলকিপারের মতোই আর্থার হোয়ার্টনও ছিলেন অনেকটাই খ্যাপাটে। আমরা যে সময়টার কথা বলছি, ১৮৮০ ও ১৮৯০ এর দশক, সে সময় গোলকিপার মানে সে লোকটি হয় পাগলাটে নয় একেবারে ষণ্ডা গোছের কেউ। ইংলিশ ফুটবলের ধরনটাই তখন এমন, রাফ অ্যান্ড টাফ। গোলকিপাররা নিজেদের অর্ধের যেকোনো জায়গায় গিয়ে বল নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন, শরীরের যেকোনো অংশ দিয়ে বল আটকাতে পারেন। তাই বিপক্ষ দলের সব খেলোয়াড়েরা যখন গোল দেওয়ার জন্য গোলমুখের সামনে ভিড় জমান, তখন বল কেড়ে নিয়ে গোল ঠেকাতে হলে যেমন রিফ্লেকশন হওয়া চাই তড়িৎগতির, তেমনি দরকার থাই কিক বক্সারদের মতো অ্যাটাকিং স্কিলও। এই দুটো কোয়ালিটিই যেমন তার ছিল, তেমনি হাতেও ছিল দারুণ শক্তি। আর্থার সবসময় হাত মুঠো করে সামনে দিকে ঘুষি মেরে উড়ে আসা বল আটকে দিতেন। আর্থারের এই টেকনিককে ব্রিটিশ মিডিয়া ‘Prodigious Punch’ নাম দেয়। ডানে-বামে লাফিয়ে শুধু হাত দিয়ে বা পাঞ্চ মেরেই যে তিনি বল আটকাতেন তা নয়, উপর দিয়ে মারা শটগুলোও মাথা দিয়ে অনায়াসে আটকে দিতেন।
তবে সবাই কিন্তু তাকে বাহবা দেয়নি, বাহবা দিলেও সাথে গায়ের রঙ উল্লেখ করে খোঁটা মারতে ছাড়েনি। যেমন, ১৮৮৭ সালে অ্যাটলেটিক জার্নালের এক কলামিস্ট লিখেছিলেন,
“হোয়ার্টন যদি নর্থ এন্ডের হয়ে গোলকিপিং করে, তাহলে ইংলিশ কাপে ওদের পক্ষে বাজির রেট নির্ঘাত বেড়ে যাবে। এই ডার্কি (Darkie) গোলপোস্টে দাঁড়ালে একটা সারস পাখিও ওকে ফাঁকি দিয়ে ঢুকতে পারবে না।”
আবার কেউ কেউ তাঁর প্রশংসা করতেও কার্পণ্য করেননি। ১৯৪২ সালে শেফিল্ডের এক ভক্ত স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে শেফিল্ড টেলিগ্রাফ অ্যান্ড ইন্ডিপেনডেন্টের কলামে লেখেন,
“রোথারহাম এবং শেফিল্ডের ম্যাচ দেখতে গিয়েছিলাম এক বুধবার, অলিভ গ্রুভ স্টেডিয়ামে। আমি আর্থারকে অবিশ্বাস্য উচ্চতা পর্যন্ত লাফ দিতে দেখেছি, এরপর দেখলাম লাফিয়ে ও ক্রসবার ধরে ঝুলছে। এরপর দু পায়ের ফাঁক দিয়ে বল আটকাল, তিনজন ফরোয়ার্ড বিলি ইংহ্যাম, ক্লিংকস মামফোর্ড আর মিকি বেনেট ছুটে এসেও ওর সামনে সুবিধা করতে পারলো না, গোলপোস্টের জালে উল্টিয়ে পড়ে গেল। আমার জীবনে কখনো আমি এরকম অসাধারণ সেইভ করতে দেখিনি কোনো গোলকিপারকে। আমি পঞ্চাশ বছর ধরে ফুটবল দেখছি।”
বলাই বাহুল্য, এক কথায় আর্থার হোয়ার্টনের গোলকিপিং ছিল দারুণ এন্টারটেইনিং।
১৮৮৮ সালে আর্থার হোয়ার্টন ফুটবল খেলা ছেড়ে দিয়ে দৌড়ে মনোনিবেশ করেন। সেসময় শেফিল্ড অ্যাথলেটিক্সের শহর হিসেবে পরিচিত। হিলসবরোর কুইন্স গ্রাউন্ডে কয়েক হাজার দর্শকের সামনে তিনি শেফিল্ড হ্যান্ডিক্যাপ জেতেন। এরপর শেফিল্ড ডেইলি টেলিগ্রাফ তাকে ‘রেসের ঘোড়ার চেয়েও দ্রুতগামী’ আখ্যা দেয়।
এত সাফল্যের পরও এক বছর পরই রোথারহাম টাউন তাকে ফুটবল খেলার প্রস্তাব দিলে আর্থার ফুটবলে ফিরতে দ্বিতীয়বার চিন্তা করেননি। বোধহয় ফুটবলকে একটু বেশিই মিস করছিলেন। ১৮৮৮ সালে ইংলিশ লিগ পেশাদার লিগ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছে। ১৮৮৯ সালে আর্থার রোথারহাম ইউনাইটেডের সাথে পুরোদস্তুর পেশাদার খেলোয়াড় হিসেবে চুক্তিবদ্ধ হন। টানা পাঁচ বছর রোথারহামের হয়ে খেলেন তিনি। আর ফুটবল লিগের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ পেশাদার ফুটবলার হিসেবে ইতিহাসের পাতায় নাম লেখান।
রোথারহামের হয়ে তিনি ভালোই সাফল্য পেয়েছিলেন। রোথারহাম মিডল্যান্ড লিগ জেতে। এছাড়া দলটি প্রোমোটেড হয়ে দ্বিতীয় ডিভিশনেও উঠে আসে।
শেফিল্ডের সময়গুলো
১৮৯৪ সালে শেফিল্ড ইউনাইটেডে যোগ দেন তিনি। শেফিল্ডে যোগ দিতে তাকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন তার বন্ধু টম বট। টম বট শেফিল্ড ইউনাইটেডের আনঅফিশিয়াল ম্যানেজার ছিলেন। অর্থাৎ ম্যানেজার না হলেও দলে তার কর্তৃত্ব ম্যানেজারের তুলনায় কম ছিল না। এদিকে মদ্যপানের প্রতি আর্থারের বেশ একটা ঝোঁক ছিল। ম্যাচ শুরুর আগে তিনি ড্রিংক করতেন প্রচুর। শেফিল্ড ইউনাইটেডের ‘স্পোর্টসম্যান কটেজ’ পাবের দায়িত্ব দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে তাকে রোথারহাম থেকে বাগিয়ে নেয় শেফিল্ড। সে সময় খেলোয়াড়দের উপযুক্ত বেতন দিতে না পারলে এরকম ছোটখাটো চাকরি দিয়ে খেলোয়াড়দের ধরে রাখতো ফুটবল ক্লাবগুলো। আর্থার শেফিল্ডের এই প্রলোভনে জড়িয়ে যান, রোথারহাম ছেড়ে শেফিল্ডে যোগ দেন।
কিন্তু শেফিল্ডের সময়টা খুব একটা ভালো যায়নি আর্থারের। ততদিনে তার বয়স ২৯ পেরিয়ে গেছে। সে বছর শেফিল্ড ১৯ বছর বয়সী এক প্রতিভাবান তরুণ গোলকিপার বিল ফোককেও সাইন করায়। ৬ ফুট ৪ ইঞ্চি লম্বা প্রায় ৮৩ কেজি ওজনের এই গোলি বিল ‘ফ্যাটি’ ফোক নামে পরিচিত ছিলেন। নিয়মিতভাবে খেলে যাচ্ছিলেন এবং দারুণ পারফর্ম করে যাচ্ছিলেন বিল ফোক। তাই বাধ্য হয়ে আর্থার বেঞ্চে বসেই কাটিয়ে দিয়েছেন সেই বছরটা। থেকে গিয়েছেন ‘সেকেন্ড চয়েস গোলকিপার’ বা ‘ব্যাকআপ গোলকিপার’ হিসেবে। শেফিল্ডের হয়ে তিনি লিস্টার ফসে, লিনফিল্ড অফ বেলফাস্ট এবং সান্ডারল্যান্ডের বিপক্ষে একটি করে মোটে তিনটি ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন। সান্ডারল্যান্ডের বিপক্ষে সেই ম্যাচে ব্লেডসরা ২-০ গোলে হেরে যায়। একটি গোল তাদের হজম করতে হয়েছিল আর্থারের ভুলের কারণেই। আর্থার তার স্বভাবসিদ্ধ আচরণ অনুযায়ী পাঞ্চ মেরে বল ঠেকাতে গিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি বল মিস করেন, তার শরীরের অনেকখানি পাশ দিয়ে বল ঢুকে যায় পোস্টে। যে ‘প্রডিজিয়াস পাঞ্চ’-এর জন্য তিনি বিখ্যাত ছিলেন, সেই পাঞ্চই সেদিন তাকে লজ্জায় ফেলে দেয়। লঘু পাপে গুরুদণ্ডই পেয়েছিলেন বলতে হবে। এই একটা ভুলের জন্য এবং সেদিন ম্যাচ হারায় তিনি আর একদমই খেলার সুযোগ পাননি। সান্ডারল্যান্ডের বিপক্ষের সেই ম্যাচটি ছিল প্রথম ডিভিশনের একটি ম্যাচ। সেই ম্যাচে খেলার মাধ্যমে প্রথম ডিভিশনে খেলা প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড় হওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করেন আর্থার হোয়ার্টন।
অতঃপর… শুধুই দলবদল
আর্থার শেফিল্ড ইউনাইটেড থেকে আবারও রোথারহাম ইউনাইটেডে ফেরত আসেন। কিন্তু ঠিক যেন মানিয়ে নিতে পারছিলেন না এখানে আর। এরপর একের পর এক ক্লাব বদলাতে থাকেন তিনি। যোগ দেন স্ট্যালিব্রিজ রোভার্সে, সেখানে খেলার সুযোগ না পেয়ে চলে যান রোভার্সের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী অ্যাশটন নর্থ এন্ডে। সেখানে তিনি দু’বছর খেলেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, ১৮৯৯ সালে ক্লাবটি ব্যাংক ঋণ শোধ করতে না পেরে দেউলিয়া হয়ে যায়। আর কোনো ক্লাব না পেয়ে লজ্জার মাথা খেয়ে তাকে আবারও স্ট্যালিব্রিজ ফেরত যেতে হয়। সেখানে কিছুদিন থাকার পর তিনি স্টকপোর্ট কাউন্টিতে যোগ দেন, ১৯০২ সাল পর্যন্ত সেখানেই খেলেন। কোথাও থিতু হতে পারছিলেন না, কোথাও নিয়মিতভাবে প্লেয়িং টাইম পাচ্ছিলেন না। এদিকে হাতে অর্থকড়িও আসছিল না সেভাবে। এহেন পরিস্থিতিতে আর্থার প্রচণ্ড হতাশ হয়ে পড়েন। এই সময় তিনি প্রচুর পরিমাণে মদ্যপান শুরু করেন। শেষমেশ ১৯০২ সালে ৩৭ বছর বয়সে তিনি ফুটবল থেকে অবসর নেন।
১৮৮৬-১৯০২ পর্যন্ত ২৭ বছরে মোট ৭টি ক্লাবের হয়ে খেলেছেন তিনি।
জীবনের শেষ ক’টা দিন…
১৯০২ সালে ফুটবল থেকে অবসর নেওয়ার পর তিনি কিছুদিন পাবে কাজ করেছেন। ১৯১৪ সালে কান্ট্রি ডারহামে তিনি ক্রিকেট কোচিং করানোর প্রস্তাব পান। কিন্তু পর্যাপ্ত সম্মানী দিতে না চাওয়ায় প্রস্তাবটি তিনি ফিরিয়ে দেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি হোম গার্ডও ছিলেন। ইংল্যান্ডের হয়ে তিনিও যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। ১৯১৫ সালে কাজের সন্ধানে তিনি দক্ষিণ ইয়র্কশায়ারের ডনকাস্টারের এডলিংটনের গ্রামে ফিরে যান। সেখানে গিয়ে ইয়র্কশায়ার মেইন কলিয়ারিতে চাকরি যোগাড় করেন। এখানে তিনি কয়লাখনির ইঞ্জিনরুমের সহকারী, কয়লা ট্রাকের কয়লা উত্তোলনের মতো অত্যন্ত বিপদজনক ও ক্লান্তিকর কাজ করে গিয়েছেন দীর্ঘদিন ধরে। স্ত্রী এমার সাথে বাকি জীবন এডলিংটনেই কাটিয়ে দেন।
তবে ক্রিকেট এবং দৌড় অনুশীলন চালিয়ে গিয়েছেন লম্বা সময় ধরে। অন্তত চল্লিশ বছর পর্যন্ত তিনি ক্রিকেট খেলেছেন। মদ্যপ হলেও অ্যাথলেটিক স্পিরিটের ওপর তার প্রভাব পড়েনি সেভাবে। একবার এক প্রত্যক্ষদর্শী তাকে বর্ণনা করেছিলেন এভাবে,
‘আর্থার এই পঞ্চাশ বছর বয়স এসেও দৌড় প্রতিযোগিতায় চাইলে কবুতরকে হারিয়ে দিতে পারবে।’
১৯৩০ সালে বালবি’র স্প্রিংওয়েল স্যানিটারিয়ামে একেবারে মদ্যপ, হতদরিদ্র অবস্থায় তিনি মারা যান ৬৫ বছর বয়সে। এপিথেলিওমিয়া বা উপরের ঠোঁটে ক্যান্সার হওয়ায় প্রচণ্ড শারীরিক কষ্টে ভুগেছেন শেষ দিনগুলোয়। কয়লাখনিতে কাজের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে রোগটিকে চিহ্নিত করলেও বাড়িয়ে বলা হবে না। মৃত্যুর পর তাকে এডলিংটনের কবরস্থানে কবর দেওয়া হয়। বহু বছর পর্যন্ত তার কবরটিতে কোনো নামফলক ছিল না।
হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের সন্ধান ও মূল্যায়ন
১৯৮০ সালে রে জেনকিনস নামে একজন ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ প্রথম আর্থার হোয়ার্টনের গল্প আধুনিক ফুটবল দর্শকদের কাছে তুলে ধরেন। তবে পুরো দুনিয়ার কাছে আর্থার হোয়ার্টনের গল্প পৌঁছে দিয়েছেন শন ক্যাম্পবেল নামের ডার্লিংটনের ৫৩ বছর বয়সী বার্বাডিয়ান বংশোদ্ভূত এক বাসিন্দা। ব্ল্যাক হিস্ট্রি মান্থের অংশ হিসেবে শহরের এক সেমিনারে লেকচার দিতে গিয়েছিলেন। সেখানেই তিনি আর্থার হোয়ার্টন সম্পর্কে প্রথম জানতে পারেন। তিনি পেশায় ছিলেন একজন ভাস্কর। তিনি সেদিনই বাড়ি ফিরে আর্থার হোয়ার্টনের একটি ভাস্কর্য তৈরি করেন। তিনি চেয়েছিলেন ডার্লিংটনের হোমগ্রাউন্ড ফিদামস স্টেডিয়ামে বা শহরের কোথাও আর্থার হোয়ার্টনের একটি ভাস্কর্য স্থাপন করা হোক, কিন্তু খুব বেশি সাড়া পাননি। এরপর সেখানকার জনপ্রিয় পত্রিকা নর্দান একোতে আর্থার হোয়ার্টন সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে তা অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এরপর শন ক্যাম্পবেল আর্থার হোয়ার্টন ফাউন্ডেশন তৈরি করেন। নিজে কৃষ্ণাঙ্গ হওয়ায় হারিয়ে যাওয়া আরেক কৃষ্ণাঙ্গের কীর্তি পৃথিবীবাসীর কাছে তুলে ধরতে তিনি আপ্রাণ চেষ্টা শুরু করেন। ফাউন্ডেশনের সাথে যুক্ত হন আর্থার হোয়ার্টনের নাতনি শেইলা লিসন। তিনি আর্থারের হারিয়ে যাওয়া ট্রফি, পুরনো ছবি, নানারকম দলিলপত্র খুঁজে পান। অনুসন্ধান চালাতে তারা ঘানাতেও গিয়েছিলেন। প্রচুর গবেষণার পর আর্থার হোয়ার্টনকে নিয়ে নানা তথ্য সামনে আসে। ১৯৮৮ সালে ফিল ভাসিলি তাদের সহায়তায় ‘The First Black Footballer’ নামে একটি বই লিখেন আর্থার হোয়ার্টনকে নিয়ে।
১৯৯৭ সালে ‘Football Unites, Racism Devides’ – ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে অর্থসংগ্রহ করা হয়। সেই অর্থে আর্থার হোয়ার্টনের কবরটিতে নামফলক লাগানোর ব্যবস্থা করা হয় ও কবরটির সংস্কার করা হয়।
২০০৩ সালে ইংলিশ ফুটবল হল অফ ফেইমে তার নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
২০১২ সালে ফিফার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সেপ ব্লাটারকে আর্থার হোয়ার্টনের ২.৫ ফুট উচ্চতার ছোট একটি ব্রোঞ্জের ভাস্কর্য আর্থার হোয়ার্টন ফাউন্ডেশনের তরফ থেকে উপহার হিসেবে তুলে দেন শন ক্যাম্পবেল। এই ভাস্কর্যটি এখনও ফিফার সদর দফতরের প্রদর্শন কক্ষে শোভা পাচ্ছে।
২০১৬ সালে সেইন্ট জর্জ পার্ক, ব্রিটিশ ফুটবল এসোসিয়েশনের (এফএ) ন্যাশনাল ফুটবল সেন্টারে আর্থার হোয়ার্টনের ১৬ ফুট লম্বা একটি ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়।
২০২০ সালে আর্থার হোয়ার্টনের ১৫৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ডার্লিংটনে একটি ম্যুরাল চিত্র আঁকা হয়। স্প্যানিশ শিল্পী জে কায়েস এই ম্যুরালটি আঁকেন।
বেঁচে থাকাকালীন যে মানুষটি প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে গিয়েছেন জীবনের সাথে, প্রাপ্য সম্মান পাননি সমাজের কাছে, মৃত্যুর প্রায় একশ’ বছর পর তাকে সম্মানিত করতে পেরে নিজেদের ধন্য মনে করছেন ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থার কর্তাব্যক্তিগণ ও সাধারণ ফুটবল ভক্তকূল।
সব কথার শেষ কথা
অনেকেই বলে থাকেন যে ১৯৯০ এর দশকে ইংল্যান্ডে ফুটবলের পুনর্জন্ম হয়েছে। খেলার ধরন এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ছাড়াও বিভিন্ন অর্গানাইজেশন যেমন Show Racism The Red Card কিংবা Kick It Out-এর সৃষ্টিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে ফুটবলের আধুনিকায়নে। ১৯৮৬ সালে পাবলিক অর্ডার অ্যাক্ট থেকে ১৯৯১ সালের ফুটবল অফেন্সেস অ্যাক্ট – এই আইনগুলো বর্ণবাদের সাথে যুদ্ধে কার্যকরী ভূমিকা রাখছে।
ব্রিটিশ ইতিহাসবিদরা বরাবরই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছে কৃষ্ণাঙ্গদের, তাদের প্রাপ্য মর্যাদা দিতে চায়নি সহজে। তারা লিখে গিয়েছে শুধু নিজেদের কথাই। কৃষ্ণাঙ্গদের হয়ে ইতিহাস লিপিবদ্ধ করার কেউ ছিল না। এ কারণেই আর্থার হোয়ার্টন ফুটবলের খুব জনপ্রিয় বা চর্চিত নাম হয়ে উঠতে পারেননি। আর্থার হোয়ার্টনের অর্জন যে কত গুরুত্বপূর্ণ, তিনি যে কত ডাইন্যামিক একজন অ্যাথলিট ছিলেন, তা ক্রীড়াবিশ্ব উপলব্ধিই করতে পারেনি লম্বা একটা সময় ধরে। তাই তার কীর্তি পাদপ্রদীপের আলোয় আসতে সময় নিয়েছে বহু দশক। বহু বছর পর শন ক্যাম্পবেলের মতো মানুষেরা নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে গিয়েছেন নিজেদের শিকড়ের ইতিহাস খুঁজে বের করতে, ছড়িয়ে দিয়েছেন পূর্বপুরুষদের ইতিহাস। তাই আজ আমরাও জানতে পেরেছি তাদের কথা।
ভিভ রিচার্ডসন-জন বার্নস-ইয়াইয়া তোরে কিংবা আজকের সাদিও মানে-এনগোলো কান্তেরা আর্থার হোয়ার্টনের কাছে অশেষভাবে কৃতজ্ঞ থাকবেন। আজকের যুগে ছয় অংকের বেতন পাওয়া, বিলাসবহুল জীবন উপভোগ করা এই ফুটবলাররা পূর্বসূরির অবদান কতটুকু উপলব্ধি করতে পারবেন, শুধুমাত্র গায়ের রঙের জন্য যথাযথ মূল্যায়ন না পাওয়া, জাতীয় দলের জন্য নির্বাচিত না হওয়া ও অর্থের কষ্ট কতটুকু অনুভব করতে পারবেন, কিংবা নামফলকহীন কবরে দিনের পর দিন পড়ে থাকার চিন্তা তাদের মনে কতটা আলোড়ন সৃষ্টি করবে, জানা নেই। তবে ইংলিশ ফুটবলে এই যে পালাবদল হয়েছে, তার শুরুটা করে দিয়ে গিয়েছেন আর্থার হোয়ার্টন, একশ বছরেরও বেশি সময় আগে।
বর্তমান শতকে এসে বর্ণবাদ পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেছে বটে, তবে এখনও তা আশানুরূপ নয়। প্রায়ই বিভিন্ন ফুটবলারের সাথে নানামহলের নানারকম বর্ণবাদী আচরণের খবর দেখতে পাই আমরা অন্তর্জালের দুনিয়ায় এবং পত্রিকার খেলার পাতাজুড়ে। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়াই চলছে লম্বা সময় ধরেই, এখনও লম্বা পথ পাড়ি দেওয়া বাকি।
আর্থার হোয়ার্টন জীবিত অবস্থায় সমাজের বিরুদ্ধে লড়াই করে ও শেষ জীবনে দুঃখ-দুর্দশায় কাটালেও ছিলেন অত্যন্ত গুণী এবং কীর্তিমান একজন মানুষ। নিজের কাজটা তিনি করে গিয়েছেন শত অপমানসত্ত্বেও, লক্ষ্যচ্যুত হননি। তাই তো মৃত্যুর এত বছর পর হলেও সম্মানের সাথে তার নাম উচ্চারিত হচ্ছে। যেমনটা ফিল ভাসিলি লিখেছেন,
“He (Arthur) ended his days sadly, but he was not a sad figure, he did things his own way, despite obstacles put in his way.”
আর্থার হোয়ার্টনের গল্প তাই সকলকে জীবনের পথে সাহসী পদক্ষেপ নিতে অনুপ্রেরণা যোগাক।