বছর শেষ হতে চলেছে। দেশের, রাজনৈতিক, উন্নয়ন খাত, কূটনৈতিক, আন্তর্জাতিকসহ বিভিন্ন পরিবর্তনের পাশাপাশি আলোচনায় ছিল অনেক কিছুই। দেশের ক্রীড়াক্ষেত্রেও ছিল নানান পাওয়া আর না পাওয়ার ঘটনা। দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ক্রিকেট ছিল কখনও কখনও টালমাটাল, কখনও ছিল প্রশংসার জোয়ারে ভাসমান। ২০১৯ বছরে দেশের ক্রিকেটে ঘটে গেছে অনেক কিছুই।
কেমন ছিল ক্রিকেটীয় ২০১৯ বছরটি? চলুন, জেনে নেওয়া যাক।
ক্রাইস্টচার্চ থেকে বেঁচে ফেরা
চলতি বছরের শুরুটাই হয়েছিল এক ভয়ঙ্কর ঘটনার মাধ্যমে। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের শুরু হয় নিউ জিল্যান্ডের সফরের মাধ্যমে। সেখানে তিনটি করে ওয়ানডে ও টেস্ট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ওয়ানডে সিরিজের পর দু’টি টেস্ট শেষে এক শুক্রবারে যখন নামাজের জন্য মসজিদে যাচ্ছিল বাংলাদেশ দল, তখনই ঘটে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা।
গেল ১৫ মার্চের সেই ঘটনায় ৪৯ জন নিহত হওয়ার পাশাপাশি আহত হয়েছিল প্রায় ৪৮ জন। সেদিন মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্য হামলার হাত থেকে বেঁচে যান তামিম ইকবাল, সৌম্য সরকার, মুশফিকুর রহিমরা। হামলার ঘটনাস্থল থেকে মাত্র ৫০ গজে দূরে ছিলেন বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটাররা। সেই ঘটনার পর দ্রুত নিউ জিল্যান্ড সফর বাতিল করে দেশে ফেরে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল।
সেদিনের সেই ঘটনা এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ‘আউটফিল্ড’ এর সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা। একটুর জন্য বেঁচে ফিরলেও ভাগ্যের ফেরে হতে পারতো অনেক বড় কিছুও। এই ঘটনা বারবার মনে করিয়ে দেয় ২০০৯ সালে পাকিস্তানে শ্রীলঙ্কার উপর জঙ্গী হামলার ঘটনার কথা।
প্রথম শিরোপার স্বাদ
২০১৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপের আগে কন্ডিশনিং ক্যাম্প করতে আয়ারল্যান্ডে যায় বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল। সেখানে আয়ারল্যান্ড ও উইন্ডিজের বিপক্ষে একটি ত্রিদেশীয় সিরিজ খেলে লাল-সবুজ জার্সিধারীরা। সেই সিরিজে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক ট্রফির স্বাদ পায় মাশরাফি বিন মুর্তজারা।
বৃষ্টিবিঘ্নিত ম্যাচে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে পয়েন্ট ভাগাভাগি করতে হয়, সেই বৃষ্টি ছিল উইন্ডিজের বিপক্ষে ফাইনাল ম্যাচেও। উত্তেজনাপূর্ণ ফাইনালে উইন্ডিজের ছুঁড়ে দেওয়া লম্বা লক্ষ্যও ছুঁয়ে ফেলে বাংলাদেশ দল। জিতে নেয় প্রথম ত্রিদেশীয় সিরিজের ট্রফি। সেই ম্যাচে ব্যাটিং অলরাউন্ডার মোসাদ্দেক হোসেনের ২৭ বলে ৫২ রানের ইনিংসটি ছিল দারুণ গুরুত্বপূর্ণ।
বিশ্বকাপ ও সাকিব আল হাসান
ত্রিদেশীয় সিরিজ জিতে বাড়তি আত্মবিশ্বাস নিয়ে ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে অংশ নিয়েছিল বাংলাদেশ। শুরু থেকেই বলা হচ্ছিল, এটি বিশ্বকাপের ইতিহাসে বাংলাদেশের সবচেয়ে শক্তিশালী দল। তাই প্রত্যাশার পারদও ছিল বেশ চড়া। সেভাবেই এগিয়েছিল বাংলাদেশ।
প্রথমবারের মতো সব দলের বিপক্ষে লড়াইয়ের নতুন নিয়মের বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সামনে ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। তবে দলের ক্রিকেটাররা ফর্মে থাকার কারণে শুরুটাও হয়েছিল মনে রাখার মতো করেই। প্রথম ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে রেকর্ড রান তুলে জয়। নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে জয়ের তীরে গিয়ে তরী ডোবানো। বলা হয়, বিশ্বকাপ থেকে বাংলাদেশের ছিটকে যাওয়ার পিছনে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে এই ম্যাচটিই ‘ষোল কলা’ পূর্ণ করেছিল। ম্যাচে মুশফিকের একটি সহজ স্ট্যাম্পিং মিসের ঘটনা সমালোচিত হয়েছিল।
ক্রমশ বাংলাদেশের অবস্থা খারাপ হতে শুরু করে। প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন নিয়ে যাওয়া বাংলাদেশ উইন্ডিজের বিপক্ষে জয় পায়, জিতে যায় আফগানিস্তানের বিপক্ষেও। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে তথাকথিত ‘শিওর শট’ ভেস্তে যায় বৃষ্টিতে। শেষ চারে যাওয়া তো দূরে থাক, ১০ দলের এই বিশ্ব টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের বিদায় হয় ৮ নম্বরে থেকে।
বাংলাদেশের পক্ষে সাকিব আল হাসান পুরো বিশ্বকাপ জুড়ে ছড়িয়েছিলেন সাফল্যের আলো। ৮ ম্যাচে ২ সেঞ্চুরির পাশাপাশি ৬০৬ রান করেন সাকিব, গড় ছিল ৮৬.৫৭। বল হাতেও ছিলেন ঝলমলে, তুলে নিয়েছিলেন ১১টি। তবে সাকিব যেমন ছিলেন ঝলমলে, তেমনই নিষ্প্রভ ছিলেন অভিজ্ঞ অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা। ইনজুরি, আর বাজে পারফরম্যান্স তাকে জনপ্রিয়তার চূড়া থেকে নামিয়ে আনে মাটিতে। সেই বিশ্বকাপের আসর থেকে ফিরে এখনও শতভাগ পারফরম্যান্স দিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি মাশরাফি।
কোচিং স্টাফদের ছাঁটাইয়ের মিছিল
ইংল্যান্ডে বিশ্বকাপ। তাই ইংলিশ কোচের দিকেই ঝুঁকেছিল বিসিবি। সেই ধারাবাহিকতায় কোচের দায়িত্ব পেলেন স্টিভ রোডস। ইংলিশ এই কোচ বাংলাদেশের দায়িত্ব নেওয়ার মাধ্যমেই প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক দলের কোচ হন। কিন্তু যে বিশ্বকাপের লক্ষ্যে তাকে নেওয়া, সেই বিশ্বকাপের ব্যর্থতায় তাকে ছাঁটাই করা হয়। বাংলাদেশ দল নিয়ে তিনি আশাবাদী ছিলেন, করতে চেয়েছিলেন অনেক কিছুই। কিন্তু নিজের দেশে বাংলাদেশ দলকে সাফল্য এনে না দিতে পারা কাল হয় শেষ পর্যন্ত।
শুধু স্টিভ রোডস নন, পেস বোলিং কোচ কোর্টনি ওয়ালশের সাথে চুক্তি শেষ হওয়াতে নতুন করে আর চুক্তি করেনি বোর্ড। তাছাড়া তার অধীনে তাসকিন-রুবেলদের উল্লেখযোগ্য কোনো পারফরম্যান্সের দেখাও মেলেনি। চুক্তি শেষ হওয়ায় দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় স্পিন বোলিং কোচ সুনীল যোশি এবং ফিজিও তিহান চন্দ্রমোহনকেও।
পরবর্তীতে আগস্টে নতুন প্রধান কোচ হিসেবে নিয়োগ পান দক্ষিণ আফ্রিকান রাসেল ডোমিঙ্গো। ওয়ালশের বদলি হিসেবে দায়িত্ব নেন আরেক প্রোটিয়া শার্ল ল্যাঙ্গেভেল্ট। ফিজিও হিসেবেও বিসিবি ভরসা রাখে দক্ষিণ আফ্রিকাতেই, নিয়োগ পান জুলিয়ান ক্যালেফাতো।
‘ফুলটাইম’ স্পিন কোচের দেখা এখনও পায়নি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড। কিন্তু পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় সাবেক ‘ব্ল্যাক ক্যাপস’ অধিনায়ক ড্যানিয়েল ভেট্টোরিকে।
ক্রিকেটারদের ধর্মঘট
বলা যায়, বাংলাদেশের ক্রিকেটে এ বছরের সবচেয়ে বড় ঘটনা ছিল ক্রিকেটারদের ধর্মঘট। তখন জাতীয় লিগের খেলা চলছিল। দ্বিতীয় রাউন্ডের খেলা শুরু হয়েছে কেবল। অক্টোবরের শেষ দিকে, ২১ তারিখে মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে জোট বেঁধে উপস্থিত হন প্রায় ৫৫-৬৫ জন ক্রিকেটার। বিকেলে তারা সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে ১১ দফা দাবি পেশ করে। দাবিগুলো ছিল: ঘরোয়া ক্রিকেটের অবকাঠামো উন্নয়ন, ক্রিকেটারদের সম্মান দেওয়া, বেতনভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো, প্রিমিয়ার লিগে পারিশ্রমিক বৃদ্ধি, টুর্নামেন্ট বাড়ানো, আম্পারিংয়ের মান বৃদ্ধি করা,জাতীয় দলে দেশি কোচদের সুযোগ দেওয়া, আম্পায়ার-মাঠকর্মীদের পারিশ্রমিক বাড়ানোর দাবি।
ধর্মঘটে সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিমসহ জ্যেষ্ঠ ক্রিকেটারদের নেতৃত্ব ছিল চোখে পড়ার মতো। আবার এটাও চোখে পড়ার মতো ছিল যে, ক্রিকেটারদের এই আন্দোলনে উপস্থিত ছিলেন না মাশরাফি বিন মুর্তজা। পরে জানা যায়, তাকে জানানো হয়নি।
এদিকে ক্রিকেটারদের এই আন্দোলনের মুখে চাপে পড়ে বিসিবি। ধর্মঘটের ডাক দেওয়ার পরদিনই সভা করা হয়, এবং সংবাদ সম্মেলনে ক্রিকেটারদের এক হাত নেন বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন। পাশাপাশি এই ধর্মঘট ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ এবং ‘বিশেষ মহলের চক্রান্ত’ বলে অভিহিত করেন। তিনি জানান, সময়ের সাথে সাথে যারা জড়িত, তাদের পরিচয় ‘অটো’ বের হয়ে আসবে। একই সাথে তিনি ক্রিকেটারদের নিয়ে নানান আপত্তিকর মন্তব্য করেন।
পরবর্তীতে ক্রিকেটাররা আবারও একত্রিত হন এবং তাদের বিষয় নিয়ে আলাপ করেন। এর আগে যদিও বিসিবির পক্ষ থেকে ক্রিকেটারদের আলোচনায় বসার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ক্রিকেটাররা বিসিবি কর্তাদের সাথে বৈঠক করেন, এবং তৃতীয় দিন রাতে ধর্মঘট শেষ হওয়ার ঘোষণা আসে। বেশ কিছু দাবি মেনে নেওয়া হয়, কিছু দাবি ‘আংশিক’ মানা হয়, এবং বাকিগুলোর ব্যাপারে আশা দেওয়া হয়।
সাকিব নিষিদ্ধ!
ধর্মঘট ও সাকিবের নিষেধাজ্ঞা; কোনটা আগে পরে বলা হবে, তা ঠিক করা দুস্কর। তবে হ্যাঁ, ধর্মঘট শেষ হওয়ার পরপর এবং ভারত সফরের আগের দিনই সাকিব আল হাসান নিষিদ্ধ হলেন। অভিযোগ, জুয়াড়ির সঙ্গে কথোপকথন গোপন করায় সাকিবকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ২০১৮ সাল থেকে মোট তিনবার ভারতীয় জুয়াড়ি দীপক আগারওয়ালের সাথে কথা বলেন সাকিব। কিন্তু সেই তথ্য আইসিসির কাছে বেমালুম চেপে যান সাকিব। ফলাফল, এক বছরের স্থগিত নিষেধাজ্ঞাসহ দুই বছরের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয় বাংলাদেশ ক্রিকেটের এই পোস্টারবয়কে। সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২০ সালের অক্টোবরের ২৯ তারিখে শেষ হবে সাকিবের নিষেধাজ্ঞা। তাতে করে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মাঝে দলের সাথে যোগ দিতে পারবেন সাকিব।
টেস্টে আফগানিস্তানের বিপক্ষে পরাজয় ও ‘গোলাপী টেস্ট’ বিভীষিকা
এ বছরের সবচেয়ে হতাশাজনক হার ছিল আফগানিস্তানের বিপক্ষে একমাত্র টেস্টে হার। মাত্র টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়া দেশটির বিপক্ষে চট্টগ্রামে বৃষ্টিবিঘ্নিত ম্যাচে বড় ব্যবধানে হারে স্বাগতিক বাংলাদেশ। ম্যাচ শেষে অধিনায়ক সাকিব আল হাসান মজা করে বলেছিলেন,
‘ভালো দিক হলো, এই ম্যাচ টেস্ট চ্যাম্পিনয়নশিপের অন্তর্ভুক্তও নয়।’
তবে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপটাও বাংলাদেশের হয়েছে ব্যর্থতায়। বছরের শেষ আন্তর্জাতিক সফর ছিল এটি। তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি ও দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে ছিল একটি দিবারাত্রির টেস্ট ম্যাচ। ইডেনে খুব জাঁকজমকপূর্ণভাবে আয়োজন করা হয় গোলাপী বলের টেস্ট ম্যাচটি। উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু বাজেভাবে সেই ম্যাচে হারে বাংলাদেশ। টি-টোয়েন্টি সিরিজটা ২-১ এবং টেস্টে ২-০ ব্যবধানে হেরে বাংলাদেশের সফর শেষ হয়।
আরও কিছু…
সরকারের শুদ্ধি অভিযানে ক্যাসিনো কাণ্ড এবং দুর্নীতি বিরোধী অভিযানে বিপাকে পড়েন একাধিক বিসিবির কর্মকর্তা। বিশেষ করে বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের বন্ধু মোহামেডানের লোকমান হোসেন ভুঁইয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় তিনি অস্ট্রেলিয়ায় অর্থ পাচার করেছেন। এই মুহূর্তে তিনি কারাগারে। এছাড়া দুদকের সন্দেহ রয়েছে মাহবুব আনাম, এই মুহূর্তে তার বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
এর বাইরে এক বছরে দু’টি বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) আয়োজনও বছরজুড়ে আলোচনায় ছিল। এই মুহূর্তে বছরের দ্বিতীয় বিপিএল চলমান রয়েছে।