বিশ্বকাপের মাস ছয়েক আগে থেকেই মাশরাফি বিন মুর্তজা পই পই করে বলে আসছিলেন, সাত নম্বরে সাব্বির রহমানকেই দরকার। এই পজিশনে তার বিকল্প নেই। সাহস আছে, বড় শটস খেলতে পারে, জোরে বোলিংয়ে হলেও মারতে পারবে। বিশ্বকাপে ওকেই চাই বাংলাদেশ দলের। ওখানে ১০ বলে ২০-২৫ রান লাগতে পারে। এমন ব্যাটিং করার মতো ওই একজনই আছে, সেটা সাব্বির।
অধিনায়কের এমন অকুন্ঠ সমর্থনে এক মাস শাস্তি কমিয়ে নিউ জিল্যান্ড সফরের দলেই নেয়া হয় এই তরুণ ব্যাটসম্যানকে। নিউ জিল্যান্ডে সেঞ্চুরি করে মাশরাফির আস্থার প্রতিদানও দিয়েছেন সাব্বির। সাত নম্বরে তার ভালো বিকল্প নেই জেনেই বিশ্বকাপ দলে রাখা হয়েছে ডানহাতি এই ব্যাটসম্যানকে। এই পজিশনের জন্য একমাত্র পরীক্ষিত সৈনিকের তকমাটাই জুড়ে গিয়েছিল ২৭ বছর বয়সী সাব্বিরের নামের সঙ্গে।
বিশ্বকাপের কয়েক মাস আগেও জাতীয় দলের আলোচনায় ছিলেন না মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত। ঢাকা প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগে আবাহনীর হয়ে লেট মিডল অর্ডারে তার ব্যাট দ্যুতি ছড়াল ধারাবাহিকভাবে। ‘ইমপ্যাক্ট’ ক্রিকেটার হিসেবে মোসাদ্দেকের একটা ভাবমূর্তি আগেই ছিল। প্রিমিয়ার লিগে ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি নিজের অফস্পিনটা চালিয়ে গেছেন। দুই মিলে কপাল খুলে যায় এই তরুণের। ব্যাটিং এবং স্পিনের দক্ষতার কারণে বিশ্বকাপ দলে ঠাঁই পেয়ে যান মোসাদ্দেক। তাছাড়া মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের কাঁধের ইনজুরি, তার বোলিং করতে না পারার সংকেতটাও মোসাদ্দেকের বিশ্বকাপ দলে আসার সিদ্ধান্তকে বেগবান করেছে।
ব্যাটিং অর্ডারে উপরের দিকে অভিজ্ঞদের আধিক্য। তামিম ইকবাল, সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম, মোহাম্মদ মিঠুন, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদরা ব্যাটিং করেন এক থেকে ছয় নম্বরের মধ্যে। সাত নম্বর পজিশনটা যেকোনো দলের জন্যই খুব গুরুত্বপূর্ণ, আর বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আরও বেশি। এখানেই খুনে, বিস্ফোরক কোনো ব্যাটসম্যান প্রয়োজন ছিল দলটার।
সাব্বিরকে এগিয়ে রেখেই ছক কষছিল বাংলাদেশ। কিন্তু ত্রিদেশীয় সিরিজে মোসাদ্দেকের পারফরম্যান্স সেই চিন্তায় ছেদ ফেলেছে। থমকে দাঁড়িয়েছে টিম ম্যানেজমেন্ট, নতুন করতে ভাবতে হচ্ছে তাদের। বলা যায়, টিম ম্যানেজমেন্টকে ভাবতে বাধ্য করেছেন, ভাবনার খোরাক যোগাড় করে দিয়েছেন মোসাদ্দেক।
আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজে খুব একটা ব্যাটিং করার সুযোগ পাননি সাব্বির। ফাইনালে সাইড স্ট্রেইনের ইনজুরিতে খেলতে না পারা সাকিবের বিকল্প হিসেবে খেলেছেন মোসাদ্দেক। সাব্বিরকে পাঠানো হয়েছিল তিন নম্বরে। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে ফিরেছিলেন। মোসাদ্দেককে দেয়া হয়েছিল সাত নম্বরের চ্যালেঞ্জিং কাজটা। বলা বাহুল্য, ক্রিকেট বিশ্ব এখন জানে ওই পজিশনে ব্যাট হাতে ক্যারিবিয়ান বোলারদের উপর কী তান্ডবই না চালিয়েছেন এই তরুণ, গত ১৭ মে ফাইনালে। ষষ্ঠ উইকেটে অগ্রজ মাহমুদউল্লাহর সঙ্গে ৭০ রানের জুটি গড়েছেন, যেখানে অভিজ্ঞ মাহমুদউল্লাহর অবদান ১৮ রান! ননস্ট্রাইকে দাঁড়িয়ে তিনি দেখেছেন এক অনুজের ধ্বংসযজ্ঞ।
আর মোসাদ্দেক ২৭ বলে চোখ ধাঁধাঁনো ম্যাচ জয়ী অপরাজিত ৫২ রানের ইনিংস খেলেছেন, যেখানে ২টি চার ও ৫টি ছক্কা ছিল। ব্যাট হাতে রুদ্রমূর্তি ধারণ করা এই তরুণ ফ্যাবিয়ান অ্যালেনের করা ২১তম ওভারেই তিন ছক্কা এক চারে তুলেছিলেন ২৫ রান। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অতীতে এমন বিস্ফোরক ব্যাটিং খুবই কমই খেলেছেন বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা। ওই ইনিংসের ফলে বাংলাদেশ ম্যাচ জিতেছিল, অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। বহুজাতিক টুর্নামেন্টে প্রথম ট্রফি জিতে নতুন ইতিহাস গড়েছিল।
ঠিক খোলনলচে না হলেও মোসাদ্দেকের ওই ইনিংসের পর সাত নম্বর ব্যাটিং পজিশন নিয়ে চিন্তার খোরাক পেয়েছে বাংলাদেশ। বেশ নড়েচড়ে বসেছেন টিম ম্যানেজমেন্টের সদস্যরা। বাংলাদেশ দলের বিশ্বস্ত সূত্রের খবর এমনই।
ত্রিদেশীয় সিরিজের পর টিম ম্যানেজেমেন্টের গুরুত্বপূর্ণ এক সদস্যের মাধ্যমে জানা গেছে, সাত নম্বরে এখন সাব্বিরের চেয়ে মোসাদ্দেকই সবার বিবেচনায় এগিয়ে আছেন। ডাবলিনে ওই ইনিংসের পর অন্তত বিশ্বকাপের শুরুর দিকে কয়েকটি ম্যাচে মোসাদ্দেককেই সুযোগ দেয়ার পক্ষে টিম ম্যানেজমেন্ট। তার সেটা প্রাপ্যও বলে মনে করা হচ্ছে। আবার সাব্বিরকেও ছুঁড়ে ফেলা হচ্ছে না। কারণ নিউজিল্যান্ডে সেঞ্চুরি করে নিজের দাবিটা পোক্ত করেই রেখেছেন তিনি। তারপরও বিশ্বকাপের প্রারম্ভে মোসাদ্দেককেই দেয়া হতে পারে সাত নম্বরে নেমে ব্যাটিংয়ে ঝড় তোলার গুরুভার।
টিম ম্যানেজমেন্টের ওই সদস্য বলেছেন,
‘আসলে আমরা সাত নম্বরে কী চাই, ২০ বলে ৩৫, ১০ বলে ২০, এমন রান। মোসাদ্দেক ওইদিন (ফাইনালে) যেমন খেলেছে, এত বেশিও হয়তো লাগবে না। ও তো অসাধারণ খেলেছে, এক ওভারেই ২৫ রান তুলছে। ওর সুবিধা হলো, ও বোলিংটাও করতে পারে। রিয়াদ যেহেতু এখনও বোলিং করতে পারছে না, কিছু ওভার দরকার হতেই পারে। সেটা মোসাদ্দেক করে দিতে পারবে। ফাইনালে ওই ইনিংসের পর আসলে বিশ্বকাপে প্রথম কয়েকটি ম্যাচে মোসাদ্দেকই সুযোগ পাওয়ার কথা। তবে সাব্বিরের কথা ভুলে গেলেও চলবে না। কারণ ও তো নিউ জিল্যান্ডে সেঞ্চুরি করে বসে আছে, ওর দাবিটাও কম নয়। এটা আমাদের জন্য ভালো হলো। একই পজিশনের জন্য দু’জনকে পাচ্ছি। দু’জনই প্রস্তুত আছে। যখন যাকে প্রয়োজন ব্যবহার করা যাবে।’
ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে অমন মারকুটে ব্যাটিংয়ে করতে নামার আগে মোসাদ্দেককে তাতিয়ে দিয়েছিলেন মাশরাফি। মোসাদ্দেককে বলা অধিনায়কের টোটকা নিয়ে টিম ম্যানেজমেন্টের এই সদস্য বলেছেন,
‘মোসাদ্দেক যাওয়ার আগে মাশরাফি বলছে, কোনো চাপ নিবি না। নিজের মতো ব্যাটিং করবি। ঠিক যেমন চাপ ছাড়া বিকেএসপিতে ব্যাটিং করোস। উইকেট ভালো আছে, গিয়া বিকেএসপির মতো সমানে শুধু চালাবি।’
তারপর ডাবলিনে মোসাদ্দেক যা করেছেন, তা এখন ইতিহাস। ক্যারিবিয়ান বোলারদের কচুকাটা করে বাংলাদেশের প্রথম ত্রিদেশীয় সিরিজের ট্রফি নিশ্চিত করে দিয়েছেন এই তরুণ ব্যাটসম্যান।
ওয়ানডেতে সাব্বির খেলেছেন ৬১ ম্যাচ। ২৫.৯৩ গড়ে ১ হাজার ২১৯ রান করেছেন তিনি, স্ট্রাইক রেট ৯১.৫১। মোসাদ্দেক খেলেছেন ২৬ ম্যাচ। ৩৩.৯১ গড়ে ৪০৭ রান করেছেন, তার স্ট্রাইক রেট ৮৪.৭৯। ২৩ বছর বয়সী মোসাদ্দেকের বাড়তি গুণ, তিনি কার্যকর অফস্পিনটাও করতে পারেন। ২০১৭ সালে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে তিনশ’ রানের পথে থাকা নিউ জিল্যান্ডকে আটকে দিয়েছিল এই তরুণের ঘূর্ণি জাদু। ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি দ্রুত তিন উইকেট নিয়ে। মোসাদ্দেক ক্যারিয়ার জুড়ে ৬, ৭, ৮ নম্বরেই খেলেছেন। ওয়ানডেতে তার ব্যাটিং গড়, স্ট্রাইক রেট এসব পজিশনেই। একটি ম্যাচ তিনি চারে খেলেছিলেন। এখানে তার দুটি হাফ সেঞ্চুরিই দেশের বাইরে।
অন্যদিকে সাব্বিরকে নিয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে। শুরুর দিকে ৫ থেকে ৮ নম্বরে খেলেছেন, পরে চন্ডিকা হাথুরুসিংহে তাকে সুযোগ দিয়েছিলেন ৩ নম্বরে। কিন্তু সেখানে তিনি থিতু হতে পারেননি। এখন আবার ৬-৭ নম্বরই হয়ে যাচ্ছে তার গন্তব্য।
তার পাঁচ হাফসেঞ্চুরির একটা আটে, একটা ছয়ে, তিনটা তিনে ব্যাট করে। একমাত্র সেঞ্চুরি ছয়ে ব্যাটিংয়ে নেমে। সাত নম্বরে সাব্বিরের সর্বোচ্চ ইনিংস অপরাজিত ৪৪ রান, যা করেছিলেন নিজের ওয়ানডে অভিষেকে জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে, ২০১৪ সালে চট্টগ্রামের সাগরিকা স্টেডিয়ামে।
মোসাদ্দেকের প্রেরণা ফাইনালের বিস্ফোরক ব্যাটিং
বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের প্রথম প্রস্তুতি ম্যাচটা বৃষ্টিতে ভেসে গিয়েছিল। যে ম্যাচে অনেক সিনিয়র ক্রিকেটারের বিশ্রামে থাকার কথা ছিল। যেখানে সাব্বির, মোসাদ্দেকরা নিজেদের মেলে ধরার বড় সুযোগ পেতেন।
ব্যাটিং অর্ডারের সাত নম্বর পজিশন নিয়ে সাব্বিরের সঙ্গে একটা অলিখিত দ্বৈরথ তৈরি হয়েছে, এটা বুঝতে বাকি নেই মোসাদ্দেকেরও। তবে সাব্বিরের সঙ্গে ঠিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ভাবতে চান না এই তরুণ ক্রিকেটার। সুযোগ পেলে নিজের সর্বোচ্চ করবেন তিনি।
মোসাদ্দেক বলেছেন,
‘আমি আমার সর্বোচ্চটা চেষ্টা করব। কেউ খারাপ করলে আমি যাব, এভাবে ভাবতে চাই না। চাই বাংলাদেশ দল ভালো করুক। যদি আমার সুযোগ আসে, আমি চেষ্টা করব।’
বিশ্বকাপ রাঙানোর স্বপ্নে মোসাদ্দেককে আত্মবিশ্বাস যোগাচ্ছে ডাবলিনে ফাইনালের সেই ইনিংস। গত ২৬ মে কার্ডিফে তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন,
‘শেষ ম্যাচে যেভাবে ব্যাটিং করেছি, চাইব সেভাবেই ব্যাটিং করতে। দলকে যতটুকু সমর্থন দেওয়া যায় ঠিক ততটুকু। পরের ম্যাচে চেষ্টা করব নিজেদের সেরাটা দেওয়ার। আর বিশ্বকাপের পুরোপুরি প্রস্তুতি নেওয়ার।’
মনে করি এটাই আমার শেষ ম্যাচ: সাব্বির
বিশ্বকাপ দলে মোসাদ্দেকের উপস্থিতি কিছুটা হলেও চাপ বাড়াচ্ছে সাব্বিরের উপর। যেমনটা ক্যারিয়ারের শুরুতে তার দলে থাকাটা চাপ ফেলতো নাসির হোসেনের উপর। পুরো বিষয়টা সাব্বির দেখছেন ভিন্ন দৃষ্টিতে। প্রতি ম্যাচে নিজেকে উদ্দীপ্ত করতে নতুন মন্ত্র রয়েছে তার। এই তরুণ ক্রিকেটার বলেছেন, প্রতিটি ম্যাচই নিজের শেষ ম্যাচ ধরেই খেলতে নামেন তিনি।
কার্ডিফে গত ২৬ মে সাব্বির বলেছেন,
‘আমি সবসময় মনে করি, এটাই আমার শেষ ম্যাচ। এই ম্যাচ থেকেই পরের ম্যাচের জন্য জায়গা করে নিতে হবে। পরের ম্যাচ দিয়ে এর পরের ম্যাচে। তাই এখানেই সব কিছু দেয়ার চেষ্টা করি, এবং চ্যালেঞ্জ নিই ভালো কিছু করে যেন পরের ম্যাচে আসতে পারি।’
আর জাতীয় দলে বিভিন্ন পজিশন নিয়ে প্রতিযোগিতা উপভোগ করেন সাব্বির। কারণ আগেও এসব চ্যালেঞ্জ নেয়ার অভিজ্ঞতার তার ঝুলিতে আছে। ২৭ বছর বয়সী এই ক্রিকেটার বলেছেন,
‘সবসময় কঠিন প্রতিযোগিতায় আমি খেলে এসেছি, চ্যালেঞ্জ নিয়ে খেলেছি। এবারও আমার জন্য সহজ হবে না। চেষ্টা করব শতভাগ দেয়ার এবং সেরা ক্রিকেটটা দেয়ার। আমি যে ইনিংসগুলো খেলেছি দেশের বাইরে, সেগুলোর ভিডিও দেখি সবসময়। নিউ জিল্যান্ডে খেলা শেষ সিরিজটা আমাকে অনেক অনুপ্রাণিত করেছে, এবং আত্মবিশ্বাসও বাড়িয়েছে। ইনশাআল্লাহ চেষ্টা করব এই আত্মবিশ্বাস ধরে রাখতে।’
সাত নম্বরে ব্যাটিংয়ে গুরুভার পালনের রঙ্গমঞ্চে সাব্বির একাই ছিলেন। মোসাদ্দেক এসে ওই মঞ্চে নিজের আলো ফেলেছেন। তারা দু’জনই তরুণ। আর এই পজিশনে সাহস, আত্মবিশ্বাস, তারুণ্যের অদম্য স্পিরিটই দরকার বাংলাদেশের। দলের চাহিদা মেটাতে পারবেন দুজনই। বোলিংটা বেশি কার্যকর বলে এখন সামগ্রিক আবহ সাব্বিরের চেয়ে মোসাদ্দেকের সম্ভাবনার পালেই বেশি হাওয়া যোগাচ্ছে।