বড় ধরণের কোন টুর্নামেন্টে ফেদেরার এবং নাদাল জুটি বেঁধে সমান তালে লড়ে যাচ্ছেন একই টেনিস সেটে, বিশ্বের অন্য দুই সেরা তারকার বিপক্ষে! কথাটা ভাবতেই যেন এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি হয়। সেই স্বপ্ন সত্যি করতেই বোধহয় ২০১৭ সালের ২২ সেপ্টেম্বের টেনিস দুনিয়ায় শুরু হচ্ছে ‘লেভার কাপ’ টুর্নামেন্ট। আসুন বিস্তারিত জানা যাক এই লেভার কাপ সম্পর্কে।
লেভার কাপ কী?
যুক্তরাষ্ট্র আর ইউরোপের সেরা গলফ খেলোয়াড়দের অংশগ্রহণে দুই বছর পরপর আয়োজন করা হয় রাইডার্স কাপ টুর্নামেন্টের। গলফের এই রাইডার্স কাপের আদলেই এবার টেনিসের জগতে শুরু হচ্ছে নতুন এক টুর্নামেন্ট, নাম ‘লেভার কাপ’। তবে এই প্রতিযোগিতাটি শুধুমাত্র ইউরোপ আর যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। এই টুর্নামেন্টটি অনুষ্ঠিত হবে ইউরোপ বনাম বিশ্বের অন্যান্য দেশের টেনিস খেলোয়াড়দের মধ্যে এবং কিংবদন্তী টেনিস তারকা রড লেভারের প্রতি সম্মান রেখে এর নামকরণ করা হয়েছে ‘লেভার কাপ’।
এর নেপথ্যে আছেন কারা?
প্রস্তাবটি এসেছে মূলত সুইস টেনিস তারকা ফেদেরার এবং তার ব্যবস্থাপনা দলের কাছ থেকে। বিংশ শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ টেনিস তারকা অস্ট্রেলিয়ার কিংবদন্তী রড লেভারের সম্মানে রজার ফেদেরার, প্রভাবশালী সুইস ও ব্রাজিলীয় ধনকুবের জর্জ পাওলো লিমান এবং টেনিস অস্ট্রেলিয়া একত্রিত হয়ে এই টুর্নামেন্টটি আয়োজন করছে।
কবে এবং কোথায় শুরু হচ্ছে?
এবারের টুর্নামেন্টটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে চেক রিপাবলিকের বৃহত্তম শহর প্রাগের ও টু টেনিস অ্যারেনায়। টুর্নামেন্টটি শুরু হবে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ২২ এবং চলবে ২৩ ও ২৪ তারিখ পর্যন্ত। প্রথম দুই দিন, বাংলাদেশ সময় বিকাল পাঁচটায় শুরু হবে প্রথম সেশন, রাত ১১টায় শুরু হবে দ্বিতীয় সেশন এবং তৃতীয় দিন একটি সেশনে খেলা শুরু হবে বাংলাদেশ সময় বিকেল ৪টায়।
দিনের প্রথম সেশনে শুরু হবে দুটি একক ম্যাচ, যাতে অংশগ্রহণ করবেন চারজন ভিন্ন খেলোয়াড়। পরে রাতের সেশনে একটি একক এবং একটি দ্বৈত ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে। প্রথম দুই দিন অর্থাৎ ২২ ও ২৩ সেপ্টেম্বর খেলা অনুষ্ঠিত হবে এই নিয়ম অনুযায়ী এবং চূড়ান্ত দিন একই সাথে শুরু হবে তিনটি একক ম্যাচ ও একটি দ্বৈত ম্যাচ।
কে খেলছেন কোন দলে?
প্রত্যেক দলে আছেন ছয়জন করে টেনিস তারকা। দলের প্রথম চারজনকে নির্বাচন করা হবে এ.টি.পি বিশ্ব র্যাংকিং অনুসারে এবং বাকি দুজনকে নির্বাচন করবেন দলের অধিনায়ক।
টুর্নামেন্টে ইউরোপীয় খেলোয়াড়দের নেতৃত্ব দিচ্ছেন একসময়কার বিশ্বসেরা সুইডিশ টেনিস তারকা বিয়ন বর্গ এবং তার অধীনে খেলছেন ছয়জন ইউরোপিয়ান টেনিস খেলোয়াড়।
ইউরোপীয় দল
- রজার ফেদেরার (সুইজারল্যান্ড)
- রাফায়েল নাদাল (স্পেন)
- মারিন সিলিক (ক্রোয়েশিয়া)
- ডমিনিক টিম (অস্ট্রিয়া)
- আলেকজান্ডার জভেরভ (জার্মানি)
- টমাস বার্ডিচ (চেক প্রজাতন্ত্র)
আরেকদিকে আছেন বর্গেরই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মার্কিন টেনিস তারকা জন ম্যাকেনরো। তিনি নেতৃত্ব থাকছেন বিশ্বের অন্যান্য দেশের মোট ছয়জন টেনিস তারকার।
বিশ্ব দল
- জ্যাক সক (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র)
- স্যাম কোয়েরি (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র)
- জন ইজনার (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র)
- নিক কিরিওস (অস্ট্রেলিয়া)
- ফ্রান্সিস টিয়াফো (অস্ট্রেলিয়া)
- ডেনিস শাপোভালোভ (কানাডা)
ফ্রান্সিস টিয়াফোর জায়গায় প্রথমে খেলার কথা ছিল হুয়ান মার্টিন দেল পোত্রোর। কিন্তু ইনজুরির কারণে তিনি খেলতে পারবেন না বলে তার পরিবর্তে দলে জায়গা পেয়েছেন টিয়াফো।
টুর্নামেন্টের নিয়মাবলী
লেভার কাপ তিন দিন ধরে পাঁচটি সেশনে অনুষ্ঠিত হবে। প্রথম দু’দিন দুই সেশনে মোট চারটি খেলা অনুষ্ঠিত হবে এবং তৃতীয় দিন একই সেশনে শুরু হবে প্রয়োজন অনুযায়ী চারটি কিংবা তারও বেশি ম্যাচ। খেলা শুরুর আগের দিন দলের অধিনায়কগণ তাদের লাইনআপ কার্ড রেফারির কাছে জমা দেবেন এবং কোর্টে আনুষ্ঠানিকভাবে ম্যাচগুলো ঘোষণা করা হবে।
প্রত্যেক খেলোয়াড় প্রথম দু’দিনের মধ্যে কমপক্ষে একটি একক ম্যাচ খেলবেন এবং কোনো খেলোয়াড়ই তিন দিনের মধ্যে দুটির চেয়ে বেশি ম্যাচ খেলবেন না। ছয়জন খেলোয়াড়ের মধ্যে অন্তত চারজনকে দ্বৈত ম্যাচে অংশগ্রহণ করতে হবে এবং একই জুটি একটি ম্যাচের বেশি খেলতে পারবেন না। তবে তৃতীয় দিন যদি দুই দলেরই পয়েন্ট ১২-১২ হয়, নির্ধারণী ম্যাচের জন্য সেই জুটি আবারও খেলতে পারবেন।
একক ও দ্বৈত উভয় ক্ষেত্রেই ম্যাচ জিততে হলে প্রথম দুই সেট জিততে হবে। তবে খেলায় ১-১ সেটের সমতা থাকলে, সেক্ষেত্রে তৃতীয় সেটটি ১০ পয়েন্টের টাইব্রেকারের মাধ্যমে নির্ধারিত হবে। প্রথম দিন প্রত্যেকটি ম্যাচের জয়ী দলের জন্যে ১ পয়েন্ট করে বরাদ্দ থাকবে, দ্বিতীয় দিন সেটা বেড়ে হবে ২ এবং তৃতীয় দিন ম্যাচ জিতলে জয়ী দল তিন পয়েন্ট করে পাবে। যে দল আগে ১৩ পয়েন্ট অর্জন করবে তাদেরকে জয়ী বলে ঘোষণা করা হবে। তবে যদি পয়েন্ট তালিকায় দু’দলেরই সমান সমান অর্থাৎ ১২-১২ করে সমতা থাকে তাহলে একটি দ্বৈত ম্যাচের মাধ্যমের জয়ী দল নির্ধারণ করা হবে।
কারা এই টুর্নামেন্টের ফেভারিট এবং কেন?
এই টুর্নামেন্টের ফেভারিট হিসেবে ধরা হচ্ছে ইউরোপের দলটিকেই। প্রথমত, টেনিসে ইউরোপ মহাদেশ সবচেয়ে শক্তিশালী, তার উপর ইউরোপের দলে খেলছেন বর্তমানে টেনিসের দুই শীর্ষ খেলোয়াড়ে রজার ফেদেরার ও রাফায়েল নাদাল। তাছাড়া এই দলটির খেলোয়াড়রা সর্বমোট ৩৬টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম শিরোপা জিতেছেন, অন্যদিকে বিপক্ষ দলের কেউই এখনও কোনো গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিততে পারেননি।
তবে বিপক্ষ দলটিকে ছোট করে দেখার কোনো কারণ নেই। টুর্নামেন্টের ফেভারিট না হওয়ার কারণে তাদের উপর কোনো মানসিক চাপ থাকছে না। অন্যদিকে বিশ্বের শীর্ষ দশজন খেলোয়াড় মধ্য থেকে গড়ে তোলা ইউরোপের দলটির উপর থাকবে প্রচণ্ড মানসিক চাপ।
লেভার কাপ সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য
এই খেলায় হারজিতের ফলে খেলোয়াড়দের বর্তমান র্যাংকিংয়ের কোনো পরিবর্তন আসবে না। তবে খেলায় অংশগ্রহণ করার জন্যে প্রত্যেক খেলোয়াড়েরকে আলাদা আলাদা পারিশ্রমিক দেওয়া হবে, যদিও এর সঠিক পরিমাণ এখনও জানা যায়নি।
প্রত্যেক বছর একবার করে এই টুর্নামেন্টটি আয়োজন করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। বর্গ এবং ম্যাকেনরো আগামী তিন বছর দুই দলের অধিনায়কত্ব করার জন্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন। টুর্নামেন্টটি পালা করে সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রধান শহরগুলোতে অনুষ্টিত হবে। শুধুমাত্র অলিম্পিকের সময় ছাড়া প্রতি বছর ইউএস ওপেনের ঠিক দু’সপ্তাহ পর এই টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হবে।
টেনিস বিশ্বে কতটুকু প্রভাব ফেলবে লেভার কাপ?
আসলে এই টুর্নামেন্টটি টেনিস জগতে কতটুকু প্রভাব ফেলবে, সেটা নির্ভর করবে এতে অংশগ্রহণকারী খেলোয়াড়দের উপরেই। খেলার মাঠে লোক দেখানো আবেগ কিংবা নকল উত্তেজনা সৃষ্টি করা অসম্ভব ব্যাপার। খেলোয়াড়রা যদি নিজেদের সেরাটা দেন, তাহলে অবশ্যই এই টুর্নামেন্ট দর্শকদের মধ্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করতে পারবে।
তবে অনেকেই লেভার কাপকে তুলনা করছেন প্রদর্শনী ম্যাচগুলোর সাথে। এই কারণে ফেদেরার কিছুটা ক্ষুব্ধ হয়েই বলেছেন,
“এটা প্রদর্শনী নয়। অনেকেই এই শব্দটা ব্যবহার করছেন, কিন্তু ব্যাপারটা আমার মোটেই পছন্দ হচ্ছে না। কিংবদন্তি রড লেভারকে সম্মানের উদ্দেশ্যেই আমরা কোর্টে নামবো। বোর্গ অবশ্যই জিততে চান এবং আমি জানি যে, ম্যাকেনরোও নিশ্চয় হারতে চান না।”
টেনিসপ্রেমীদের অবশ্য শুভ কামনা থাকবে দু’দলেরই প্রতি, এই টুর্নামেন্টের খেলোয়াড়রা সময়কে অতিক্রম করেই যে হয়েছেন কিংবদন্তী। ভাগ্য ভালো থাকলে এবারে টেনিসের দুই মহারথীকে দ্বৈত ম্যাচে হয়তো দেখা যাবে একই কোর্টে, একই জুটিতে।