নিজের সামর্থ্যের সর্বোচ্চ প্রয়োগ করেও যদি সফলতা পাওয়া না যায়, তাহলে সেটা মেনে নেওয়া খুব কঠিন। এখন প্রশ্ন আসতে পারে, ‘সফলতা’ বিষয়টাকে কীভাবে ব্যখ্যা করা যায়?
দলীয় কোনো খেলাধুলায় দলগত সফলতাটাই মুখ্য। এখানে দলের প্রতিটা খেলোয়াড়েরই লক্ষ্য থাকে দলের সর্বোচ্চ সাফল্য নিশ্চিত করা। তাতে করে কোনো খেলোয়াড়কে যদি ব্যক্তিগতভাবে কিছুটা ছাড়ও দিতে হয়ে, তাহলেও দলীয় স্বার্থে সেটা মেনে নিতে হয়। তবে দলীয় সফলতা আবার দলের খেলোয়াড়দের ব্যক্তিগত সাফল্যেরই সমষ্টি। কাজেই একজন খেলোয়াড় যখন ব্যক্তিগতভাবে সফল হবেন, তখন দলের সাফল্য পাওয়ার সম্ভাবনা স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে যাবে।
ক্রিকেটে একজন ব্যাটসম্যানের মূল কাজ হচ্ছে রান করা। সেই হিসেবে একজন ব্যাটসম্যান যখন কোনো ম্যাচে সেঞ্চুরি করেন, তখন তাকে ব্যক্তিগতভাবে সফল বলাই চলে। সেঞ্চুরি করার পরও পরাজিত দলে থাকার দু’টো কারণ থাকতে পারে: দলের বোলারদের ব্যর্থতা, কিংবা প্রতিপক্ষ দলের ব্যাটসম্যানদের অসাধারণ ব্যাটিং পারফরম্যান্স।
বিশ্বকাপ ক্রিকেটে এই পর্যন্ত সেঞ্চুরি হয়েছে ১০৩টি, এর মধ্যে ফাইনাল ম্যাচে সেঞ্চুরি হয়েছে ৭টি। তবে ফাইনালে সেঞ্চুরি করে পরাজয়ের স্বাদ বরণ করতে হয়েছে কেবল একজন ব্যাটসম্যানকে। ১০৩টি সেঞ্চুরির বিপরীতে বোলারদের ইনিংসে ৫+ উইকেট পাওয়ার সংখ্যা মাত্র ৫৪টি, এই তথ্যের মাধ্যমেই বুঝতে পারা যায় যে, ক্রিকেটে বোলারদের তুলনায় ব্যাটসম্যানরা একটু বাড়তি সুবিধাই পায়। বিষয়টা আসলে অস্বাভাবিকও নয়, একজন ওপেনার ব্যাটসম্যানের পক্ষে সম্ভব শুরু থেকে পুরো ৫০ ওভার টিকে থেকে ১৫০+ বল খেলা। কিন্তু একজন বোলার চাইলেও ৫০ ওভারের একটা ম্যাচে ৬০টির বেশি বল করতে পারেন না। সেই হিসেবে ইনিংসে ৫+ উইকেট পাওয়াটা একজন বোলারের জন্য খুবই কঠিন।
তবে এর চাইতেও কঠিন বিষয় হচ্ছে, ৫+ উইকেট পাওয়ার পরও দলের অন্যান্য খেলোয়াড়দের ব্যর্থতায় দলীয়ভাবে হেরে যাওয়া। আর সেই হারটা যদি হয় বিশ্বকাপ ফাইনালের মঞ্চে, তাহলে তার কষ্টটা কতটা তীব্র, সেটা হয়তো ভুক্তভোগী ব্যতীত আর কারো পক্ষে বুঝতে পারা সম্ভব নয়। বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ১১টি আসরে এই পর্যন্ত ফাইনাল ম্যাচে ৫+ উইকেট পেয়েছেন মাত্র ২ জন বোলার। এর মাঝেও পরাজিত হয়েছিলেন একজন বোলার।
আজ আমরা সেই দুর্ভাগা দুইজন খেলোয়াড়ের গল্পটাই শুনবো।
মাহেলা জয়াবর্ধনে
মাহেলা জয়াবর্ধনের বিশ্বকাপ আসরের পারফরম্যান্সটা আসলে অম্লমধুর। ১৯৯৯ সালে প্রথম বিশ্বকাপের সময় তার বয়স ছিল মাত্র ২২। সেই বিশ্বকাপে সনাৎ জয়াসুরিয়া, মারাভান আতাপাত্তু, রোশান মহানামা, অরবিন্দ ডি সিলভা, অর্জুনা রানাতুঙ্গাদের মতো গ্রেট এবং অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যানদের ভিড়ে ব্যাটিং করতে হয়েছিল কিছুটা নিচের দিকে। দলীয়ভাবেই শ্রীলংকার সেই বিশ্বকাপটা খুবই বাজে হয়েছিল। মাহেলা ৪টি ম্যাচে মাত্র ১০২ রান সংগ্রহ করেন। ২০০৩ বিশ্বকাপে মাহেলার পারফরম্যান্স ছিল এক কথায় জঘন্য। ৭ ইনিংসে করতে পারেন মাত্র ২১ রান, সর্বোচ্চ স্কোর ছিল মাত্র ৯। ২০০৭ বিশ্বকাপটা অবশ্য মাহেলার দুর্দান্ত কাটে। টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান (৫৪৮) সংগ্রাহক হন তিনি। ২০১১ বিশ্বকাপে মাহেলা মোটামুটি ভালো ফর্মেই ছিলেন। তবে সবকিছু ছাপিয়ে যান ফাইনাল ম্যাচে।
ফাইনাল ম্যাচটা যেন ভারতের জন্য মঞ্চ সাজানো ছিল। নিজ দেশের মাটিতে ফাইনালে ভারত হাতছাড়া করতে চাইবে না, সেটা সবাই জানতো। তবে টস জিতে ব্যাটিং করতে নামা শ্রীলঙ্কার ব্যাটসম্যানরা ঠিক স্বস্তিতে ব্যাট করতে পারছিলেন না। ইনিংসের ৭ম ওভারে দলীয় ১৭ রানের মাথায় উপুল থারাঙ্গা ব্যক্তিগত ২ রানে আউট হন। দিলশান এবং সাঙ্গাকারা সতর্কতার সাথে খেলে ৪৩ রানের একটা ছোট জুটি গড়েন। এরপর দিলশান আউট হলে মাঠে নামেন মাহেলা।
সাঙ্গাকারা কিছুটা স্থবির হলেও অন্য প্রান্তে মাহেলা ছিলেন সাবলীল। ২৮তম ওভারে সাঙ্গাকারাও আউট হয়ে গেলে চাপটা মাহেলার উপরেই এসে পড়ে। তখন উইকেট ধরে রাখার পাশাপাশি রানের চাকাটা সচল রাখার দায়িত্বটাও চলে আসে অভিজ্ঞ মাহেলার উপরেই। মাত্র ৪৯ বলে ব্যক্তিগত অর্ধশত রান পূর্ণ করে দলের চাহিদাটা বেশ ভালোভাবেই মেটাচ্ছিলেন তিনি। পরের অর্ধশত করতে বল খরচ করেন মাত্র ৩৫টি বল। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, মাহেলা উইকেটে থাকার কারণেই লোয়ার অর্ডারে কুলাসেকারা এবং পেরেরা নিশ্চিন্তে ব্যাট করতে পারছিলেন। শেষ পর্যন্ত মাহেলার অপরাজিত ১০৩ রানের সুবাদে ২৭৪ রানের একটা শক্ত স্কোর দাঁড় করায় শ্রীলঙ্কা।
আগের ৯টি আসরের মাঝে ৭টিতেই জিতেছে প্রথমে ব্যাট করা দল, এর মাঝে ফাইনালের ৫ জন সেঞ্চুরি করা ব্যাটসম্যানের প্রতিজনই ছিলেন জয়ী দলে। প্রথম ইনিংসের পর পাল্লাটা তাই কিছুটা হলেও শ্রীলংকার দিকেই হেলে ছিল। দলীয় শূন্য রানে শেবাগ এবং ৩১ রানে শচীনকে আউট করে মালিঙ্গা আরেকটু এগিয়ে দিয়েছিলেন শ্রীলঙ্কাকে। কিন্তু গৌতম গম্ভীরের সতর্ক ৯৭ এবং অধিনায়ক ধোনীর বুদ্ধিদীপ্ত অপরাজিত ৯১ রানের সুবাধে জয় নিয়েই মাঠ ছাড়ে ভারত। একই সাথে জয়াবর্ধনে হয়ে যান বিশ্বকাপ ফাইনালে সেঞ্চুরি করেও পরাজিত দলে থাকা একমাত্র ব্যাটসম্যান।
গ্যারি গিলমোর
গিলমোরও হতে পারতেন ইতিহাসের স্মরণীয় নায়কদের একজন। সেটার প্রতিফলন দেখিয়েছিলেন সেমিফাইনাল থেকেই। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেমিতে গিলমোরের অবিশ্বাস্য বোলিংয়ে মাত্র ৯৩ রানেই অলআউট হয়ে যায় ইংল্যান্ড। ১২ ওভারে মাত্র ১৪ রান দিয়ে ৬টি উইকেট নেন গিলমোর, যার মাঝে ইংল্যান্ডের প্রথম ৫ জন ব্যাটসম্যানের হন্তারকই ছিলেন তিনি। এছাড়া একদিনের ক্রিকেটে সেটাই ছিল প্রথম কোনো বোলারের ইনিংসে ৬ উইকেট পাওয়ার প্রথম ঘটনা। ৬০ ওভারে ৯৪ রানের টার্গেট খুব সহজ হলেও ইংলিশ বোলাররা মাত্র ৩৯ রানেই ৬ জন অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যানকে আউট করে ম্যাচটা জমিয়ে তোলেন। কিন্তু ৮ নম্বরে নেমে গিলমোর ২৮ বলে ৫টি বাউন্ডারির সাহায্যে অপরাজিত ২৮ রান করে অস্ট্রেলিয়াকে ফাইনালে তোলার পেছনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
ফাইনালে অস্ট্রেলিয়া টস জিতে ফিল্ডিং করার সিদ্ধান্ত নেয়। মাত্র ৫০ রানেই প্রথম ৩ উইকেট পড়ার পর ধারণা করা হচ্ছিল যে, ইয়ান চ্যাপেলের সিদ্ধান্তটা সঠিকই ছিল। কিন্তু এরপরই রোহান কানহাইকে নিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ অধিনায়ক ক্লাইভ লয়েড গড়ে তোলেন ১৪৯ রানের একটা সময়োপযোগী জুটি। লয়েড মাত্র ৮২ বলে সেঞ্চুরি করেন।
অবশ্য লয়েডের ইনিংসটাতে কিছুটা ভাগ্যের ছোঁয়া ছিল, ২৬ রানেই ক্যাচ হওয়া থেকে বেঁচে যান তিনি। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ২৯১ রানের স্কোর গড়লেও গিলমোর এই ইনিংসে ৫ উইকেট পান। ১২ ওভারে এই উইকেট পেতে তাকে খরচ করতে হয় ৪৮টি রান। অস্ট্রেলিয়ানদের জবাবটাও ভালোই হচ্ছিল। কিন্তু ভিভ রিচার্ডসের তিনটি রানআউটে ম্যাচ থেকে ছিটকে যায় অস্ট্রেলিয়ানরা। গিলমোর এই ম্যাচেও ৮ নম্বরে নেমে কিছুটা চেষ্টা করেছিলেন। তবে তার ১১ বলে ১৪ রানের ইনিংস দলের পরাজয়কে আটকাতে পারেনি। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ১৭ রানের জয় পেয়ে প্রথমবারের মতো বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়।
গিলমোর টুর্নামেন্টে মাত্র ২টি ম্যাচ খেলেই সর্বোচ্চ উইকেট (১১টি) শিকারী হন। সেরা গড় (৫.৬৪) এবং সেরা স্ট্রাইকরেটও (১৩.০৯) গিলমোরের। তবে একটা বিশ্বকাপ জয়ের কাছে এসব ব্যক্তিগত অর্জন সবসময়ই মূল্যহীন। নিজে এরকম বোলিং করেও শিরোপা জয় করতে না পারার আক্ষেপ গিলমোরের পর আর কোনো বোলারের এখন পর্যন্ত হয়নি।