১৭ মার্চ, ১৯৯৬। লাহোরের ফাইনাল ম্যাচটি অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে। ইনিংসের তখন ৪৬.১ ওভার। রানাতুঙ্গার লেইট কাট শট থেকে বলটা বাউন্ডারির দিকে ছুটে যাচ্ছে, ছুটে যাচ্ছে নতুন দিনের জয়গান গাইতে গাইতে। ক্রিকেট বিপ্লবের সংজ্ঞাটা নতুন করে শিখিয়ে দেয়া সেই বিশ্বকাপের শেষ বাউন্ডারি হিসেবে বলটা যখন সীমানা দড়ি অতিক্রম করলো, আধুনিক ক্রিকেটে পদার্পণের ঠিক আগ মুহূর্তে সবগুলো দলও সেরে ফেললো নিজেদের পোশাকি মহড়া।
শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটের উত্থানের গল্পটি যদি শুরু হয় ১৯৯৬ বিশ্বকাপ থেকেই, আরো নির্দিষ্ট করে বললে ওই ফাইনাল ম্যাচটি থেকেই, বাংলাদেশের জন্য ২০১৫ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটি সেই জায়গাটি দখল করে আছে। রুবেলের হাত থেকে বের হওয়া এখন পর্যন্ত এদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত দুইটি বলই ম্যাচের ইতি টানলেও জয়ের সূতিকাগার কিন্তু গড়ে উঠেছিল মূলত বাটিংয়ের সময় মুশফিক-মাহমুদউল্লাহর ১৪১ রানের পার্টনারশিপে।
হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগিয়ে যাওয়া এদেশের ক্রিকেট গত ২০ বছরে খুব কমই সুযোগ পেয়েছে নিজেকে মেলে ধরার, গর্বের স্থানে নিয়ে যাওয়ার। যে কয়বার সেটা সম্ভব হয়েছে, সেগুলোর পিছনের গল্পটা জুড়ে ছিল হয়তো ম্যাচ ঘুরিয়ে দেয়া দুর্দান্ত কোনো স্পেল কিংবা মহাকাব্যিক কোনো পার্টনারশিপ। আজকের লেখাটি মূলত ইতিহাসের দ্বার উন্মোচন করে দেয়া আমাদের সেই কালজয়ী পার্টনারশিপগুলো নিয়ে। দুই পর্বের এই আয়োজনে আজ প্রথম পর্ব।
১. অ্যাডিলেড, ২০১৫
ক্রিকেট ইতিহাসের ভয়ঙ্করতম পেস জুটির একটি অ্যান্ডারসন-ব্রড জুটি। ২০১৫ সালের ৯ মার্চ। অ্যাডিলেডে সেদিন হারলেই বাদ, এমন সমীকরণের সামনে দাঁড়িয়ে সেই পেস জুটি দেখিয়ে যাচ্ছিল নিজেদের ক্ষমতার ভয়ঙ্করতম প্রদর্শনী। ধারাবাহিকভাবে খারাপ করতে থাকা বাংলাদেশের ওপেনাররা ওই ম্যাচেও দ্রুত বিদায় নিলেন, দ্রুত বলতে একটু দ্রুতই। ৮ রানেই দুই উইকেট নেই।
দৃশ্যপটে এলেন সৌম্য-মাহমুদউল্লাহ। সেট হয়ে উইকেট বিলিয়ে দিয়ে আসাটাকে সেবারের বিশ্বকাপে রীতিমতো অভ্যাসে পরিণত করা সৌম্য এদিনও তার ব্যতিক্রম ঘটাননি। তার আর মাহমুদউল্লাহর ৮৬ রানের পার্টনারশিপে স্বপ্ন দেখতে শুরু করা বাংলাদেশ আবারও ব্যাকফুটে চলে গেল। প্রত্যাবর্তনের গল্পটা এখান থেকে শুরু হলেও সেটিকে কালজয়ীই বলা হতো, কিন্তু বিপদের ষোলোকলা পূর্ণ করে সাকিবও যে পরের ওভারে বিদায় নিলেন!
অ্যাডিলেডের গুটিকয়েক বাংলাদেশী সমর্থক আর সাড়ে চার হাজার মাইল দূর থেকে টিভির স্ক্রিনে চোখ রাখা এদেশের ১৬ কোটি জনতা সেই মুহূর্তে স্কোরকার্ডের দিকে তাকিয়ে ঘোর অমানিশা ছাড়া যে কিছু দেখতে পাচ্ছিলেন না, সেটা হলফ করেই বলা যায়। কিন্তু হতাশায় গ্যালারি ছেড়ে চলে না গিয়ে বা টিভি বন্ধ করে না দিয়ে যারা খেলা দেখা চালিয়ে গেছেন, পরের ১০০ মিনিট তারা এমন কিছুর সাক্ষী হয়েছিলেন, দেশীয় ক্রিকেটকে ক্রিকেটাররা যত উপহার দিয়েছেন তার মধ্যে সর্বকালের সেরার তালিকায় উপরের দিকেই থাকবে সেটি।
সেই বিশ্বকাপে কোচ হাথুরুসিংহের নেয়া যুগান্তকারী সিদ্ধান্তের একটি ছিল মাহমুদুল্লাহকে চারে নামিয়ে দেয়া। চাপের মধ্যে মাথা ঠাণ্ডা রেখে খেলার যে সহজাত প্রতিভা মাহমুদউল্লাহর মাঝে কোচ লক্ষ্য করেছিলেন, সেটির চূড়ান্ত প্রদর্শনী হয়ে গেল ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটিতে। অ্যান্ডারসন-ব্রড জুটিকে সামলানোই যারা ওই ম্যাচের শেষ কথা ভেবেছিলেন, বিভীষিকার ভয়াবহতা বাড়িয়ে দেয়ার জন্য তাদের চোখ রাঙাচ্ছিল অ্যাডিলেডের উইকেটের ভয়ংকর পেস আর বাউন্স। কিন্তু মাহমুদউল্লাহ সেদিন দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন, নিজের ব্যাটটাকে বর্ম বানিয়ে লড়ে যাওয়া মাহমুদউল্লাহ মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন বঙ্গবন্ধুর সেই অমর বক্তৃতার একটি লাইন,
“তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থেকো।”
ব্যাটসম্যানশিপ নিয়ে প্রশ্ন ওঠা মাহমুদউল্লাহ সেদিন সত্যিকার অর্থেই প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। নিজে যা জানতেন, তার উপরই ভরসা করে খেলেছিলেন এমন একটি ইনিংস, বাংলাদেশ ক্রিকেট যতদিন বেঁচে থাকবে, অন্তত সেই ইনিংসটির জন্য হলেও মানুষ মাহমুদউল্লাহকে মনে রাখবে। করলেন ১৩৮ বলে ১০৩ রান, এদেশের ক্রিকেট অভিষিক্ত হলো বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম সেঞ্চুরিতে।
আর অপর প্রান্ত কে সামলেছেন? বাংলাদেশ ক্রিকেটে চিরকালীন ভরসার প্রতীক হয়ে ওঠা মুশফিকুর রহিম। ‘মিস্টার ডিপেন্ডেবল’ তকমাটা যে শুধু তাকেই মানায়, মুশফিক সেদিন আবার সেটা প্রমাণ করলেন। শুরুতে মাহমুদউল্লাহর সামান্য শ্লথগতিতে রান করাটা যে পুরো ইনিংসে তেমন কোনো প্রভাব ফেলেনি, সেটা মুশফিকের জন্যই সম্ভব হয়েছিল। সবসময়ই দলের কথা চিন্তা করে ব্যাটিং করা মুশফিক এদিনও তার ব্যত্যয় ঘটাননি। বাংলাদেশ ক্রিকেটে তার ৭৭ বলে ৮৯ রানের ইনিংসটির মূল্য ঠিক ততটুকুই, যতটুকু মাহমুদউল্লাহর সেঞ্চুরির।
আজ প্রায় পাঁচ বছর হতে চললো বিখ্যাত সেই ম্যাচটির। এদেশের ক্রিকেট গত পাঁচ বছরে যে পরিমাণ এগিয়েছে, তার আগের ১৫ বছরেও সে পরিমাণ এগোয়নি। দিনবদলের সূচনা করে দেয়া সেই ম্যাচটি থেকে আত্মবিশ্বাস নামক যে জ্বালানী বাংলাদেশ ক্রিকেট দল সংগ্রহ করেছিল, আজ পর্যন্ত তার রেশ ধরে এগিয়ে যাচ্ছে এবং এগিয়ে যাবে ভবিষ্যতেও। আর স্মৃতির ভেলায় ভেসে কেউ যখন সে ম্যাচের স্কোরকার্ড দেখতে ক্রিকইনফোতে ঢুঁ মারবেন, জয়ের নিয়ামক হিসেবে রুবেলের বোলিং ফিগারের পাশে অমর হয়ে জ্বলজ্বল করবে মুশফিক-মাহমুদউল্লাহর সেই ১৪১ রানের পার্টনারশিপ।
২. কার্ডিফ, ২০১৭
কার্ডিফ + বাংলাদেশ = সুখস্মৃতি!
ঐতিহ্যগতভাবে যথেষ্টই সমুন্নত ওয়েলসের রাজধানী কার্ডিফ। একই সাথে শহরটি ধারণ করে আছে দ্য সেনেড, প্রিন্সিপালিটি স্টেডিয়াম, নরমান কীপ কিংবা ওয়েলস ন্যাশনাল ওয়ার মেমোরিয়ালের মতো দর্শনীয় স্থান। কিন্তু ১৪০ বর্গকিলোমিটারের ওই শহরটিকে এদেশের খুব কম মানুষই আছেন, যারা ওই দর্শনীয় স্থানগুলোর জন্য মনে রাখবেন। বেশিরভাগের মনেই কার্ডিফ এখনো জায়গা করে আছে ২০০৫ সালে মহাপরাক্রমশালী অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর সুখস্মৃতি নিয়ে। সুখস্মৃতির সলতেয় নতুন করে আগুন ধরিয়ে দিয়ে ২০১৭ সালে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে নিউ জিল্যান্ডের সাথে ম্যাচটি সেই সম্পর্ককে নিয়ে যায় নতুন উচ্চতায়। আর তাই তো ২০১৯ বিশ্বকাপে একই মাঠে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে হারটাকে একপাশে রেখে এদেশের আপামর ক্রিকেট রোম্যান্টিকদের মনে কার্ডিফ এখনো জায়গা করে আছে সুখস্মৃতির সমার্থক হিসেবে।
চ্যাম্পিয়নস ট্রফির উদ্দেশ্যে দেশ ছাড়ার আগে মাশরাফিকে একদিন বিপক্ষ দলগুলোর বোলিং সক্ষমতা নিয়ে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি আলাদাভাবে বোল্ট-সাউদির কথা বলেছিলেন। কার্ডিফ মহাকাব্যের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরুর আগেই শেষ হয়ে যাওয়ার যে উপক্রম হয়েছিল, সেটি এই দু’জনের কারণেই। একদিকে এই পেস জুটির ট্রেডমার্ক হয়ে যাওয়া বিধ্বংসী সুইং, অন্যদিকে তাদের দু’হাত ভরে দেয়ার জন্য তৈরি হয়ে থাকা কার্ডিফের উইকেট। সত্যিকারের ধ্বংসস্তূপ বলতে যা বোঝায়, এদিন সেটিরই মুখোমুখি হয়েছিল এদেশের ক্রিকেট দল। ৩৩ রানে ৪ উইকেট চলে যাওয়ার পর সব থেকে আত্মবিশ্বাসী লোকটিও হয়তো সুদূরতম কল্পনাতে চিন্তা করতে পারেননি বাংলাদেশ আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে ম্যাচটি জিততে পারে। কিন্তু এদিন রূপকথা রচনার জন্য দুইজন ত্রাতা পেয়েছিল এদেশের ক্রিকেট।
বলছিলাম কার্ডিফ মহাকাব্যের দ্বিতীয় অধ্যায়ের কথা। বাংলাদেশ ইনিংসের শুরুর দিকে ওই ভয়াবহতম বিভীষিকার অংশটা বাদ দিলে বাকি অংশটা সাক্ষ্য দিবে বীরত্বগাঁথার অমর এক দৃষ্টান্তের। স্বর্ণালী অক্ষরে লিখা থাকবে বুক চিতিয়ে লড়াই করে পাওয়া সাকিব-মাহমুদউল্লাহর পার্টনারশিপের অমূল্য ২২৪টি রান।
বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসের মহানায়ক বনে যাওয়া সাকিব সেদিন দেখিয়েছিলেন নিজের নামের মাহাত্ম্য। পাহাড়সম চাপ যে তার ব্যাট টাকে সবসময়ই হালকা করে দিয়েছে, এদিন সেটি আবারও প্রমাণ হলো। দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে গেলেন বোল্ট-সাউদিদের রুখতে। সুকান্তের ‘দুর্মর’ কবিতায় অমর হয়ে হওয়া সেই লাইনগুলো এদিন সাকিবের ইনিংসের প্রতিরূপ হয়ে দেখা দিয়েছিল,
“সাবাশ বাংলাদেশ, এই পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়,
জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার, তবু মাথা নোয়াবার নয়!”
বর্ণিল সেই ইনিংসের শুরুর দিকে সাকিব একটু ধরে খেলেছেন, উইকেটটাকে বোঝার চেষ্টা করেছেন, আর সেট হওয়ার পর ছড়ি ঘুরিয়েছেন বোলারদের উপর, নিশ্চিত করেছেন বাংলাদেশ ক্রিকেটে রূপকথাতুল্য একটি বিজয়। তাকে নিয়ে মাঠের বাইরে কিছু কানাঘুষো চলছিল, অনেকের চোখেই তিনি ফুরিয়ে আসছিলেন। এই কথাগুলো যে সাকিবের কানে যায়নি, বিষয়টা এমন নয়। প্রবল জেদকে মনের মধ্যে পুষে রেখে অবশেষে সেঞ্চুরি পূর্ণ করলেন সাকিব। কার্ডিফের কমেন্ট্রি বক্সে নাসের হোসাইনের কণ্ঠে তখন সাকিব স্তুতি,
“He is a superstar of Bangladesh cricket, and he played like a superstar today.”
সেঞ্চুরি করার পর সাকিবের ব্যাটিংয়ের ধরনকে অনেকেই তার বিরুদ্ধে ওঠা প্রশ্নের উত্তর হিসেবে ধরে নিতে পারেন। বোল্টের বিধ্বংসী সুইংকে থোড়াই তোয়াক্কা করে মারলেন দুই বলে দুই চার। আউট হওয়ার আগে আবারও মনে করিয়ে দিলেন, এই সাকিব সমালোচনার জবাব চিরকাল এভাবেই দিয়ে এসেছেন!
সাকিবের দ্বারা সেদিন মাইলফলক স্পর্শ করা সম্ভব হয়েছিল অপরপ্রান্তে ততদিনে বাংলাদেশ ক্রিকেটে ‘সাইলেন্ট কিলার’ খেতাব পেয়ে যাওয়া মাহমুদউল্লাহ ছিলেন বলে। বাংলাদেশ দলটাতে মাহমুদউল্লাহ এমনই এক চরিত্র, যার অবদান মানুষ মনে রাখে না, রাখতে পারে না। সেই ম্যাচেই আগ পর্যন্তও লম্বা সময় ধরেই মাহমুদউল্লাহর বড় কোনো ইনিংস ছিল না, অনেকে শেষও দেখতে পাচ্ছিলেন। জবাবটা মোক্ষম সময়েই দিলেন তিনি। কার্ডিফে সেদিন মহাবিপর্যয়ের সময়টাতেও ক্রমশই নিভে যাওয়া জয়ের প্রদীপটাতে নতুন করে আলো জ্বেলে দিতে হাজির হয়েছিলেন মাহমুদউল্লাহ। একপাশে রানের চাকাকে সচল রেখেছেন, রিকোয়ার্ড রানরেটকে কখনোই ধরাছোঁয়ার বাইরে যেতে দেননি, সাকিবকে সুযোগ করে দিয়েছেন নিজের সহজাত খেলাটি খেলার। সর্বোপরি, তার আর সাকিবের সেঞ্চুরিতে পুষ্ট হয়েই বাংলাদেশ দল পেলো ২২৪ রানের এক মহাকাব্য, যেটি রচনা করলো কার্ডিফের সুখস্মৃতির দ্বিতীয় অধ্যায়।
মাহমুদউল্লাহ অবশ্য বরাবরই ‘ক্রাইসিস ম্যান’ হিসেবে পরীক্ষিত। বিপক্ষ দলের বোলিং তাণ্ডবে যখন বাংলাদেশ শিবির ছত্রখান, ভরসার প্রতীক হয়ে তখনই অপর প্রান্তে ঠায় দাঁড়িয়ে যান মাহমুদউল্লাহ। বিপর্যয়ের মুখে মাহমুদউল্লাহর ব্যাটের দিকে তাকিয়ে দল, আর তিনি সকলকে আশাহত করে প্যাভিলিয়নের পথ ধরেছেন, এমন সময় খুব কমই এসেছে। আর এভাবেই জন্ম নেয় কার্ডিফের স্বর্ণালী বিকেল, নিদাহাস ট্রফির সেই রূপকথার রাত।
শ্রীলঙ্কার সাথে ম্যাচে নিজেদের ক্রমাগত ভুলেই যখন ম্যাচ হাত থেকে বের হয়ে যাওয়ার জোগাড়, ঠিক তখনই দৃশ্যপটে মাহমুদউল্লাহ। ২ বলে ৬ রান দরকার, এমন অবিশ্বাস্য সমীকরণের সামনে দাঁড়িয়ে এদেশের ১৬ কোটি জনতার সবাই যখন বাংলাদেশের হারটাই দিব্য চোখে দেখতে পাচ্ছিলো, বাহুজোড়ার শেষ শক্তিকে কাজে লাগিয়ে মাহমুদউল্লাহর ব্যাকওয়ার্ড স্কয়ার লেগের উপর দিয়ে মারা ছক্কাটা আবার করে মনে করিয়ে দিলো, এটা নতুন দিনের বাংলাদেশ, এটা মাহমুদউল্লাহদের হাতে গড়া বদলে যাওয়া বাংলাদেশ।
৩. খুলনা, ২০১৫
২০১৫ সালের পর থেকে এদেশের ক্রিকেটে যে অগ্রযাত্রা, সেটা শুধু ওয়ানডেতেই সীমাবদ্ধ থাকতো, যদি না খুলনার শেখ আবু নাসের স্টেডিয়ামে সেদিনের সেই উপাখ্যানের সৃষ্টি হতো।
২৮ মে, ২০১৫। পাকিস্তানের সাথে সেই টেস্ট ম্যাচটিতে প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশের যাচ্ছেতাই ব্যাটিংয়ের পর পাকিস্তানের গড়া রানপাহাড়। ২৯৬ রানের লিড ভেঙে বাংলাদেশ ম্যাচে ফিরে আসবে, এটা সেই সময় দূরবর্তী কষ্ট কল্পনা বললেও কম হতো বৈকি!
কিন্তু সেই কল্পনাকে বাস্তবের জমিনে নামিয়ে আনার দায়িত্ব নিলেন তামিম ইকবাল, আর অপর প্রান্ত থেকে তাকে যোগ্য সঙ্গ দিলেন একসময় জাতীয় দলে তার নিয়মিত ওপেনিং সঙ্গী ইমরুল কায়েস।
ক্যারিয়ারের একদম শুরুর দিকে তামিম ইকবাল ছিলেন ধ্বংসাত্মক ব্যাটিংয়ের অন্য নাম। বোলারদের উপর ছড়ি ঘুরাতে তিনি তখন ডাউন দ্য উইকেটে আসতেন, জহির খানদের লং অনের উপর দিয়ে সীমানাছাড়া করতেন, অ্যান্ডারসন-ফিনরা আছরে পড়তো লর্ডস কিংবা ওল্ড ট্র্যাফোর্ডের গ্যালারিতে। ২০১৫-এর পর থেকে ক্রমেই স্মৃতি হয়ে আসা তামিমের সেই বিধ্বংসী ব্যাটিংয়ের সর্বশেষ প্রদর্শনীটা বোধহয় পাকিস্তানের সাথে সেই টেস্ট ম্যাচটিতেই দেখা গিয়েছিল।
পুরো সিরিজে উড়ন্ত ফর্মে থাকা তামিম সেদিন দ্বিতীয় ইনিংসে বাংলাদেশের ব্যাটিং এর শুরু থেকেই বোলারদের উপর আধিপত্য বিস্তার করে খেলতে থাকেন, যেমনটা তিনি ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে করতেন। প্রথম ইনিংসে কষ্টেসৃষ্টে ৮০ রান করার পর মমিনুল যেখানে বলেছিলেন উইকেটে রান নেই, সেখানেই তামিম গড়লেন এমন এক কীর্তি, বাংলাদেশ ক্রিকেটে অমর হয়ে যাওয়া ইনিংসের তালিকায় সগৌরবে যেটি তার জায়গা করে নিয়েছে। মুশফিকুর রহিমের পর দ্বিতীয় বাংলাদেশী ব্যাটসম্যান হিসেবে গড়লেন ডাবল সেঞ্চুরির কীর্তি। ২৭৮ বলে ৭৪.১০ স্ট্রাইকরেটে তার করা ২০৬ রান জানান দিয়ে গিয়েছিল, সেদিন খুব বেশি দূরে নয়, যখন টেস্ট ক্রিকেটেও বাংলাদেশ বড় দলগুলোর বিপক্ষে চোখে চোখ রেখে লড়াই করতে পারবে।
অবদান রেখে ক্রমশই ধূসর হয়ে আসা চরিত্র তো এদেশের ক্রিকেট কম দেখেনি। ইমরুল কায়েসকেও সে দলে ফেললে বোধহয় কারো আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু যতদিন দলে ছিলেন, এমন কিছু ইনিংস উপহার দিয়েছেন, যেগুলোর কথা মনে করলে এদেশের ক্রিকেট সমর্থকদের এখনো হতাশায় দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ইচ্ছে হয়, মনের অজান্তেই জেগে ওঠে অনিবার্য সেই প্রশ্নটি, “ইমরুল কায়েসের ভবিষ্যৎ কি এতটাই অনিশ্চিত হওয়ার কথা ছিল?” ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংস প্রশ্নে হয়তো অনুমিতভাবেই ইমরুল কায়েসের উত্তর হবে, ওই একই ম্যাচে পাকিস্তানের সাথে তার ২৪০ বলে ১৫০ রানের ইনিংসটি।
তামিমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সেদিন রান উৎসবে মেতে উঠেছিলেন। ওপেনিং জুটিতে ক্রমাগত ছুঁতে থাকলেন একের পর এক মাইলফলক। ১০০ রান, ১৫০ রান, ২০০ রান, ২৫০ রান! মাইলফলকের শেষ কোথায়? পাঠক নড়েচড়ে বসতে পারেন। প্রায় ৫ ঘণ্টা ৫০ মিনিট ধরে ব্যাটিং করে তামিমের সাথে ইমরুল সেদিন গড়েছিলেন ৩১২ রানের এক পার্টনারশিপ, এদেশের ক্রিকেটে যেটিকে এখনো যক্ষের ধনের সাথেই তুলনা করা হয়।