২০১০ সালের বিশ্বকাপে মূল মঞ্চে খেলার সৌভাগ্য হয়নি বেলজিয়ামের। খেলা হয়নি ২০১২ সালে ইউরোতেও। কিন্তু এর পরবর্তী সময় এবং ২০১৪ সালের ব্রাজিল বিশ্বকাপে এই দলটিতে এসেছিল আমূল পরিবর্তন। এক তরুণ প্রজন্ম রাজত্ব করতে শুরু করেছিল, স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছিল বেলজিয়ামকে ঘিরে। এই তো সেদিনের কথা – এই বেলজিয়াম প্রজন্মকে ধরা হচ্ছিল ‘গোল্ডেন জেনারেশন’।
এই ‘গোল্ডেন জেনারেশন’ কাতার বিশ্বকাপসহ খেলেছে মোট তিনটি বিশ্বকাপ, দু’টি নেশন্স কাপ এবং দু’টি ইউরো। কিন্তু তাদের অর্জনের খাতাটা যে একেবারেই শূন্য। ডি ব্রুইনা নিজেই সেদিন বলেছেন, এই দলটি একেবারে বুড়িয়ে গেছে। ভুল কিছু কিন্ত তিনি বলেননি। যে তরুণ প্রজন্মের হাত ধরে বেলজিয়াম স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল, তারা অনেকেই চলে এসেছেন ক্যারিয়ারের শেষ প্রান্তে। এডেন আজার তো হঠাৎ অবসরই নিয়ে ফেললেন বিশ্বকাপ যাত্রা শেষে। সোনালী সময় শেষ হয়ে গেল, কিন্তু কিছু যে জেতা হলো না।
বেলজিয়ামের সোনালী প্রজন্মের গল্প শুরু করলে সেটা ২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপ থেকেই করা উচিত। কোয়ার্টার ফাইনালে তাদের প্রতিপক্ষ আর্জেন্টিনা। উভয়পক্ষের জমাট রক্ষণ। একপাশে মেসি-লাভেজ্জি-হিগুয়াইন, অন্যপাশে অরিগি-এডেন আজার-ডি ব্রুইনারা শট নিয়েই চলেছেন। কিন্তু বেলজিয়ান রক্ষণ ভাঙতে পেরেছিলেন একমাত্র হিগুয়াইন, যদিও গোলটা এসেছিল কিছুটা ভাগ্যের জোরে; কিন্তু গোল তো গোলই। ৯ মিনিটে ঐ একমাত্র গোলে বেলজিয়ামের বিদায়ঘণ্টা বেজে গেল। সেবারের বিশ্বকাপে তাদের পারফরম্যান্স বলে – তারা চেষ্টা করেছিল, কিন্তু ভাগ্যদেবী তাদের দিকে প্রসন্ন হয়ে হাসেননি।
২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপ ছিল বেলজিয়ামের জন্য শিরোপা জেতার সবচেয়ে সুবর্ণ সুযোগ। গোল্ডেন জেনারেশনের সকল সদস্য তখন এমন একটা বয়সে, যে বয়সে একজন ফুটবল খেলোয়াড়ের মানসিক এবং শারীরিক দিকে ভারসাম্য চলে আসে। ডি ব্রুইনা, লুকাকু, তিয়েলেমানস, এডেন আজার, ক্যারাস্কো, থিবো কোর্তোয়া – প্রত্যেকেই তখন পোক্ত খেলোয়াড়। তবে অভিজ্ঞতার ছোঁয়া দিতে ভিনসেন্ট কোম্পানি, ইয়ান ভের্টোনেন এবং টবি অল্ডারভাইরেল্ড ছিলেন রক্ষণে, মাঝমাঠে ছিলেন ফেলাইনি ও মৌসা দেমবেলে। সেবার বিশ্বকাপে বেলজিয়াম শুরুটাও করেছিল জাকজমক। গ্রুপপর্বে ৯ গোল করে ‘রেড ডেভিল’রা পরের রাউন্ডে উঠেছিল গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে। এরপর জাপানের সাথে পিছিয়ে পরেও ফিরে আসা, ফেভারিট ব্রাজিলকে পুরো কৌশলের লড়াইয়ে হারিয়ে স্বপ্নের সেমিফাইনাল।
কিন্তু জয়যাত্রা থমকে গেল আরেক ফেভারিট ফ্রান্সের সামনেই। গল্পটা অনেকটা ব্রাজিল বিশ্বকাপের মতোই ছিল। ৫১ মিনিটে ফরাসিদের হয়ে একমাত্র গোল স্যামুয়েল উমতিতির। কিন্তু বারবার আক্রমণ করেও লুকাকু-ডি ব্রুইনারা ভাঙতে পারেনি ফরাসি দেয়াল। যদিও ফ্রান্স ছাড় দেয়নি এক মুহূর্তও। তাদের আক্রমণ একের পর এক আছড়ে পড়েছে বেলজিয়াম উপকূলে। কিন্তু রেড ডেভিলদের অভিজ্ঞ রক্ষণের দৌলতে ফ্রান্স গোলসংখ্যাটা আর বাড়াতে পারেনি। কিন্তু হারিয়ে দিতে তো উমতিতির এক গোলই যথেষ্ট ছিল।
বেলজিয়াম যে দলটা নিয়ে ২০১৬ ইউরোতে গিয়েছিল, সেটার সাথে ২০১৮ এর বিশ্বকাপের দলের সাথে খুব তফাৎ নেই। দলটা পরিণত হতে শুরু করেছিল তো তখনই। এডেন আজার আর মিচি বাতসুয়াই তখন ফর্মের তুঙ্গে। মাঝে ডি ব্রুইনা এবং দুই উইংয়ে আজার এবং মারটেন্সকে রেখে মার্ক উইলমরটসের দল তখন রীতিমতো উড়ছে। কিন্তু যে দল হাঙ্গেরির বিপক্ষে শট নিল ২৫টি। সেই দলই পা ফসকাল ওয়েলসের সামনে। এডেন আজার, লুকাকু এবং ডি ব্রুইনার অফ ফর্মের দিনে রেড রেডিলদের রক্ষণ হজম করল তিন গোল।
শক্তিমত্তা এবং সামর্থ্যের কথা দিক দিয়ে চিন্তা করলে বেলজিয়াম যেন নিখুঁত। কিন্তু চাঁদের কলঙ্কের মতো এই দলে ধারাবাহিকতার চরম অভাব ছিল। একবার রক্ষণভাগ তো কোনোদিন আক্রমণভাগের অধারাবাহিকতা এই বেলজিয়ামকে প্রতিবার খাদে ফেলে দিয়েছে। ২০২১ সালে হওয়া ইউরোতে আক্রমণের দিক থেকে পর্তুগালের সামনে তারা দাঁড়াতেই পারেনি। থরগান আজারের চকিতে এক গোল দেবার পর পর্তুগিজরা বেলজিয়ামকে ক্রমে ক্রমে চেপে ধরেছে। কিন্তু তাদের প্রতিটা আক্রমণ বেলজিয়ান রক্ষণ হজম করেছে দাঁতে দাঁত চিপে। কিন্তু ইতালির সাথে পরের ম্যাচ! দুর্দান্ত প্রতাপে ম্যাচ শুরু করা ইতালিয়ানদের আক্রমণ বেলজিয়াম আর ঐদিন ঠেকাতে পারেনি কোনোমতেই। প্রথম ৪৫ মিনিট শেষ হবার আগেই যেন কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিয়েছিলেন ইনসিনিয়ে।
ফুটবলটা কখনই একক প্রতিভা দেখানোর জায়গা নয়। একজন খেলোয়াড়ের পক্ষে তখনই তার প্রতিভা বিশ্বের সামনে তুলে ধরা সম্ভব যখন দলটা সংবদ্ধভাবে খেলতে পারে। ডি ব্রুইনা হয়তো ম্যানচেস্টার সিটির হয়ে সফলতার সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে গেছেন। একসময় এডেন আজার ছিলেন চেলসির নয়নের মণি। রোমেলু লুকাকু যেমন ইউরোপের সেরা স্ট্রাইকারদের একজন। তেমনই লেস্টার সিটির মতো ক্লাবের মধ্যমাঠটা সামলে রাখেন ইউরি টিয়েলেমান্স। এরা সবাই কখনও বেলজিয়ামের হয়ে দলগত ফুটবলটা খেলতে পেরেছেন কী? তাদের কোচ রোবের্তো মার্তিনেস এই দল সামলাচ্ছেন সেই ২০১৬ থেকে। এই ছয় বছরে মার্তিনেস নিজেও কি এই তারকাদের একত্রে দলগত ফুটবলটা খেলাতে পেরেছেন?
এই দুই বিশ্বকাপ এবং ইউরো থেকে বেলজিয়ামের তাও অর্জন কিছু ছিল। গোল্ডেন এক প্রজন্ম নিয়ে তারা তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েনি। দৃষ্টিকটু ফুটবলও খেলেনি শুধুমাত্র প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য। বেলজিয়াম লড়াই করেছে এবং হেরেছে সেরা দলের কাছেই। আর ঐ ম্যাচগুলোতে তাদের হারের কারণ ছিল প্রতিপক্ষের সাথে মাঠের লড়াইয়ে টিকতে না পারা।
কিন্তু এবার? বিশ্বকাপে আরও একবার বেলজিয়ামের সেই গোল্ডেন জেনারেশন। অনেকে ক্যারিয়ারের অন্তিম সময় দেখতে শুরু করেছেন। অনেকে এই বিশ্বকাপ দিয়েই বিশ্বকাপের বুটজুড়ো তুলে রাখবেন। কিন্তু টিকে থাকার কথা পরেই না হয় বলছি, টিকে থাকার লড়াইটা কী এবার হলো?
রিয়াল মাদ্রিদের এডেন আজার এখনও বেলজিয়ামের আর্মব্যান্ডটা হাতে পরেন। কিন্তু দলনেতা হয়েও সামনে থেকে দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি পুরোদস্তুর ব্যর্থ। মরক্কো ম্যাচে তার ফর্মহীনতা পুরোটা সময় দলকে ভুগিয়েছে। আজার বল হারিয়েছেন বারবার, সামান্য ড্রিবল করতে গিয়ে থমকে গেছেন মরক্কান রক্ষণের সামনে। ইনজুরি এবং ইনজুরি-পরবর্তী সময়ে ফর্ম হারানোর পর রিয়াল মাদ্রিদের বেঞ্চে জায়গা করে নেওয়া এডেন আজারের ক্যারিয়ারের শেষ দেখে ফেলেছেন অনেকেই। তবে এটা সত্য যে তিনি হারিয়ে গেছেন। চেলসির ঐ এডেন আজার ফুটবলের পর্দায় আর কখনোই হয়তো ফিরবে না।
লেস্টার সিটির ইউরি তিয়েলেমান্সকে নিয়ে বেলজিয়াম হয়তো দিবাস্বপ্নই দেখছিল। কিন্তু এই দলের মধ্যমাঠে নেমে তিয়েলেমানস একেবারেই চুপসে গেছেন। এজন্য মরক্কোর বিপক্ষে ম্যাচে নেমেছিলেন এভারটনের আমাদু ওনানা। সে ম্যাচে ওনানা করেছেন আরও বেশি হতাশ। তিয়েলেমানসের মতো ব্যর্থ অনেকেই হয়েছেন। বাতসুয়াই, মুনিয়ে, কেইটলায়েয়ার, কাস্তানিয়ে, ক্যারাস্কো – নামের তালিকা শুধু বাড়তেই থাকবে। কিন্তু বেলজিয়াম যেই কেভিন ডি ব্রুইনার উপর ভরসা করেছিলেন, সে ডি ব্রুইনা হয়তো ক্যারিয়ারের সেরা তিন বাজে ম্যাচ খেললেন এই গ্রুপ-পর্বে।
বিশ্বকাপের মধ্যেই নিজেদের বুড়ো বলে দলের সাথে নিজের সম্পর্ক কিছুটা হলেও চিড় ধরেছিল। পরে তার সতীর্থদের কথাবার্তা শুনে বোঝা গেছে, চিড় নয়। এই বেলজিয়াম দলে সবার সাথে সবার সম্পর্ক আসলে ভেঙেই গেছে। এই ভেঙে যাওয়া একাদশ নিয়ে ডি ব্রুইনা যেন চাচ্ছিলেন ম্যাচগুলো কোনোমতে শেষ করতে। আর এই বিশ্বকাপ দিয়ে হয়তো প্রমাণ হয়ে গেল, এই ডি ব্রুইনা হয়তো শুধুই ম্যানচেস্টার সিটির।
ভরসা ছিল রোমেলু লুকাকুর উপরও। ক্রোয়েশিয়ার ম্যাচে বেঞ্চে ছিলেন, কিন্তু দল একেবারেই গোলের দেখা পাচ্ছিল না বলে দ্বিতীয়ার্ধে রবার্তো মার্তিনেস নামিয়েছিলেন তাকে। ক্রোয়াটদের জালে এক গোল দিলেই পাশার দান উলটে যেত। সেখানে লুকাকুর গোল মিসের মহড়া দেখে গ্যালারিতে থাকা রেড ডেভিল সমর্থক দুয়োটাও দিতে যেন ভুলে গিয়েছিল।
বেলজিয়ানদের এই প্রজন্মের শেষ দেখে নিল কাতার। দারুণ এক সম্ভাবনা নিয়ে এই প্রজন্মের উত্থান হয়েছিল। কিন্তু সেই প্রজন্মের বিদায়ঘণ্টা বাজছে একেবারে শূন্য হাতে। অনেকে হয়তো কোচ রবার্তো মার্তিনেসকে দোষী বানাবেন। তিনি লম্বা সময় ধরেও এই দলকে এক সুতোয় বাঁধতে পারেননি। অনেকে দোষ দেবেন এই দলের প্রত্যেক খেলোয়াড়কে, যারা ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারেননি। ক্লাবের ফর্ম টেনে আনতে পারেননি জাতীয় দলের হয়ে। হয়তো সমস্যাটা দলের একদম শিকড়ে। এই দেশের হয়ে কোনো তারকা ফুটবলার হয়তো নিজেদের ভেতর বোঝাপড়াটা ঠিকমতো গড়ে তুলতে পারেননি।
আগামী বিশ্বকাপে এই একাদশের অধিকাংশই থাকবেন না। আবার নতুন কোচের অধীনে হয়তো ঢেলে সাজাতে গিয়ে বাদ পড়বেন অনেকেই। কিন্তু বেলজিয়ামের হাতে এখন এমন খেলোয়াড় নেই, যারা ভবিষ্যৎ বেলজিয়ান ফুটবলকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন। আসলে বেলজিয়ামের গেছে যে দিন, হয়তো একেবারেই গেছে। আপাতত রয়েছে একরাশ আক্ষেপ। এক ‘গোল্ডেন জেনারেশন’কে নিয়ে আক্ষেপ।