গ্লেন ম্যাকগ্রাকে টপকে ভারতের বিপক্ষে সিরিজে ইতিহাসের সবচেয়ে সফল ফাস্ট বোলার হয়ে গেছেন জেমস অ্যান্ডারসন। এই সিরিজেই রিচার্ড হ্যাডলিকে টপকে পঞ্চম সেরা ফাস্ট বোলার হয়ে গেছেন স্টুয়ার্ট ব্রড। নতুন করে লেখা হলো সেরা পাঁচ পেসারের তালিকা।
এই সময়ে আমরা দেখে নেই টেস্ট ইতিহাসের সেরা ৫ ফাস্ট বোলারকে।
৫. স্টুয়ার্ট ব্রড
তার সবকিছুই জেমস অ্যান্ডারসনের ছায়ায় ঢাকা পড়ে থাকে।
জেমস অ্যান্ডারসন যে সিরিজে গ্লেন ম্যাকগ্রাকে টপকালেন, সেই ভারতের বিপক্ষে সিরিজেই রিচার্ড হ্যাডলিকে টপকে টেস্ট ইতিহাসের পঞ্চম সফলতম পেসার হয়ে গেলেন ব্রড। কিন্তু সেভাবে ব্যাপারটা কেউ খেয়ালই করলো না।
৪১৭ উইকেট নিয়ে এই সিরিজ শুরু করেছিলেন ব্রড। আর হ্যাডলির ছিলো ৪৩১ উইকেট। ১৪ উইকেট নিয়েই ব্রড স্পর্শ করলেন হ্যাডলিকে। আর পরের উইকেটে চলে এলেন তালিকার ৫ নম্বরে। শেষ অবধি এই ভারতের বিপক্ষে সিরিজ যখন শেষ হয়েছে, তখন ব্রডের উইকেটসংখ্যা ৪৩৩। এখন তিনি কপিল দেবের চেয়ে মাত্র ১ উইকেট পেছনে আছেন। নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, কপিল-ওয়ালশকে টপকে অ্যান্ডারসনকে টপকানোর দিকে চোখ থাকবে এই ইংলিশ বোলারের।
ক্রিস ব্রডের ছেলে স্টুয়ার্ট ব্রড তার বোলিংয়ের চেয়ে ক্যারিয়ারের একটা বড় সময় আলোচিত ছিলেন মাঠের বাইরের ও ভেতরের আচরণগত নানা সমস্যার কারণে। কিন্তু সেসব সমস্যা আটকে রাখতে পারেনি ব্রডকে। হয়ে উঠেছেন ইংল্যান্ডের ইতিহাসের দ্বিতীয় সেরা বোলার।
ইংল্যান্ডের প্রথম বোলার হিসেবে ৪০০ উইকেটের মাইলফলক স্পর্শ করেছিলেন অ্যান্ডারসন। এরপর দ্বিতীয় বোলার হিসেবে সেই তালিকায় নাম লিখিয়েছেন অ্যান্ডারসনের বেশ কিছুকাল ধরে নতুন বলের সঙ্গী ব্রড।
বোলার হিসেবে দারুণ আক্রমণাত্মক। সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো, যেকোনো ধরনের উইকেটে বাউন্স আদায় করে নিতে পারেন। ১৬ বার ক্যারিয়ারে ৫ উইকেট নিয়েছেন। এর মধ্যে ৭ বার ৫ উইকেট নিয়েছেন ১ স্পেলে। বলের পাশাপাশি ব্যাটটাও চালাতে পারেন। টেস্টে একটি সেঞ্চুরির পাশে ১২টি ফিফটিও আছে ব্রডের।
৪. কপিল দেব
সে সময় টেস্টে ৪০০ উইকেট- এটা আকাশছোঁয়া ব্যাপার ছিলো। রিচার্ড হ্যাডলি উচ্চতাটা বাড়িয়ে রেখেছিলেন। সেই উচ্চতাটা স্পর্শ করতে ক্যারিয়ারের শেষে খুব লড়াই করতে হয়েছে কপিল দেবকে। শেষ অবধি নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে খেলেই যখন অবসর নিলেন কপিলের উইকেট তখন ৪৩৪টি। হ্যাডলির চেয়ে ৩ উইকেট বেশি। সেই সময় অবধি কপিলই ছিলেন বিশ্বের সবচেয়ে বেশি উইকেটের মালিক।
পুরোদস্তুর এক অলরাউন্ডার ছিলেন কপিল দেব। যদিও ব্যাটিংটা ঠিক বোলিংয়ের মতো অতটা প্রশংসিত ছিলো না। তবে এটা নিঃসন্দেহে সত্যি যে, ভারতের ইতিহাসের সেরা পেসার ছিলেন তিনি। এমন একটা সময় খেলেছেন, যখন বিশ্ব দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন আরও তিন কিংবদন্তী অলরাউন্ডার ইয়ান বোথাম, রিচার্ড হ্যাডলি ও ইমরান খান। অলরাউন্ডারদের এই স্বর্ণযুগে সমানে পাল্লা দিয়ে পারফর্ম করেছেন কপিল। ছিলেন ভারতের বহু ইতিহাসের নায়ক ও অধিনায়ক। এর মধ্যে ভারতকে বিশ্বকাপ এনে দেওয়াটা ছিলো কপিলের জীবনের সেরা অর্জন।
পরিসংখ্যান অবশ্য বলবে, কপিল ইতিহাসেরই সেরা অলরাউন্ডার ছিলেন। কারণ তিনি ইতিহাসের একমাত্র অলরাউন্ডার, যিনি একাধারে চার শতাধিক উইকেট নিয়েছেন এবং পাঁচ হাজারের ওপর রান করেছেন। ব্যাটসম্যান হিসেবে ছিলেন খুবই আক্রমণাত্মক। ১৩১ টেস্টে ৩১.০৫ গড়ে ৫২৪৮ রান করেছেন। এর মধ্যে আছে ৮টি সেঞ্চুরি। ওয়ানডেতেও আছে ৩ হাজারের ওপরে রান। আছে ভারতকে বিশ্বকাপের নাটকীয়তা জেতানো এক সেঞ্চুরি।
৩. কোর্টনি ওয়ালশ
শেন ওয়ার্ন আর মুত্তিয়া মুরালিধরণ তখনও অবিশ্বাস্য সেই সংখ্যাগুলোর জন্ম দেননি। সেই যুগে ৪০০ উইকেট ছিলো একজন টেস্ট বোলারের জীবনের চূড়ান্ত স্বপ্ন। আর ৫০০ উইকেট ছিলো এক অসম্ভব মাইলফলকের নাম। মনেই করা হতো যে, কোনো টেস্ট বোলারের পক্ষে পাঁচশ উইকেটের এই মাইলফলকে পৌঁছানো সম্ভব হবে না। আর সেই অসম্ভব কাজটাই করলেন আজকের বাংলাদেশ দলের বোলিং কোচ কোর্টনি ওয়ালশ।
নিঃসন্দেহে তার সময়ের সেরা বোলার ছিলেন ওয়ালশ। শুধু সেরা বোলার বলে এই ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানকে বোঝানো সম্ভব না। একজন অসম্ভব শৃঙ্খলাপরায়ণ, পরিশ্রমী ও ধৈর্যশীল একজন ফাস্ট বোলার ছিলেন। ফাস্ট বোলাররা যে এত নিয়ন্ত্রিত ও বিনয়ী হতে পারে, সেটারও অন্যতম উদাহরণ তৈরি করলেন এই মানুষটি। কার্টলি অ্যামব্রোসের সাথে জুটি বেঁধে একটা ত্রাস তৈরি করে ফেলেছিলেন নব্বইয়ের দশকে।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের সোনালী যুগের পেস ব্যাটারির স্মৃতি ফিরিয়ে এনেছিলেন এই ওয়ালশ ও অ্যামব্রোস।
টেস্টে ৩০ হাজার ১৯টি বল করেছেন। সেই সাথে জ্যামাইকা ও গ্লুস্টারশায়ারের হয়ে হাজার হাজার ডেলিভারি করেছেন। কখনো গতি আর নিয়ন্ত্রণের সাথে আপোষ করেননি। বলা হয়ে থাকে, সবচেয়ে বেশিকাল ধারালো গতি ধরে রাখা ফাস্ট বোলার ওয়ালশ।
ক্যারিয়ারের শেষ লগ্নে এসে কপিল দেবকে ছাপিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে সফল বোলার হয়ে ওঠেন। আর প্রথম বোলার হিসেবে পাঁচশ উইকেট নেওয়ার কীর্তি তো আছেই।
এখন খেলা ছাড়ার পর বিভিন্ন জায়গা ঘুরে বাংলাদেশে এসেছে। কোচ হিসেবেও অত্যন্ত পরিশ্রমী ও আন্তরিক বলে নিজেকে প্রমাণ করছেন। বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের কাছে তার নাম ‘মাস্টার’।
২. গ্লেন ম্যাকগ্রা
ওয়াসিম আকরামের মতো প্রতিভা তার ছিলো না। শোয়েব আখতার, ব্রেট লির মতো গতিতারকা তিনি নন; এমনকি ওয়ালশের মতো গতিশীলও ছিলেন না। তারপরও তিনি সেরা ছিলেন। দিনের পর দিন অফস্ট্যাম্পের ওপর অক্লান্ত বল করে যাওয়া এবং মারণঘাতি এক লেন্থে বল ফেলে যাওয়ার অসম্ভব ক্ষমতা নিয়ে এসেছিলেন ক্রিকেটে। আর এই করে বাধ্য করতেন ব্যাটসম্যানকে ভুল করতে। আর এই করে করেই হয়ে উঠেছিলেন একটা সময় টেস্ট ইতিহাসের সফলতম পেস বোলার।
গ্লেন ম্যাকগ্রা অস্ট্রেলিয়া দলে মার্ভ হিউজের জায়গাটা নিয়েছিলেন। সেখান থেকে অস্ট্রেলিয়ার তো বটেই, বিশ্বেরই সফলতম খেলোয়াড়ে পরিণত হয়েছিলেন।
তার ক্যারিয়ারের এপিটাফ অনেকবার লিখে ফেলা হয়েছিলো। কখনো ইনজুরি, কখনো অসুস্থ স্ত্রীর পাশে থাকার জন্য লম্বা সময় ধরে ছিলেন মাঠের বাইরে। তখনই অনেকে ম্যাকগ্রার শেষ দেখে ফেলেছিলেন। কিন্তু ম্যাকগ্রার চিত্রনাট্যটা আজীবন তিনি নিজেই লিখেছেন। ২০০৬-০৭ মৌসুমে ইংল্যান্ডকে অ্যাশেজে হোয়াইট ওয়াশ করে তবেই বিদায় নিয়েছিলেন টেস্ট থেকে। একইরকম ওয়ানডেতে ২০০৭ বিশ্বকাপের সেরা বোলার হয়ে তবে অবসর নিয়েছেন।
২০০৫ সালে সুপার টেস্টে কোর্টনি ওয়ালশকে ছাপিয়ে সবচেয়ে সফল পেস বোলার হয়ে ওঠেন। এরপর নিজেকে তুলে নিয়ে গেছেন আরও উঁচুতে। ২০০৭ সালে যখন অবসর নিয়েছেন, নামের পাশে তার ৫৬৩ উইকেট। একজন ফাস্ট বোলারের জন্য অকল্পনীয় এক উচ্চতা। ম্যাকগ্রার এই ৫৬৩ উইকেট আরও গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে, তিনি খেলেছেন ১২৪টি টেস্ট।
১. জেমস অ্যান্ডারসন
ইংল্যান্ডের বাস্তবতায় জেমস অ্যান্ডারসন এক অকল্পনীয় লম্বা রেসের ঘোড়া।
টেস্টে ইংল্যান্ডের হয়ে এর আগে সর্বোচ্চ উইকেট ছিলো ইয়ান বোথামের, ৩৮৩টি। বোথাম খেলতে পেরেছিলেন ১০২টি টেস্ট। যদিও বোথাম ছিলেন সর্বকালের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার। তারপরও সেই দেশের অ্যান্ডারসন যখন ১৪৩ টেস্ট খেলে ফেলেন, সেটা হয়ে ওঠে বিস্ময়কর এক ব্যাপার। আর এই ১৪৩ টেস্টেও অ্যান্ডারসনের থামার কোনো লক্ষণ নেই। গত কয়েক বছর ধরে প্রতি বছরই যেন আগের বছরের চেয়ে ভালো পারফর্ম করার প্রতিযোগিতায় মেতেছেন এই ফাস্ট বোলার।
ইংলিশরা ঘরোয়া কন্ডিশনে অন্য দেশের ফাস্ট বোলারদের চেয়ে একটু সুবিধা পেয়ে থাকেন। ডিউক বলে বল করতে পারেন, সেটার মুভমেন্ট কোকাবুরার চেয়ে একটু বেশি। তারওপর গ্রীষ্ম জুড়ে উইকেটে নানা রকম সুবিধা পেয়ে থাকেন। কিন্তু এসব সুবিধার পাশে ক্লান্তিও কম বড় ব্যাপার নয়। শত শত ওভার বল করতে হয় তাকে। প্রতিদিন একজন উপমহাদেশীয় স্পিনারের মতো টানা বল করে যেতে হয়। এই পরিমাণে বল করে প্রায় দেড়শ টেস্ট খেলে ফেলাটাই অ্যান্ডারসনের সেরা কৃতিত্ব।
তবে অ্যান্ডারসন ওখানেই থেমে থাকেননি। বোথামকে ছাড়িয়ে একসময় ইংল্যান্ডের সফলতম বোলারে পরিণত হয়েছেন। এরপর ইংল্যান্ডের প্রথম বোলার হিসেবে নিয়েছেন চারশ উইকেট। আর এবার ভারতের বিপক্ষে সিরিজে হয়ে উঠলেন ইতিহাসের সেরা ফাস্ট বোলার।
ম্যাকগ্রার থেকে ২৩ উইকেট পেছনে থেকে এই ভারতের বিপক্ষে সিরিজ শুরু করেছিলেন অ্যান্ডারসন। এই ৩৬ বছর বয়স পার করে এসে এক সিরিজেই ম্যাকগ্রাকে টপকে যাবেন, এমন আশা করাটা কঠিন ছিল। কিন্তু লর্ডস টেস্টে ৯ উইকেট নিয়ে সেই পথে অনেকটাই এগিয়ে যান তিনি। শেষ টেস্টের শেষ ইনিংসে ম্যাকগ্রাকে টপকাতে দরকার ছিল আর ৩ উইকেট। টেস্টের চতুর্থ দিন বিকেলে শিখর ধাওয়ান ও চেতেশ্বর পুজারাকে আউট করে ম্যাকগ্রাকে স্পর্শ করে ফেলেন অ্যান্ডারসন। শেষ দিনে দরকার ছিল তার একটি মাত্র উইকেট। কিন্তু একে একে ভারতের প্রায় সব উইকেটের পতন হয়ে যাচ্ছিল, অ্যান্ডারসনের আর উইকেটের দেখা নেই। তখন বাকি কেবল শেষ উইকেট। আর সেই সময়ই অব্যর্থ লক্ষ্যভেদে রেকর্ড নিজের করে নিলেন অ্যান্ডারসন।