Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ববি ফিশার: দাবার ম্যারাডোনা? 

শিরোনাম দেখে অনেকেরই ভ্রু কুঁচকে গেছে হয়তো এতক্ষণে। নিখাদ দাবাপ্রেমীরা আঁতকেও উঠতে পারেন। হয়তো বলতে পারেন, ফিশার কেন দাবার ম্যারাডোনা হতে যাবেন! বরং ম্যারাডোনা হচ্ছেন ফুটবলের ফিশার। তাতে অবশ্য লেখকের বিশেষ আপত্তি নেই। তবে দাবা এবং ফুটবলের সর্বকালের সেরাদের তালিকায় থাকা এই দু’জনের মধ্যে বেশ মিল খুঁজে পাওয়া যেতেই পারে। কোথায়? সেটাই এখন শোনা যাক!

ডিয়েগো ম্যারাডোনা ; Image Credit: Getty Images

শুরু করা যাক দু’জনের শুরু দিয়ে।

দু’জনেরই উত্থান একদম অল্প বয়সে। অবশ্য এটা তেমন উল্লেখযোগ্য কোন মিল নয়। সর্বকালের সেরাদের শুরুটা অল্প বয়সেই হবার কথা। ফুটবলের সর্বকালের অন্যতম তিন সেরা পেলে-ম্যারাডোনা-মেসি আর দাবার সর্বকালের তিন সেরা ফিশার-ক্যাসপারভ-কার্লসেন — সবাই বিশ পেরোবার আগেই সবার নজর কেড়েছিলেন। তারপরও তারা আলাদা, কারণ আর্জেন্টিনার সর্বকনিষ্ঠ ফুটবলার হচ্ছেন ম্যারাডোনা যিনি ১৬ বছর ৩ মাস বয়সে আকাশী-সাদা জার্সি গায়ে জড়িয়েছিলেন। আর পনের বছর বয়সে ববি ফিশার যখন গ্র‍্যান্ডমাস্টার হন, তিনি ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ গ্র‍্যান্ডমাস্টার, যে রেকর্ড অক্ষুণ্ন ছিল পরের তেত্রিশ বছর!

দুজনেরই পেশাদারী খেলোয়াড়ের জীবন শুরু পনের-ষোল বছরের দিকে। ষোল বছরের ম্যারাডোনা যখন আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্সের হয়ে খেলা শুরু করেন, শুরুতেই চারদিকে হৈচৈ ফেলে দেন। ‘৭৬-‘৮১ মৌসুমে ১৬৭ ম্যাচে ১১৫ গোল করলেও শিরোপা জেতা হয়নি। ছোট ক্লাবে খেললে যা হয় আর কি। সে কারণেই কি না ১৯৮১ সালে চলে যান বোকা জুনিয়র্সে, অভিষেকেই করেন দুই গোল। এবং সে মৌসুমে চ্যাম্পিয়ন হয় বোকা। এরপরেই স্পেনে পাড়ি জমান তিনি। বহু বছর পরে আবার আর্জেন্টিনায় ফিরে আর্জেন্টাইন লিগে খেললেও ১৯৮১ এর সেই শিরোপাটিই ম্যারাডোনার একমাত্র আর্জেন্টাইন লিগ শিরোপা।

দাবা যেহেতু একক নৈপুণ্যের খেলা, এখানে ছোট ক্লাব বা বড় ক্লাবের হিসেব নেই। সুতরাং পনের বছর বয়সে ইউএস চ্যাম্পিয়নশিপ খেলতে নেমেই চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেলেন তিনি। সেবার নিয়ে মোট আটবার ইউএস চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণ করেন তিনি, বলুন তো কতবার জিতেছিলেন তিনি? উত্তর সঠিক হয়েছে, আটবারই তিনি চ্যাম্পিয়ন। এর মধ্যে ১৯৬৩-৬৪তে ১১ খেলার সবক’টিতে জেতেন তিনি, আজ পর্যন্ত টিকে আছে ইউএস চ্যাম্পিয়নশিপে ১০০% জেতার এই রেকর্ড। 

দু’জনের ঝুলিতেই আছে শতাব্দীসেরা কিছু অর্জন। ডিয়েগো ম্যারাডোনার ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেই ‘গোল অফ দ্য সেঞ্চুরি’ মোটামুটি সবাই জানে। দাবা ফুটবলের মতো জনপ্রিয় নয়, নতুবা ডোনাল্ড বার্নের বিপক্ষে ফিশারের ‘গেম অফ দ্য সেঞ্চুরি’র কথাও সবাই জানত। মাত্র তের বছর বয়সে সেই খেলায় প্রথমে নিজের মন্ত্রী বিসর্জন দিয়ে তারপর তুমুল আক্রমণ করে বার্নকে হারানো সেই ম্যাচ আজ দাবার রূপকথার অংশ, যেভাবে একের পর এক ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে দেয়া ম্যারাডোনার সেই গোল ফুটবল রূপকথার অংশ!

হৈচৈ ফেলে দেয়া ববি ফিশারের সেই ম্যাচের পেপার কাটিং; Image Credit: Sydney Academy of Chess

দু’জনেরই আছে নিজ নিজ ক্ষেত্রে বিশ্বচ্যাম্পিয়নের তকমা। এবং দু’জনের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার গল্পেই আছে রাজনীতির উত্তাপও। ১৯৮৬তে আর্জেন্টিনা-ইংল্যান্ড ম্যাচ শুধুই ফুটবল ম্যাচ ছিল না, তাতে ছিল ফকল্যান্ড যুদ্ধের উত্তাপও।

ফিশারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হবার গল্পের রাজনীতির আঁচ আরো বেশি লেগেছিল। ১৯৭২ সালে ববি ফিশার যখন ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন সোভিয়েত ইউনিয়নের বরিস স্পাসকির মুখোমুখি হন, স্নায়ুযুদ্ধ তখন চরমে। দাবা বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ যেন পুঁজিবাদী যুক্তরাষ্ট্র আর সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘প্রক্সি’ যুদ্ধ। সে সময় দাবায় সোভিয়েত ইউনিয়নের নিরঙ্কুশ আধিপত্য, টানা চব্বিশ বছর ধরে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন কোন না কোন সোভিয়েত। ঠিক তখন মঞ্চে আগমন মার্কিন তরুণ ববি ফিশারের। উত্তেজনার পারদ এতটাই চড়েছিল যে সেবারই প্রথম দাবা বিশ্বচ্যাম্পিয়ানশিপ টিভিতে সম্প্রচারের ব্যাবস্থা নেয়া হয়। 

মজার ব্যাপার হলো, ফিশারের খামখেয়ালিপনায় সেই চ্যাম্পিয়নশিপ প্রায় ভেস্তে যাচ্ছিল। কিন্তু পরে তাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ফেরানোর কাজটা করেন সেই সময়ের মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার।  শোনা যায় যে ফিশারকে তাঁতানোর জন্য কিসিঞ্জার নাকি যথারীতি ‘সোভিয়েত কার্ড’ খেলেছিলেন। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত ফিশার খেলতে রাজি হন এবং সব জল্পনা-কল্পনা শেষে সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে দাবার শ্রেষ্ঠত্ব কেড়ে নেন।

ম্যারাডোনা এবং ফিশার – দু’জনেই রাজনৈতিক মত প্রকাশে পিছুপা হতেন না, এবং দু’জনেই শক্তিমানদের বিরুদ্ধেও কথা বলতে ভয় পাননি। ম্যারাডোনা তো হুগো শ্যাভেজ বা ফিদেল কাস্ত্রোর কাছের মানুষ ছিলেন, আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের বিপক্ষে ছিলেন সবসময়ই। ফিফার অনিয়মের বিরুদ্ধেও কথা বলেছেন সবসময়ই, এখন আমরা জানি ফিফা আসলেই দুর্নীতির সাথে জড়িত ছিল ক্ষেত্রবিশেষে। ফিলিস্তিনের পক্ষে ছিলেন, বলেছেন:

“In my heart, I am Palestinian”

ফিশারও ছিলেন সাম্রাজ্যবাদের বিপক্ষে। আমেরিকা বা ইসরায়েলের সমালোচনা করতে তিনিও ছাড়েননি। বলেছিলেন:

“The U.S. and Israel have been slaughtering the Palestinians, just slaughtering them, for years. Robbing them and slaughtering them.”

১৯৯২ সালে বরিস স্পাসকির বিপক্ষে রি-ম্যাচ খেলেছিলেন যুগোস্লাভিয়াতে, সে সময় যুগোস্লাভিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। যুক্তরাষ্ট্র ফিশারকে সতর্ক করে চিঠি দেয়। সংবাদ সম্মেলনে প্রকাশ্যে সেই চিঠিতে থুতু দিয়ে ছিঁড়ে ফেলেন। এরপরে যুক্তরাষ্ট্র ফিশারের আমেরিকান পাসপোর্ট বাতিল করে দেয়। সেই বাতিল পাসপোর্ট নিয়ে জাপানে গিয়ে বিপদে পড়েন ফিশার, কিছু দিন জেলেও ছিলেন তিনি।

Photo: Schirner/ullstein bild/Getty

সমস্যা হচ্ছে, কিছু কিছু ব্যাপারে ফিশারের সমালোচনা ছিল মাত্রাছাড়া। আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতির সমালোচনা এক জিনিস কিন্তু টুইন টাওয়ারে হামলা পর তিনি যখন রেডিওতে উল্লাস প্রকাশ করেন, সেটা বাড়াবাড়ি হয়ে যায়। একইভাবে ইসরায়েলের সমালোচনা এক জিনিস, কিন্তু ফিশার ছিলেন রীতিমতো ইহুদিবিদ্বেষী। অনেকবারই আপত্তিকর মন্তব্য করে তিনি বিতর্ক সৃষ্টি করেছেন।

বিতর্ক তৈরির ক্ষেত্রেও তাই ফিশার আর ম্যারাডোনার মধ্যে মিল দেখা যায়। ফিশারের মতো চরম ভাবাপন্ন না হলেও উল্টোপাল্টা কথা তিনিও কম বলেননি। সাথে কোকেন সেবন করে নিষিদ্ধ হওয়া কিংবা সাংবাদিকদের উপর গুলি চালানোর মতো কাণ্ডও আছে তার।

তবে সবচেয়ে বড় মিল বোধহয় নিজের সম্ভাবনার অপচয়ের ক্ষেত্রে। ১৯৯১ সালে প্রথমবারের মতো নিষেধাজ্ঞা পাবার পর আমরা আর কখনোই আগের ম্যারাডোনাকে পাইনি। যদিও ১৯৯৪ এর বিশ্বকাপে তিনি আবার জাতীয় দলে ঢুকেছিলেন এবং ফের নিষিদ্ধ হয়েছিলেন। নাপোলিতে সাফল্যের শিখরে ওঠার পর সেখান থেকেই পতন, এরপর স্পেনের সেভিয়া হয়ে আর্জেন্টিনার নিউ ওয়েলস ওল্ড বয়েজ ক্লাব ঘুরে শেষে আবার বোকা জুনিয়র্সে। সেখান থেকেই ১৯৯৭ সালে অবসর। ক্যারিয়ারের শেষ সাত বছরে তার অর্জন তার অমিত প্রতিভার তুলনায় সামান্যই। 

Image Credit: Getty Images

ববি ফিশারের ব্যাপারটা আরো অদ্ভুত। ১৯৭২ এ বরিস স্পাসকিকে হারানোর পর তিনি আর সিরিয়াসলি দাবাই খেলেননি। আনাতোলি কারপভের বিপক্ষে শিরোপা ধরে রাখার লড়াইয়ে নামার আগে অনেক শর্ত দেন তিনি, ফিদে তাতে রাজি হয়নি। সুতরাং তিনি অংশই নেননি, ফলাফল শিরোপা আবারও চলে যায় সোভিয়েত ইউনিয়নের কারপভের কাছে। ফর্মের তুঙ্গে থাকা অবস্থাতেই ‘অঘোষিত অবসর’ বলা চলে। এর প্রায় বিশ বছর পর বরিস স্পাসকির বিপক্ষে আবার খেলেন তিনি, কিন্তু সেটা তো আর প্রতিযোগিতামূলক দাবা নয়। তিনি ঠিকঠাক মতো খেললে কী কী যে অর্জন করতে পারতেন, সেটা আমরা এখন কেবল কল্পনাই করতে পারি।

ডিয়েগো ম্যারাডোনা আর রবার্ট জেমস ফিশারের মধ্যে সবচেয়ে বড় মিল তাই তাদের আক্ষেপ জাগানিয়া সমাপ্তিতেই। আপনারাই এবার ভেবে দেখুন, ফিশারকে ডিয়েগো ম্যারাডোনার সাথে তুলনাটা করা যায় কি না!

This article is in Bangla language. It is about the uncanny resemblance of the career graph of Boby Fischer and Diego Maradona.

Featured Image: CARL MYDANS

Related Articles