একটা ছবিতেই ফেঁসে গেল সবকিছু। বিশ্বকাপের পর সবাই যখন বিশ্রামশেষে ক্রমশ মাঠমুখী হচ্ছে, তখন সামাজিক যোগাযোগে ভাইরাল সাকিব আল হাসান ও রংপুর রাইডার্স। দেখা গেল, হাস্যোজ্জ্বল মুখে রংপুর রাইডার্সের সঙ্গে চুক্তিপত্র হাতবদল করছেন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব। অথচ, এই রংপুরের আইকন মাশরাফি বিন মুর্তজা। আর সাকিবও সমান পদে খেলছিলেন ঢাকা ডায়নামাইটসে। তাহলে? কাউকে কিছু না বলেই দল বদলে ফেললেন সাকিব?
একেবারে গলির ক্রিকেট থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের তিন মোড়ল, সবখানেই ‘কমিটির টিম’ বলে ছোট্ট একটা শব্দ আছে। স্বাগতিকরা বাড়তি সুবিধা পাবেন, সেটাও অলিখিত নিয়ম ও চিরায়ত সত্য। সেই ধারাবাহিকতায় যেন রংপুর রাইডার্স আর সাকিব মিলে পা দিয়ে বসলেন বাঘের পায়ে। ব্যস, সবকিছু তোলপাড়! খবর পেয়ে নড়েচড়ে বসলো ঢাকা ডায়নামাইটস, যাদের মালিকানা থেকে শুরু করে কর্মকর্তার প্রায় সবাই কোনো না কোনোভাবে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সাথে জড়িত। সে কারণেই কি না অদৃশ্য স্বার্থ বাঁচাতে মরিয়া হলো বর্তমান চ্যাম্পিয়ন দলটি। শোনা যায়, এ নিয়ে বিসিবির উপর চাপ এসেছিল। তাই তো বিপিএলের গভর্নিং কমিটির সাথে তড়িঘড়ি বৈঠক। সাথে সাথে বদলে ফেলা হলো সব নিয়ম। অথচ এসব বৈঠক কিংবা বিপিএল ইস্যু, আলোচনাতেই আসার কথা নয়। কারণ নতুন কোচ, ঘরের মাঠে সিরিজ সবকিছু নিয়ে খবরের উপলক্ষ কম ছিল না।
বিপিএল কমিটি তাদের রুদ্ধদ্বার বৈঠক শেষে জানিয়ে দিলেন, সবগুলো দলের মেয়াদ শেষ, নতুন করে চুক্তি করতে হবে। আর চুক্তি নবায়নের আগ পর্যন্ত কোনো খেলোয়াড়ের চুক্তিই বৈধ নয়। হুট করে এমন সিদ্ধান্ত শুনে অবাক হয়েছিল সবাই। ঢাকা ডায়নামাইটস তাদের দলের সেরা খেলোয়াড়কে হারিয়ে শোকে পাথর হচ্ছে, আর মুখের খাবার কেড়ে নেওয়ায় বিরক্ত রংপুর। বসুন্ধরা গ্রুপের এই ফ্র্যাঞ্চাইজিটির ব্যাপারে এমন গুঞ্জনও এসেছিল যে সাকিবকে যদি তারা খেলাতে না পারেন, তাহলে তারা নাকি বিপিএলেই থাকবেন না। যদিও পরবর্তীতে বিসিবি ও বিপিএল গভর্নিং কমিটির সাথে বৈঠকে খানিকটা নরম হয়েছে সাবেক চ্যাম্পিয়ন এই দলটি।
সাকিব ইস্যুতে রংপুরের প্রধান নির্বাহী পরিচালক ইশতিয়াক সাদেক সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে বলেছিলেন,
‘সাকিব এবার রংপুরে খেলবে কি না, তা এখনও নিশ্চিত করে বলতে পারছি না। আমরা তো প্রস্তাব রাখবোই, কারণ সবকিছুই বোর্ডের অধীনে। বোর্ড বলেছে, দু’জন বিদেশির সাথে সরাসরি চুক্তি করা যাবে। আমরা বলেছি, তাহলে স্থানীয় একজনের সাথে নয় কেন? সাকিব যেহেতু রংপুর রাইডার্সের সাথে চুক্তি করেছে, তাকে আমরা খেলাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো।’
এত সব নিয়ে যখন আলোচনা, তখনই প্রশ্ন আসে, মাশরাফি তবে কোথায় খেলবেন? তিনিও যে রংপুরেই, সেটাও আবার অধিনায়কের দায়িত্বে! এখানে স্বচ্ছ ব্যাখ্যা দিয়েছে রাইডার্স কর্তারা। তারা জানিয়েছে, মাশরাফি যেহেতু টি-টোয়েন্টি খেলছেন না, তিনি আর আইকন থাকতে পারবেন না। তাছাড়া তার অবসরের গুঞ্জনও শোনা যাচ্ছিল।
তিনি দাবি করেন, গেল আসরেই মাশরাফি আইকন হিসেবে থাকতে চাননি। সবকিছু মিলিয়ে এ বছরে যেহেতু মাশরাফি আইকন থাকতে পারবেন না, তাই তারা সাকিবের প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছে। দলে সাকিব ও মাশরাফি দু’জনকেই খেলাতে চায় তারা।
প্রায় প্রতি আসরেই বিপিএলের নিত্যনতুন নিয়ম বদলানোর ঘটনা সবার জানা। এ নিয়ে সমালোচনাও কম হয় না। কিন্তু কোনো না কোনোভাবে প্রতিবার জন্ম নেয় নতুন বিতর্ক। এ নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করেছেন রংপুর ও খুলনার কোচ যথাক্রমে টম মুডি ও মাহেলা জয়াবর্ধনে। মুডির মতে,
‘আয়োজকদের উচিত ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর জন্য খেলার পরিবেশ ও নিয়মে ধারাবাহিকতা বজায় রাখা। শুধু দলগুলো নয়, সমর্থকদের কথাও মাথায় রাখতে হবে। কারণ এ ধরণের টুর্নামেন্টে ভক্তরাই মূল। জানতে হবে, স্থানীয় বা আন্তর্জাতিক কোন ক্রিকেটারদের অনুসরণ তারা করবে। এভাবেই ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ এগিয়ে যায়। বারবার নিয়ম বদলালে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে।’
অনেকটা একই ভাবনা মাহেলা জয়াবর্ধনের। সাবেক লঙ্কান অধিনায়ক মনে করেন, ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক লিগগুলোতে নিয়মগুলো অপরিবর্তিত থাকা উচিত, ফ্র্যাঞ্চাইজির স্বার্থও দেখা উচিত। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন,
‘লম্বা পরিকল্পনা গুরুত্বপূর্ণ। প্রতি বছর টুর্নামেন্ট চলার আগে বা চলাকালীন সময়ে এভাবে নিয়ম বদলানো ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের জন্য ভালো না। বিশ্বের অন্যান্য টুর্নামেন্টে এগুলো হয় না, ফ্র্যাঞ্চাইজিরা নিজেদের নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে।’
সাকিব ইস্যুতে বিসিবির অবস্থান দেখে মুখ খুলতে শুরু করেছে অন্যান্য ফ্র্যাঞ্চাইজিরাও। অভিযোগের আঙ্গুল উঠছে বোর্ডকর্তাদের উপর, যাদের শীর্ষস্থানীয়দের অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে চাকরি করেন ঢাকা ডায়নামাইটসের মালিকানাধীন সংস্থাগুলোতে।
এবারই প্রথমবারের মতো একসাথে প্রায় সবগুলো ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টের লভ্যাংশ নিয়ে সোচ্চার হয়েছে। অন্যান্য ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের মতো তারাও টুর্নামেন্টে লভ্যাংশ পাবেন, এই আশা সবার। এ প্রসঙ্গে সাবেক চ্যাম্পিয়ন দল কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের চেয়ারম্যান নাফিসা কামাল বলেছেন,
‘আমরা বিপিএলে আছি, প্রায় ৫-৬ বছর হয়ে গেছে। অবশ্যই ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা আছে বলেই এখনও রয়েছি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, এখানে নিয়মগুলো যেভাবে গড়ে উঠেছে, তাতে আমার মনে হয় না ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর আর্থিক কোনো অর্জন রয়েছে। কারণ, আমাদের সাথে মাঠ বা টিকিটের কোনো লভ্যাংশ ভাগ করা হয় না। আমরা মিডিয়া সত্ত্বেরও কোনো অংশ পাই না। আমরা কেবল স্পন্সরের মাধ্যমেই অর্থ পেয়ে থাকি। আবার এটা কিন্তু সহজ নয় যে, প্রতি বছর সমানসংখ্যক স্পন্সর আপনি পাবেন। যদি আগের বছরে ফলাফল খারাপ হয়, এ বছরে স্পন্সরও স্বাভাবিকভাবে কমে যায়। আমরা আইপিএলে যা দেখি, সেটা হলো সঠিক নিয়ম। সেখানে ক্রিকেট বোর্ড ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর সাথে লভ্যাংশ শেয়ার করে।’
কীভাবে লভ্যাংশ ভাগ করা যেতে পারে বিপিএলে, সেই পরিকল্পনাও দিয়েছেন তিনি। বলেছেন,
‘দুইভাবে লভ্যাংশ শেয়ার হতে পারে। প্রথমত, আপনি যদি বিপিএলের দিকে তাকান, তাহলে টের পাবেন ফ্র্যাঞ্চাইজিরা কোনো ধরনের লভ্যাংশ পায় না। এটা খুব দুর্ভাগ্যজনক। আমরা সপ্তম আসরে চলে এসেছি। আমাদের উচিত ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর সাথে লভ্যাংশ শেয়ার করা। আমরা সমানভাবে অর্থ ভাগ করতে পারি, অথবা সম্প্রচারস্বত্ত্বের কিছু অংশ, মাঠ, টিকিট বিক্রির অংশ পেতে পারি। আমরা নিজেকের কাজটাকেই ভাগ করে নিতে পারি। এভাবে চলছে বলেই প্রতি বছর ফ্র্যাঞ্চাইজি আসছে, যাচ্ছে। এটা ভালো খবর নয়।’
লভ্যাংশ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে রংপুর রাইডার্স এবং খুলনা টাইটান্সও। তবে এ নিয়ে অতীতে সবার আগে কন্ঠ তোলে রাজশাহীর ফ্র্যাঞ্চাইজি। এবারও একই সুর তুলেছে তারা। যদিও বিসিবির পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে, আয়োজনশেষে তেমন কিছুই থাকে না, যে কারণে ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোকে লভ্যাংশ দেওয়ার কোনো সুযোগ তাদের নেই।
গেল আসরে সম্প্রচার, বিপণন, বিজ্ঞাপন, এমনকি বিপিএল নিয়ে সমর্থকদের মধ্যে ছিল না কোনো উত্তেজনা। অনেক ক্রিকেটাররা সংবাদ সম্মেলনে লিগে ফাঁকা গ্যালারি দেখে হা-হুতাশ করেছিলেন। মুশফিকুর রহিম স্বয়ং দর্শকদের মাঠে আসতে বলেছিলেন। মাঠের পারফরম্যান্স রমরমা হলেও মাঠের বাইরের পারফরম্যান্সের এমন করুণ হালের পিছনে লিগের আয়োজন ও প্রচারে অনেকখানি পিছিয়ে আছে বিপিএল, এমনটাই মনে করা হচ্ছে। সেই ধারাবাহিকতায় টিভিস্বত্ত্ব, মাঠের স্বত্ত্ব আর টিকিট বিক্রির অংশ যদি ফ্র্যাঞ্চাইজির হাতে তুলে দেওয়া যেত, তাহলে অবশ্যই প্রচারে ও প্রসারে ভিন্নতা আসতো বলে মনে করা হয়। কারণ, একা বিপিএল গভর্নিং কমিটির পক্ষে মাঠ ও মাঠের বাইরের সবটুকু করা এক কথায় অসম্ভব।
আয়োজকরা দাবি করে, আইপিএলের পর জনপ্রিয়তার দিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে বিপিএল। কিন্তু নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে স্বেচ্ছাচারিতা হতে পারে ব্যর্থতার বড় নিয়ামক।