ক্লাব ফুটবলের অনেকটা আকর্ষণ নিবদ্ধ থাকে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের উপর। নামী-দামী ক্লাবের পাশাপাশি বড় বড় খেলোয়াড়েরাও দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন ইতিহাদ কিংবা ওল্ড ট্রাফোর্ডের মাঠ। নিজ দেশের এত জনপ্রিয় লিগ ছেড়ে তাই ক্যারিয়ারের শুরুতেই পারতপক্ষে কোনো ব্রিটিশ খেলোয়াড় ভিন্ন দেশের ক্লাবের হয়ে খেলতে আগ্রহ প্রকাশ করেন না। তবে এর ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়। আজ আমরা দেখবো এমন কয়েকজন খেলোয়াড়, যারা ক্যারিয়ারের শুরুতেই ব্রিটিশ লিগ ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছেন ভিন্ন দেশের লিগে।
অলিভার বুর্কি
নটিংহ্যাম ফরেস্ট থেকে আরবি লাইপজিগ
ফি – ১৫ মিলিয়ন ইউরো
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে ড্যারেন ফ্লেচারের অভিষেকের পর এই প্রথম কোনো স্কটিশ খেলোয়াড় নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে ব্রিটিশ মিডিয়া। বুর্কি ক্যারিয়ার শুরু করেন নটিংহ্যাম ফরেস্টের হয়ে। অবশ্য কিছুদিনের মধ্যেই ২০১৬ সালের আগস্টে যোগ দেন আরবি লাইপজিগে।
উইংগার বুর্কি কিছুদিনের মধ্যেই নিজের সহজাত গতি ও স্কিল দিয়ে নজর কাড়েন। বুন্দেসলিগায় নিজের প্রথম সাত ম্যাচেই করেন ১টি গোল ও ২টি অ্যাসিস্ট। তবে এর পরপরই খেই হারিয়ে ফেলেন তিনি। ক্যারিয়ারের মোড়ের অপেক্ষায় থাকা বুর্কিকে ধারে পাঠানো হয় ওয়েস্ট ব্রমে। কিন্তু ২০১৭-১৮ পুরো মৌসুমে মাত্র ১২ বার ওয়েস্ট ব্রমের জার্সি গায়ে মাঠে নামেন তিনি। মরার উপর খাড়ার ঘাঁ হয়ে আসে ওয়েস্ট ব্রমের লিগ থেকে অবনমন হয়ে যাওয়া। অলিভার বুর্কি তাই এখন খেলছেন ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় বিভাগে।
রবি কিন
কভেন্ট্রি সিটি থেকে ইন্টার মিলান
ফি – ১৩ মিলিয়ন ইউরো
নিজের সমসাময়িক কালে আয়ারল্যান্ডের পোস্টার বয় ছিলেন রবি কিন। কভেন্ট্রি সিটির হয়ে অভিষেকের কিছুদিন পরই পাড়ি জমান ইন্টার মিলানে।
২০ তম জন্মদিনে ২০০০ সালে সান সিরোতে পাড়ি জমান কিন। ইন্টারে পাড়ি জমানোর পেছনে মূল হোতা ছিলেন তৎকালীন ইন্টার ম্যানেজার মার্সেলো লিপ্পি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, কিন ইন্টারে যোগদানের ১ বছরের মাথায় বরখাস্ত হন লিপ্পি। নতুন কোচ তারদেল্লির সুনজরে ছিলেন না কিন। সেই মৌসুমে মাত্র ১৪ ম্যাচ খেলে ৩ গোল করেন তিনি। তবে কিনের দলে জায়গা না হওয়ার পেছনে আরেকটি কারণও ছিলো। সেই সময় ইন্টার মিলান ছিলো স্ট্রাইকার সমৃদ্ধ দল। ব্রাজিলের রোনালদো ছাড়াও হাকান সুকুর, ক্রিশ্চিয়ান ভিয়েরিরাও ছিলেন দলে।
তাই পরের মৌসুমেই ধারে এবং পরবর্তীতে স্থায়ীভাবে লিডসে যোগদান করেন কিন। ইন্টারের হয়ে সেভাবে আলো না কাড়তে পারলেও ক্যারিয়ারে পরে ঠিকই জ্বলে উঠেছেন তিনি। টটেনহামের হয়ে করেছেন শতাধিক গোল। জাতীয় দলে আয়ারল্যান্ডের হয়ে সর্বোচ্চ গোলদাতাও তিনি। ১৪৬ ম্যাচ খেলে আইরিশদের হয়ে তার গোল ৬৮।
এমএলএস ও ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ খেলে ২০১৮ সালের নভেম্বরে নিজের বুট জোড়া তুলে রাখার ঘোষনা দেন রবি কিন। বর্তমানে তিনি আয়ারল্যান্ড জাতীয় দলের সহকারী ম্যানেজারের দায়িত্বে আছেন।
রায়ান গাল্ড
ডান্ডি ইউনাইটেড থেকে স্পোর্টিং সিপি
ফি – ৩ মিলিয়ন ইউরো
ক্যারিয়ারে শুরুতেই ‘স্কটিশ মেসি’ উপাধি পাওয়া রায়ান গাল্ড ক্যারিয়ার শুরু করেন ডান্ডি ইউনাইটেডের হয়ে। শুরু থেকেই ড্রিবলিং আর বডি ব্যালেন্স দিয়ে সবাইকে বিস্মিত করেন গাল্ড। ১৭ বছর বয়সেই বড় বড় ক্লাবগুলোর রাডারে চলে আসেন তিনি।
২০১৪ সালেই ৩ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে স্পোর্টিং সিপিতে যোগ দেন গাল্ড। তবে এখানে এসে মূল দলে থিতু হতে পারেননি তিনি। খেলেছেন মাত্র ৫টি ম্যাচ। যদিও বি দলের হয়ে খেলেছেন ৭৩টি ম্যাচ। পরে সেখান থেকে ধারে চলে যান ভিটরিয়া দে আভেস ক্লাবে। সেখানে ৩২ ম্যাচ খেললেও করেননি কোনো গোল কিংবা অ্যাসিস্ট। বর্তমানে ২২ বছর বয়সী রায়ান গাল্ড নিজেকে হারিয়ে খুঁজে ফিরছেন।
রাভেল মরিসন
ওয়েস্ট হাম থেকে লাজিও
ফি – ফ্রি ট্রান্সফার
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের যুবদলে একসাথে খেলেছেন পল পগবার সাথে। সেখান থেকে ওয়েস্ট হাম সিনিয়র দলে যোগ দেন মরিসন। ২০১২ সালে ফ্রি ট্রান্সফারে ওয়েস্ট হামে যোগ দেওয়ার পেছনে কারণ ছিলো কোচিং স্টাফরা তার উপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছিলো বলে।
ওয়েস্ট হামের হয়ে শুরুও করেছিলেন দুর্দান্ত। হোয়াইট হার্ট লেনে একক নৈপুণ্যে দলকে ৩-০ গোলে জেতান তিনি। কিন্তু ক্যারিয়ারে হঠাৎ করেই খারাপ সময় দেখা শুরু করেন মরিসন। সেজন্য দল ছেড়ে যোগ দেন লাজিওতে। যদিও সেখানে খেলতে পেরেছেন মাত্র ৮টি ম্যাচ। লাজিও থেকে ধারে কুইন্স পার্ক রেঞ্জার্স হয়ে বর্তমানে তিনি আছেন একটি মেক্সিকান ক্লাবে। সেখানে এখন পর্যন্ত ২৫ ম্যাচ খেলে করেছেন মোটে ৪টি গোল।
ডেলে জেনিংস
ট্রানমেয়ার রোভার্স থেকে বায়ার্ন মিউনিখ
ফি – ১.৮ মিলিয়ন ইউরো
ট্রানমেয়ার রোভার্স থেকে অখ্যাত এক খেলোয়াড়কে যখন বায়ার্ন দলে ভেড়ায়, তখন সবাই বেশ বিস্মিত হয়েছিলো। রোভার্সের হয়েও তেমন আহামরি পারফর্ম করেননি জেনিংস।
১৯ বছর বয়সী জেনিংস ২০১০-১১ মৌসুমে ২৯ ম্যাচ খেলে ট্রানমেয়ার রোভার্সের হয়ে গোল করেন ৬টি। আর তাতেই ২০১১ সালে তাকে দলে ভেড়ায় বাভারিয়ানরা। তবে দুই মৌসুম ধরে বায়ার্নের বি দলে খেলার পর জেনিংস ফেরত আসেন প্রিমিয়ার লিগেই। লিভারপুল একাডেমিতে বেড়ে ওঠা জেনিংস ফিরতি দলবদলে যোগ দেন বার্নসলিতে।
জন বস্টক
টটেনহাম থেকে রয়্যাল এন্টওয়ার্প
ফি – ফ্রি ট্রান্সফার
নিজেদের যুব একাডেমির খেলোয়াড় বিক্রয় করে বেশ অর্থকড়ি আয় করে ক্রিস্টাল প্যালেস। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো উইলফ্রেড জাহা, নাথানিয়েল ক্লাইন, ভিক্টর মোজেস প্রমুখ। তবে সবচেয়ে তারকা যাকে ভাবা হচ্ছিলো, সেই জন বস্টকই নিজের নামের প্রতি সুবিচার করতে পারেননি।
মাত্র ১৫ বছর বয়সেই ক্রিস্টাল প্যালেসের হয়ে অভিষেক হয় বস্টকের। তারপর তাকে নিয়ে ক্লাবের টানাহেঁচড়ায় টটেনহামে যোগ দেন তিনি। কিন্তু টটেনহামে নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী পারফর্ম করতে পারেননি তিনি। নিজের ক্যারিয়ারকে আবার মেলে ধরতে এবার বেলজিয়ান ক্লাব রয়্যাল এন্টওয়ার্পে পাড়ি জমান বস্টক। সেখানে ৫৮ ম্যাচে ২০ গোল করেন এই ফুটবলার।
বেলজিয়াম থেকে বস্টক পরবর্তীতে পাড়ি জমান ফ্রান্সে। ২০১৬ সালে যোগ দেন ফ্রান্সের ক্লাব লেন্সে। প্রথম মৌসুমে লেন্সের হয়ে ৩২ ম্যাচ খেললেও দ্বিতীয় মৌসুমে দলে অনিয়মিত হয়ে পড়েন। তাই ক্লাব ছেড়ে যোগ দেন তুরস্কের বুরসাস্পরে। তবে সেখান থেকে আবার ফ্রান্সেই ফিরে আসেন। বর্তমানে আছেন ফ্রান্সের ক্লাব তুলুজে।
মাইকেল মানচিয়েন
চেলসি থেকে হামবুর্গ
ফি – ১.৭৫ মিলিয়ন ইউরো
ডিফেন্সে জন টেরির যোগ্য সঙ্গী হিসেবে মানচিয়েনকে ধরা হলেও নিজেকে সেই পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারেননি তিনি। তিন বছর ধরে উলভসে ধারে থাকার পর ২০১১ সালে স্থায়ীভাবে ব্লুজ ছাড়েন তিনি। ২ মিলিয়ন ইউরোর কিছু কমে যোগ দেন জার্মান ক্লাব হামবুর্গে।
তিন মৌসুম হামবুর্গে থাকার পর ২০১৪ সালে অবশ্য আবার ইংল্যান্ডে এই ফিরে আসেন মানচিয়েন। যোগ দেন নটিংহ্যাম ফরেস্টে। ভালো পারফর্ম না করলেও নটিংহ্যাম ফরেস্টের হয়ে শতাধিক ম্যাচ খেলে ফেলেন মানচিয়েন। বর্তমানে রক্ষণভাগের এই খেলোয়াড় খেলছেন এমএলএসে।
এরিক ডায়ার
এভারটন থেকে স্পোর্টিং সিপি
ফি – ধারে
মাত্র ৭ বছর বয়সেই পর্তুগালে পাড়ি জমিয়েছিলেন এরিক ডায়ার। ১০ বছর বয়স পর্যন্ত স্পোর্টিংয়ের একাডেমিতে ছিলেন। পেশাদার ফুটবলে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার পরপরই ধারে এভারটনে যোগ দেন তিনি। কিন্তু ইংল্যান্ডে থিতু হতে সমস্যা হওয়ায় স্পোর্টিং সিপিতেই ফিরে যান তিনি।
২০১৪ সালে টটেনহাম ম্যানেজার মাউরিসিও পচেত্তিনোর চোখে পড়েন ডায়ার। সেই বছরই তাকে পচেত্তিনো উড়িয়ে আনেন হোয়াইট হার্ট লেনে। প্রথম মৌসুমে বিভিন্ন পজিশনে খেললেও পরবর্তীতে হোল্ডিং মিডফিল্ডে নিয়মিত হয়ে ওঠেন তিনি, ডাক পান ইংল্যান্ডের জাতীয় দলেও। ইংল্যান্ডের হয়ে এখন পর্যন্ত খেলেছেন ৩৮টি ম্যাচ।
বর্তমানে ফুটবলের এই পজিশনে অন্যতম একজন ভবিষ্যৎ তারকা বিবেচনা করা হয় এরিক ডায়ারকে।
জ্যাডোন সাঞ্চো
ম্যানচেস্টার সিটি থেকে বরুশিয়া ডর্টমুন্ড
ফি – ৭ মিলিয়ন ইউরো
প্রতিভাবান হওয়া সত্ত্বেও ম্যানচেস্টার সিটির মূল দলে জায়গা না পাওয়ায় ২০১৭ সালের আগস্টে নিজেই ক্লাব ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন। যোগ দেন জার্মান ক্লাব বরুশিয়া ডর্টমুন্ডে। প্রথম মৌসুমে ৪ গোল এবং ১টি অ্যাসিস্ট করলেও সেবার মাত্র ১২টি ম্যাচ খেলেছেলিন সাঞ্চো।
তবে এই মৌসুমে শুরু থেকেই সবাইকে মুগ্ধ করে এসেছেন এই তরুণ সেনশেসন। মাত্র ১৮ ম্যাচ খেলেই এখন পর্যন্ত ডর্টমুন্ডের হয়ে ৫টি গোলের পাশাপাশি ৮টি অ্যাসিস্টও করেন সাঞ্চো। ইংল্যান্ডের হয়েও ইতিমধ্যে খেলেছেন ৩টি ম্যাচ।
এত দ্রুত বলা বাড়াবাড়ি হয়ে গেলেও বলা যায়, সাঞ্চো হতে যাচ্ছেন পরবর্তী প্রজন্মের বড় একজন তারকা।