
ব্রুস ইয়ার্ডলির রেকর্ডটা ভাঙা হলো ২০১৭ সালে। মানে এই তো, সেদিনের মতো। মাত্র ২৯ বলে টেস্টে হাফ সেঞ্চুরি করে অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে দ্রুততম টেস্ট হাফ সেঞ্চুরির রেকর্ড গড়েছিলেন ইয়ার্ডলি। সেই রেকর্ড অক্ষত ছিল ৩৮টি বছর!
ইয়ার্ডলি হালের কোনো ক্রিকেটার নন। তিনি অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসের অন্যতম কিংবদন্তি স্পিনার হতে পারতেন। সে যোগ্যতাও তার ছিল। কিন্তু অস্ট্রেলিয়া নিজেই ইয়ার্ডলিকে সেই সুযোগ দেয়নি। ১৯৭৮ সালে অভিষেক করে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত ছিল তার জাতীয় দলের ক্যারিয়ার। যে সময়ে ৩৩ টেস্টে সুযোগ পেয়ে অফস্পিনার হিসেবে তুলে নিয়েছিলেন ১২৬ উইকেট। ৭ ওয়ানডে ম্যাচে ৭ উইকেট। ইয়ার্ডলি লোয়ার অর্ডারে ব্যাট হাতে বেশ সফল ছিলেন। টেস্টে ৯৭৮ রান তুলতে গিয়ে চারটি হাফ সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন, সর্বোচ্চ রানের ইনিংসটি ছিল ৭৪। ইয়ার্ডলি প্রথম শ্রেণীতে ১০৫ ম্যাচ খেলে ৩৪৪ উইকেট নেওয়া ক্রিকেটার। পুরনো বলে তার সফলতা ছিল হিংসা করার মতোই।

ক্যারিয়ারে অনেকদূর যাওয়ার মতো পাথেয় তার ছিল। কিন্তু হয়নি। দিন শেষে, নিজের স্বপ্নটা পূরণ করার চেষ্টা করেছেন কোচ হিসেবে। ১৯৯৬ বিশ্বকাপে যখন শ্রীলঙ্কা ট্রফি জিতলো, তারপর জাতীয় দলের কোচের দায়িত্ব পেলেন ইয়ার্ডলি। এশিয়ার এই পরাশক্তির সঙ্গে কাজ করেছেন ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত।
শ্রীলঙ্কার হয়ে ইয়ার্ডলির সবচেয়ে বড় সাফল্য ছিল কিংবদন্তি মুত্তিয়া মুরালিধরনকে উঠিয়ে আনা। একজন স্কুলবালককে বৈশ্বিক টেস্ট জগতে ছেড়ে দেওয়া চাট্টিখানি কথা ছিল না। অস্ট্রেলিয়ান ইয়ার্ডলি নিজে অফস্পিনার ছিলেন বলেই বোধ হয় মুরালির ঐশ্বরিক প্রতিভাটা টের পেয়েছিলেন। কোচের দায়িত্ব ছাড়ার পরও অনেকটা সময় ইয়ার্ডলির সঙ্গ পেয়েছিলেন মুরালিধরন।
সেই ব্রুস ইয়ার্ডলি জীবনের মায়া কাটিয়েছেন গেল ২৭ মার্চ। দীর্ঘদিন ক্যান্সারে ভোগার পর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন তিনি। তার মৃত্যুতে তার প্রিয় ছাত্র মুরালিধরনের পক্ষে সহজে শোক কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। তবে এই সুযোগে ইয়ার্ডলি তার জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কীভাবে একজন ব্রুস ইয়ার্ডলির হাত ধরে আজকের কিংবদন্তি মুত্তিয়া মুরালিধরন হয়ে ওঠা, সেই বর্ণনা তিনি দিতে ভোলেননি।
আমার ক্যারিয়ারে ব্রুস ইয়ার্ডলির অসামান্য প্রভাব রয়েছে। আমি তাকে প্রথম দেখি ১৮ বছর বয়সে। সেবার আমি আমার স্কুল থেকে শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট আয়োজিত স্পিন ক্যাম্পের জন্য নির্বাচিত হয়েছিলাম। আর ক্যাম্পের জন্য আমাকে নির্বাচিত করেছিলেন অস্ট্রেলিয়ান ইয়ার্ডলি। ক্যাম্প যখন শেষ হলো, তিনি আমাকে বলেছিলেন আমি নাকি শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটের সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিশীল ক্রিকেটার হতে যাচ্ছি। সেই যে স্কুল থেকে তিনি আমাকে তুলে নিয়ে এলেন, তারপর থেকেই; আমার ক্রিকেটের প্রতিটি পদক্ষেপে তার কিছু না কিছু প্রভাব ছিলোই।
আর আমিও, দীর্ঘদিন যাবৎ তাকে সেরা জ্ঞান করতাম। কারণ, তিনি ছিলেন আমার জীবনের প্রথম ব্যক্তি যিনি বিশ্বাস করতেন সেই ১৮ বছর বয়স থেকেই আমি টেস্ট ক্রিকেট খেলার যোগ্যতা রাখি। তিনি বিশ্বাস করতেন আমি ভালো কিছু করতে পারি।

বোলিংয়ে ব্রুস ইয়ার্ডলি; Image Source: Getty Image
১৯৯৬ বিশ্বকাপের পর বছর দুয়েকের জন্য শ্রীলঙ্কা জাতীয় দলের অন্তর্বর্তীকালীন কোচ হয়েছিলেন ব্রুস ইয়ার্ডলি। ফলাফল, আবারও আমি আমার প্রিয় কোচের সঙ্গে জুটি বাঁধার সুযোগ পেয়ে গেলাম। একটা কথা না বললেই নয়, ১৯৯৭ সালে নিউজিল্যান্ডের ঘটনায় তিনি আমার পাশে ছিলেন। আমরা সেবার কুইন্সটাউনে একটা অনুশীলন ম্যাচ খেলেছিলাম। ইয়ার্ডলি আমার কাছে এসে বললেন, “মুরালি, তুমি কিছু একটা ছেড়ে যাচ্ছো। ‘এরাউন্ড দ্য উইকেট’ না গিয়ে তুমি তোমার বোলিংয়ের বৈচিত্র্যগুলোকে কাজে লাগাচ্ছো না। তুমি চাইলে তোমার অ্যাকশন থেকে শুরু করে বোলিংয়ে অনেক বেশি বৈচিত্র্য আনতে পারো, এমনকি এলবিডব্লিউতেও!“

মুত্তিয়া মুরালিধরন; Image Sourece: skysports.com
ইয়ার্ডলি আমাকে এই কাজগুলো করার জন্য বারবার চাপ দিয়েছেন। আমিও বাধ্য হয়ে মেনেছি। যা আমাকে এনে দিয়েছে অনেক অনেক উইকেট শিকারের গৌরব।
একজন অফস্পিনার থেকে আরেকজন, তিনি (ইয়ার্ডলি) আমাকে শিখিয়েছিলেন কীভাবে বোলিংয়ে অ্যাঙ্গেলগুলো ব্যবহার করতে হয়। আমিও পরবর্তী স্পিনারদের শেখাতে গেলে এভাবেই শেখাই। আমি তার থেকে অনেক কিছু শিখেছি- কীভাবে ‘এরাউন্ড দ্য উইকেট’ বল করতে হয়, কীভাবে বোলিংয়ের সময় বলের গতি নিয়ন্ত্রণ করতে হয়; এমন নানান কৌশল তিনি আমাকে শিখিয়েছিলেন।
আমার দুসরা করার পেছনেও ব্রুস ইয়ার্ডলির তাড়না সবচেয়ে বেশি ছিল। আমি অবশ্য সাকলাইন মুশতাককে এই জিনিস করতে দেখতাম। তারপর যখন ইয়ার্ডলি আমাদের দলের কোচ হয়ে এলেন, তিনি আমাকে শিখিয়েছিলেন কীভাবে এই দুসরা বল করতে হয়। পুরো ব্যাপারটা আয়ত্ব করতে আমার চার বছর লেগে যায়। এমনকি যখন আমার বোলিং অ্যাকশনের বৈধতা নিয়ে বিতর্ক চলছে, তখন তিনি চাইলে বন্ধু হিসেবে আমার পাশে না-ও থাকতে পারতেন। কিন্তু তিনি জানতেন আমার অ্যাকশনে কোনো ধরনের কৃত্রিমতা ছিল না। সবকিছু মিলিয়েই আমি অ্যাকশনের পরীক্ষা দেই। ইয়ার্ডলি আমার উপর বিশ্বাসটা রেখেছিলেন।

অস্ট্রেলিয়ান বোলার হিসেবে নিজের দেশে সঠিক মূল্যায়ন পাননি তিনি। তিনি তার দেশে সেই সময়ে একমাত্র স্পিনার ছিলেন, যিনি কি না বেনসন এন্ড হেজেস ওয়ার্ল্ড সিরিজে ‘ম্যান অব দ্য সিরিজ’ পুরস্কার জয় করার গৌরব অর্জন করেছিলেন। খুব বেশি ক্রিকেটার এমন অর্জনের পাশে নিজেদের নাম লেখার সৌভাগ্য পায়নি। যখনই তিনি খেলার সুযোগ পেয়েছেন, অস্ট্রেলিয়ার জন্য সেরা পারফরম্যান্সটা দিয়েই মাঠ ছেড়েছেন।
ইয়ার্ডলি খুবই ভালো মনের মানুষ ও ভালো কোচ ছিলেন। তিনি শ্রীলঙ্কার দায়িত্ব ছাড়ার পরও দীর্ঘদিন তার সাথে আমার যোগাযোগ ছিল। আমাদের মধ্যে বোঝাপড়ার সম্পর্কটাও সেই শুরু থেকে দেখার মতো। এমনকি দায়িত্ব ছাড়ার পর তার সাথে আমার প্রায়ই সাক্ষাৎ হতো। যখনই আমি পার্থে যেতাম, কিংবা তিনি শ্রীলঙ্কায় আসতেন; সেসব মুহূর্তগুলো আমরা উপভোগ করতাম। আমি দেখেছি, তিনি খুব সুখী জীবন কাটাতেন। সহজ ও সুন্দর। তিনি সারা বিশ্বে বেড়াতে পছন্দ করতেন। তার সময়ের সেরা কোচ ও ধারাভাষ্যকার হিসেবে তার বেশ সুখ্যাতি ছিলো। দুর্ভাগ্যবশত তার ক্যান্সার ধরা পড়লো। তিনি আরও ভালো কিছু করতে পারতেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও এটাই জীবনের নিয়ম যে, একদিন সবাইকে চলে যেতে হয়।

তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। তার চলে যাওয়ার দিন আমি সকালে আমি জানতে পারি। আমার কাছে একটি ক্ষুদেবার্তা আসে, আমি তার মেয়ের সাথে কথাও বলি। ব্রুস ইয়ার্ড মজা করতে খুব পছন্দ করতেন। সাধারণ, সুন্দর ও সুখী একটা জীবনই ছিল তার একমাত্র চাওয়া। তিনি মারা যাওয়ার আগে তার মেয়ে ও পরিবারকে বলে গিয়েছিলেন, “আমি যখন মারা যাবো, তোমরা আমার কোন অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া করো না। তার চাইতে বরং বড় একটা পার্টি করো। কারণ আমি আমার জীবনকে উপভোগ করেছি। তাই আমি চাই না কেউ এমন দিনে কষ্ট পাক আমার জন্য।”
ব্রুস ইয়ার্ডলি ঠিক এমন মানুষই ছিলেন। সত্যিই তার পরিবার তার মৃত্যুতে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পরিবর্তে পার্টির আয়োজন করেছে।
দিন শেষে, ইয়ার্ডলি ছিলেন সুখী মানুষ