মাঝমাঠ থেকে ডিফেন্স চেরা একটা পাস, চোখ ধাঁধানো একটা গোল কিংবা মুগ্ধ করে দেওয়া একটু গোলের সহায়তা; চিরচেনা ফ্রাঙ্ক ল্যাম্পার্ডকে এমন কোনো ভূমিকায় আর দেখা যাবে না।
মাঠের সীমানা পার করে চলে এসেছেন ল্যাম্পার্ড ডাগ আউটে। এখন তিনি ইংলিশ চ্যাম্পিয়নশিপের দল ডার্বি কাউন্টির কোচ।
ল্যাম্পার্ডকে এই অবধি আসতে কম কাঠ খড় পোড়াতে হয়নি। দীর্ঘ এক খেলোয়াড়ী ক্যারিয়ারের মালিক তিনি। ১৯৯৫ সালে ওয়েস্ট হ্যামের হয়ে শুরু করেছিলেন ফুটবল। এরপর ২০০১ সালে যোগ দেন চেলসিতে। পরের প্রায় দেড় দশক, ১৪ বছর তিনি চেলসির হয়ে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ মাতিয়ে রেখেছেন।
চেলসির হয়ে শিরোপা জিতেছেন, করেছেন রেকর্ডের পর রেকর্ড। দলটির ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতা তিনি, প্রিমিয়ার লিগের ইতিহাসের চতুর্থ সর্বোচ্চ অ্যাসিস্ট তার। চেলসির হয়ে আস্তে আস্তে নিজেকে একজন কিংবদন্তী করে তুলেছেন। স্টিভেন জেরার্ডের সাথে তার জুটি ছিলো এক গল্পের বিষয়।
ইংল্যান্ড জাতীয় দলের হয়েও বর্নাঢ্য ক্যারিয়ার ছিলো। ১৫ বছর খেলেছেন জাতীয় দলের হয়ে। ইংল্যান্ডের হয়ে ২৯ গোল করার পাশাপাশি দলটির ইতিহাসের সর্বোচ্চ ৯টি গোল করেছেন পেনাল্টি থেকে।
২০১৪ সালে চেলসি ছেড়ে নিজে কেঁদে এবং অনেককে কাঁদিয়ে যোগ দেন ম্যানচেস্টার সিটিতে। আর ক্যারিয়ার শেষ করেছেন একই মালিকানার নিউইয়র্ক সিটিতে।
খেলোয়াড়ী জীবনে থাকতেই শুরু করেছিলেন কোচিংয়ে আসার পরিকল্পনা। সেই পরিকল্পনা আস্তে আস্তে বাস্তবে রূপ পেয়েছে। খেলা ছাড়ার দুই বছর পর এবার তিনি পৌঁছে গেছেন একটি দলের এক নম্বর কোচের চেয়ারে।
নিজের কোচিং দর্শন, কী চান, কেমন দল চান; এসব নিয়ে কথা বলেছেন ইংলিশ কিংবদন্তী ফ্রাঙ্ক ল্যাম্পার্ড
কোচিংয়ে কেনো এলেন?
এমন না যে, আমি একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠলাম আর এই সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি আমার খেলোয়াড়ী জীবন থেকেই এটার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলাম। ফুটবল সবসময়ই আমার জীবন। আমি ফুটবলীয় একটা পরিবারে বড় হয়ে উঠেছি। অনেক লম্বা একটা ফুটবল ক্যারিয়ার ছিলো। আমার বয়স যখন বিশের কোটায় ছিলো, তখন আমি ভবিষ্যত নিয়ে খুব বেশি ভাবতাম। কিন্তু তিরিশের কোটায় এসে আমার দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্যই বদলে গিয়েছিলো। এই সময়ে আমি যত কোচের অধীনে খেলেছি, তাদের কাছ থেকে নেওয়ার চেষ্টা করেছি। আমি যেসব সতীর্থর সাথে খেলেছি, তাদের কাছ থেকেও শেখার চেষ্টা করেছি। শেষ অবধি সুযোগটা যখন এলো, তখন অবশ্যই ‘হ্যাঁ’ বলতে হতো।
ডার্বিকে কেন বেছে নিলেন কোচিং করানোর জন্য?
ওরা আমার কাছে এসেছিলো। আর ওদের আসাটা খুব কঠিন ছিলো না। কারণ, ওদের ক্লাবের আকারটা তো আমরা জানি। আমি জানি ওদের স্টেডিয়াম কেমন, ওদের ট্রেনিং সুবিধা কেমন এবং কী অবকাঠামো ওদের কাছে। আমি জানি, ওরা ১০ বছর ধরে প্রিমিয়ার লিগের বাইরে আছে। কিন্তু আমি প্রথম যেদিন ডার্বিতে গেলাম, ওদের ওখানে আবেগটা দেখেই আটকে গেছি। শহরের সমর্থকরা যে কী নিবিঢ়ভাবে ক্লাবটাকে ভালোবাসে, এদের কাছে এই ক্লাবের অর্থ কী; এটা বুঝতে পারলাম। আমি এরপর যত জায়গা থেকে পরামর্শ নেওয়ার তা নিয়েছি। আর সব শেষে আমি দ্রুত ওদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছি।
আপনার স্বপ্ন কী এই পেশায়?
২১ বছর খেলার পর আমি এখানে এসেছি। সাবেক খেলোয়াড়দের কী কাজ করা উচিত, এ নিয়ে অনেক তর্ক হয়েছে। আমি আর স্টিভেন জেরার্ড প্রায় একই রকম সময় ধরে ফুটবল খেলেছি। এটা অস্বীকার করছি না যে, দীর্ঘ এই ক্যারিয়ার আমাদের কিছুটা হলেও বোঝাপড়ার ক্ষমতা দিয়েছে। সেই সাথে আমরা যাতে একটা চাকরির প্রস্তাব পেতে পারি, সে জন্য অনেক পরিশ্রমও করেছি। আমার কোনো ভ্রান্তি বিলাস নেই। আমি জানি, আমাকে ফলাফল দিয়ে বিচার করা হবে, আমার কোচিং স্টাইল দিয়ে বিচার করা হবে। কিন্তু সেই অবধি যেতে আমাকে অনেক পরিশ্রম করতে হবে। আশা করি, আমি আমার কাজের স্টাইল দিয়ে কিছু একটা পার্থক্য এখানে গড়ে দিতে পারবো। শুধু আমি নয়, আমার স্টাফরা সবাই মিলে এটা করবো। আমরা কোথায় যেতে চাই, সে জন্য কী করতে চাই; এটাই গুরুত্বপূর্ণ।
অন্যদের কাছ থেকে কী শেখেন?
অবশ্যই। আমি তেমনই একজন। আমি আমার জীবনের প্রতিটা ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতি থেকে শেখার চেষ্টা করেছি। আমার যেসব কোচ ঘনিষ্ঠ ছিলেন, যেসব কোচ ঘনিষ্ঠ ছিলেন না, যেসব বিষয়ে আমি একমত হয়েছি, যেসব বিষয়ে আমি একমত হইনি; বছরের পর বছর এর প্রতিটা ব্যাপার থেকে আমি শিখেছি। তবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, এসবের মধ্যে নিজের ব্যক্তিত্বকে ধরে রাখা। কোনো একজন কোচের প্রতিলিপি হওয়ার চেয়ে আমি আমার নিজের একটা ব্যক্তিত্ব তৈরিতে আগ্রহী। আমি আমার নিজের স্টাইলের ব্যবস্থাপনা তৈরি করতে চাই, নিজে একটা আচড় কেটে রাখতে চাই। আমি কখনোই তাই বলে শেখা বন্ধ করবো না। আমি নিজে কিছু আইডিয়া নিয়ে শুরু করবো। কিন্তু আমাকে উন্নতি করতে থাকতে হবে এবং শুনতে হবে। লোকেদের কাছ থেকে গ্রহণ করতে হবে। আমার এই দীর্ঘ পরিকল্পনার বছরগুলোতে আশা করি এমন কিছু তথ্য ও রসদ আমি জমাতে পেরেছি, যা এখন ব্যবহার করতে পারবো।
আপনার দলের ধরণ কেমন হবে?
অবশ্যই কঠোর পরিশ্রমী। আমি খেলোয়াড় হিসেবে যেমন ছিলাম। আমার সবসময় কঠোর পরিশ্রমের একটা নীতি ছিলো। আমি যে ফুটবল পরিবারে বড় হয়ে উঠেছি, সেখান থেকেই আমি এটা শিখেছি। আমার দলের ক্ষেত্রে আমি চাই এটা তাদের ভিত্তি হোক। আমি চাইবো তারা আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলুক, আগ্রাসী ফুটবল খেলুক, আমি চাইবো তারা সুন্দর ফুটবল খেলুক, দ্রুতগতির ফুটবল খেলুক। আমি অবশ্য সুন্দর মানেই টিকিটাকা বোঝাতে চাচ্ছি না। তবে আমি চাই খেলোয়াড়দের মধ্যে সেই শক্তিটা থাকুক। তারা যেন যেকোনো জায়গায় খেললে সমর্থকদের রোমাঞ্চিত করতে পারে। আমি সোজা কথায় শক্তি চাই, কঠোর পরিশ্রম চাই এবং আক্রমণ চাই।
আপনার কোচিং স্টাইল কী হবে?
এটা কঠিন বলা। আমার ওপর এখনও কোনো ক্যামেরা এসে দাঁড়ায়নি। আমি স্রেফ প্রাক মৌসুম ফুটবল খেলিয়েছি। আমি বলবো না যে, আমি খুব লাফালাফি পছন্দ করি। এমন একজন কোচও না যে, খুব ওঠাবসা করবো সাইডলাইনে। তবে আমি মাঠে যতটুকু প্রভাব ফেলা যায়, সেটা ফেলার চেষ্টা করবো। যদি এমন হয় যে, ওঠাবসার ভেতর দিয়ে খেলোয়াড়দের সাথে আমার যোগাযোগ আরও ভালো হচ্ছে, আমি সেটাই করবো। এটা আসলে আপনাকে নিজেকেই দেখতে হবে যে, আমি কেমন করি। তবে আমার মনে হয় না যে, আমি প্রকৃতিগতভাবে খুব বেশি লাফালাফি করা বা বেঞ্চে ওঠাবসা করা মানুষ।
ডার্বিকে নিয়ে আপনার প্রত্যাশাটা কী?
খুব কঠিন প্রশ্ন। অবশ্যই প্রমোশন মূল লক্ষ্য। চ্যাম্পিয়নশিপে যতগুলো ক্লাব অংশ নিচ্ছে, সবারই লক্ষ্য এটা। কিন্তু আমরা আসলে ধাপে ধাপে এগোতে চাই। আমরা দলের যা সামর্থ্য আছে, তার সেরাটা মাঠে দিতে চাই। সোজা কথা হলো, আমরা যত পারি, ততটা উপরে উঠতে চাই। আমরা প্রমোশন চাই। কারণ, এটা একটা প্রিমিয়ার লিগের ক্লাব। আমাদেরকে সেই লক্ষ্য নিয়েই শুরু করতে হবে। খেলোয়াড়রা এটা জানে। আমরা এখানে সবাই মিলে এটা চাচ্ছি। এই স্টাফ, খেলোয়াড়, বিল্ডিং- সবকিছুর চাওয়া একটাই। আমরা ক্লাবকে প্রিমিয়ার লিগে দেখতে চাই।