ক্রিকেটকে বলা হয় ‘জেন্টলম্যান গেম’। কিন্তু অন্যান্য খেলাগুলোর মতোই ক্রিকেটও জন্ম দিয়েছে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার। স্বাভাবিকভাবেই এইসব বিরূপ ঘটনার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচনা ও সমালোচনার মুখে পড়েছে বিশ্বকাপের মতো বড় মঞ্চে ঘটে যাওয়া কিছু কাহিনী। আজ আমরা আসন্ন বিশ্বকাপ উপলক্ষ্যে পেছন ফিরে দেখবো ক্রিকেট বিশ্বকাপে ঘটে যাওয়া কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা।
ইডেন গার্ডেনে দাঙ্গা
১৯৯৬ বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল। দুই এশিয়ান পরাশক্তি শ্রীলঙ্কা ও ভারত মুখোমুখি হয় কলকাতার ইডেন গার্ডেনে। প্রথমে ব্যাট করতে নেমে শ্রীলঙ্কা সংগ্রহ করে ২৫১ রান। ২৫২ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে ভারতের ব্যাটিং লাইনআপ। এক পর্যায়ে স্কোরলাইন হয়ে যায় ৮ উইকেটে ১২০ রান।
ভারতের এই নির্মম হার মেনে নিতে পারছিলেন না কলকাতার দর্শকেরা। আর তাতেই ক্ষুব্ধ ভারতীয় সমর্থক মাঠের ভেতর বোতল ছুড়ে মারতে শুরু করেন। স্ট্যান্ডিংয়ে লাগিয়ে দেন আগুন। পুরো স্টেডিয়ামে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে গেলে ১৫ মিনিটের জন্য খেলা বন্ধ রাখেন ম্যাচ রেফারি ক্লাইভ লয়েড। কিন্তু ক্ষুব্ধ জনতা নিয়ন্ত্রনের বাইরেই চলে যায়। নিরাপত্তাকর্মীরাও তাদের শান্ত করতে ব্যর্থ হন। তাই খেলা বাতিল করে শ্রীলঙ্কাকে বিজয়ী দল ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে সেবার রানাতুঙ্গার নেতৃত্বে সেবার বিশ্বচ্যাম্পিয়নই হয় শ্রীলঙ্কা।
গণতন্ত্রের মৃত্যু
২০০৩ বিশ্বকাপ আয়োজক তিন দেশের মধ্যে একটি ছিল জিম্বাবুয়ে। কিন্তু সেই সময় রবার্ট মুগাবে’র নেতৃত্বে জিম্বাবুয়ের অবস্থা ছিলো টালমাটাল। রবার্ট মুগাবে’র বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার মোক্ষম সুযোগ বেছে নেন জিম্বাবুয়ের অধিনায়ক অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার ও হেনরি ওলোঙ্গা। নিজেদের প্রথম ম্যাচে বাহুতে কালো ফিতা বেঁধে মাঠে নামেন এই দুইজন। আর এর কারণ হিসেবে তারা উল্লেখ করেন, গণতন্ত্রের মৃত্যুর প্রতীক হিসেবে তারা কালো আর্মব্যান্ড পড়েছেন।
অন্যদিকে, এই অবস্থা দেখে ইংল্যান্ড নিরাপত্তার কথা ভেবে জিম্বাবুয়ের সাথে ম্যাচ খেলতে অস্বীকৃতি জানায়। আর এই ওয়াকওভার পেয়ে ২০০৩ বিশ্বকাপে সুপার সিক্সেও পৌঁছে যায় জিম্বাবুয়ে।
অন্ধকারে ফাইনাল
২০০৭ বিশ্বকাপ ফাইনালে মুখোমুখি হয় অস্ট্রেলিয়া ও শ্রীলঙ্কা। কেনসিংটন ওভালে শুরু হওয়া ম্যাচের শুরুতেই বাগড়া দেয় বেরসিক বৃষ্টি। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, কেনসিংটন ওভালের সেই মাঠে ছিল না কোনো ফ্লাডলাইটও। অন্যদিকে, কতৃপক্ষ ফাইনালের জন্য কোনো রিজার্ভ ডে-ও রাখেনি যে খেলাটি অন্য কোনোদিন হবে।
কিছুক্ষণ পর বৃষ্টি থেমে এলে খেলা ৩৮ ওভারে নামিয়ে আনা হয়। সেই ৩৮ ওভারেই গিলক্রিস্টের ব্যাটিং তান্ডবে অস্ট্রেলিয়া দাঁড় করায় ২৮১ রানের সংগ্রহ। কিন্তু শ্রীলঙ্কার ব্যাটিংয়ের সময় পুরো আকাশ অন্ধকারে ছেয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত দুই অধিনায়ক জয়াবর্ধনে ও পন্টিং মিলে সেই সময় থেকে স্পিনারদের দিয়ে বল করানোর সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তাতেও ঠিকঠাক বল দেখা যাচ্ছিল না। সেই তিন ওভারে শ্রীলঙ্কা তুলতে পারে মাত্র ৯ রান। পরবর্তীতে খেলা সেখানে থামিয়ে দিয়ে ডাকওয়ার্থ লুইস পদ্ধতিতে অস্ট্রেলিয়াকে ৫৩ রানে জয়ী ঘোষণা করা হয়।
কিন্তু পুরো ঘটনার জন্য সমালোচনার মুখে পড়তে হয় আইসিসিকে। পরের বছর অনুষ্ঠিত হওয়া টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সেদিনের ফাইনালে থাকা তিন আম্পায়ার; স্টিভ বাকনার, আলীম দার ও বিলি বাউডেনকে সেই টুর্নামেন্টের জন্য বরখাস্ত করা হয়।
২০১১ বিশ্বকাপ ট্রফি: আসল, নাকি নকল ?
২৮ বছর পর ভারতের সামনে সুযোগ আসে আইসিসি ওয়ার্ল্ড কাপ ট্রফি উঁচিয়ে ধরার। কিন্তু সেই ট্রফি নিয়েও শুরু হয় বিতর্ক। কিছু রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতকে সেবার ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল একটি রেপ্লিকা শিরোপা।
ইন্ডিয়া টুডে জানায়, আসল শিরোপাটি সরকারের গোডাউনে রাখা ছিল। শ্রীলঙ্কা বনাম নিউজিল্যান্ড সেমিফাইনালের পর ২৯ মার্চ ট্রফিটি কলম্বো থেকে মুম্বাই আসার পর সেটি মুম্বাই কাস্টমস অফিস রেখে দেয়। সেখান থেকে সেটি চলে যায় সরকারী গোডাউনে।
ইন্ডিয়া টুডে’কে পরবর্তীতে আইসিসি প্রেসিডেন্ট হারুন লরগাত বলেন যে, মিডিয়ার রিপোর্টে তিনি যারপরনাই মর্মাহত হয়েছেন। কারণ ভারতকে যে ট্রফি দেওয়ার কথা, সেটিই দেওয়া হয়েছে।
তার এই কথাতেই সবাই গলদ খুঁজে নেয়। তার মানে কি ভারতকে রেপ্লিকা ট্রফি দেওয়ারই কথা ছিল? হারুন লরগাত বলেন যে, কাস্টমস অফিসে থাকা ট্রফিটি ছিল রেপ্লিকা আর ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে ছিল আসল শিরোপা। কিন্তু প্রশ্ন ছিল, নকল ট্রফিই বা আনার কি হেতু ছিল। অন্যদিকে, আইসিসির আসল ট্রফির নিচের বেসমেন্টে প্রতি আসরের জয়ীদের নাম খোদাই করা থাকে। কিন্তু ভারতকে দেওয়া ট্রফিতে সেই বেসমেন্ট ছিল সম্পূর্ণ ফাঁকা। এই ব্যাপারটি তখন ব্যাখ্যা না করে এড়িয়ে গিয়েছিলেন হারুন লরগাত।
বৃষ্টি আইন
১৯৯২ বিশ্বকাপে সর্বপ্রথম রঙিন পোশাকে ওয়ানডে ক্রিকেট খেলা শুরু হয়। আর এই বিশ্বকাপেই প্রথমবারের মতো বৃষ্টি আইন চালু হয়। এই নিয়ম আসার আগে বৃষ্টিতে পড়লে যত ওভার কাটা যেত, তা দিয়ে প্রতিপক্ষের পার ওভার রানকে গুণ করে মোট লক্ষ্য থেকে বাদ দেওয়া হতো। তবে এই প্রথায় দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করা দলগুলোর জন্য কিছুটা অনিয়ম হয়ে যেতো। তাই এজন্য আবিষ্কার করা হয় বৃষ্টি আইন।
তবে প্রথমবারই তুমুল সমালোচনার জন্ম দেয় এটি। সেমিফাইনালে সেবার মুখোমুখি হয় দক্ষিণ আফ্রিকা ও ইংল্যান্ড। ৪৫ ওভারে ইংল্যান্ড আগে ব্যাট করে সংগ্রহ করে ৬ উইকেটে ২৫২ রান। স্লো বোলিংয়ের জন্য ইংল্যান্ডের খেলা থামিয়ে দেওয়া হয় ৪৫ ওভারেই।
লক্ষ্যে ব্যাটিং করতে নেমে ঠিকমতোই এগোচ্ছিল প্রোটিয়ারা। কিন্তু যখন ১৩ বলে প্রয়োজন ২২ রানের, ঠিক সেই সময় তুমুল বৃষ্টি হানা দেয়। তাই খেলা বন্ধ থাকে কিছুক্ষণ। পরবর্তীতে খেলা মাঠে গড়াতেই চক্ষু ছানাবড়া হয়ে যায় প্রোটিয়াদের। স্কোরবোর্ডে তখন দেখাচ্ছিল, জিততে হলে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রয়োজন ১ বলে ২২ রান! বৃষ্টি আইনে ২ ওভার কাটা হলেও রানের কোনো হেরফের হয়নি। এই নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয় যে, চাইলেই শেষ দুই ওভার খেলাতে পারতেন আম্পায়াররা। এমনকি পুরো খেলা শেষ হয়ে যাওয়ার পরও নির্ধারিত সময়ের আরো ২ মিনিট তখনও হাতে ছিল।
শেন ওয়ার্নের নিষেধাজ্ঞা
সম্ভবত সবচেয়ে হাস্যকর কাহিনী ছিল শেন ওয়ার্নের নিষেধাজ্ঞা। ২০০৩ বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়া মূল দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন এই কিংবদন্তি লেগ স্পিনার। কিন্তু টুর্নামেন্ট শুরুর একদিন আগেই ডোপ টেস্টে পজিটিভ হয়ে টুর্নামেন্ট থেকে বহিষ্কৃত হন তিনি। তবে শেন ওয়ার্নের ভাষ্য অনুসারে, কোনো ড্রাগ তিনি নেননি। নিজেকে সুশ্রী করে তুলতে মায়ের দেওয়া একটি ডাই-ইউরেটিক ওষুধ খেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তাতে যে ডোপ পজিটিভ উপাদান ছিল, সেটা তিনি নিজেও নাকি জানতেন না। সত্য হোক কিংবা মিথ্যে, নিষেধাজ্ঞা তাতে আটকায়নি। বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার এক দিন আগে এক বছরের জন্য নিষিদ্ধ হন শেন ওয়ার্ন। যদিও ওয়ার্নকে ছাড়াই সেবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল অস্ট্রেলিয়া।
বব উলমারের মৃত্যু
১৮ মার্চ, ২০০৭ সাল। জ্যামাইকার পেগাসাস হোটেলে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় তৎকালীন পাকিস্তান কোচ বব উলমারকে। গ্রুপপর্বের ম্যাচে আয়ারল্যান্ডের সাথে হেরে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে যাওয়ার রাতেই মারা যান উলমার। কিন্তু কে বা কারা খুন করেছে, কিংবা আদৌ তিনি খুন হয়েছেন কি না, তার কূলকিনারা করতে পারেনি পুলিশ।
অনেকের মতে, পাকিস্তানের হারের কারনে বাজিকররা খুন করেছে উলমারকে। তবে সাবেক পাকিস্তানি কোচ জিওফ লসন বলেছেন, টাকার চেয়ে মর্যাদা এখানে প্রাধান্য পেয়েছে। বিশ্বকাপ থেকে বাদ পড়ার ক্ষোভ কেউ মিটিয়েছেন উলমারকে খুন করে। আরেক ধরনের তত্ত্বমতে, সেই ম্যাচ পাকিস্তান ফিক্সিং করেই হেরে গিয়েছিল আয়ারল্যান্ডের সাথে। আর সেটি যাতে উলমারের মাধ্যমে বিশ্ববাসী জানতে না পারে, তাই খুন করা হয়েছিল তাকে। তবে যা’ই হোক, ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম কালো দিন হয়ে থাকবে এই ঘটনাটি।