চাপ নাকি ঈশ্বরের অভিশাপ? রাশিয়া বিশ্বকাপে জার্মানির বিদায়ে এই নিয়ে টানা তৃতীয়বারের মতো ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নরা বাদ পড়লো প্রথম পর্ব থেকেই। ২০১০ এ ইতালির পর ২০১৪-তে স্পেন। সেই নিয়তি মেনে নিয়ে এবার গ্রুপ টেবিলে চতুর্থ হয়ে আরো বাজেভাবে সমাপ্তি ঘটলো ডাই ম্যানশ্যাফটদের বিশ্বকাপ যাত্রার। চলুন দেখে আসা যাক এই তিন দলের বাদ পড়ার আদ্যোপান্ত।
ইতালি (২০১০ বিশ্বকাপ)
২০০৬ বিশ্বকাপ শুরুর আগে ইতালি কোনোভাবেই ফেভারিটদের তালিকায় ছিলো না। যদিও বিশ্বমঞ্চে ইতালি বরাবরের মতোই ভয়ঙ্কর। কিন্তু জুভেন্টাসের ম্যাচ ফিক্সিং কেলেঙ্কারিজনিত সমস্যায় তখন ইতালিয়ান ফুটবলও ছিলো টালমাটাল অবস্থায়। তবে সেই দলকে নিয়েই ইতালিকে চতুর্থবারের মতো বিশ্বকাপ জেতান মার্সেলো লিপ্পি। জিনেদিন জিদানের ফ্রান্সকে টাইব্রেকারে হারিয়ে শিরোপা উল্লাসে মাতেন ক্যানাভেরো, পিরলো, বুফনরা।
ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন হিসেবে ২০১০ দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপ খেলতে যায় বুফন, দেল পিয়েরোরা। বলতে গেলে প্রায় একই দল নিয়ে সেই বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করে আজ্জুরিরা। দলের ডাগ আউটে আগেরবার ইতালিকে চ্যাম্পিয়ন করানো মার্সেলো লিপ্পি। এফ গ্রুপে ইতালির সাথে বাকি তিনটি দল ছিলো প্যারাগুয়ে, স্লোভাকিয়া এবং নিউজিল্যান্ড। সেবারই প্রথমবারের বিশ্বকাপ খেলতে আসে নিউজিল্যান্ড। সেই বিবেচনায় মোটামুটি সহজ গ্রুপই পায় তৎকালীন সাবেক বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা।
১৪ জুন কেপটাউন স্টেডিয়ামে প্যারাগুয়ের সাথে ম্যাচ দিয়ে বিশ্বকাপে যাত্রা শুরু হয় আজ্জুরিদের। ক্যানাভারোর নেতৃত্বে রসি, বুফন, কিয়েল্লিনিদের নিয়ে দল সাজান লিপ্পি। ম্যাচের প্রথমার্ধ শেষ হওয়ার ছয় মিনিট আগে আলকারাজের গোলে লিড নেয় প্যারাগুয়ে। দ্বিতীয়ার্ধে ভালো খেললেও আক্রমণভাগের ব্যর্থতায় বারবার সুযোগগুলো হারাচ্ছিলো ইতালি। ম্যাচের ৬৩ মিনিটে মধ্যমাঠের খেলোয়াড় ডি রসির গোলে সমতায় ফেরে ইতালি। পরবর্তীতে আর গোল না হওয়ায় ড্র করে এক পয়েন্ট নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় লিপ্পির শিষ্যদের।
দ্বিতীয় ম্যাচে ইতালির মুখোমুখি হয় নবাগত নিউজিল্যান্ড। ম্যাচের সাত মিনিটের মাথায় ফ্রি কিক থেকে বাড়ানো বলে বুফনকে ফাঁকি দিয়ে বল জালে জড়ান নিউজিল্যান্ডের স্মেল্টজ। ম্যাচের আধাঘন্টার মাথায় ডি বক্সে ডি রসিকে ফাউল করায় পেনাল্টি পায় ইতালি। স্পটকিক থেকে ২৯ মিনিটে দলকে সমতায় ফেরান ইয়াকুইন্টা। বাকি সময় ম্যাড়ম্যাড়ে আক্রমণে আর কোনো গোলের দেখা পায়নি ইতালি। দুই ম্যাচে দুই ড্র নিয়ে শেষ ম্যাচের আগেই বিপাকে পড়ে লিপ্পির দল।
শেষ ম্যাচে স্লোভাকিয়ার সাথে জয় ছাড়া কোনো বিকল্প ছিলো না ইতালির। ২৪ জুন জোহানেসবার্গে মুখোমুখি হয় এই দুই দল। চাপের মুখে পড়ে সেদিন স্বাভাবিক খেলাই খেলতে পারেনি ইতালি। সেই সুযোগ নিয়ে ২৫ মিনিটে স্লোভাকিয়াকে এগিয়ে নেন ভিতেক। গোলের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠা ইতালিকে প্রতি-আক্রমণে ৭৩ মিনিটে আরেকটি গোল দিয়ে বসেন প্রথম গোল করা ভিতেকই। ৮১ মিনিটে ডি নাটালের গোলে আশার আলো জ্বলে উঠলেও ৮৯ মিনিটে তা পুরোপুরি নিভিয়ে দেন কপুনেক। স্লোভাকিয়া এগিয়ে যায় ৩-১ গোলে। ৯৩ মিনিটে কোয়াগ্লিয়ারেলার গোল শুধুমাত্র সান্ত্বনা জোগায়। চার ম্যাচে মাত্র ২ পয়েন্ট নিয়ে গ্রুপপর্ব থেকেই বিদায় নেয় ইতালি।
পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে ইতালি দক্ষ স্ট্রাইকারের অভাবে ভুগেছিল। ২০০৬ সালে লুকা টনির সাথে দেল পিয়েরো মিলে ইতালিকে সাহায্য করেছিলেন। কিন্তু ২০১০ এ দেল পিয়েরোর ধার কমে যাওয়া আর লুকা টনির অবসরে ইতালি ভালোভাবেই ভোগে, যার মাশুল দিতে হয় প্রথম পর্ব থেকেই ছিটকে পড়ে।
স্পেন (২০১৪ বিশ্বকাপ)
দেল বস্কের হাত ধরে স্পেনের টিকিটাকার যুগ শুরু। সেই টিকিটাকাতেই মুকুটে একের পর এক পালক যোগ করেছিলো লা রোহারা। ২০০৮ ইউরোর পর ২০১০ বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন হয় তারা। সেই সাফল্য বজায় থাকে পরবর্তী ২০১২ ইউরোতেও। চার বছর আগে বিশ্বকাপ জেতা প্রায় বেশিরভাগকে দলে রেখেই ব্রাজিলে যান দেল বস্ক।
চিলি, নেদারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে বি গ্রুপের লড়াইয়ে স্পেন নামে বিশ্বকাপ ধরে রাখার মিশনে। প্রথমেই হাইভোল্টেজ ম্যাচে সালভাদরে নেদারল্যান্ডের মুখোমুখি হয় স্পেন। আগের বিশ্বকাপের ফাইনালের বদলা তুলে নেন রোবেন, স্নাইডাইররা। এল সালভাদরে লা রোহাদের তারা বিধ্বস্ত করে ৫-১ গোলে। অবশ্য প্রথমে কস্তার আদায় করা পেনাল্টি থেকে ম্যাচের ২৭ মিনিটেই স্পেনকে এগিয়ে দেন জাভি আলোন্সো। প্রথমার্ধ শেষ হওয়ার ঠিক আগমূহুর্তে ব্লিন্ডের বাড়ানো ক্রসে দারুণ ক্ষিপ্রতায় উড়ন্ত অবস্থায় হেডে বল জালে জড়ান ভ্যান পার্সি। দ্বিতীয়ার্ধে ভ্যান পার্সি আর রোবেনের সাথে পেরে ওঠেনি স্পেন। ভ্যান পার্সি ও রোবেনের জোড়া গোলের পাশাপাশি ডি ব্রিজের একটি গোলে ৫-১ গোলে স্পেনকে হারায় নেদারল্যান্ড।
প্রথম ম্যাচের দুঃস্বপ্ন ভুলতে ১৮ জুন মারাকানায় চিলির মুখোমুখি হয় স্পেন। কিন্তু মারাকানাতে স্পেনকে আরেকটি দুঃস্বপ্ন উপহার দেয় চিলি, বাঁচা-মরার ম্যাচে লা রোহারা ম্যাচটি হারে ২-০ গোলে। প্রথমার্ধে ভার্গাস ও আরাঙ্গুইজের গোলে ২-০ তে এগিয়ে যায় চিলি। শেষপর্যন্ত সেই লিড ধরে রেখে দ্বিতীয় রাউন্ডে উর্ত্তীর্ণ হয় সাম্পাওলির চিলি। আর ইতালির মতো ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন হিসেবে প্রথম পর্ব থেকে স্পেনের বিদায়ও নিশ্চিত হয় তখন। নিয়ম রক্ষার শেষ ম্যাচে অবশ্য অস্ট্রেলিয়াকে ৩-০ গোলে হারিয়ে সান্ত্বনার জয় তুলে নেয় স্পেন।
স্পেনের বিদায়ের সাথে দেল বস্কও পদত্যাগ করেন কোচের পদ থেকে। বেশিরভাগ ফুটবল বোদ্ধার মতে, স্পেনের অতিরিক্ত পাসিং নির্ভর ট্যাক্টিকসই ধরাশায়ী হওয়ার মূল কারণ। অতিরিক্ত পাস নির্ভর আর ধীর গতির ফুটবল খেলে প্রতি-আক্রমণে মার খায় স্পেন।
জার্মানি (২০১৮ বিশ্বকাপ)
২০১৪ ফাইনালে মারাকানায় আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে চতুর্থবারের মতো বিশ্বসেরার মুকুট পরে জোয়াকিম লোর জার্মানি। বিশ্বকাপের পরপরই অবসরে যান জার্মানির অভিজ্ঞ কিছু খেলোয়াড়। অধিনায়ক লাম থেকে শুরু করে শোয়েন্সটাইগার, ক্লোসা, পোডলস্কিরাও বুট জোড়া তুলে রাখার সিদ্ধান্ত নেন। তবে যথেষ্ট প্রতিভাবান খেলোয়াড় থাকায় ভুগতে হয়নি জার্মানিকে। তরুণ খেলোয়াড়দের নিয়েই লো জিতে নেন কনফেডারেশন কাপ। ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে ১ নাম্বার স্থানটি দখল করে নেয় তারা। প্রতিটি পজিশনে দুর্দান্ত খেলোয়াড়দের নিয়েই শিরোপা ধরে রাখার লক্ষ্যে রাশিয়ায় যায় ডাই ম্যানশ্যাফটরা।
জার্মানির সাথে মেক্সিকো, সুইডেন আর দক্ষিণ কোরিয়াকে নিয়ে রাশিয়া বিশ্বকাপে তৈরি হয় গ্রুপ এফ। ১৭ জুন প্রথম ম্যাচেই মেক্সিকোর সাথে মুখোমুখি হয় নয়্যারের জার্মানি। কিন্তু হোঁচট খেয়েই বিশ্বকাপ যাত্রা শুরু হয় ক্রুস, মুলারদের। মেক্সিকোর সাথে ১-০ গোলে হেরে যায় তারা। পরবর্তী খেলায় সুইডেনের সাথে ১-০ গোলে পিছিয়ে থেকেও অন্তিম মূহুর্তে ক্রুসের গোলে জীবন ফিরে পায় জার্মানি। রিউস ও ক্রুসের কল্যাণে ২-১ গোলে সুইডেনকে হারায় তারা।
শেষ ম্যাচে জার্মানির জন্য সমীকরণটা সহজই ছিলো। দক্ষিণ কোরিয়াকে হারাতে পারলেই দ্বিতীয় পর্বের টিকেট কাটতে পারতো তারা। কিন্তু সেই সহজ সমীকরণটাই জটিল করে তোলে লোর শিষ্যরা। প্রথমার্ধে কোনো গোল না পাওয়ায় দ্বিতীয়ার্ধে কিছুটা চাপে পড়ে যায় জার্মানি। একের পর এক আক্রমণ দক্ষিণ কোরিয়ার রক্ষণের সামনে মুখ থুবড়ে পড়তে থাকে। গোলের দেখা তো দূরে থাক, উল্টো কর্নার থেকে রক্ষণের ভুলে ৯৪ মিনিটে দক্ষিণ কোরিয়াকে এগিয়ে দেন ইয়ং গোন কিম। অল আউট অ্যাটাকে যাওয়া জার্মানিকে শেষবারের মতো স্তব্ধ করে দেন হং মিন সন। ম্যাচটি দক্ষিণ কোরিয়া জিতে নেয় ২-০ গোলে। তাতে পয়েন্ট টেবিলে চতুর্থ স্থান পাওয়ার পাশাপাশি ইতালি, স্পেনের দেখানো পথে হেঁটে আবারো ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন হিসেবে প্রথম পর্ব থেকেই বিদায় নেয় জার্মানি।
টুর্নামেন্টে ওজিল, মুলারদের ফর্মহীনতা আর এর পাশাপাশি নিষ্প্রভ আক্রমণভাগই ডাই ম্যানশ্যাফটদের বিদায়ের মূল কারণ। প্রতি ম্যাচে প্রায় ৬০ শতাংশের উপর বল ধরে রেখেও পুরো টুর্নামেন্টে মাত্র ২টি গোল করতে পারে জার্মানি। আর তাতেই প্রথম পর্ব থেকে বিদায় নিশ্চিত হয় তাদের।