![](https://assets.roar.media/assets/ybnT43VMCC4PmVmc_60cfd84f8f27c.jpg?w=1200)
রুবেল হোসেনের করা ইয়র্কারে স্ট্যাম্প ভাঙল জেমস অ্যান্ডারসনের। আর কমেন্ট্রি বক্স থেকে ভেসে এলো নাসির হুসাইনের কণ্ঠ:
“দ্য বাংলাদেশ টাইগার্স হ্যাভ নক়ড দ্য ইংল্যান্ড লায়ন্স আউট অফ দ্য ওয়ার্ল্ড কাপ!”
পুরো বিশ্বকাপে হতশ্রী পারফরম্যান্সের পর গ্রুপপর্ব থেকে ছিটকে পড়ল তারা। শুরু হলো “গেল গেল” রব। এ ব্যর্থতা যেন কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলেন না তারা। ঠিক কতটা অপ্রত্যাশিত ছিল সেই ব্যর্থতা, বুঝে নেওয়া যায় স্টুয়ার্ট ব্রডের একটা কথা থেকেই,
“We would have to have an absolute stinker not to make the quarter-finals.”
চার বছর পর লর্ডসে সেই ইংল্যান্ডই খেলেছে বিশ্বকাপ ফাইনাল। শেষ বলে ডিপ মিড উইকেট অঞ্চলে পাঠিয়ে দেয়া বল জেসন রয়ের কাছ থেকে দ্রুত সংগ্রহ করে মার্টিন গাপটিলকে রানআউট করার মধ্য দিয়ে শিরোপাটাকে যেন হাতের মুঠোয় এনে দিলেন উইকেটরক্ষক জস বাটলার। দর্শকদের চোখে ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা এই শ্বাসরুদ্ধকর ফাইনালে সুপার ওভারে নিউ জিল্যান্ডকে হারিয়ে ট্রফি ঘরে তুলল তারা। আর তার সাথে ঘুচল দীর্ঘ ৪৪ বছরের আক্ষেপ। অথচ এই দলটিই কি না চার বছর আগে হতশ্রী পারফরম্যান্সের জন্য অনেকের বিদ্রুপের শিকার হয়েছিল!
![](https://assets.roar.media/assets/7eDmnN2T4VNsR5uz_192160594_387858775919397_1458625486017207181_n.jpg)
চার বছরের মধ্যে শূন্য থেকে একেবারে শিখরে পৌঁছানো এই দলটির নাম ইংল্যান্ড। তবে এই পরিবর্তন কিন্তু রাতারাতি হয়নি। ২০১৫ সালের বিশ্বকাপে অপ্রত্যাশিত ভরাডুবির পর ইংল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ড নড়েচড়ে বসে। নিজেদের মাঠে অনুষ্ঠেয় পরবর্তী বিশ্বকাপকে সামনে রেখে পুরো ক্রিকেট বোর্ডকে নতুনভাবে সাজানো শুরু করে তারা। শুরুটা হলো বোর্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পল ডাউনটনকে অপসারণের মধ্য দিয়ে। তারপর বরখাস্ত করা হলো জাতীয় দলের কোচ পিটার মুরসকে। অনেকের চোখে প্রধানত এই দু’জনই ইংলিশদের এই ভরাডুবির জন্য দায়ী ছিলেন। পরবর্তীতে আট বছর ধরে ক্রিকেট বোর্ডের চেয়ারম্যানের পদে থাকা জাইলস ক্লার্কও পদত্যাগ করেন। আর নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় কলিন গ্রেভসকে। পাশাপাশি ‘ডিরেক্টর অফ ক্রিকেট’ নামে নতুন একটি পদ তৈরি করা হয় – যেখানে নিয়োগ দেয়া হয় ২০১১ বিশ্বকাপে ইংলিশদের অধিনায়কত্ব করা ওপেনার অ্যান্ড্রু স্ট্রাউসকে।
ক্রিকেট বোর্ডের এই পুনঃসংস্কার যে কতটা ফলপ্রসূ ছিল, তার প্রমাণ মেলে পরবর্তী সিরিজগুলোতে। মুরসের অপসারণের পর নতুন কোচ ট্রেভর বেলিস ও অধিনায়ক ইয়ন মরগানের অধীনে ঐ বিশ্বকাপের পর ছয়টি সিরিজের চারটিতেই জয়লাভ করে তারা। শুধু তাই নয়, ২০১৫ বিশ্বকাপের পর থেকে ২০১৯ বিশ্বকাপের আগ পর্যন্ত সময়ে ম্যাচ জয়ের শতকরা হারের দিক দিয়ে সবার ওপরে ছিল ইংলিশরাই।
![](https://assets.roar.media/assets/XlLXb6Gd6sugeEk0_Team-Record-2015-2019.png)
ইংলিশ ক্রিকেটের এই নবজাগরণের মূলমন্ত্র ছিল ভয়ডরহীন ক্রিকেট খেলা। ২০১৫ বিশ্বকাপ-পরবর্তী ওয়ানডে সিরিজগুলোতে সাড়ে তিনশ’রও বেশি রান করা মামুলি ব্যাপার বানিয়ে ফেলেছিল তারা, যার মধ্যে ছিল চারটি চারশর অধিক সংগ্রহ।
ইংলিশদের মধ্যে এই নির্ভীক ক্রিকেট খেলার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে বড় অবদান ছিল অ্যান্ড্রু স্ট্রাউসের। ইংলিশদের সফলতার পেছনে আক্রমণাত্মক ক্রিকেট খেলাকেই মূল চাবিকাঠি মানেন তিনি। তার মতে,
“ভয়ডরহীন ক্রিকেটই ইংল্যান্ডকে সফলতার দিকে এগিয়ে নিয়েছিল।”
তিনি এই নির্ভীক ক্রিকেট খেলার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন নিউ জিল্যান্ডের মারমুখী ওপেনার ব্রেন্ডন ম্যাককালামের কাছ থেকে। এ ব্যাপারে অধিনায়ক মরগান বলেন,
“তার (স্ট্রাউসের) সাথে ফোনে কথা বলার বিষয়টি আমাকে অনেক আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছিল। তিনি তার বন্ধু ব্রেন্ডন ম্যাককালামের যেকোনো পরিস্থিতিতে ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে খেলার বিষয়টি পছন্দ করতেন। তিনি চাইছিলেন, ম্যাককালামের সেই ইতিবাচক থাকার বিষয়টি যাতে আমরাও গ্রহণ করি। অধিনায়ক হিসেবেও তিনি (ম্যাককালাম) অন্যদের চাইতে আলাদা।”
![](https://assets.roar.media/assets/oHATTWl9Avh3XaTx_Picture1.png)
তারা যে সঠিক পথেই হাঁটছিলেন, তার প্রতিফলন ঘটে ইংলিশদের ধারাবাহিক সাফল্যে। ২০১৫ বিশ্বকাপের পর থেকে ২০১৯ বিশ্বকাপের আগ পর্যন্ত সময়ে অনুষ্ঠিত ২৩টি ওয়ানডে সিরিজে মাত্র চারটিতে হারের বিপরীতে জয় ছিল ১৭টিতে। আর বিশ্বকাপ শুরুর ঠিক আগে পাঁচ ম্যাচের দ্বিপাক্ষিক সিরিজে পাকিস্তানকে ৪-০ ব্যবধানে হারিয়ে জানান দেয়, এই বিশ্বকাপে হট ফেভারিট হয়েই আসছে তারা।
নতুন রূপে আবির্ভূত এই ইংলিশদের বিশ্বকাপ অভিযান শুরু হয় ওভালে আফ্রিকার বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে। গ্রুপপর্বের ঐ ম্যাচে প্রথমে ব্যাট করে জেসন রয়, জো রুট, ইয়োন মরগান ও বেন স্টোকসের চারটি পঞ্চাশোর্ধ্ব রানের কল্যাণে ৩১১ রানের পুঁজি পায় তারা। পরবর্তীতে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ২০৭ রানে অলআউট করে ১০৪ রানের জয় পায় ইংলিশরা। আসরের প্রথম ম্যাচেই শিরোপার আরেক দাবিদার দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে নিজেদের সামর্থ্যের প্রমাণ দেয় তারা। আর নিজেদের তৃতীয় ম্যাচে বাংলাদেশের বিপক্ষে জয় নিয়ে বিগত দুই বিশ্বকাপে হারের একপ্রকার বদলাই নিয়ে নেয় তারা।
তারপর একে একে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, আফগানিস্তান ও ভারতকে হারিয়ে সেমিতে ওঠার লড়াইয়ে টিকে থাকে ইংলিশরা। মাঝে অবশ্য পাকিস্তান ,শ্রীলঙ্কা ও অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরে সেমিফাইনালে ওঠার পথটা কিছুটা কঠিন হয়ে পড়ে তাদের জন্য। তবে নিউ জিল্যান্ডকে ১১৯ রানে হারিয়ে সেই বাধা দূরও করে তারা।
চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী অস্ট্রেলিয়ার সাথে সেমিফাইনালে সাক্ষাৎ হয় ইংলিশদের। গ্রুপপর্বের ম্যাচে এই অজিদের কাছেই ৬৪ রানে হারে তারা। তবে এজবাস্টনে অনুষ্ঠিত সেমিফাইনালের ম্যাচটিতে বোলারদের নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে অজিদের মাত্র ২২৩ রানে বেঁধে ফেলে ইংল্যান্ড। মূলত তখনই ম্যাচের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। সেই লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে রয় ও বেয়ারস্টো মিলে ১২৪ রানের উদ্বোধনী জুটি গড়ে কাজটাকে একেবারে সহজ করে ফেলেছিলেন। পরে অধিনায়ক মরগানকে সাথে নিয়ে বাকি কাজটুকু সারেন জো রুট। আর তাতেই দীর্ঘ ২৭ বছর পর বিশ্বকাপের ফাইনালে জায়গা করে নেয় ইংলিশরা।
![](https://assets.roar.media/assets/FI4dvS09PQ0prC6d_Viz.png)
২০১৫ বিশ্বকাপে ভরাডুবির পর ইংল্যান্ডের এভাবে ঘুরে দাঁড়ানো বিস্ময়কর ব্যাপারই বটে! খোদ অধিনায়কও এ ব্যাপারটিতে বিস্মিত হয়েছিলেন। ইয়োন মরগান বলেন:
“২০১৫ বিশ্বকাপে ছিটকে যাওয়ার পর আপনি যদি আমাকে বলতেন যে আমরা পরের বিশ্বকাপে ফাইনাল খেলব, আমি আপনাকে বিশ্বাস করতাম না।”
শুধু তিনিই নন, ২০১৫ বিশ্বকাপের হতশ্রী পারফরম্যান্সের পর কেউই বিশ্বাস করতে চাইতেন না যে এই দলই পরবর্তী বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলবে!
দীর্ঘ ২৭ বছর পর বিশ্বকাপের ফাইনালে ইংলিশরা। এবার এমন কিছু করার সুযোগ এসেছে, যা বিগত ৪৪ বছরেও করা যায়নি। গত চার বছরে বহু কাঠখড় পোড়ানোর পর এবার সুযোগ এসেছে শিরোপা-খরা কাটানোর। প্রতিপক্ষ – সেমিফাইনালে ভারতকে হারানো আগের বিশ্বকাপের রানারআপ নিউ জিল্যান্ড। ‘হোম অফ ক্রিকেট’ খ্যাত লর্ডস ক্রিকেট মাঠে অনুষ্ঠিত ফাইনালে টসে জিতে আগে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেয় নিউ জিল্যান্ড। ল্যাথাম-নিকোলসদের ছোট ছোট অবদানে ২৪১ রানের সংগ্রহ পায় ব্ল্যাক ক্যাপসরা। পরে লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে বহু নাটকীয়তার পর সেই ২৪১ রানেই থামে ইংল্যান্ডের ইনিংস। আর এর নেপথ্যে বড় অবদান ছিল বেন স্টোকসের। একপ্রান্ত আগলে রেখে ৯৮ বলে ৮৪ রানে শেষ পর্যন্ত অপরাজিত থাকেন তিনি।
সুপার ওভারে খেলা গড়ানোর পর কাকতালীয়ভাবে সেখানেও এ দুই দলের স্কোর সমান হয়ে যায়। শেষ বলে জয়ের জন্য ২ রান দরকার হলেও ১ রান সংগ্রহ করতে সক্ষম হন গাপটিল। আর তাতেই বাউন্ডারির হিসেবে বিজয়ী হয় ইংলিশরা। আর তার সাথে অবসান হয় দীর্ঘ ৪৪ বছরের অপেক্ষা।
![](https://assets.roar.media/assets/7iXs8zsTNLWMvGU3_000_1ir47v.jpg)
ইংলিশদের বিগত চার বছরের পরিকল্পনার সঠিক বাস্তবায়নের ফসল এই শিরোপা জয়। ক্রিকেট বোর্ডের পুনঃসংস্কার, গতানুগতিক খেলার রীতি ভেঙে আক্রমণাত্মক ক্রিকেট খেলার সংস্কৃতি তৈরি, খেলোয়াড়দের জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ – এসবই ছিল তাদের পরিকল্পনার অংশ। ২০১৫ বিশ্বকাপের ভরাডুবির পর ইংল্যান্ডের ক্রিকেটে আমূল পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যে সাফল্য অর্জন, তার পেছনে ছিল পরিকল্পনার যথাযথ বাস্তবায়ন। শূন্য থেকে শিখরে পৌঁছানোও যে সম্ভব, তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে ইংলিশদের এই নব উত্থান।