তাসমান পাড়ের এপার-ওপার। দুই প্রতিবেশী। তবে প্রকৃতিতে, ব্যবহারে, আচরণে, সংস্কৃতিতে ভিন্নতা আছে বেশ। অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড। পাশাপাশি দুটি দেশ। দুই দেশের দ্বৈরথে খুব একটা ঝাঁজ নেই; যেমনটা পাবেন অ্যাশেজে, যেমনটা পাবেন পাক-ভারত মহারণে। উত্তেজনার বারুদ নেই সেখানে, নেই উত্তাপ আলাপ। পাল্টাপাল্টি কথার খেল। তবুও আছে মর্যাদা আর আভিজাত্যের চাপা রেশ। রেষারেষি নেই সত্যি, মিথ্যে নয় তবু একরত্তি ছাড় না দেয়ার মনোবৃত্তি। যেন তারা পাশাপাশি সেই দুই প্রতিবেশী ভদ্রলোক- যারা খোশ আলাপে মেতে ওঠেন, উত্তেজিত হন, চিৎকার করেন না। নিজের জায়গা ছেড়ে দেন না, তবে অপরের মতকেও অশ্রদ্ধা ভরে ছুঁড়ে ফেলেন না। পরস্পরের প্রতি পরস্পর সম্মানের জায়গাটা ঠিক রাখলেও তর্কে কেউ হারতে রাজি থাকেন না।
সম্ভ্রমের পরিমিত ও পরিণত বোধের এমনই বিশ্বকাপ দ্বৈরথ নিয়ে আজকের আয়োজন। প্রিয় পাঠক, এই আলাপে আপনাকে স্বাগতম।
১.
পাশাপাশি দেশ বা প্রতিবেশী হলেও ক্রিকেট সংস্কৃতিতে বিস্তর ফারাক দুই অঞ্চলে। অস্ট্রেলিয়া যেখানে অজি অহংই জানে শেষ কথা, সেখানে নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটে নিপাট ভদ্রলোক প্রায় সবাই। ক্রিকেটের বদলে তারা ভব্যতার দূত হতে পারলে বুঝি ভালো করতেন। অস্ট্রেলিয়া যেখানে ‘দ্য আল্টিমেট চ্যাম্পিয়ন’ স্যার ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যানের মতো মহাপুরুষ জন্ম দিয়েছে, সেখানে নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটে নেই সেই পর্যায়ের কোনো বড় নাম। টেস্ট ক্রিকেটে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতেই অস্ট্রেলিয়ার চেয়ে প্রায় অর্ধশতাধিক বছর বেশি সময় নিয়েছে নিউজিল্যান্ড।
অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেটে বড় বড় ক্রিকেট মহাপুরুষের ছড়াছড়ি হলেও, নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটে তা হাতেগোণা। তবে একটা জায়গায় হয়তো নিউজিল্যান্ডকে একটু এগিয়ে দিয়েছিলেন গ্লেন টার্নার। বিশ্বকাপের দ্বিতীয় সেঞ্চুরিয়ান। কোনো অস্ট্রেলিয়ানের আগেই কাজটা করতে পেরেছিলেন তিনি। সে যা-ই হোক, মূল আলোনায় ফেরা যাক।
তাসমান সাগরের এপার-ওপার হলেও, বিশ্বকাপ সাক্ষাৎ তাদের হয়নি প্রথম তিনটি বিশ্বকাপে। চতুর্থ বিশ্বকাপে এসে একেবারে দুবার মুখোমুখি হয়ে যায় দুটি দল। এযাবৎ মোট দশবারের সাক্ষাতে সাতবারই জয়ী দল অস্ট্রেলিয়া। বাকি তিনবার জিতেছে নিউজিল্যান্ড। মোট লড়াইয়েরই প্রতিচ্ছবি যেন! ১৩৬ বারের ওডিআই ম্যাচে ৭টি পরিত্যক্ত হলেও বাকি ম্যাচে প্রায় ৭০ শতাংশ ম্যাচ পকেটে পুরেছে অস্ট্রেলিয়া। ৩০ শতাংশ নিউজিল্যান্ডের। মানে দাঁড়ায়- ৯০টি অস্ট্রেলিয়া জিতেছে, ৩৯টি নিউজিল্যান্ড।
মর্যাদার এই লড়াই বিশ্বক্রিকেটে দিয়েছে দুর্দান্ত কিছু ম্যাচ, দারুণ উত্তেজনা। বিশ্বকাপের এই সময়ে বিশ্বকাপেরই তেমন কয়েকটি লড়াই নিয়ে আমরা সাজিয়েছি আমাদের আজকের এই আলেখ্য।
২.
আপনার তখন কিশোর বয়স হয়তো। কিংবা কিশোর হতে আরো বছর এক-দুই বাকি। বিশ্বকাপ দেখেন ভীষণ উত্তেজনা নিয়ে। আপনার বাবা আপনাকে বিশ্বকাপের নানাবিধ গল্প শোনান, আপনি শোনেন মুগ্ধ হয়ে। অপ্রতিরোধ্য অস্ট্রেলিয়া সেবার মুখোমুখি হবে নিউজিল্যান্ডের।
সেন্ট জর্জেস পার্ক, পোর্ট এলিজাবেথ, দক্ষিণ আফ্রিকা।
মঞ্চ প্রস্তুত। আপনার বাবা আপনাকে বেশ ক’দিন ধরেই বলতে থাকেন- অস্ট্রেলিয়াকে যদি কেউ থামাতে পারে তবে নিউজিল্যান্ডই পারবে। দেখে নিস!
পাকিস্তান-ইংল্যান্ড-ভারত কাউকেই পাত্তাই দিল না অস্ট্রেলিয়া, স্রেফ গুড়িয়ে দিল। সামনে যাকেই পেলো তাকেই যেন খুন করলো। এ যাত্রায় থামবে বলে মনে হয় না ওদের। ইংল্যান্ড যা একটু সামান্য প্রতিরোধ দেখিয়েছিল তা-ও এক ফুৎকারে নিভিয়ে দিল অস্ট্রেলিয়া। আপনার বাবা আপনাকে ম্যাচের আগের দিনও বলে ওঠেন- অস্ট্রেলিয়াকে যদি নিউজিল্যান্ড থামাতে না পারে, তাহলে পারবে না কেউই।
আপনি ক্ষণ গোণেন। অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড ম্যাচের। পরম আগ্রহে দেখতে চান- নিউজিল্যান্ড কী করে? আপনার চোখকে ছানাবড়া করে অস্ট্রেলিয়ার হাওয়া হয়ে গেল ৭ উইকেট, ৮৪ রানেই। শেন বন্ড নামের তেজস্বী বোলারটা একাই নিলেন ৬ উইকেট। আপনি আরো অবাক হয়ে দেখলেন একটা পাশ থেকে তাকে দিয়ে বল করিয়ে অধিনায়ক শেষ করে ফেললেন তার কোটা। ম্যাচের তখন মোটে অর্ধেক গেছে। আপনি পরম বিস্ময়ে বাবার কথাকে অকপট সত্যি বলে মেনে নেন। শেন বন্ড ও নিউজিল্যান্ড ঘোর লাগিয়ে দেয় আপনার দু’চোখে। তবে সেই ঘোর কাটতেও সময় লাগে না তেমন। বাবার প্রতি বিশ্বাসের মোহটাও থাকে না বেশীক্ষণ। মাইকেল বেভান এ্যান্ডি বিকেলের জুটিতে ওঠে ৯৭ রান, অস্ট্রেলিয়া পেয়ে যায় লড়াইয়ের মতো পুঁজি। সেই পুঁজিতে ঠেস দিয়ে নিউজিল্যান্ডকে চেপে ধরে অস্ট্রেলিয়া।
নিউজিল্যান্ডের পরাজয়ের ব্যবধান বিশাল হলেও দুই দলের পার্থক্যটা বিশাল মনে হয় না আপনার। আপনার মনে হয় লড়াইটা সেয়ানে সেয়ানেই ছিল, পরিসংখ্যান বা ম্যাচ ফলাফলের সাধ্য কী সে লড়াইয়ের চিত্র বোঝায়?
৩.
আপনার তখন জন্মও হয়নি হয়তো। অথবা জন্ম হয়েছে, কিন্তু খুব ছোট। ক্রিকেট বোঝেন বা বোঝার চেষ্টায় আছেন, অথবা বোঝেন না। এই ম্যাচের কোনো স্মৃতি নেই আপনার মানসপটে, অথবা থাকলেও আবছা আবছা। আপনি এই ম্যাচের গল্প শুনেছেন মামা-চাচা-খালুর কাছে। অথবা বাবার মুখেই।
প্রথমবারের মতো ইংল্যান্ডের বাইরে বিশ্বকাপ। অথবা বিশ্বকাপ প্রথমবারের মতো ঘর ছাড়লো বা হলো দেশান্তরী। প্রথমবারের মতো এশিয়ার মাঠে বিশ্বকাপ আয়োজন। বড়দের মুখে এই আসরের গল্প যতবার শুনেছেন ততবার যেন পাশের বাড়ির গল্প বলছেন- এমনভাবেই তারা শুনিয়েছেন আপনাকে। আপনিও সেভাবেই শুনেছেন।
নেহেরু স্টেডিয়াম, ইন্দোর।
তাসমান পাড়ের দুই দেশের প্রথম বিশ্বকাপ সাক্ষাৎ। বৃষ্টি বাঁধায় ম্যাচ রিজার্ভ দিনে গড়ালেও পুরো ম্যাচ আয়োজনে ছেদ পড়লো তাতেও। ম্যাচটা হয়ে গেল ৩০ ওভারের। অস্ট্রেলিয়া প্রথমে ব্যাট করে জমা দিল ১৯৯ রান। জেফ ক্রোর নেতৃত্বাধীন নিউজিল্যান্ড জবাবটাও দিল সমানে সমান। মার্টিন ক্রোর ব্যাটে কক্ষপথে থাকলেও শেষ পর্যন্ত গন্তব্যে পৌঁছানো হয় না নিউজিল্যান্ডের। মাত্র তিন রানের ব্যবধানে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বিশ্বকাপ ম্যাচের জয়টা হাতছাড়া হয় নিউজিল্যান্ডের, প্রথম সাক্ষাতেই অস্ট্রেলিয়া প্রমাণ করে প্রতিপত্তি আর দাপটে সেরা কারা!
৪.
সেই বিশ্বকাপে আরো একটি ম্যাচের ফলাফলও যায় অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে। সেটা ১৭ রানে জেতে অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু পরের আসরের উদ্বোধনী ম্যাচে দুই সহ-আয়োজক অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের লড়াইয়ে, প্রতিবেশীদের বিপক্ষে প্রথম বিশ্বকাপ জয়টা তুলে নেয় মার্টিন ক্রোর চৌকস ক্রিকেটারদের সমন্বয়ে গড়া নিউজিল্যান্ড। তাদের চতুর্থ সাক্ষাতও হয় এশিয়ার মঞ্চে। রঙ্গমঞ্চ– চেন্নাইয়ের চিদাম্বরম স্টেডিয়াম। হাই স্কোরিং ম্যাচটাও জিতে নেয় হলদে রঙের ধারকেরা। মার্ক ওয়াহর স্টাইলিশ সেঞ্চুরিতে ম্লান হয়ে পড়ে ক্রিস হ্যারিসের ১২৪ বলে ১৩০ রানের দুরন্ত ইনিংসটা। আবার কার্ডিফে রজার ট্যুজ আর কেয়ার্ন্সের ব্যাটে দ্বিতীয় জয়ের দেখা পায় কিউই পাখির দল।
ক্যারিবিয়ানে, ভিনগ্রহের হলুদ-রাঙা দলটার সামনে বড্ড অসহায় হয়ে যায় এই গ্রহের সাধারণ একটা দল- নিউজিল্যান্ড। ২১৫ রানের বিশাল পরাজয়ও বোঝাতে পারে না কতটা অসহায় আর ছন্নছাড়া ছিল নিউজিল্যান্ড, বিপরীতে কতটা দাপট আর প্রতাপে ছিল অস্ট্রেলিয়া!
এশিয়ার তৃতীয় আয়োজনে, চতুর্থ তাসমান-ক্ল্যাসিকোয় তেমনই করুণ সময়ের আবর্তে ঘুরপাক খায় নিউজিল্যান্ড। অস্ট্রেলিয়ার একচ্ছত্র শাসনে ছেদ পড়লেও প্রতিবেশীর বিপক্ষে তেমনই নিষ্ঠুর থাকলো অস্ট্রেলিয়া। প্রতিবেশীর বিপক্ষে টানা তিনটি বিশ্বকাপ ম্যচে জয় পায় তারা।
আর তারপর?
তারপর এলো এপিক ইডেন পার্ক, এপিক ক্ল্যাশ। আর তারও পর তো মেলবোর্নের দ্য গ্র্যান্ড ফিনালে…।
৫.
আপনি তখন হয়তো তরুণ। অথবা পেরিয়ে গেছেন তারুণ্য। চোখ কচলে খেলা দেখতে বসে ঘুমভাঙা চোখ আরেকবার রগড়ে নেন। বলে কী! ১৪৬/৯? নিউজিল্যান্ড? প্যাট কামিন্সের ঐ তেজস্বী বলটাকে তেমনই মোলায়েম ভঙিমায় সীমানা দড়ির উড়াল পথ দেখালেন উইলিয়ামসন। নিউজিল্যান্ড ম্যাচ জিতল ২৩ দশমিক ১ ওভারে, তবে ৯ উইকেট হারিয়ে!
অথবা আপনি খুব ভোরে উঠে গিয়েছিলেন। পুরো ম্যাচ দেখেছেন। তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করেছেন পুরোটা সময়। বোল্টের আচমকা তোপে ৮০/১ থেকে অস্ট্রেলিয়ার ১০৬/৯ হওয়া, এবং তারপর ব্র্যাড হাডিনের উন্মত্ত ব্যাটে চড়ে অস্ট্রেলিয়ার পেরিয়ে যাওয়া দেড়শো; ১৫১ রানে অল আউট হয়ে যাওয়া। জবাব দিতে নেমে ম্যাককালামের ব্যাট নামক চাবুকে রক্তাক্ত অস্ট্রেলিয়ান বোলারদের করুণ আর্তনাদে হয়তো খানিক করুণা বোধ করেছেন ওদের জন্য। মাত্র ২৪ বলে ৫০ করা ম্যাককালামের আউটের পর পরপর দুই বলে টেলর-ইলিয়টের বোল্ডে রোমাঞ্চিত হয়েছিলেন নিশ্চয়ই! তবে উত্তেজনার কারণ টের পাননি তখনও।
সেটা টের পেলেন যখন নিউজিল্যান্ড ১৩১/৪ থেকে ভোজবাজির মতো ধুম করে ১৪৬/৯ হয়ে গেল। কী অবিশ্বাস্য ক্রিকেট! ক্ষণিকের জন্য হয়তো হার্টবিট মিস হতে হতে বেঁচে গিয়েছিলেন আপনি। মিলনে-সাউদি পরপর দুই বলে বোল্ড হয়ে ফিরলেন স্টার্কের গোলায়, পড়িমরি করে বাকি দুটো বল ঠেকালেন ট্রেন্ট বোল্ট।
আর তারপর? তারপর…
চাপ বা উত্তেজনা কোনোটাই আর বয়ে নেয়ার প্রয়োজন মনে করলেন না সদ্য তারুণ্যে পা রাখা উইলিয়ামসন। সময়ের ফ্যাবুলাস ফোরের একজন। প্যাট কামিন্সকে সপাটে হাঁকিয়ে আছড়ে ফেললেন বাউন্ডারীর ওপারে, ইডেন পার্কে তখন টেকা দায়! কান ফাটানো গর্জন আর লোমখাড়া করা শিহরণ আপনাকে অদ্ভুত অবিশ্বাস্য এক রোমাঞ্চের জগতে যেন নিয়ে যায়। আপনি বোঝেন- এই অনুভূতির সৃষ্টির কারণটা ইহজগতের হলেও অনুভূতিটা অন্য জগতের। প্রকাশ করা যায় না তা, কেবল অনুভব করা যায়!
ইডেন পার্কের সেই মহাকাব্যিক দ্বৈরথ বিশ্বকাপের তো বটেই, একদিনের ক্রিকেট ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা ম্যাচ।
পরিশিষ্ট
তাসমান ডার্বির সর্বশেষ বিশ্বকাপ লড়াইটা ছিল গত আসরের সমাপনী মঞ্চে। মিচেল স্টার্কের দু-দুটি দুরন্ত গতির গোলা মিস করার পর তৃতীয় বলে ব্রান্ডন ম্যাককালামের অফস্ট্যাম্প নড়ে গেলে, পুরো নিউজিল্যান্ডই কেমন নড়ে গিয়েছিল, মনে আছে নিশ্চয়ই! সেই নাড়িয়ে দেয়াটা এতটাই প্রভাব ফেলেছিল যে, আর স্থির হতে পারেনি নিউজিল্যান্ড। হলদে রঙের পঞ্চম উচ্ছ্বাসের একপাশে প্রথম রানার্সআপেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল নিউজিল্যান্ডকে।
বিশ্বকাপের বাইরেই এই দুই দলের লড়াই মেলে ধরে রোমাঞ্চের সমস্ত আয়োজন, বিশ্বকাপে নিশ্চিতভাবেই তা আরো রঙ ধরে, আরো রঙিন হয়। উত্তেজনা-উত্তাপ বা আলোচনায় সেভাবে না এলেও মর্যাদা আর সম্মান প্রশ্নে আপোষহীন তারা। নান্দনিক ক্রিকেটের উৎকৃষ্ট প্রকাশ যদি দেখতে আগ্রহী হন আপনি, নির্দ্বিধায় অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড বিশ্বকাপ ম্যাচ দেখতে বসে যান। হতাশ হবেন- সে সুযোগ খুব একটা নেই!