Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

স্টিভ স্মিথ: ট্রাজেডির নায়ক, নাকি ভিলেন!

স্টিভেন স্মিথের ক্রিকেট ক্যারিয়ারটাই এরকম একটা প্রশ্নের মতো।

একটা সময় অবধি লোকে প্রশ্ন করতো, স্টিভ স্মিথ লেগস্পিনার, নাকি ব্যাটসম্যান? লেগস্পিনার হিসেবেই দলে এসেছিলেন। এমনকি লোকে তাকে ওয়ার্নির উত্তরসূরীও মনে করা শুরু করেছিলেন। শেন ওয়ার্ন নিজে তাকে নিয়ে কিছু কাজও করেছেন। একজন লেগস্পিনার হিসেবে ব্যাটিং অর্ডারের নিচের দিকে ব্যাট করতেন।

হ্যাঁ, ঘরোয়া ক্রিকেটে কিছু বলার মতো ইনিংস স্মিথের ছিলো। কিন্তু সেসব ইনিংসকে ছাপিয়ে গেলো জাতীয় দলে এসে স্মিথের ব্যাটিং। নিজের ব্যাটিং দক্ষতা দিয়ে প্রমোশন পেয়ে পেয়ে টপ অর্ডারে চলে এলেন। কালক্রমে সময়ের সেরা ব্যাটসম্যানে পরিণত হলেন। বিশ্বের এক নম্বর ব্যাটসম্যান তো হয়েছেনই। সেই সাথে সর্বকালের সেরা রেটিংয়ে স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের চেয়ে সামান্য পিছিয়ে সর্বকালের দ্বিতীয় সেরা রেটিংধারী ব্যাটসম্যানও হয়েছেন। অনেকের মতেই আধুনিক যুগের সেরা দুই ব্যাটসম্যান বিরাট কোহলি ও স্টিভ স্মিথ।

শেন ওয়ার্ন যখন স্মিথের পরামর্শদাতা; Source: Vince Caligiuri

তাহলে একটা প্রশ্নের উত্তর ব্যাট দিয়ে দিয়েছেন। বলে দিয়েছেন, এককালে স্পিনিং অলরাউন্ডার থাকলেও এখন তিনি কালজয়ী ব্যাটসম্যান। কিন্তু এখন যে স্মিথের সামনে আরেকটা প্রশ্ন এসে দাঁড়িয়েছে।

এখন ক্রিকেট বিশ্বের সামনে প্রশ্ন উঠেছে, এই স্টিভেন স্মিথ কি একজন ভিলেন? নাকি বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো একজন ট্রাজেডির নায়ক?

স্টিভেন স্মিথকে ভিলেন মনে করছে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া।

যা খবরাখবর পাওয়া যাচ্ছে, তা সত্যি হলে দু-এক দিনের মধ্যে এক বছরের জন্য নিষিদ্ধ হতে যাচ্ছেন তিনি। তাকে একটা ‘জাতীয় শত্রু’ হিসেবে চিহ্নিত করে ফেলেছে সে দেশের ক্রিকেট বোর্ড ও ক্রীড়া প্রশাসন। তাদের মতে স্মিথ ও ওয়ার্নার ভিলেন ছাড়া আর কিছু নন।

কিন্তু আসলেই কি তাই?

একটু গোড়া থেকে খতিয়ে দেখা যাক। কেপ টাউন টেস্টের তৃতীয় দিন বিকেল বেলায় সম্প্রচারকারী টেলিভিশনের ক্যামেরায় ধরা পড়লো যে, অস্ট্রেলিয়ান ফিল্ডার ক্যামেরন ব্যানক্রফট বলকে কিছু একটা করছেন। ক্যামেরা আরও জুম করলে বোঝা গেলো হলুদ কিছু একটা দিয়ে বল ঘষছেন তিনি। মাঠের জায়ান্ট স্ক্রিনে এই দৃশ্য ভেসে উঠতেই ব্যানক্রফট জিনিসটা চালান করে দিলেন অন্তর্বাসের ভেতর। এরপর আম্পায়ার ডাকলেন তাকে ও স্মিথকে। এই অবস্থায় দুজনই অস্বীকার করলেন বল টেম্পারিংয়ের কথা।

তরুন স্মিথ; Source: Fiona-Lee Quimby

কিন্তু দিনের খেলাশেষে বদলে গেলো দৃশ্য। ব্যানক্রফটকে নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে এলেন স্মিথ। ব্যানক্রফট প্রথমে সবটা স্বীকার করে নিলেন। বললেন যে, ‘স্যান্ড পেপার’ দিয়ে বল ঘষে পরিবর্তন করার চেষ্টা করেছিলেন। এরপর স্মিথ বেশ পরিষ্কারভাবে সব দায় নিজের কাঁধে নিয়ে নিলেন,

যা ঘটেছে, তার জন্য আমি দুঃখিত। আমার নেতৃত্বে এই প্রথম এমন কিছু ঘটল। কথা দিচ্ছি, এটাই শেষ। এটা করে কিছুটা সুবিধা নেওয়ার কথা ভেবেছিলাম। সিনিয়ররা ব্যাপারটা জানেন (লিডারশিপ গ্রুপ)। কিন্তু কোচ লেম্যান এই ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। এটা মোটেও গর্ব করার মতো ব্যাপার নয়। আমরা এটা নিয়ে লজ্জিত।

আর এখানেই সেই প্রশ্নটা।

স্মিথ যদি স্বীকার না করতেন? যদি তিনি বলতেন যে, কিছু একটা ঘটেছে, তবে তাদের জ্ঞাতসারে এরকম কিছু ঘটেনি? কিংবা যদি একেবারেই সংবাদ সম্মেলনে না আসতেন?

দেখুন, বল টেম্পারিংয়ের ক্ষেত্রে এমনটাই ঘটেছে এর আগে।

খোদ ওয়াসিম আকরাম, ইমরান খান, শচীন টেন্ডুলকার থেকে শুরু করে ইয়ান বোথামের নামে অভিযোগ উঠেছে। এই কিছুদিন আগে ফাফ ডু প্লেসিসের নামেও অভিযোগ উঠেছে। ডু প্লেসিসসহ অনেকের বিপক্ষে ফুটেজের প্রমাণও ছিলো। কিন্তু কোনো ক্ষেত্রেই দলের অধিনায়ক আগ বাড়িয়ে এসে বলেননি যে, এটা তাদের সিদ্ধান্তে হয়েছে।

অথচ বল টেম্পারিং বিষয়টাই এমন যে, ফাস্ট বোলারের সুবিধার জন্য এটা দলীয় সিদ্ধান্তেই হয়ে থাকে। মানে, স্টিভ স্মিথ এ ক্ষেত্রে প্রথম পাপী নন। তিনি বরং প্রথম মানুষ, যিনি দায় কাঁধে নিতে ছুটে এসেছেন। এখানে স্মিথের উদ্দেশ্যটা ছিলো খুব মহৎ। তিনি ব্যানক্রফটের মতো একজন তরুনকে বুলেটের সামনে দাঁড় করিয়ে দিতে চাননি। কারণ, বল টেম্পারিং নিয়ে যত বিতর্ক হয়, সেটা যে ধরা পড়ে, তাকে নিয়েই হয়।

স্মিথ জানতেন যে, তিনি যদি এই ক্ষেত্রে সামনে এগিয়ে না আসেন, শাস্তি খুব বেশী না হলেও আগামী কয়েক দিন মিডিয়া অন্তত ব্যানক্রফটকে ছিড়ে ফেলবে। সেই ভাবনা থেকেই ব্যানক্রফটের মতো একজন তরুণকে বাঁচাতে নিজে এগিয়ে এসে সবটা দায় নিজেদের কাঁধে নিয়ে নিয়েছেন।

এই স্বীকারোক্তির ফলে স্মিথ হয়ে গেছেন সবার লক্ষ্যবস্তু।

সংবাদ সম্মেলনে স্বীকারোক্তি দিচ্ছেন স্মিথ ও ব্যানক্রফট; Source: ক্রিকইনফো

অস্ট্রেলিয়ার স্পোর্টস কমিশন, এএসসি তার বিবৃতিতে পরিষ্কার বলেছে যে, স্মিথ যেহেতু এই স্বীকৃতি দিয়েছেন, ফলে তাকে ও জড়িতের কঠোর শাস্তি না দিয়ে উপায় নেই। এসএসসির বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “এসএসসি খেলাধুলায় যেকোনো ধরনের প্রতারণার তীব্র নিন্দা করে।” অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট অধিনায়ক স্টিভেন স্মিথ যে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন, তারপর এএসসি বলছে যে, ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া যেন দ্রুততম সময়ে তাকে এবং দলের আরও যারা এই বল টেম্পারিং সম্পর্কে আগে থেকে জানতো, তাদের সবাইকে পদ থেকে সরিয়ে দেয়।

একইরকম অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী ম্যালকম টার্নবুলও তার সমস্ত নিন্দা করেছেন ওই স্মিথের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতেই। তিনি বলেছেন,

আমরা সবাই দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে পাওয়া এই খবরে একটা ধাক্কা খেয়ে হতাশার সাথে আজকের দিনটায় ঘুম থেকে উঠেছি। এটা বিশ্বাস করতেই কষ্ট হচ্ছে যে, অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট দল এরকম একটা প্রতারণার সাথে জড়িত হয়েছে। আমি ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার চেয়ারম্যান ডেভিড পিভারের সাথে কথা বলেছি। তাকে দক্ষিণ আফ্রিকার এই ঘটনা নিয়ে আমি আমার পরিষ্কার দুশ্চিন্তার কথা জানিয়েছি।

আর এসব প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তরের ক্ষোভ ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়াকে এখন বাধ্য করছে কঠোর কোনো শাস্তির ঘোষণা দেওয়ার জন্য। যা শোনা যাচ্ছে, তাতে এক বছর অন্তত নিষিদ্ধ হবেন স্মিথ।

স্মিথ যদি ক্রিকেট থেকে এক বছর নিষিদ্ধ হন, তার একেবারে কম করে হলেও ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার লোকসান হবে। তার চেয়ে বড় কথা অল্প পাপে কঠিন একটা কালির দাগ লেগে যাবে স্মিথের শরীরে। এখন বলা হচ্ছে, স্মিথ যেন ক্রনিয়ের মতো সেই স্বীকৃতি দিলেন।

স্মিথের এই রূপ দেখতে চায় বিশ্ব; Source: এবিসি

লোকে বল টেম্পারিংকে ফিক্সিংয়ের মতো অপরাধ মনে করছে।

ফিক্সিংয়ের তুলনায় বল টেম্পারিং নিতান্তই ছোট অপরাধ। ফিক্সিং হলো ব্যক্তিগত স্বার্থে, অর্থের লোভে ম্যাচ পাতানো বা ম্যাচ বিষয়ক তথ্য আদানপ্রদান করা। সেটা জাতির সাথে, ক্রিকেট খেলার সাথে অনেক বড় একটা প্রতারণা। সে তুলনায় বল টেম্পারিংয়ের সাথে ব্যক্তিগত কোনো লাভের প্রশ্নই নেই। এটা মূলত দলের স্বার্থে করা একটা ছোট প্রতারণা, যার ক্রিকেটীয় শাস্তি হলো ৫ রান।

কিন্তু অস্ট্রেলিয়ান প্রশাসনের আচরণে মনে হচ্ছে বল টেম্পারিং ফিক্সিংয়ের চেয়েও বড় অপরাধ।

আজ অস্ট্রেলিয়া স্রেফ স্মিথের স্বীকারোক্তির কারণে একধরনের ভদ্রতার পক্ষে উন্মত্ত আচরণ করছে। এই অস্ট্রেলিয়ারই ‘মহান’ ক্রিকেটার শেন ওয়ার্ন ফিক্সিং, ড্রাগ কেলেঙ্কারিতেও জড়িয়েছিলেন। সে সময়ও ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়াকে এতটা তৎপর মনে দেখা যায়নি। আজ স্টিভেন স্মিথ এক স্বীকারোক্তি দিয়ে এতো বড় ভিলেন হয়ে গেলেন।

একটা তরুণকে বাঁচাতে এসে ভিলেন হয়ে যাওয়াকে ট্রাজেডি ছাড়া আর কী বলবেন!

ফিচার ইমেজ: স্কাই নিউজ

Related Articles