১
সময়টা ১৯৬১ সাল, ‘টুর্নোয়া ডি প্যারি’ টুর্নামেন্টের ফাইনাল। মুখোমুখি ব্রাজিলের ক্লাব সান্তোস আর পর্তুগীজ ক্লাব বেনফিকা। আগের বছরের চ্যাম্পিয়ন সান্তোসে খেলছেন সুপারস্টার পেলে। স্বাভাবিকভাবেই ফেভারিট সান্তোস, দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই বেনফিকা যখন ৪-০ গোলে পিছিয়ে পড়লো, তখন বোঝা গেল যে সান্তোসকে ফেভারিট ভাবাটা অমূলক ছিল না। সেই সময়ে এক কৃষাঙ্গ ১৯ বছরের তরুণ বদলী হিসেবে মাঠে নামল। সে মাঠে নামার কিছুক্ষণের মাঝেই স্কোর দাঁড়ালো ৫-০ তে। দর্শক তখন অপেক্ষা করছে প্রতিযোগিতাবিহীন এক ফাইনালে শেষ হওয়ার অপেক্ষায়।
ঠিক সেই সময়ে ৬৩ মিনিট থেকে ৮০ মিনিটের মাঝে কৃষাঙ্গ ছেলেটি হ্যাটট্রিক করে বেনফিকাকে ম্যাচে ফিরিয়ে আনল। ম্যাচের বাকি আর ১০ মিনিট, স্কোর ৫-৩। এই মুহূর্তে সেই ছেলেটিকে সান্তোসের ডি বক্সে ফাউল করা হলো, বেনফিকা পেনাল্টি পেল। ম্যাচে ফিরে আসার দুর্দান্ত সুযোগ, কিন্তু বেনফিকার জোসে অগাস্টো পেনাল্টি মিস করলেন। শেষপর্যন্ত বেনফিকা ম্যাচটি হেরে গেল ৩-৬ গোলে। কিন্তু ১৯ বছরের সেই ছেলেটি কেড়ে নিলেন সবার নজর এবং পেলেকে ছাপিয়ে জায়গা পেলেন ফ্রান্সের বিখ্যাত স্পোর্টিং সংবাদ পত্র L’Equipe এর প্রচ্ছদে।
সাড়া জাগানো সেই ছেলেটার নাম ছিল ইউসেবিও।
২
ভাই-বোনদের মাঝে তিনি ছিলেন চতুর্থ। তার বাবা লোরিন্দো অ্যান্টনিও দ্য সিলভা ফেরেইরার ছিলেন অ্যাঙ্গোলিয়ান রেল শ্রমিক এবং মা এলিসা বেনি ছিলেন গৃহবধু। খুব ছোটবেলাতেই স্কুলে বন্ধুদের সাথে খালি পায়ে ফুটবল খেলতেন স্কুলের লাফালাফি করতে ব্যবহৃত পিচে। এতটাই দরিদ্র ছিল তার পরিবার যে, জুতা কেনার টাকাটাও যোগাড় করতে পারনেনি তিনি। ইউসেবিওর বয়স যখন মাত্র ৮ বছর, তখন তার বাবা মারা যান। এই সময়ে আক্ষরিক অর্থেই আর্থিক অসচ্ছলতার মুখোমুখি হয় তার পরিবার। কিন্তু তার মা তখন শক্ত হাতে পরিবারের হাল ধরেন।
ইউসেবিও তার খেলা শুরু করেন ওএস ব্রাজিলেইরস নামের স্থানীয় একটি অপেশাদার দলে, দলটি তিনি এবং তার বন্ধুরা গড়ে তুলেছিলেন ১৯৫০ এর ব্রাজিল জাতীয় দলের সম্মানার্থে। মাত্র ১৫ বছর বয়সেই তিনি স্পোর্টিং ক্লাব ডি লরেঙ্কো মারকুইজ-এ খেলার প্রস্তাব পান। একই সময় জুভেন্টাসের সাবেক এক গোলরক্ষক তাকে জুভেন্টাসের হয়ে খেলার প্রস্তাব দেন। এটি অনেক বড় একটি প্রস্তাব ছিল, কিন্তু তার মায়ের নিষেধের কারণে তিনি তখন সেই প্রস্তাব গ্রহণ করতে পারেনি। সেই মুহূর্তে তার মা দেশ ছেড়ে কোথাও যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না।
ক্লাবের হয়ে প্রথম মৌসুমে ম্যাচ খেলেন ৪টি, গোল করেন ৯টি। ক্লাবের চার মৌসুমেই তার এই সফলতা অব্যহত থাকে। এই সময়ে তিনি গোল করেন ৭৭টি, ম্যাচ খেলেন মাত্র ৪২টি। ম্যাচ প্রতি তার গোল গড় ছিল ১.৮৩ এবং সেটিও ১৮ বছর বয়স হবার আগেই।
এর পরেই তিনি পর্তুগীজ ক্লাব বেনফিকায় যোগ দেন। তখন তার বয়স মাত্র ১৮ বছর। তবে তার দলবদল খুবই বিতর্ক সৃষ্টি করেছিল। পর্তুগালের প্রতিদ্বন্দ্বী দুটি দল তাকে একইসাথে দলে নিতে চাওয়ায় সমস্যাটি তৈরি হয়েছিল। বেনফিকা ইউসেবিওর মায়ের সাথে কথা বলে চুক্তি সেরে ফেলে, কিন্তু অন্য ক্লাবটি তাকে অপহরণ করার পরিকল্পনা করে। সেই সময়টি খুবই স্পর্শকাতর ছিল, এই কারণে ইউসেবিওকে তখন ‘রুথ ম্যালোসো’ ছদ্মনামে ডাকা হতো। একপর্যায়ে তাকে ১২ দিন একটি হোটেল রুমে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। বিপর্যস্ত ইউসেবিও এই পর্যায়ে পর্তুগাল ছেড়ে চলে যেতে চান, কিন্তু তার মায়ের নিষেধে সিদ্ধান্ত পাল্টান।
৩
বেনফিকার হয়ে ইউসেবিওর অভিষেক হয় একটি প্রীতি ম্যাচে। অ্যাটলেটিকো ক্লাব ডি পর্তুগালের বিপক্ষে সেই ম্যাচে ইউসেবিওর হ্যাটট্রিকে বেনফিকা জেতে ৪-২ গোলে। অফিশিয়ালি বেনফিকার বিপক্ষে খেলেন পর্তুগীজ কাপের একটা খেলার দ্বিতীয় লেগে। একই দিনে ইউরোপিয়ান কাপে বার্সেলোনার বিপক্ষে বেনফিকার ফাইনাল ম্যাচ ছিল। এই কারণে বেনফিকা পূর্ণ শক্তির দল মাঠে নামাতে পারেনি। শিডিউল না পাল্টানোর কারণে পর্তুগীজ ফুটবল ফেডারেশন বিতর্কিত হয়। রিজার্ভ স্কোয়াড নিয়ে বেনফিকা সেই ম্যাচে ১-৪ গোলে হেরে যায়। ইউসেবিও একটি গোল করেন কিন্তু এর সাথে সাথে একটি পেনাল্টিও মিস করেন। তার ক্যারিয়ারে তিনি মাত্র পাঁচটি পেনাল্টি মিস করেন, এটি ছিল তার প্রথমটি। সেই মৌসুমে লিগে একটি ম্যাচ খেলেন ইউসেবিও, তাতে একটি গোলও করেন।
ধীরে ধীরে ইউসেবিও অনিয়মিতভাবে মূল একাদশে জায়গা পান। পরের মৌসুমে লিগে ১৭ ম্যাচে ১২ গোল করেও লিগ জিততে ব্যর্থ হয় তার দল। কিন্তু পর্তুগীজ কাপ জেতায় তার ৭ ম্যাচে ১১ গোলের একটি অবদান ছিল, এর মাঝে ফাইনাল ম্যাচেই করেন দুই গোল। কিন্তু এ সবকিছুকেই ছাপিয়ে যায় সেই মৌসুমের ইউরোপিয়ান কাপের ফাইনালের পারফর্মেন্স।
ফাইনালে বেনফিকা মুখোমুখি হয় তৎকালীন জায়ান্ট রিয়াল মাদ্রিদের। সেই দলটিকে সর্বকালের সেরা দলের প্রথম দিকেই রাখা হয়। স্কোয়াডটিও ছিল তারায় তারায় ভরা। স্টেফানো আর পুসকাসের রিয়াল শুরু থেকেই আধিপত্য নিয়ে খেলছিল। পুসকাসের দুই গোলে রিয়াল এগিয়ে যায় কিন্তু বেনফিকা খুব দ্রুতই ২ গোল করে ম্যাচে ফিরে আসে। ৩৮ তম মিনিটে পুসকাসের হ্যাটট্রিকে স্কোর দাঁড়ায় ৩-২ এ। শেষ পর্যন্ত ইউসেবিওর ২ গোলের সুবাদে ম্যাচটি বেনফিকা জিতে নেয় ৫-৩ গোলে। ম্যাচ শেষে মাদ্রিদ লিজেন্ড পুসকাসের সাথে ইউসেবিওর জার্সি বিনিময়কে হাঙ্গেরীয় মিডিয়া বর্ণনা করে এভাবে, এক যুগের গ্রেটের হাত থেকে পরের যুগের গ্রেটের দায়িত্ব বুঝে নিয়েছেন।
সেই মৌসুমে ইউসেবিও সব মিলিয়ে ৩১ ম্যাচে গোল করেন ২৯টি। শুরু হয় বেনফিকার হয়ে তার জয়রথ। ক্লাব ক্যারিয়ারের মূল সময়টি ইউসেবিও কাটান বেনফিকাতেই। এই সময়ে তিনি লিগ শিরোপা জেতেন ১০টি, সাথে ৫টি পর্তুগীজ কাপ। এরই সাথে ‘তাকা ডি হোনরা’ টুর্নামেন্ট জেতেন ৯ বার এবং পর্তুগালের আরেকটি মর্যাদাসম্পন্ন ‘তাকা রিবেরো দস রেই’ কাপ জেতেন ৪ বার।
দলগত অর্জনের পাশাপাশি তার ব্যক্তিগত অর্জনও ছিল অসাধারণ। তিনি সাতবার হন পর্তুগীজ লিগের সর্বোচ্চ স্কোরার, যেটি এখনও পর্যন্ত রেকর্ড হয়ে আছে। বর্তমানে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ নামে পরিচিত যে টুর্নামেন্ট, সেখানে তিনি সর্বোচ্চ স্কোরার হন তিনবার। ১৯৬৮ সালে ইউরোপিয়ান গোল্ডেন বুটের পুরস্কার জিতে নেন প্রথম বছরেই। পরবর্তীতে ১৯৭৩ সালে আরেকবার জেতেন এই পুরস্কার। ‘৬২ এর ব্যালন ডি অর মনোনয়নে দ্বিতীয় হন, ‘৬৫তে পুরস্কার জিতে নেন, ‘৬৬ সালে আবার দ্বিতীয় হিসেবে মনোনয়ন পান।
ইউসেবিওর ম্যাচ প্রতি গোল গড় সবার বিস্ময় জাগানোর জন্য যথেষ্ট। বেনফিকার হয়ে ৬১৪ ম্যাচে তার গোল ৬৩৮টি, পুরো ক্লাব ক্যারিয়ারে ৭৩৩ ম্যাচে করেছেন ৭৪৮ গোল। স্কোরিং হিসেবে সেরা সময় কাটিয়েছেন ১৯৬৩-৬৪ সালে। সেই মৌসুমে ২৬ ম্যাচে করেন ৪৬ গোল, গড় ১.৬৪। পরপর ৬ মৌসুমে তার গোল গড় ছিল ০.৯৩, ১.৬৪, ১.৩৩, ১.২৩, ১.২৪ এবং ১.৪২।
একটা মাত্র চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতলেও দুর্ভাগ্য তাকে আরো দুটো চ্যাম্পিয়ন্স লিগ থেকে বঞ্চিত করেছে। ১৯৬২-৬৩ সালে তার দল ফাইনালে খেলে। টুর্নামেন্টে সাত ম্যাচে ছয় গোল করেন ইউসেবিও, ফাইনাল ম্যাচে মিলানের বিপক্ষে প্রথমেই এক গোল করে দলকে এগিয়ে নিয়ে যান। কিন্তু পরবর্তীতে মিলান দুই গোল করে ম্যাচটি জিতে নেয়। ১৯৬৪-৬৫ এর টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা হন এবং বেনফিকাকে ফাইনালে তোলেন, কিন্তু এবার হার মানেন ইন্টারমিলানের বিপক্ষে। ১৯৬৭-৬৮ তে আবারও টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা হন ইউসেবিও এবং আবারও ফাইনালে ওঠে বেনফিকা। এবার প্রতিপক্ষ ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। ১-১ গোলে ড্র থাকা অবস্থায় ম্যাচের একেবারে অন্তিম মুহূর্তে ইউসেবিও একটা অতিমানবীয় চেষ্টা করেন। কিন্তু ইউনাইটেড গোলকিপার অ্যালেক্স স্টেপনে এর চাইতেও অতিমানবীয়ভাবে গোলটা রক্ষা করেন। ম্যাচটি পরবর্তীতে অতিরিক্ত সময়ে যাওয়ার পর ইউনাইটেড জিতে যায়।
৬৩ ম্যাচে ৪৭ গোল করে বর্তমানে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ইতিহাসের ১১তম সর্বোচ্চ গোলদাতা ইউসেবিও, আর সেই সময়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা ছিলেন তিনি, সর্বোচ্চ ছিল স্টেফানোর ৪৯ গোল।
৪
জাতীয় দলের হয়ে ইউসেবিওর গোল ৪১টি, সেটিও মাত্র ৬৪টি ম্যাচে। তবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পর্তুগাল সেসময় মাঝারি মানের দল হিসেবেও বিবেচিত হতো না। ইউসেবিওর আমলে ইউরো কাপ হয়েছে তিনবার (১৯৬৪, ১৯৬৮ আর ১৯৭২ সালে)। এর মাঝে একবারও পর্তুগাল সেই টুর্নামেন্টে কোয়ালিফাই করতে পারেনি। বিশ্বকাপ হয়েছে চারবার (১৯৬২, ১৯৬৬, ১৯৭০ আর ১৯৭৪); এখানেও মাত্র একবার পর্তুগাল বাছাইপর্ব পার করতে পেরেছিল।
এখন এই সাত টুর্নামেন্টের মাঝে ছয়টিতেই মূল পর্বে সুযোগ না পাওয়ার জন্য কেউ ইউসেবিওকে দোষারোপ করতে পারে, আবার মাত্র একটি টুর্নামেন্টে সুযোগ পাওয়ার জন্যও ইউসেবিওকে ক্রেডিট দিতে পারে। তবে ক্রেডিট দেওয়া কিংবা দোষারোপ করার আগে কিছু তথ্য জেনে নেওয়া উচিত। ব্যক্তিগত কিংবা দলীয় সফলতার জন্য দলগত সমর্থনটা প্রয়োজন। বিচার করার সময় এটি বিবেচনা করা উচিত, কোন দলকে নিয়ে কোন পর্যায় পর্যন্ত পৌছানো সম্ভব আর একজন কতদূর পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছে।
ইউসেবিওর আমলে পর্তুগাল খুবই দুর্বল দল ছিল। ইউসেবিও আসার আগে পর্তুগাল কখনো ইউরো অথবা বিশ্বকাপ খেলতে পারেনি। ইউসেবিও পরবর্তী যুগে পর্তুগাল ইউরো খেলতে পেরেছে ১৯৮৪ সালে, আর বিশ্বকাপ ১৯৮৬ সালে। তারপর আবার আর একটি লম্বা বিরতি। লুইস ফিগোর সোনালি প্রজন্মের সময় আর বর্তমান ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর যুগে পর্তুগাল ইউরো খেলার সুযোগ পায়। এছাড়া বিশ্বকাপেও তারা সুযোগ পায় ফিগো আর ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর আমলেই।
তবে বাছাই পর্বগুলোতে ইউসেবিওর পারফর্মেন্স দেখলে বোঝা যায় যে, সেই আমলে ইউসেবিও মোটামুটি একাই চেষ্টা করে গিয়েছিলেন পর্তুগালকে একটি পর্যায় পর্যন্ত নিয়ে যেতে।
৫
জাতীয় দলের হয়ে ইউসেবিও মূলত নজর কেড়েছিলেন ১৯৬৬ বিশ্বকাপে। কিন্তু অনেকেই হয়তো জানেন না যে, সেই বিশ্বকাপের বাছাই পর্বেও ইউসেবিওর পারফর্মেন্স অসামান্য ছিল। মোটামুটিভাবে একক দক্ষতা দিয়েই পর্তুগালকে তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন তাদের সফলতার সর্বোচ্চ পর্যায়ে। সেটিই একটু লক্ষ্য করা যাক।
বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব ১৯৬৬
১৯৬৬ বিশ্বকাপের কোয়ালিফাইয়ে পর্তুগালের প্রতিপক্ষ ছিল চেকোস্লোভিয়া, রোমানিয়া আর তুরস্ক। এখান থেকে এক দল মূল পর্বে যেতে পারবে। তুরস্কের সাথে ৫-১ গোলে জেতা প্রথম ম্যাচে ইউসেবিও হ্যাটট্রিক করেন। পরের ম্যাচে তুরস্কের সাথেই ১-০ গোলে জেতা ম্যাচে ১ গোল করেন।
চেকোস্লোভিয়ার সাথে ১-০ গোলে জেতা ম্যাচে এক গোল করেন। রোমানিয়ার সাথে ২-১ গোলে জেতা ম্যাচে দুটি গোলই করেন। পরের দুই ম্যাচে ইউসেবিও গোল পাননি। এক ম্যাচ গোল শূন্য ড্র করে আরেক ম্যাচে ২-০ গোলে হেরে যায়। বাছাই পর্বে পর্তুগাল গোল করে নয়টি। এর মাঝে ইউসেবিও করেন সাতটি।
বিশ্বকাপ ১৯৬৬
ইউসেবিওর ক্যারিয়ারের সবচেয়ে হাইলাইটিং পয়েন্ট হচ্ছে ১৯৬৬ সালের বিশ্বকাপ ফুটবল। ১৯৬৬ সালে পর্তুগালের গ্রুপ পর্বে সঙ্গী ছিল গত দুইবারের চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল, হাঙ্গেরি আর বুলগেরিয়া। পর্তুগালের প্রাথমিক টার্গেট ছিল ব্রাজিলের সঙ্গী হয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠা। হাঙ্গেরি আর বুলগেরিয়ার সাথে দুটো ম্যাচ জিতে ব্রাজিলের সাথে গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে যখন মুখোমুখি হয়, তখন পুরো ফুটবল বিশ্ব অধীর আগ্রহে তাকিয়ে ছিল পেলে আর ইউসেবিওর যুদ্ধ দেখার জন্য। ইউসেবিও দুই গোল করে শুধু যুদ্ধটাই জেতেননি, সাথে সাথে ব্রাজিলকেও টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় করে দেন। তবে ম্যাচটি নিয়ে বিতর্ক আছে। সেই ম্যাচটিকে ‘৬৬ এর বিশ্বকাপের সব থেকে বাজে ম্যাচ বলে স্বীকার করা হয়। ওই ম্যাচে পুরো ব্রাজিল দল, বিশেষ করে পেলেকে এত বেশি পরিমাণ ফাউল করা হয় যে, পেলে মাঠ থেকে তো ইনজুরড হয়ে বের হনই এবং সেই সাথে ম্যাচের পর তিনি অবসরের ঘোষণাও দেন। পরবর্তীতে ইউসেবিও এবং পর্তুগাল দলের সকল ফুটবলার আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রাজিলের কাছে ক্ষমা চায়।
কোয়ার্টার ফাইনালে পর্তুগালের মুখোমুখি হয় সেই বিশ্বকাপের বিস্ময় উত্তর কোরিয়া। গ্রুপ পর্ব থেকে চিলি আর ইতালিকে হটিয়ে কোয়ার্টারে ওঠা উত্তর কোরিয়া প্রথম ২৫ মিনিটেই ৩ গোল করে এগিয়ে যায়। এরপরেই শুরু হয় ইউসেবিও ম্যাজিক। ২৭, ৪৩, ৫৬ ও ৫৯ মিনিটে টানা চার গোল করে শেষ পর্যন্ত ৫-৩ গোলে উত্তর কোরিয়াকে হারায়। কিন্তু পর্তুগাল ম্যজিক শেষ হয় সেমিতে ওঠার পর। স্বাগতিক ইংল্যান্ডের সাথে ২-১ গোলে হারা সে ম্যাচটিতেও ইউসেবিও এক গোল করে তার চেষ্টা বহাল রাখেন। সেই বছর বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয় ইংল্যান্ড।
শেষপর্যন্ত তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে সোভিয়েত ইউনিয়নকে ২-১ গোলে হারিয়ে পর্তুগাল বিশ্বকাপে তার সর্বোচ্চ সাফল্য নিশ্চিত করে। নয় গোল করে ইউসেবিও জেতেন বিশ্বকাপের গোল্ডেন বুট। এছাড়া সেই বিশ্বকাপের ব্রোঞ্জ বল জিতে নেন তিনি।
৬
অন্যান্য বাছাই পর্বে ইউসেবিওর পারফর্মেন্স
১৯৬২ বিশ্বকাপের বাছাই পর্বে লুক্সেমবার্গের বিপক্ষে ৪-২ গোলে হারা ম্যাচে একটি গোল করেন তরুণ ইউসেবিও। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ২-০ গোলে হারা ম্যাচে কোনো গোল পাননি। ১৯৭০ বিশ্বকাপের কোয়ালিফাইং রাউন্ডের ৬ ম্যাচে মাত্র একটি ম্যাচে জয় পায় পর্তুগাল। ইউসেবিও ছয় ম্যাচে তিন গোল করেন। ১৯৭৪ বিশ্বকাপের বাছাই পর্বে ইউসেবিও তিন ম্যাচে এক গোল করেন।
১৯৬৪ সালে ইউরো বাছাই পর্বে পর্তুগাল মুখোমুখি হয় বুলগেরিয়ার। প্রথম লেগে ৩-১ গোলে হারে পর্তুগাল। তবে মূল্যবান অ্যাওয়ে গোলটি করেন ইউসেবিও।
পরের লেগে ঘরের মাঠে পর্তুগাল ৩-১ গোলে জিতলে তৃতীয় ম্যাচে নিষ্পত্তি হয়। ইউসেবিওবিহীন সেই ম্যাচে পর্তুগাল ১-০ গোলে হেরে টুর্নামেন্টে কোয়ালিফাই করতে পারেনি।
১৯৬৮ সালের ইউরো বাছাই পর্বে পর্তুগালের সঙ্গী ছিল বুলগেরিয়া, নরওয়ে আর সুইডেন। এখানে নরওয়ের সাথে ২-১ গোলে জেতা ম্যাচে গোল দুটি করেন ইউসেবিও। ৬ ম্যাচ খেলেও মাত্র দুটি গোল করে দলকে বাছাই পর্বের গণ্ডিও পার করতে পারেননি।
১৯৭২ সালের ইউরো বাছাই পর্বে পর্তুগালের সঙ্গী ছিল বেলজিয়াম, স্কটল্যান্ড আর ডেনমার্ক। এখানে দুই ম্যাচে একটি করে গোল করেন। গ্রুপ থেকে মূল পর্বে ওঠা বেলজিয়াম সেই ইউরোতে সেমিফাইনাল খেলে আর তৃতীয় হয়।
৭
প্রাণীকুলে চিতাবাঘ তার ক্ষিপ্রগতির জন্য বিখ্যাত। ইউসেবিওর ডাকনাম ছিল কালোচিতা, নাম থেকে বোঝা যায় যে, তার গতি অসামান্য ছিল। তবে কতটা সেটা বুঝতে হলে আপনাকে একটি বিষয় জানতে হবে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ইউসেবিও ১০০ মিটার পেরুতে পারতেন মাত্র ১১ সেকেন্ডে। ১৯৬০ এর দশকে ১০০ মিটার অ্যাথলেটে সবচেয়ে দ্রুত গতির রেকর্ড ছিল ১০ সেকেন্ডের। ইউসেবিওকে ‘সর্বকালের সেরা আফ্রিকান খেলোয়াড়’ হিসেবে গণ্য করা হয়। এছাড়া IFHHS এর গত শতাব্দীর সেরা ফুটবলার নির্বাচনে তার নাম ছিল নবম স্থানে।
ফুটবলে অসংখ্য কীর্তি গড়া ইউসেবিও ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ৭১ বছর বয়সে মারা যান। তার সম্মানে ‘ইউসেবিও কাপ’ নামে একটি প্রীতি ম্যাচের সূচনা করা হয়, যেখানে প্রতি বছর মৌসুম শুরুর ১/২ সপ্তাহ আগে বেনফিকা ক্লাব আর অন্য একটি ক্লাবের মাঝে অনুষ্ঠিত হয়। এই ম্যাচে রিয়াল মাদ্রিদ, ইন্টারমিলান, আর্সেনালের মতো বড় বড় ক্লাব অংশ নেয়।
তার মৃত্যুর কিছু সময় পর সর্বকালের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় আলফ্রেডো ডি স্টেফানো (যাকে ইউসেবিও নিজের আইডল মানতেন) বলেন, “আমার কাছে সর্বকালের সেরা খেলোয়াড় সবসময়ই ইউসেবিও”।
ভালোবেসে কেউ কেউ আবার ইউসেবিওকে কালো মুক্তো বলেও ডাকতো। এই নামকরণের পেছনে তার গায়ের রঙ একটি ভূমিকা রেখেছিল নিশ্চিত। তবে কালো মুক্তা দিয়ে আরেকটি বিষয় বোঝা যায়, দুষ্প্রাপ্যতা। ২০০৩ সালে পর্তুগীজ ফুটবল ফেডারেশন গত ৫০ বছরের পর্তুগালের শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে নির্বাচিত হন ইউসেবিও।
ফুটবল ইতিহাসের সর্বকালের সেরা না হোক, সর্বকালের অন্যতম সেরা নিঃসন্দেহেই বলা যায় ব্ল্যাক প্যান্থার ইউসেবিওকে।
ফিচার ইমেজ: Pinterest