জীবনটা কখনো কখনো নাটকের চেয়েও বেশি নাটকীয়।
হঠাৎ ভাগ্যে কিছু বদল না এলে ফখর জামানকে এই পাকিস্তান-জিম্বাবুয়ে সিরিজটা টেলিভিশনে দেখতে হতো। হয়তো পাকিস্তান নৌবাহিনীর কোনো একটা ফ্রিগেটে থাকতেন এখন তিনি। হয়তো আরব সাগর ধরে চলতে চলতে রেডিওতে খবর পেতেন এই সিরিজে পাকিস্তান জিতলো কি না!
কিন্তু ভাগ্য তা হতে দেয়নি। পাকিস্তানের ঘরোয়া ক্রিকেটে পাঁচ-ছয়টা কষ্টকর মৌসুম কাটানোর পর অবশেষে তিনি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছিলেন। নৌবাহিনীর একজন নাবিক থেকে ফখর জামান হয়ে উঠেছেন পাকিস্তান দলের একজন সৈনিক। তাই কোনো জাহাজে বসে নয়, মাঠেই পাকিস্তান-জিম্বাবুয়ে ম্যাচের একজন যোদ্ধা হয়ে উঠলেন। তার ব্যাটেই পাকিস্তানের পক্ষে ওয়ানডে ক্রিকেটে প্রথম ডাবল সেঞ্চুরিটি এলো বুলাওয়েতে।
আরেক তরুণ ইমাম-উল-হকের সাথে উদ্বোধনী জুটিতে ৩০৪ রান করে বিশ্বরেকর্ড করলেন ফখর। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে এই ম্যাচে ইমাম আউট হয়ে গেলেন ১১৩ রান করে। কিন্তু ফখর অপরাজিত রইলেন। বিশ্বের মাত্র ষষ্ঠ ব্যাটসম্যান হিসেবে ৫০ ওভারের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তুলে নিলেন ডাবল সেঞ্চুরি- অপরাজিত ২১০!
ম্যাচ শেষে ফখর বলছিলেন,
‘দিনটা শুধু আমার ছিলো।’
ফখরের এই কথাটা কেবল কথার কথা নয়। দিনের শুরুতে কোচ মিকি আর্থারের সাথে নাকি তার ডাবল সেঞ্চুরি করা নিয়ে কথাও হয়েছিলো। কোচ নাকি বলেছিলেন, তাকে আজ একটা ডাবল সেঞ্চুরি করতে হবে। ফখর বলছিলেন,
‘মিকি আমাকে টসের আগে বলছিলো, আমরা যদি টস জিতি, তাহলে ব্যাটিং করবো আগে। আর ‘আমি চাই তুমি একটা ডাবল সেঞ্চুরি করো’। ফলে আমি আজ নিজের খেলাটা খেলার চেষ্টা করেছি এবং একটা (ডাবল) করেই ফেললাম।’
পাকিস্তানের ব্যাটিং কোচ গ্রান্ট ফ্লাওয়ার বলছিলেন, ফখরকে এই ধরনের লক্ষ্য ঠিক করে দেওয়া বিচিত্র কিছু নয়। কারণ এই ধরনের চাপ দিলেই এই সাবেক নাবিক ভালো খেলে থাকেন,
‘কোনো কোনো কোচ তার খেলোয়াড়কে পুরোপুরি স্বাধীনতা দেয়। আবার অনেকে লক্ষ্য ঠিক করে দেয়। কেউ কেউ এই ধরনের চাপের মধ্যে ভালো খেলে। আবার কেউ কেউ বাকিদের চেয়ে চাপটা বেশি টের পায়। এটা আসলে ওই খেলোয়াড়ের ওপর নির্ভর করে।’
তিন সপ্তাহ আগে জিম্বাবুয়ে সফরে আসার পর থেকে ফখরের ব্যাট স্বাভাবিকের চেয়েও বেশি ঝলসাচ্ছে। ৯টি ইনিংসে ৭০৮ রান করেছেন। টি-টোয়েন্টিতে ৫৫ গড়ে রান করেছিলেন। ওয়ানডেতে এখন অবধি চার ইনিংসে ৪৩০ রান করেছেন। এর মধ্যে একবার মাত্র আউট হয়েছেন।
শুক্রবার যে ২১০ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেছেন, সেখানে ছিলো ২৯টি চার। যেকোনো পাকিস্তানী ব্যাটসম্যানের জন্য এক ওয়ানডে ইনিংসে সর্বোচ্চ রান। এটা মনে রাখতে হবে, ইনিংসের চতুর্থ ওভারের আগে বল সামলানোর সুযোগ পাননি ফখর। এই ইনিংস খেলার পথে টপকে গেছেন পাকিস্তানী গ্রেট সাঈদ আনোয়ারের সর্বোচ্চ রানের ইনিংস; এখন ফখরই হয়ে উঠেছেন পাকিস্তানের সর্বোচ্চ ইনিংসের মালিক।
সাঈদ আনোয়ারকে টপকে যাওয়াটা এই যুগের ক্রিকেটার হিসেবে ফখরের কাছে অনেক বড় একটা অর্জন। পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে তিনি বলছিলেন,
‘আমার অসাধারণ লাগছে। সাঈদ আনোয়ারের মতো একজন কিংবদন্তীর রেকর্ড পার করে ফেলাটা বিরাট একটা গর্বের ব্যাপার।’
২৮ বছর বয়সী ফখর ১৫৬ বলে খেলেছেন ২১০ রানের এই ইনিংস। ২১ বছর আগে সাঈদ আনোয়ার খেলেছিলেন ১৯৪ রানের ইনিংস।
ফখর বলছেন, এই রেকর্ড করা, এত এত রান করা, এসব নিয়ে জীবনে কখনো চিন্তা করেননি। একটা সময় স্বপ্ন ছিলো কেবল প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট খেলা আর জাতীয় দলের ডাক পাওয়া। সেই সময়টার কথা বলছিলেন ফখর,
‘আমি যখন শুরু করি, তখন শুধু প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ খেলতে চাইতাম। যখন সেই সুযোগ পেলাম, তখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম। আমার স্বপ্ন ছিলো পাকিস্তানের হয়ে আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা। কখনো একটা রেকর্ড করবো বা এরকম কিছু কল্পনা করিনি।’
শুধু সাঈদ আনোয়ারের রেকর্ড ভেঙেছেন, তা-ই নয়, ফখর ও ইমামের ৩০৪ রানের জুটি পাকিস্তানের জন্য যেকোনো উইকেট জুটিতে ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ রান। সেই সাথে ওয়ানডে ক্রিকেটের ইতিহাসে এটা এখন সর্বোচ্চ উদ্বোধনী রানের জুটি। আগে যে রেকর্ড ছিলো সনাৎ জয়াসুরিয়া ও উপুল থারাঙ্গার হাতে।
এই ইনিংস নিয়ে কথা বলতে গিয়ে ফখল বলছিলেন, ২০০ রান ব্যাটিং করার সময় মাথায় ছিলো না,
‘ম্যাচের আগে এ নিয়ে কথা হলেও আমার মাথায় ২০০ রানের কথা ছিলো না। এটা ঠিক সেঞ্চুরি নিয়ে ভাবছিলাম। সেঞ্চুরির পর স্রেফ চিন্তাটা ছিলো, স্কোরবোর্ডকে সচল রাখতে হবে। যত বেশি সম্ভব রান করতে হবে।’
‘আমার ওপর নির্দেশনা ছিলো, যতক্ষণ পারি যেনো ব্যাট করি। আামি দলের জন্য একটা ভালো শুরু চাচ্ছিলাম। ইমাম আমার সাথে দারুণ একটা ইনিংস খেলেছে।’
ফখরের শুরু থেকে তার উত্থান, একটু একটু করে পাকিস্তান দলের ভরসা হয়ে ওঠা এবং এই রেকর্ড; সবই কাছ থেকে দেখছেন গ্রান্ট ফ্লাওয়ার। পাকিস্তান দলে পঞ্চম বছর কাটাতে থাকা ফ্লাওয়ার বলছিলেন, ফখরের এই অর্জন অনেকটাই তার প্রাকৃতিক ক্ষমতার ফল,
‘এটা অসাধারণ একটা অর্জন। আমি ওর সাথে নেটে অনেক কাজ করেছি। কিন্তু ওর প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া প্রতিভাটা অনেক বেশি। সেই সাথে অনেক পরিশ্রমও করে। ও যে নৌবাহিনী থেকে এসেছে, তার ফলে শুরু যখন করেছিলো, তখন অনেক কাঁচা ছিলো। ওর টেকনিকে অনেক অনেক পরিবর্তন আনতে হয়েছে। কিন্তু তারপরও সে তার সহজাত খেলাটাই খেলে। আর আমার ধারণা, এটাই ওর সেরা সম্পদ।’
ফখরের এই ডাবল সেঞ্চুরি তার বিশাল উপন্যাসের মতো জীবনের ছোট্ট একটা অধ্যায় মাত্র। কৈশোর পার হতে না হতেই মারদান এলাকার কাটলাং থেকে এসে নৌবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন ফখর। কিন্তু ভালোবাসাটা ছিলো ক্রিকেটের প্রতি। তাকে যখন পিএনএস কারসাজে পাঠানো হলো আরো ট্রেনিংয়ের জন্য, ফখর দেখা করলেন পাকিস্তান ন্যাভাল ক্রিকেট অ্যাকাডেমির কোচ নাজিম খানের সাথে।
নাজিম খান তাকে দলে আমন্ত্রণ জানালেন। প্রথম ম্যাচেই সেঞ্চুরি করে ফখর নিজের ক্ষমতাটা বুঝিয়ে দিলেন। এরপর নাজিম খানই তাকে বিভিন্ন জায়গায় খেলার সুযোগ করে দিলেন। তিনি খেললেন আন্তঃজেলা অনূর্ধ্ব-১৯ টুর্নামেন্ট।
নৌ বাহিনীর সমর্থনে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে খেলা শুরু করে দিলেন। ফখর বলেন, সেই সময়টায় বাহিনী থেকে যে সমর্থন পেয়েছেন, তা ভোলার মতো নয়। পাঁচ বছর লড়াই করার পর ২০১৬-১৭ সালের কায়েদ-ই-আজম ট্রফিতে এসে সাফল্য পেতে শুরু করলেন। সেই সাফল্যের ফলেই ডাক পেলেন পাকিস্তান সুপার লিগে। আর প্রথম পিএসএল মৌসুমেই যে তান্ডব দেখালেন, তাতে পাকিস্তান টি-টোয়েন্টি দলে জায়গা হয়ে গেলো।
জাতীয় দলে নিজেকে স্থিতিশীল করতে খুব একটা সময় নেননি। বিশেষ করে পাকিস্তানকে চ্যাম্পিয়নস ট্রফি জেতানোর পথে ফাইনালের সেরা খেলোয়াড় হয়ে নিজের দামটা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।
ফ্লাওয়ার বলছিলেন, নৌবাহিনীতে যে শৃঙ্খলা ও পরিশ্রম করার অভ্যেস ফখর পেয়েছেন, সেটা তাকে এখনও উপকৃত করছে,
‘এটা অবশ্যই ও নৌবাহিনী থেকে পেয়েছে। ও দারুণ ফিট এবং ওর এই ফিটনেস ওকে ডাবল সেঞ্চুরি পেতে সহায়তা করেছে। ও নিজের মানসিক শক্তিটা দেখিয়েছে।’
ফখর নিজেও নৌবাহিনীর সেই সময়টাকে ভোলেন না। তিনিও এই ডাবল সেঞ্চুরি করার পর কৃতজ্ঞতার সাথে মনে করেছেন সময়টাকে। আর ইনিংসটা উৎসর্গ করেছেন সেই নাজিম খানকে,
‘আমি এই ইনিংসটা নাজিম স্যারকে এবং নৌবাহিনীর যে বন্ধুদের সাথে এক রুমে থাকতাম, তাদের উৎসর্গ করছি। আমার ন্যাভাল ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে যেসব কোচ ছিলেন, তাদের স্মরণ করছি। আমি যখন পাকিস্তান-এ দলে খেলি, তখন ভালো করতে পারছিলাম না। সেই সময় তারাই আমাকে সহযোগিতা করেছেন। আমার সংগ্রামের দিনগুলোতে যারা পাশে ছিলেন, তাদের সবাইকে উৎসর্গ করছি।’